হাত-পায়ের নখ কাটার সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি

প্রশ্ন: হাত-পায়ের নখ কাটার সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কি? নখ কাটার নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ আছে কি? হাত-পায়ের নখ কাটার পর সেগুলো কি করা উচিত?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: হাত পায়ের নখ কাটা প্রকৃতিগত একটি সুন্নাত। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে নারী-পুরুষের হাত পায়ের নখ বড় করা বৈধ নয়, কারণ মানুষ একটি সভ্য জাতি, বিশেষ করে কোন মুসলিম অসভ্য পশুর সদৃশ হতে পারে না। তাই নারী-পুরুষ উভয়ের উপর এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য। শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চল্লিশ দিনের বেশি সময় হাত পায়ের নখ, গোঁফ, নাভির নীচের পশম ও বগলের পশম রেখে দেওয়া জায়েজ নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মানুষের স্বভাবগত আমল হলো: ৫টি। যথা- (১).নাভীর নিচের লোম সাফ করা (২).খাৎনা করা (৩).গোফ ছেঁটে ফেলা (৪).বগলের লোম সাফ করা (৫).নখ কাটা। (সহীহ বুখারী হা/১২৫৭ হা/৫৮৮৯, ৫৮৯০)। আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, মোচ কাটা, নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা, বগলের লোম উপড়ে ফেলা ও নখ কাটার ব্যাপারে আমাদের চল্লিশ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। আমরা যেন তা বেশি সময় ছেড়ে না দেই। (সহীহ মুসলিম হা/ ২৫৮, তিরমিযী হা/২৭৫৮, ২৭৫৯; আবু দাঊদ ৪২০০)
.
সুতরাং যে ব্যক্তি নখ কর্তন করে না, সে সৃষ্টিগত সুন্নাতের বিরোধী। নখ কাটতে বলার তাত্ত্বিক কারণ হলো:

(১). নখকে জীবাণু ও নোংরা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
(২). কাফিরদের সাদৃশ্য থেকে দূরে রাখা এবং
(৩). পশুতুল্য আচরণ থেকে বিরত রাখা।’(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৩)।
..
❑ নারী পুরুষের হাত পায়ের নখ কাটার নির্দিষ্ট কোন সময় কিংবা নিদিষ্ট কোন দিন তারিখ আছে কি?
.
ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে হাত পায়ের
নখ, চুল কাটার নির্দিষ্ট কোন সময় কিংবা দিন তারিখের কথা বিশুদ্ধ কোন হাদিসে বর্ণিত হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বিভিন্ন বই পুস্তকে নখ কাটার বিভিন্ন নিয়ম যেমন: অমুক নখ থেকে কাটা শুরু করা ও অমুক নখে শেষ করা, অমুক দিনে নখ কাটা বা না কাটা ইত্যাদির ফযীলত বা ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এগুলো সবই পরবর্তী যুগের প্রবর্তিত নিয়ম। সালাফগন একমত যে, এ বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত আছে সবই বাতিল, বানোয়াট ও মিথ্যা। সুতরাং কোন সময় কিংবা দিন তারিখ নির্দিষ্ট না করে বরং নিজের সুবিধা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪০ দিনের মধ্যেই হাত পায়ের নখ, চুল ও বগলের পশম কাটতে হবে অন্যথায় গুনাহ হবে। আর এটাই বিশুদ্ধ কথা।
.
একদা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] -কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, ‘কোন কোন মহিলা তাদের নখগুলো মাসের পর মাস রেখে দেয় এবং তারা দাবি করে যে, এগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক’। জবাবে তিনি বলেন,”এটা বৈধ নয়, চল্লিশ দিন পূর্ণ হলেই নখ কাটা ওয়াজিব হয়ে যাবে।’(ফাতাওয়া নূরন ‘আলাদ দারব ইবনে বায, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৫৭)।
.
এতদ্ব্যতীত এটা ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও অন্যান্য বিজাতীদের সংস্কৃতি। অথচ ইসলামে কাফিরদের সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে”। (দেখুন সূরা আল-মায়িদাহ: ৫১; আবু দাঊদ, হা/৪০৩১; সহীহ বুখারী, হা/৩৪৫৬, ৬১৬৮-৬১৬৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৪০)।
.
❑ নারী পুরুষের হাত পায়ের নখ কাটার বিশুদ্ধ নিয়ম কী?
.
ইসলাম মানুষকে অনন্য শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে নানা নিয়ম-কানুন মেনে চলার জন্য ইসলামে যেমন নির্দেশনা রয়েছে। তেমনি কাজ কর্মে হাত-পায়ের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান হলো: قاعدة الشريعة : تقديم اليمين في كل ما كان من باب الكرامة ، وتقديم الشمال في كل ما كان من باب المهانة ، تنبيها على تعظيم اليمين ، وتميزها ، وزيادة لشرفها .অর্থাৎ ডান হাতকে কেবল সম্মানিত জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আর বাম হাতকে এমন জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, যা অশুচি বলে গণ্য। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৮৩৮২) উক্ত মূলনীতির আলোকে আমাদের প্রসিদ্ধ সালাফগন বলেছেন, হাতের নখ কাটার সময় প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাতের নখ কাটতে হয়। পায়ের নখ কাটার সময় ডান পায়ের নখ আগে কাটতে হয়। তবে এগুলোর সরাসরি যেমন দলিল নেই তেমনি কোন আঙ্গুলের নখ আগে কাটতে হয়, তারও কোন দলীল নেই।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] তার আল মাজমু’ গ্রন্থে বলেছেন,

” تقليم الأظفار مجمع على أنه سنة , وسواء فيه الرجل والمرأة واليدان والرجلان , ويستحب أن يبدأ باليد اليمنى ثم اليسرى ثم الرجل اليمنى ثم اليسرى ”

“আলেমগনের ইজমাহ তথা ঐক্যমতে নখ কাটা সুন্নাত। এটি পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য এবং হাত ও পায়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।এটি ডান হাত দিয়ে শুরু করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ প্রথমে ডান হাত, তারপর বাম, তারপর ডান পা তারপর বাম হাত দিয়ে শুরু করা”।(নববী আল মাজমু’ ১ম খন্ড পৃষ্ঠা: ৩৩৯)
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) তার শরহে সহীহ মুসলিমে আরো বলেছেন,

ويستحب أن يبدأ باليدين قبل الرجلين فيبدأ بمسبحة يده اليمنى ، ثم الوسطى ، ثم البنصر ، ثم الخنصر ، ثم الإبهام ، ثم يعود إلى اليسري فيبدأ بخنصرها ثم ببنصرها ، إلى آخرها ثم يعود إلى الرجلين اليمنى فيبدأ بخنصرها ويختم بخنصر اليسرى . والله أعلم

(নখ কাটার ক্ষেত্রে)“পায়ের আগে হাত দিয়ে শুরু করা এবং ডান হাতের তর্জনী দিয়ে শুরু করা মুস্তাহাব, তারপর মধ্যমা, তারপর অনামিকা, তারপর কনিষ্ঠা আঙুল, তারপর বুড়ো আঙুল, তারপর বাম হাতের দিকে সরানো। কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে শুরু করুন তারপর অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে, এভাবে শেষ পর্যন্ত কাটবে। তারপর ডান পায়ের দিকে যেতে হবে। ডান পায়ের সবচেয়ে ছোট আঙুল (কনিষ্ঠা আঙ্গুল) দিয়ে শুরু করতে হবে এবং বাম পায়ের সবচেয়ে ছোট আঙুল (কনিষ্ঠা আঙ্গুল) দিয়ে শেষ করতে হবে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।”(নববী শরহে সহীহ মুসলিম খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৪৯)
.
হাম্বলী মাজহাবের আলেমগন নখ কাটার সময় আঙ্গুলের ভিন্ন ভিন্ন ধারার কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। আল্লামা ইরাকি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,”নখ কাটার বিষয়ে এমন কোন প্রমাণিত হাদীস নেই যা অনুসরণ করা যেতে পারে।”( ত্বরহুত তাসরীব খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭৭)
.
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন:

“لم يثبت في ترتيب الأصابع عند القص شيء من الأحاديث …. ثم قال : وقد أنكر ابن دقيق العيد الهيئة التي ذكرها الغزالي ومن تبعه وقال : كل ذلك لا أصل له ، وإحداث استحباب لا دليل عليه ، وهو قبيح عندي بالعالم ، ولو تخيل متخيل أن البداءة بمسبحة اليمنى من أجل شرفها فبقية الهيئة لا يتخيل فيه ذلك . نعم ، البداءة بيمنى اليدين ويمنى الرجلين له أصل وهو (كان يعجبه التيامن) ”

“নখ কাটার সময় এবং আঙ্গুলের হুকুম সম্পর্কে কোনো প্রমাণিত (বিশুদ্ধ) হাদীস নেই। ইমাম ইবনে দাকীক আল-ঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) তিনি ইমাম গাজ্জালী (রাহিমাহুল্লাহ) এবং তাঁর অনুসারীদের উল্লিখিত আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেছেন: এর কোনটির কোন ভিত্তি নেই এবং এর কোন প্রমাণ না থাকলে এটিকে মুস্তাহাব বলে পরামর্শ দেওয়া আমার নিকটে জঘন্যতম অপরাধ। যদি কেউ ডান তর্জনী দিয়ে শুরু করা মুস্তাহাব বলে পরামর্শ দেয়, তবে এই ধারাবাহিকতার বাকি আঙ্গুলগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। হ্যাঁ ডান হাত এবং ডান পা দিয়ে শুরু করার জন্য একটি ভিত্তি আছে, যা হল “তিনি ডানদিকে শুরু করতে পছন্দ করেছেন”।(ফাতহুল বারী: খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ৩৪৫)
.
❑ হাত পায়ের নখ কাটা কিংবা চুল ফেলার পর সেগুলো দাফন করা কি আবশ্যক?
.
শাঈ দৃষ্টিকোণ থেকে হাত পায়ের নখ কাটার পর সেগুলো দাফন করা আবশ্যক কিংবা বাধ্যতামূলক নয়। তবে নখ কাটার পর কেউ যদি সেগুলো দাফন করেন তাহলে সেটি ভালো। আর যদি সেটা করতে না পারে তাহলেও ইনশাআল্লাহ্‌ কোন অসুবিধা নাই। চুল ও নখ দাফন করার নির্দেশ সম্বলিত কিছু হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু সে হাদিসগুলো সহিহ নয়। ইমাম বাইহাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘শুআবুল ঈমান’ গ্রন্থে বলেন:

وقد روي حديث دفن الشعر والأظفار من أوجه ، كلُّها ضعيفة ”

চুল ও নখ দাফন করার হাদিসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই দুর্বল।(নাসবুর রায়াহ ফি তাখরিজি আহাদিছিল হিদায়া, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৮৯)
.
হাত-পায়ের নখ কাটার পর সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা উত্তম। এই মর্মে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.] বলেছেন,” يَدفن الشعر والأظفار ، وإن لم يفعل : لم نَرَ به بأساً “চুল ও নখ দাফন করবে। যদি না করতে পারে; তাহলে এতে আমরা কোন অসুবিধা মনে করি না।”(খাল্লাল ‘আত-তারাজ্জুল’ পৃষ্ঠা: ১৯)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে চুল ও নখ দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন,

” ذَكر أهل العلم أن دفن الشعر والأظافر أحسن وأولى ، وقد أُثر ذلك عن بعض الصحابة رضي الله عنهم ، وأما كون بقائه في العراء ، أو إلقائه في مكان يوجب إثماً : فليس كذلك ”

“আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, চুল ও নখ দাফন করা উত্তম ও ভালো। কিছু সাহাবী থেকে এটি বর্ণিত আছে। পক্ষান্তরে এগুলো খোলা জায়গায় পড়ে থাকলে কিংবা কোন স্থানে ফেললে গুনাহ হয় এমন কথা ঠিক নয়।”(উসাইমীন মাজমুউ ফাতাওয়াস, ১১/প্রশ্নোত্তর নং ৬০ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৭৭৪০)।
.
পাশাপাশি জেনে রাখা ভালো যে, জিহাদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নখ লম্বা রাখা হারাম নয়। (কাশশাফুল ক্বিনা’ খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৯৪-৯৫)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, নারী পুরুষের হাত পায়ের নখ কাটা স্বভাবগত সুন্নাহ। এগুলো সর্বোচ্চ ৪০ দিনের আগেই কাটতে হবে অন্যথায় গুনাহ হবে। আর নখ কাটার সুনির্দিষ্ট কোন দিন, তারিখ, সময় কিংবা বিশুদ্ধ কোন নিয়ম নেই। তবে উত্তম হচ্ছে, আগে ডানদিক থেকে শুরু করা বামদিক দিয়ে সম্পন্ন করা যেমনটা সালাফগন উল্লেখ করেছেন। আশা করি সবাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন (আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।