হাদিস থেকে বাছাইকৃত উচ্চারণ ও অর্থসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ টি দুআর মধ্যে ২০তম দুআ

হাদীসের মধ্যে ইসমে আযম শিরোনাম যতগুলো দু’আ বর্নিত হয়েছে, সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদে বর্নিত দু’আটি আজ আমরা বাক্যে বাক্যে অর্থসহ শিখতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: প্রিয় পাঠক ইসমে আযমের পরিচয় সম্পর্কে সমাজের অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন কেউ মনে করেন, ইসমে আযম আল্লাহর দুই একটি নিদিষ্ট নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আবার কেউ মনে করেন ইসমে আযম পড়ে আকাশে উড়া যায়, কারো মতে নিদিষ্ট একটি দু’আ করার কারণেই দু’আটি কবুল হয়েছে অন্য কারণে নয়। এই ধারণাগুলো যে সঠিক নয় সেটা আজ আমরা পরিস্কার ভাবে বুঝার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। প্রথমেই জানবো ইসমে আযম আসলে কি?
.
ইসমে আযম দুটি আরবি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এই দুটি শব্দের সম্মিলিত অর্থ হচ্ছে: মহান নাম, শ্রেষ্ঠ নাম। অর্থাৎ ইসমে আযম হলো,“আল্লাহর সবচাইতে মহান বা শ্রেষ্ঠ নাম”।ইংরেজিতে The Greatest Name of Allah, ইসমে আ’যমের গুরত্ব ও ফজিলত হচ্ছে, এই নামের ‘উসীলা’ দিয়ে আল্লাহকে ডাকলে বা তাঁর কাছে দু’আ করলে আল্লাহ সবচাইতে বেশি খুশি হন এবং বান্দার দু’আ কবুল করে নেন। হাদীসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে সালাতে তাশাহুদ ও দুরুদের পরে সালাম ফিরানোর পূর্বে (দুয়া মাসুরা পড়ার সময়) নিচের এই দুয়াটি পড়তে শুনলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তুমি আল্লাহর ওই নাম নিয়ে দু‘আ করেছো, যার মাধ্যমে কিছু চাওয়া হলে তিনি তা দান করেন এবং দু‘আ করা হলে কবুল করেন। ইসমে আযম কোনগুলো? তা নির্ধারণে প্রসিদ্ধ সালাফদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক মতামত পাওয়া যায়। যেমন:
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] সালাফদের থেকে প্রায় ১৪ টি মতামত উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: (১) আল্লাহ্ (الله) আল্লাহ। (২) আর রাব্ব (اَلرَّبُّ) [প্রতিপালক]।(৩) আল ‘হাইয়ূ (اَلْحَيُّ) [চিরঞ্জীব] (৪) আল ক্বাইয়ূম (اَلْقَيُّوْمُ) [চিরস্থায়ী] (৫) আল মান্নান (اَلْمَنَّانُ) [সীমাহীন দাতা] (৬) যুল জালালি ওয়াল ইকরাম (ذُوْ الْجَلَالِ والْإِكْرَام) [মহত্ত্ব ও মহানুভবতার অধিকারী] (৭) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ) [আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই] (৮) আসমাউল হুসনা (সুন্দর নামসমূহ) তথা হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর সুন্দর গুণবাচক ৯৯ টি নামকেও আলিমগণ ইসমে আযম বলেছেন (বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে হাজার ফাৎহুল বারী খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা: ২২৪-২২৫)
.
তবে জমহুর তথা অধিকাংশ সালাফদের মতে,
শব্দ ও অর্থগতভাবে মহান রবের সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ‘আল্লাহ’ শব্দটিই ইসমে আযম। এটি পবিত্র কুরআনে সর্বোচ্চ ২৬৯৭ বার এসেছে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নাম হল ‘আল-হাইয়ুল কাইয়ূম।(দেখুন ইবনুল কাইয়ুম মাদারিজুস সালিকীন, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩২; মুগনিউল মুহতাজ, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৮৮, ৮৯) বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,“ইসমে আ’যম হচ্ছে, আল-হা’ইয়্যু (চিরঞ্জীব) এবং আল-ক্বাইয়্যুম” (চিরস্থায়ী)।(উসাইমীন মাজমু ফাতাওয়া, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৬০)।
.
পবিত্র কুরআন থেকে ইসমে আযম: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহর ইসমে ‘আযম কুরআনের তিনটি সূরার মধ্যে রয়েছে: সূরা বাকারাহ, সূরা আলে ইমরান ও সূরা ত্ব-হা।’’(ইবনু মাজাহ: ৩৮৫৬, হাদিসটি হাসান] সেগুলো হলো: সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত—আয়াতুল কুরসির প্রথম বাক্যটি, সূরা আলে ইমরানের ২ নং আয়াত ও সূরা ত্ব-হার ১১১ নং আয়াত। অন্য একটি হাদিসে সূরা বাকারার ১৬৩ নং আয়াতকেও ইসমে আযম বলা হয়েছে। [আবু দাউদ: ১৪৯৬, হাদিসটি সহিহ] অপর একটি হাদিসে ইউনুস (আ.)-এর দু‘আটিকে ইসমে আযম বলা হয়েছে। সেটি আমরা সবাই জানি: লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুব‘হা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনায যোয়ালিমীন। [মুসতাদরাক হাকিম: ১/৬৮৫] এছাড়াও আরো যেসকল দু’আ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কোনটি সহীহ, কোনটি যঈফ, কোনটি মওকূফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
.
❑ প্রিয় পাঠক! হাদীসের কিতাবে ইসমে আযম শিরনামে বিভিন্ন বাক্যে বেশ কিছু বর্ননা এসেছে। আজকের পর্বে আমরা হাদীস থেকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদের বর্নিত ইসমে আযমের দু’আটি বাক্যে বাক্যে উচ্চারণ ও অর্থসহ উল্লেখ করার চেষ্টা করছি আলহামদুলিল্লাহ। হাদীসটি বর্ননা করেছেন রাসূল ﷺ এর প্রখ্যাত সাহাবী বুরাইদাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ব্যক্তিকে বলতে শুনেন দু’আটি নিছে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেনঃ সেই মহান সত্তার ক্বসম যাঁর হাতে আমার জীবন! নিঃসন্দেহে এই লোক আল্লাহ তা’আলার মহান নামের ওয়াসীলায় তার নিকটে প্রার্থনা করেছে, যে নামের ওয়াসীলায় দু’আ করা হলে তিনি ক্ববূল করেন এবং যে নামের ওয়াসীলায় প্রার্থনা করলে তিনি দান করেন। দু’আটির মূল আরবি হচ্ছে:
.
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ أَنِّيْ أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللّٰهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ الْأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِيْ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
.
মোটামুটি উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা, আন্নী আশহাদু আন্নাকা আনতাল্লাহ্, লা ইলা-হা ইল্লা আনতাল আহাদুস সমাদ, আল্লাযী লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ, ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আ‘হাদ। (আরবির সঠিক উচ্চারণ বাংলায় লেখা কোনোভাবেই শতভাগ সম্ভব নয়; তাই আরবি টেক্সট মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন,পাশাপাশি আরবির সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন, না হয় ভুল শিখতে হবে) কমেন্ট থেকে ভিডিও দেখে শিখতে পারেন ইনশাআল্লাহ।
.
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার নিকট চাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনিই আল্লাহ। আপনি ছাড়া কোনো সার্বভৌম সত্তা নেই, যিনি একক, অমুখাপেক্ষী। যিনি কাউকে জন্ম দেন নি, তার থেকে কেউ জন্ম নেয়নি এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।(মুসনাদে আহমাদ হা/ ১৮৯৭৪ আবু দাউদ হা/১৪৯৩ তিরমিযি হা/৩৪৭৫ ইবনে মাজা হা/৩৮৫৭)
.
এই হাদীসটি সম্পর্কে হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী ইমাম শাওকানী এবং বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম নাছিরউদ্দিন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,সনদ ও মতনের দিক থেকে উল্লেখিত তথা বুরায়দাহ বর্ণিত হাদীসটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ (ফাৎহুল বারী: খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা: ২২৪-২২৫; শাওকানী তোহফাতুয যাকেরীন পৃষ্ঠা: ৫২; আলবানী সিলসিলা যঈফাহ হা/২১২৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
.
এবার এভাবে আরবী এবং বাংলা উচ্চারণসহ সহজে মুখস্থ করুন: .
.
اَللَّهُمَّ
َ(আল্লা-হুম্মা) অর্থ: হে আল্লাহ
.
إنِّيْ أَسْأَلُكَ
(ইন্নী আসআলুকা) অর্থ: নিশ্চয়ই আমি আপনার নিকট চাই,
.
أَنِّيْ أَشْهَدُ أَنَّكَ
(আন্নী আশহাদু আন্নাকা) অর্থ: নিশ্চয়ই আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি,
.
أَنْتَ اللّٰهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا
আনতাল্লাহ্, লা ইলা-হা ইল্লা) অর্থ: আপনি আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই।
.
أَنْتَ الْأَحَدُ الصَّمَدُ
(আনতাল আহাদুস সমাদ) অর্থ: আপনি একক, অমুখাপেক্ষী।
.
الَّذِيْ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ
(আল্লাযী লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ) অর্থ:যিনি কাউকে জন্ম দেন নি, তার থেকে কেউ জন্ম নেয়নি,
.
وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
(ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আ‘হাদ) অর্থ:এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।
.
প্রিয় পাঠক! আগেই বলেছি ইসমে ‘আযমের এরকম বেশ কয়েকটি দু‘আ আছে, এটি একটি দু’আর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তবে আমি যেটি উল্লেখ করেছি সনদের দিক থেকে এটিই সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং সহীহ। ইসমে আযম দিয়ে দু‘আ করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান হলো ফরজ নফলসহ সকল সালাতের সালাম ফেরানোর পূর্ব মুহূর্ত। অর্থাৎ, নামাজের শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু, দরুদ, দু‘আ মাসুরা (দু‘আ মাসূরা পড়া ঐচ্ছিক) পাঠ শেষ করার পর ইসমে আযমের উপরের দু‘আটি অর্থের দিকে লক্ষ রেখে আগ্রহ, আন্তরিকতা এবং আল্লাহর প্রতি ধারণা নিয়ে পড়বেন, নামাজের শেষ বৈঠকে পড়লে তাশাহহুদ ও দরুদের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজির উপর দরুদ পড়া হয়ে যায়। সালাতে সিজদায় ও পড়তে পারেন। যাহোক, সালাতে পড়লে ইসমে আযমের বাক্যগুলো বলার পর আরবি ভাষায় দু‘আ করবেন এবং নিজের চাওয়াগুলো আল্লাহর কাছে চাইবেন।আর নামাজের বাইরে ইসমে আযম দিয়ে দু‘আ করলে যেকোনো ভাষায় নিজের চাওয়া বলতে পারেন। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নামাজে আরবি ব্যতীত অন্য ভাষায় দু‘আ করা জায়েয নেই এটাই বিশুদ্ধ মত। যদিও আলেমগণের একটি অংশ নফল নামাজে মাতৃভাষায় দু‘আ করা বৈধ বলেছেন। তবে, এটির পক্ষে স্পষ্ট কোনো দলিল নেই। সুতরাং, সতর্কতা হিসেবে মাতৃভাষায় দু‘আ না করাই কর্তব্য। নামাজের মতো ইবাদতকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখাই উচিত। আশা করি বুঝতে পেরেছেন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।