দোয়া কবুল হওয়া সম্পর্কে একটি হাদিসের ব্যাখ্যা

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তিন ব্যক্তির দো‘আ কবুল হয় না; (১). যে তার চরিত্রহীনা স্ত্রীকে তালাক দেয় না, (২). যে ঋণ প্রদান করে সাক্ষী রাখে না এবং (৩). যে মূর্খ বা বুদ্ধিহীন (অপচয়কারী) – ব্যক্তির হাতে অর্থ প্রদান করে। হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
হাদীসটির সম্পর্কে আলোচনা করার আগে একটি বিষয় পরিস্কার করি, একজন ব্যক্তির জন্য কেন সালাফদের মানহাজ আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য উপরোক্ত হাদীসটি তার বাস্তব প্রমাণ। কেননা হাদীসটির সরল অনুবাদ আর প্রকৃত অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই যে কোন মানুষ অথবা আলেম রেফারেন্স সহ হাদীসের সরল অনুবাদ করতে পারলেই তাকে বড় আলেম বড় জ্ঞানী ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই না। কেননা কুরআনের বহু আয়াত এবং অসংখ্য হাদীস রয়েছে যেগুলোর সরল অর্থ প্রকৃত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত।তাই কুরআন হাদীসের প্রকৃত অর্থ,মর্ম এবং আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বুঝার জন্য সালাফদের ব্যাখ্যা, বুঝ এবং মানহাজ অনুসরণ জরুরী। তাই পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে যার তার কাছ থেকে দ্বীনি ইলম নিতে সতর্ক থাকবেন। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা দ্বীনের ইলম। সুতরাং তোমরা দেখ যে, কাদের নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ।’ (ইবনু আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫)। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন,‘ইমাম আবুল মুযাফফার সাম‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আমরা সুন্নাতের অনুসরণ করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং বিদ‘আত হতে আমাদেরকে নিষেধ ও তিরস্কার করা হয়েছে। সুতরাং আহলুস সুন্নাহর প্রতীক হলো, সালাফে- সালেহীনের অনুসরণ করা এবং প্রত্যেক নব উদ্ভূত ও বিদ‘আতকে বর্জন করা।’ (সাওনুল মানত্বিক, পৃ. ১৫৮)।
.
যাইহোক এবার মূল কথায় আসি, যে হাদীসটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন পরিপূর্ণ বর্ননাটি হলো, বিখ্যাত সাহাবী আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তিন ব্যক্তির দো‘আ কবুল হয় না; (১). যে তার চরিত্রহীনা স্ত্রীকে তালাক দেয় না, (২). যে ঋণ প্রদান করে সাক্ষী রাখে না এবং (৩). যে মূর্খ বা বুদ্ধিহীন (অপচয়কারী)-ব্যক্তির হাতে অর্থ প্রদান করে। (তাহক্কীক: হাদীসটি ইমাম মুসতাদরাকে হাকেম বর্ণনা করেছেন। তিনি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, হাদীসটি মারফু যা রাসূল (ﷺ)-এর কথা। (দেখুন, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮০৫)
.
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আল- মানাবী (রাহিমাহুল্লাহ)-বলেছেন, তিন ব্যক্তির দো‘আ কবুল হয় না যেমন:
.
(১). প্রথম ব্যক্তির দো‘আ: যে তার চরিত্রহীনা স্ত্রীকে তালাক দেয় না, অর্থাৎ যার দুশ্চরিত্রা স্ত্রী রয়েছে,সে তাকে তালাক না দিয়ে যদি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে তাহলে তা গৃহীত হবে না। কারণ তার ক্ষমতা ছিল, তাকে তালাক দেওয়ার কিন্তু সে তা করেনি। আল্লাহ তা‘আলা তালাক দেওয়াকে অপছন্দ করেন একথা ঠিক কিন্তু জাতির কল্যাণে, প্রয়োজনে তালাক বৈধ রেখেছেন। সুতরাং, অসভ্য দুশ্চরিত্রা স্ত্রীকে তালাক দেওয়া জায়েজ হওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি সেটা না করে ওই স্ত্রীর সাথে বসবাস করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে।অতঃপর সে যদি তার দুশ্চরিত্রা সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে তাহলে ঐ ব্যক্তির দু’আ অথবা বদদোয়া আল্লাহ কবুল করবেন না।
.
(২). দ্বিতীয় ব্যক্তি: যে ঋণ প্রদান করে সাক্ষী রাখে না। অর্থাৎ যে সাক্ষী রাখা ছাড়া অন্যকে অর্থ ধার দিয়েছে। যা কুরআনের সেই আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় যেখানে আল্লাহ তায়ালা একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদানের সময় দুজন সাক্ষী রাখতে বলেছেন, কিন্তু সে তা পালন করেনি। মহান আল্লাহ বলেন, “এবং তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে দু’জন সাক্ষীকে সাক্ষী রাখ।” (সূরা বাকারাহ, ২/২৮২)। সুতরাং ঋণদাতা ঋণ দেওয়ার সময় সাক্ষী না রাখার ফলে ঋণগ্রহীতা যদি অস্বীকার করে যে সে টাকা ধার করেনি ফলে পাওনাদার তার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার বদদোয়া কবুল করবেন না।
.
(৩). তৃতীয় ব্যক্তিটি: যে মূর্খ বা বুদ্ধিহীন (অপচয়কারী)-ব্যক্তির হাতে অর্থ প্রদান করে। ফলে সে তা আত্মসাৎ করে বা নষ্ট করে তাহলে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বদদোয়া আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। কারণ, আল্লাহ নির্বোধের হাতে সম্পদ তুলে দিতে বারণ করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমরা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদেরকে নিজেদের মাল প্রদান করো না।” (সূরা নিসা; ৪/৫)। উপরোক্ত আয়াতের মতে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততি কিংবা অনভিজ্ঞ স্ত্রীলোকদের হাতে অথবা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন এমন সবার হাতেই সম্পদ অৰ্পন করা যাবে না যাদের হাতে পড়ে ধন-সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে। এতে ইয়াতীম শিশু বা নিজের সন্তানের কোন পার্থক্য নেই।মোটকথা, মালের হেফাজত অত্যন্ত জরুরী এবং অপচয় করা গোনাহের কাজ। নিজের সম্পদের হেফাজত করতে গিয়ে যদি কেউ নিহত হয়, তবে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: নিজের মালের হেফাজত করতে গিয়ে যদি কেউ নিহত হয়, তবে সে শহীদ।’ (সহীহ বুখারীঃ ২৪৮০, মুসলিমঃ ১৪১)। সুতরাং,দুর্বল মনের ব্যক্তির হাতে সম্পদ অর্জন করলে সে যদি সেই সম্পদের অপচয় করে। অতঃপর মালিক তার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দো‘আ করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা সেই দো‘আ প্রত্যাখ্যান করবেন। কারণ, এখানে মালিক নিজেই অর্থ অপচয়ের জন্য দায়ী ছিলেন।
.
মোটকথা, উপরোক্ত তিন ব্যক্তি আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করে নিজেদের উপরে নিজেই শাস্তি চাপিয়ে নিয়েছে। যার ফলে এই সকল ক্ষেত্রে তাদের দোয়া আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। আর এই হাদীস দ্বারা এটা বোঝায় না যে, তাদের অন্য কোন দোয়া কবুল হবে না। অন্যান্য দোয়ার ক্ষেত্রে এই হাদীস প্রয়োগ করা সঠিক নয়। (দেখুন ইসলামওয়েব ফাতওয়া নং-৮৭৬৫, আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৯৯৬৫০)‌।আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।