হজ্জ উমরাহ করার সময় ছবি তোলা বা সেলফি তোলা কতটা শরীয়ত সম্মত

হজ্জ শরীয়তের অন্যতম রুকন এবং ইসলামের প্রধান পাঁচটি বিষয়ের পঞ্চম স্তম্ভ। এটি একটি ফরয ইবাদত। যা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর জীবনে একবার ফরয। এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি ফযীলতও সীমাহীন। পৃথিবীতে যত নেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে হজ্জ শ্রেষ্ঠতম। রাসূল (ﷺ) অন্য সকল আমলের উপর হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনকারীকে গুণাহমুক্ত নবজাতকের ন্যায় বলা হয়েছে। কবুল হজ্বের পুরস্কার জান্নাত। হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে পৃথক ফযীলত ও মর্যাদা। এই ইবাদতের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে, পবিত্র হজ্জ উমরাহ এর সময় বিভিন্ন ইবাদতি আনুষ্ঠানিকতার সময় অনেকেই সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকেন। পবিত্র হজ্জ উমরাহ পালন করতে আসা কিছু মানুষের আচরণ দেখলে মনে হয় তারা হজ্জ করতে নয় বরং আনন্দ ভ্রমণে এসেছেন (নাউযুবিল্লাহ)।এছাড়াও পবিত্র হজ্জের সফরেও অনেকে খ্যাতনামা বিভিন্ন ব্যক্তিদের দেখে তাদের সঙ্গে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন। এমনকি পবিত্র কাবাঘরের সামনে পর্যন্ত সেলফি তোলা নেশায় পরিনত হয়েছে। হজ্জ উমরাহ গিয়ে ছবি তোলে সেই ছবি আবার ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে পোস্ট না করলে যেন,মনে শান্তি আসেনা, রাতে ঘুম হয়না। অথচ হজ্জ/উমরাহ গিয়ে পবিত্র স্থান মসজিদুল হারামে এভাবে ছবি তোলা জায়েজ কিনা এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা নেই,নেই কারো মাথাব্যাথা। আজ আমরা হজ্জ উমরাহ পালন করতে গিয়ে মসজিদুল হারামে তাওয়াফ,শাঈ ইত্যাদি সম্পূর্ণ করার সময় ছবি তোলা জায়েজ কিনা সেটি জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে একান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে নারী-পুরুষসহ যেকোনো প্রানী অর্থাৎ মানুষ, জীব-জন্তুর ছবি তোলা, অঙ্কন করা, ব্যবহার করা, সংরক্ষণ করা এবং প্রানীর ছবি বিশিষ্ট পোশাক পরিধান করা হারাম এবং কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কারন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ছবি-মূর্তি অংকনকারীর সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে’। (সহীহ বুখারী হা/৫৯৫০; মুসলিম হা/২১০৯; মিশকাত হা/৪৪৯৭)। অপর বর্ণনায়, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, যারা এসব ছবি তৈরী করে, তারা ক্বিয়ামতের দিন কঠিন আযাবপ্রাপ্ত হবে। তাদেরকে বলা হবে তোমরা যা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ দাও।’ (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৯২ ‘পোষাক’ অধ্যায়, ‘ছবি সমূহ’ অনুচ্ছেদ)। আরেক বর্ণনায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী, كُلُّ مُصَوِّرٍ فِي النَّارِ ‘তথা প্রত্যেক ছবি অঙ্কনকারী জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সহীহ মুসলিম, ২১১০; মিশকাত, হা/৪৪৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮১১). আবু তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ، وَلَا صُورَةٌ “ফেরেশতাগণ ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর অথবা ছবি থাকে। (সুনানে আন-নাসায়ী হা/৫৩৪৭) .
.
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে সৌদি সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন, আর এটা প্রমাণ করে যে, ছবি অঙ্কন করা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কবীরা গুনাহ ব্যতীত লা‘নতের (অভিশাপের) বিষয়টি আসে না এবং কবীরা গুনাহের প্রসঙ্গ ছাড়া কঠিন শাস্তির হুমকিও প্রদান করা হয় না; কিন্তু শরীরের হাত, পা ও অনুরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি অঙ্কন বৈধ। কারণ, এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রাণ অবস্থান করে না; হাদিসের বক্তব্যসমূহের বাহ্যিক দিক হলো, ঐ ছবি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অঙ্কন করা হারাম, যার মাঝে প্রাণ বা জীবনের অবস্থান সম্ভব। কেননা নবী (ﷺ) বলেন“,যে ব্যক্তি ছবি তৈরি করে, তাকে কিয়ামতের দিন তাতে জীবন দানের জন্য নির্দেশ দেয়া হবে, কিন্তু সে সক্ষম হবে না।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৫৬০৬)। শাইখ ইবনু উসাইমীন; মাজমু‘উ ফতোয়া ওয়া রাসায়েল,২ / ২৭২) স্বাভাবিক ভাবে বিনা কারণে ছবি তোলা এতটা ভয়ঙ্কর হলে হজ্জ-ওমরায় গিয়ে ছবি তোলা কেমন হতে পারে?
.
হজ্জ/উমরাহ গিয়ে পবিত্র মসজিদুল হারামে ছবি তোলা সম্পর্কে সৌদি সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হলে শাইখ বলেন, মসজিদুল হারামেরস্থলে হজযাত্রীদের ছবি তোলা দুটি কারণে জায়েয নয়। যেমন:

(১). তারা এখানে ছবি তোলে যেন পরবর্তীতে এই ছবিগুলো তারা স্মৃতির জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারে, অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কোনো প্রানীর ছবি স্মৃতির জন্য রাখা হারাম।

(২). তাওয়াফ এবং দু’আ করার সময় ছবি তোলা। এটি সাধারণত লোক দেখানো অর্থাৎ রিয়া থেকে মুক্ত নয়, কারণ লোকেরা ছবি তোলে অন্যদের দেখানোর জন্য যে তারা হজ্জ করেছে। যা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তবে কারণবশত যদি ছবি তোলার প্রয়োজন হয়, যেমন এই লোকটি অন্য কারো পক্ষ থেকে বদলি হজ্জ করছে, তাই যার পক্ষ থেকে হজ্জ করা হচ্ছে তাকে প্রমান হিসেবে দেখানোর জন্য একটি ছবি তোলে যাতে প্রমান হয় সে হজ্জ করেছে,তারপর এই ছবিটি তার কাছে পৌঁছানো অর্থাৎ যিনি তাকে হজ্জ করতে পাঠিয়েছেন। অতঃপর ছবিটি দেখার পর যদি তিনি সেটা মুছে ফেলেন অথবা ছিঁড়ে ফেলেন, তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই, কারণ এর প্রয়োজনে তোলা হয়েছে,আর এর পেছনের উদ্দেশ্য প্রমান পেশ করা স্মৃতির জন্য রাখা নয়। (মাজমু’ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২৪/৭০-৭১, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৯২৩২)
.
হজ্জ/উমরাহ গিয়ে ছবি তোলা সম্পর্কে সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ)[জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেন, হে ভাই, আমি দেখেছি মানুষ মসজিদুল হারামে ছবি তুলছে, দ্বিতীয় তলায় ছবি তুলছে, এটা হারাম ও মুনকার, এটা জায়েজ নয়। যারা এই কাজ করছে অবশ্যই তাদেরকে থামাতে হবে। তাদের ক্যামেরার ডিভাইসগুলো আটক করতে হবে এবং ধ্বংস করতে হবে। মহান আল্লাহর মসজিদুল হারামে মন্দ তথা খারাপ কাজ জায়েজ নয়।তাছাড়া যেখানে সব জায়গাতেই খারাপ কাজ জায়েজ নয় সেখানে মসজিদুল হারামে কিভাবে জায়েজ হতে পারে? মহান আল্লাহ বলেন, আর যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে সেখানে (মসজিদুল হারামে) পাপকাজ করতে চায়, তাকে আমি যন্ত্রণাদায়ক আযাব আস্বাদন করাব। (সূরা হজ্জ; ২২/২৫)। সুতরাং আপনার-আমার দায়িত্ব হলো মসজিদুল হারামের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই মন্দ কাজ সম্পর্কে অবহিত করা। যাতে তারা এই অপরাধীদেরকে থামাতে পারে, যারা ইবাদত করার জন্য আসেনি বরং তারা ক্ষতি করতে এবং খারাপ কাজ করতে এসেছিল। লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। (শাইখের একটি বিডিও থেকে অনূদিত)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! হজ্জ একটি ইবাদত, যা আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশেষ মর্যাদা লাভ করা যায়। একজন মুসলিমের জন্য, হজ্জ-উমরাহ করা সহজ কাজ নয়। কারণ, হজ্জ-উমরাহ করতে আল্লাহর সাহায্য এবং প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অনেক মুসলিমের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে হজ্জ, উমরাহ করতে পারেনা। মহান আল্লাহ আমাদের মধ্যে যাদেরকে হজ্জ- উমরাহ করার তৌফিক দান করেছেন আমাদের উচিত শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী হজ্জ/উমরাহ করা। সেখানে গিয়ে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট না করে প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা। জেনে রাখা ভালো, পবিত্র কুরআন এবং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ মোতাবেক ও ত্রুটিবিহীন ভাবে হজ্জ সম্পন্ন না হলে তা কবুল হয় না। সুতরাং আমাদের উচিত পূর্ব থেকেই হজ্জের বিধি-বিধান ভালোভাবে জেনে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সম্পন্ন করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এর গুরুত্ব ও ফযীলত বুঝে তদানুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।