হাদিস থেকে বাছাইকৃত উচ্চারণ ও অর্থসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ টি দুআর মধ্যে ২১তম দুআ

আজকের দু’আটি ভীষণ উপকারী একটি দু‘আ। আজকের দু’আটি সব রকমের বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবতে পড়া যায়।
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: হে মুসলিম তৌহিদী জনতা! আমরা সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমবেশি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ বিপদ আপদের সম্মুখীন হই। বালা-মুসিবত তাওহীদ, ঈমান ও তাওয়াক্কুলের অন্যতম একটি শিক্ষা: কারণ বালা-মুসিবত বাস্তবে আপনার নিজের স্বরূপ আপনার কাছে তুলে ধরে যাতে করে আপনি জানতে পারেন যে, আপনি একজন দুর্বল দাস, আপনার রব ছাড়া আপনার কোন ক্ষমতা নেই শক্তি নেই। তখন আপনি তাঁর উপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর (তাওয়াক্কুল) করবেন। পরিপূর্ণভাবে তাঁর কাছে আশ্রয় নিবেন; আর তখনি গৌরব, অহমিকা, অহংকার, আত্মপ্রীতি, প্রবঞ্চনা ও গাফলতির পতন হবে। আপনি বুঝতে পারবেন যে, আপনি এমন এক অসহায় ব্যক্তি যে তার মনিবের শরণাপন্নের মুখাপেক্ষী, এমন এক দুর্বল ব্যক্তি যে মহাশক্তিধর ও পরাক্রমশালীর আশ্রয়ের কাঙ্গাল। মূলত: মানুষের ঈমান অনুসারেই আল্লাহ্ তা’আলা বিপদ আপদ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা, বিপদাপদ-বালা মুসিবত নবীদেরকে প্রদান করেন। তারপর যারা তাদের পরের লোক, তারপর যারা এর পরের লোক, তারপর যারা এর পরের লোক।”(মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৬৯) অর্থাৎ প্রত্যেকের ঈমান অনুসারেই তাদের পরীক্ষা হয়ে থাকে। তবে পরীক্ষা যেন কেউ আল্লাহর কাছে কামনা না করে। বরং সর্বদা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা কামনা করাই মুমিনের কাজ।
.
আজকের দু’আটি বান্দার যাবতীয় বিপদ আপদে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার জন্য ভীষণ উপকারী একটি দু‘আ। যা পাঠ করে রবের নিকট দু’আ করলে মহান আল্লাহ কঠিন বিপদ আপদ থেকে মুক্তি এবং কল্যাণকর জীবনযাপনে সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। রাসূল (ﷺ) যখন কোন বিপদের সম্মুখীন হতেন তখনই এই দু’আটি পাঠ করতেন। সহীহ মুসলিমের বর্ননায় হাদীসটি বর্ননা করেছেন যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] তিনি বলেন,আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদ বা কষ্টের সময় এ কথাগুলো বলতেন। মুসনাদে আহমেদ এবং সহীহ ইবনে হিব্বানের বর্ননায় প্রখ্যাত সাহাবী আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৪০ হি.] বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (ﷺ) আমাকে কোনো কষ্ট বা বিপদে পড়লে উপরের এ দোয়া পড়তে শিখিয়েছেন— দু’আটির মূল আরবি হচ্ছে:
.
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَرَبُّ الْأَرْضِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
.
মোটামুটি উচ্চারণ: লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল আযীমুল হালীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুল আরশিল আযীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদ্বি ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম।(আরবির সঠিক উচ্চারণ বাংলায় লেখা কোনোভাবেই শতভাগ সম্ভব নয়; তাই আরবি টেক্সট মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন, পাশাপাশি আরবির সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন, না হয় ভুল শিখতে হবে)
.
অর্থ: আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি মহান, মহাধৈর্যশীল মহা বিচক্ষণ, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি মহান আরশের প্রভু, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই, যিনি আসমানসমূহের, জমিনের ও সম্মানিত আরশের প্রভু। (সহীহ মুসলিম, হা/ ৬৮১৪ সহীহ বুখারী হা/৬৩৪৬ সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১৪৭, মুসনাদ আহমদ হা/১৯৪)
.
এবার এভাবে আরবী এবং বাংলা উচ্চারণসহ সহজে মুখস্থ করুন: .
.
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ،
(লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) অর্থ: আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই,
.
الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ
(আল-আযীমুল হালীম) অর্থ:যিনি মহান, মহাধৈর্যশীল মহা বিচক্ষণ।
.
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ،
(লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) অর্থ: আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই,
.
رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ،
(রাব্বুল আরশিল আযীম) অর্থ:যিনি মহান আরশের প্রভু,
.
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ،
(লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) অর্থ: আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই,
.
رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَرَبُّ الْأَرْضِ
(রাব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদ্বি) অর্থ:যিনি আসমানসমূহের, জমিনের ও সম্মানিত প্রভু।
.
وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
(ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম) অর্থ: এবং মহান আরশের রব।
.
প্রিয় পাঠক! একটু খেয়াল করে দেখুন এই দু‘আটি খুবই ছোট এবং সহজ হলেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদে আপদে যে দু’আগুলো পাঠ করতেন তন্মধ্যে এটি অন্যতম। সহীহ মুসলিমের ব্যাখায় এই দু’আটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

وَهُوَ حَدِيث جَلِيل , يَنْبَغِي الِاعْتِنَاء بِهِ , وَالْإِكْثَار مِنْهُ عِنْد الْكُرَب وَالْأُمُور الْعَظِيمَة , قَالَ الطَّبَرِيُّ : كَانَ السَّلَف يَدْعُونَ بِهِ , وَيُسَمُّونَهُ دُعَاء الْكَرْب , فَإِنْ قِيلَ : هَذَا ذِكْر وَلَيْسَ فِيهِ دُعَاء , فَجَوَابه مِنْ وَجْهَيْنِ مَشْهُورَيْنِ : أَحَدهمَا : أَنَّ هَذَا الذِّكْر يُسْتَفْتَح بِهِ الدُّعَاء ثُمَّ يَدْعُو بِمَا شَاءَ , وَالثَّانِي : جَوَاب سُفْيَان بْن عُيَيْنَةَ فَقَالَ : أَمَا عَلِمْت قَوْله تَعَالَى : ( مَنْ شَغَلَهُ ذِكْرِي عَنْ مَسْأَلَتِي أَعْطَيْته أَفْضَل مَا أُعْطِي السَّائِلِينَ ) وَقَالَ الشَّاعِر : إِذَا أَثْنَى عَلَيْك الْمَرْء يَوْمًا كَفَاهُ مِنْ تَعَرُّضه الثَّنَاء ”

“এটি একটি মহান হাদিস। এ হাদিসটিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিপদাপদ ও বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে এ দু’আটি বার বার আবৃত্তি করা উচিত। ইমাম তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: সলফে সালেহীনগণ এ দু’আটি দিয়ে দোয়া করতেন। তাঁরা এটিকে বিপদাপদ মুক্তির দোয়া আখ্যায়িত করতেন। যদি কেউ বলে: এটি তো যিকির, এর মধ্যে তো কোন দু’আ (প্রার্থনা) নেই। এ প্রশ্নের প্রসিদ্ধ দুইটি জবাব রয়েছে: (১). ব্যক্তি এ যিকিরের মাধ্যমে দু’আর সূচনা করবে; এরপর যে দু’আ করতে চায় সে দু’আ করবে। (২). সুফিয়ান বিন উয়াইনা যে উত্তরটি দিয়েছেন সেটি হচ্ছে- আপনি কি আল্লাহ তাআলার সে বাণীটি শুনেননি: ‘আমার যিকির করা যাকে আমার কাছে চাওয়া থেকে ব্যস্ত রেখেছে আমি তাকে সওয়ালকারীদেরকে যা দিই তার চেয়ে উত্তম দিব।’ কবি বলেন: ‘যদি কোনদিন কেউ আপনার প্রশংসা করে তাহলে তার চাওয়া-পাওয়া পেশ করার জন্য আপনাকে প্রশংসা করাই যথেষ্ট’।(নববী শারহে মুসলিম,হা/ ৬৮১৪ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৯২৭৬)
.
তাই সবার উচিত দু’আটি মুখস্ত করে নেওয়া।অতএব আপনারা উপরোক্ত বাক্যগুলোর অর্থ খেয়াল করে,সবধরনের বিপদ আপদে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অবস্থাকে অন্তরে ধারণ করে দু‘আটি পড়বেন। দু‘আটি আমরা (বিশেষত নফল) নামাজের সিজদায়, নামাজের সালাম ফেরানোর আগে, দু‘আ কবুলের বিশেষ সময়ে কিংবা যেকোনো দু‘আর মধ্যে পড়তে পারি। আনুষ্ঠানিক দু‘আ ছাড়াও সাধারণভাবে এসব বাক্য পড়তে পারি। নামাজের সিজদায় পড়ার নিয়ম হলো: প্রথমে সিজদার তাসবিহ “সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা”। ৩/৫/৭ বার পড়ে নেবেন, এরপর এই দু‘আটি পড়বেন। এবং অন্তরে আল্লাহর প্রতি সুধাণা রাখবেন।আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন আল্লাহ সবার ইলমে আমলে বারাকাহ দান করুক। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।