সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্টে লাভ রিয়েক্টসহ ইমোজি ব্যবহার করা কি হারাম

প্রশ্ন: ইসলামে একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত প্রাণীর ছবি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্টে লাভ রিয়েক্টসহ যেসব “ইমোজি” ব্যবহার করি সেগুলো কী হারাম হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কুরআন-সুন্নাহর দলিল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মানহাজ হচ্ছে, যে কোনো প্রাণসমৃদ্ধ প্রাণীর ছবি, চিত্রকর্ম অঙ্কনের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট। তা হলো, এগুলো হারাম। চাই সেটা মানুষের হোক, জন্তুর হোক বা পাখির হোক। এগুলি সংরক্ষণ করা কিংবা বাড়ীতে রাখা নিষিদ্ধ এবং এগুলি ভেঙ্গে ফেলা বা নষ্ট করা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে এত পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে- ফকীহগণ বলেন, অর্থের দিক থেকে সেগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাণীর ছবি অংকন সংক্রান্ত এই হাদীসগুলোর মাধ্যমে শুধুমাত্র কাফের-মুশরিকদেরকে সম্বোধন করেননি; বরং এই সম্বোধন সাহাবীদের থেকে শুরু করে গোটা উম্মাহর প্রতি। এ ক্ষেত্রে মুসলিম হওয়া বা কাফের হওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যাইহোক আজ আমরা প্রাণসমৃদ্ধ প্রাণীর ছবি নিয়ে কথা বলবো না। আজ আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশক, হাসি-কান্না, লাইক, লাভ ইত্যাদি “ইমোজি” ব্যবহার করার হুকুম কি? এগুলো কখন কার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বৈধ এবং কখন কার ক্ষেত্রে বৈধ নয় এই বিষয়টা চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
.
ইমোজি কী?
.
Emoji শব্দটি E এবং Moji দুটি শব্দের সমষ্টিতে গঠিত, জাপানি ভাষায় E মানে “ছবি” এবং Moji মানে হলো “চরিত্র”। এজন্য একে সচিত্র বার্তাও বলা হয়, অর্থাৎ ইমোজি শব্দটির উৎপত্তি জাপানী শব্দ ইমোডজি থেকে, যার অর্থ স্মাইলি অর্থাৎ হাসিমুখ। এটি এক ধরনের আইকন, যা মানুষের বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতি প্রকাশার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে যেমন: ফেসবুক বা মেসেঞ্জারে যেসব ইমোজি ব্যবহার করা হয়। আরো সহজ ভাষায়, ইমোজি মানে আপনার আবেগ কাউকে কম শব্দে ব্যাখ্যা করা। ধরুন আপনি খুব খুশি এবং কোনো বন্ধু আপনাকে জিজ্ঞেস করছে আপনি কেমন আছেন, তাহলে আপনি যদি কোনো লেখা না লিখে শুধু একটি খুশির ইমোজি পাঠান, তাহলে আপনার বন্ধু সহজে বুঝে যাবে যে আপনি এখন খুশি আছেন। এই ইমোজি বা ইমোকটিন প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে ২০১২ সালে। যদিও ১৯৯৯ সাল থেকে ইমোজির অস্তিত্ব ছিল।
.
▪️সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা কাউকে লাইক-কমেন্টে যে ইমোজি গুলি ব্যবহার করি এগুলো কি ছবির অন্তর্ভুক্ত?
.
এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের সালাফদের বক্তব্য হচ্ছে,বযে ছবিগুলো দিয়ে বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় যেমন হাস্যকর বা বিষণ্ণ মুখ, স্টিকার ইত্যাদি। এগুলো প্রকৃত ছবির হুকুমের আওতায় পড়বে না দুটি কারণে:
.
(১).প্রথমটি: এগুলো স্পষ্ট ছবি নয়। বরং এটা একটা প্রতীকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আহলুল আলেমগণ বলেছেন, لو كانت صغيرة بحيث لا تبدو للناظر إلا بتأمل : لا يُكْره ছবি যদি এমন ছোট হয় যে, সেটাকে স্পষ্ট চিনতে গেলে অনেক গবেষণা করতে হয় বা বারবার দেখতে হয় , তাহলে এমন ছবির ক্ষেত্রে মাকরুহ নয়।(ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১০৮)
.
(২).দ্বিতীয়টি: যখন কোন ছবির কোন একটা অংশ কেটে নেওয়া হয় যেখানে তার কোন জীবন বাকি থাকে না। হয়তো তার পেট নাই বা পিঠ নাই অথবা প্রকৃতপক্ষে তার মাথা নাই তাহলে সেটা ছবি হিসেবে গণ্য হবে না বরং সেটা হবে চুল, নাক-কানবিহীন একটি বৃত্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (الصورة الرأس ، فإذا قطع الرأس فلا صورة) ছবি হলো যার মাথা রয়েছে, মাথা যখন কেটে ফেলা হবে তখন সেটি ছবি থাকে না।(সহীহ আল-জামি হা/৩৮৬৪)। বর্ননাটি ইসমাইলী তার অভিধানে ইবনে আব্বাসের হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায়হাকী আল-সুনান আল-কুবরা হা/১৪৫৮০ বর্ননা করেছেন। শাইখ আলবানী সিলসিলাতুস সহিহাতে সহিহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা/১৯২১)। অপর বর্ননায় জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ﷺ)-কে নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘সুতরাং ঐ প্রতিকৃতিগুলোর মাথা কেটে ফেলুন, যা ঘরের দরজায় রয়েছে, তা কাটা হলে তখন তা গাছ-গাছড়ার আকৃতি হয়ে যাবে।’ (আবু দাঊদ হা/৪১৫৮; মিশকাত হা/৪৫০১; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৫৬)। তাছাড়া হানাফী, মালেকী এবং অধিকাংশ শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবসহ অধিকাংশ ফকিহগন বলেছেন যে, أن الصورة إذا قطع منها ما لا تبقى معه الحياة أنها لا تأخذ حكم الصورة যখন কোন ছবির কোন অংশ কেটে ফেলা হবে যেটা ছাড়া জীবন বাঁচতে পারেনা তাহলে সেটা ছবির হুকুমে থাকে না। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৮৩৫৪৫)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন: فإن قطع رأس الصورة , ذهبت الكراهة . قال ابن عباس : الصورة الرأس , فإذا قطع الرأس فليس بصورة . وحكي ذلك عن عكرمة . وقد روي عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أتاني جبريل , فقال : أتيتك البارحة , فلم يمنعني أن أكون دخلت إلا أنه كان على الباب تماثيل , وكان في البيت ستر فيه تماثيل , وكان في البيت كلب , فمر برأس التمثال الذي على الباب فيقطع , فيصير كهيئة الشجر , ومر بالستر فلتقطع منه وسادتان منبوذتان يوطآن , ومر بالكلب فليخرج . ففعل رسول الله صلى الله عليه وسلم .وإن قطع منه ما لا يبقى الحيوان بعد ذهابه , كصدره أو بطنه , أو جعل له رأس منفصل عن بدنه , لم يدخل تحت النهي , لأن الصورة لا تبقي بعد ذهابه , فهو كقطع الرأس .وإن كان الذاهب يبقي الحيوان بعده , كالعين واليد والرجل , فهو صورة داخلة تحت النهي .
وكذلك إذا كان في ابتداء التصوير صورة بدن بلا رأس , أو رأس بلا بدن , أو جعل له رأس وسائر بدنه صورة غير حيوان , لم يدخل في النهي ; لأن ذلك ليس بصورة حيوان ”
.
“নিশ্চয়ই ছবির মাথা কেটে ফেলার মাধ্যমে কারাহাতটা দূর হয়ে যায়। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন; ছবি বা মূর্তির মূল হলো মাথা। কেননা যখন মাথা কেটে ফেলা হয় তখন সেটা আর ছবি থাকে না। সেটা বর্ণনা করা হয়েছে ইকরিমা থেকে। আর আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেছেন, আমার কাছে জিবরীল আসলো অতঃপর সে বলল আমি তোমার নিকট গতকাল রাতে এসেছিলাম কিন্তু আমাকে তোমার বাড়িতে প্রবেশ হতে বাধা প্রদান করেছিল, তোমার ঘরের দরজায় দরজায় ছবি ছিলো। ঘরের মধ্যে ছিলো ছবিযুক্ত পর্দা এবং ঘরের ভিতরে ছিলো কুকুর। সুতরাং তুমি আদেশ করো ঐ প্রতিকৃতিগুলোর মাথা কেটে ফেলতে, যা তোমার ঘরের দরজায় রয়েছে, তা কাটা হলে তখন তা গাছ-গাছড়ার আকৃতি হয়ে যাবে, আর তুমি আদেশ করো পর্দার ব্যাপারে, সেটি কেটে দু’টি গদি তৈরি করে নেবে, যা বিছানা এবং পায়ের নিচে থাকবে। আর কুকুরটির ব্যাপারে আদেশ করো যেন তাকে অবশ্যই ঘর থেকে বের করা হয়; তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করলেন।(তিরমিযী হা/২৯৭০, আবু দাঊদ ৪১৫৮, সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৫৮৫৪, সহীহুল জামি হা/৬৮)। সুতরাং যদি ছবি বা মূর্তির এমন কোন অংশ কাটা হয় যেটা কাটার পর মূর্তির অবস্থা থাকে না; যেমন তার বুক কেটে ফেলা অথবা তার পেট কেটে ফেলা অথবা তার মাথাটাকে তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা তাহলে ঐ ছবি নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে না, কেননা ছবি বা মূর্তিটা ঐ অংশ কেটে ফেলার ফলে আর ছবি বা মূর্তি থাকে না। তখন সেটা মাথা কেটে ফেলার ন্যায়। আর যদি কোন অংশ কেটে ফেলার পরেও প্রাণীর হিসাবে চিহ্নিত করা যায় যেমন চোখ তুলে ফেলা, হাত কেটে ফেলা অথবা পা কেটে ফেলা, তাহলে সেটা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে। অনুরূপভাবে ছবি বা মূর্তির সূচনা লগ্নে যখন সেটা এমন ছবি বা মূর্তি হবে যার শরীর আছে কিন্তু মাথা নেই অথবা তার মাথা আছে কিন্তু শরীর নেই, অথবা তার মাথা আছে কিন্তু তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ঐ প্রানী ছাড়া অন্যের তখন সেটা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা সেটা কোন প্রাণীর ছবি না।(ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ২১৬)। এই মাসয়ালার আরো বিস্তারিত আলোচনা দেখতে এবং অন্যান্য মাযহাবের বক্তব্য গুলো জানতে দেখুন, আহকামুত তাসবীর ফি ফিকহিল ইসলামি, পৃষ্ঠা: ২৩৪-২৪০)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন, আর এটা প্রমাণ করে যে, ছবি অঙ্কন করা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কবীরা গুনাহ ব্যতীত লা‘নতের (অভিশাপের) বিষয়টি আসে না এবং কবীরা গুনাহের প্রসঙ্গ ছাড়া কঠিন শাস্তির হুমকিও প্রদান করা হয় না; কিন্তু শরীরের হাত, পা ও অনুরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি অঙ্কন বৈধ। কারণ, এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রাণ অবস্থান করে না; হাদিসের বক্তব্যসমূহের বাহ্যিক দিক হলো, ঐ ছবি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অঙ্কন করা হারাম, যার মাঝে প্রাণ বা জীবনের অবস্থান সম্ভব। কেননা নবী (ﷺ) বলেন; «من صور صورة في الدنيا كلف يوم القيامة أن ينفخ فيها الروح وليس بنافخ» ( أخرجه البخاري) “যে ব্যক্তি ছবি তৈরি করে, তাকে কিয়ামতের দিন তাতে জীবন দানের জন্য নির্দেশ দেয়া হবে, কিন্তু সে সক্ষম হবে না।” (সহীহ বুখারী হা/৫৬০৬; উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৭২)
.
আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) অন্য জায়গায় বলেন, إذا لم تكن الصورة واضحة ، أي : ليس فيها عين ، ولا أنف ، ولا فم ، ولا أصابع : فهذه ليست صورة كاملة ، ولا مضاهية لخلق الله عز وجل ” .
যদি ছবিটি পরিষ্কার না হয়, অর্থাৎ: এতে চোখ, নাক, মুখ কিংবা আঙ্গুল না থাকে, তবে এটি সম্পূর্ণ চিত্র নয়, এবং এটি আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করছে না। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড,২ পৃষ্ঠা: ২৭৮)। অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্টে ব্যবহার করা ইমোজিগুলো ছবির অন্তর্ভুক্ত নয়।
.
▪️সোশ্যাল মিডিয়ায় পাবলিক পোস্টে কমেন্ট, রিয়েক্ট এবং তা শেয়ার করা কখন বৈধ এবং কখন কার ক্ষেত্রে বৈধ নয়।
.
এতে কোন সন্দেহ নাই যে, বর্তমান মিডিয়ার যুগে সমাজের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যুবক-যুবতি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত। কেউ এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে আর কেউ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি গবেষণায় প্রমাণিত ফেসবুকে সবচেয়ে বেশী সময় সক্রিয় থাকা ব্যবহারকারীদের তালিকায় শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দিয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান ‘মেটা’। সংস্থাটি জানায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পৃথিবীর ২০০ কোটি মানুষ একবার হলেও ফেসবুকে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ব্যবহারকারী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইন থেকে।
.
যাইহোক, কোন ধরনের পাবলিক পোস্টে কখন এই লাইক-কমেন্টে ইমোজিগুলো ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে আমরা এখন বলবো। যদি কোনও ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালো ও উপকারী কোনও লেখা, প্রবন্ধ, পোস্টার, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি পোস্ট করে। যেমন: দাওয়াতি কার্যক্রম সংক্রান্ত পোস্ট তথা কুরআন-হাদিস ও সহিহ আকিদা ভিত্তিক লেখা বা ভিডিও ক্লিপ, মানুষকে সৎকর্ম ও মানব কল্যাণের প্রতি উৎসাহ প্রদান, পাপাচার ও অন্যায় প্রতিরোধের আহ্বান, সৎ চরিত্র ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা, হারানো শিশুর সন্ধান চেয়ে পোস্ট ইত্যাদি তাহলে এই জাতীয় পোস্টে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শালীন ভাষায় উৎসাহ মূলক কমেন্ট ও ফিতনা বিহীন ইমোজি রিয়েক্ট প্রদান এবং সেগুলো শেয়ার করতে পারে। এতে কোন আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ। এর মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পাশাপাশি উপকারী ও কল্যাণময় বার্তা মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া হয় এবং পোস্ট দাতাকে ভালো কাজে সহযোগিতার করা হয়। এতে করে যে তা পোস্ট করছে এবং যারা সৎ নিয়তে তাতে লাইক-শেয়ার করবে তারা সকলেই সওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ এটি ভালো কাজের সহযোগিতার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ ۖ إِنَّ اللَّـهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ “আর সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সহায়তা কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তি দাতা।” (সূরা মায়িদা: ২)
.
অপরদিকে কোনও পোস্ট যদি খারাপ ও নোংরা বার্তা বহন করে, সমাজে পাপাচারের বিস্তার ঘটায়, দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয় এবং হারাম ও অন্যায়-অপকর্মের দিকে আহ্বান করে (যেমন: বেপর্দা নারীর ছবি, অপসংস্কৃতির প্রচার, মিউজিক, নাটক, সিনেমা, অশ্লীল ও অনর্থক ফানি ভিডিও ক্লিপ, শিরক- বিদআত সম্বলিত ওয়াজ, সমাজে অন্যায়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী পোস্ট ইত্যাদি) তাহলে তাতে উৎসাহ মূলক কমেন্ট দেওয়া বা সেগুলো শেয়ার করা সবই হারাম। এতে করে পোস্ট দাতা এবং কমেন্ট কারী বা শেয়ার কারী সকলেই গুনাহগার হবে। কারণ এটি সমাজে আল্লাহর নাফরমানি, হারাম, পাপাচার ও অন্যায়-অপকর্ম ছড়িয়ে দেওয়ার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ “যারা পছন্দ করে যে, ইমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহা ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা নূর: ১৯)। রাসূল (ﷺ) বলেন; যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো মন্দ রীতির প্রচলন করবে, তার জন্য তার কাজের গুনাহ রয়েছে এবং তাঁর পরবর্তীতে যারা এ কাজ করবে, তাদেরও গুনাহ রয়েছে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কিছুই কম করা হবে না। (সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; মিশকাত, হা/২১০)।
.
▪️সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে রিয়েক্ট প্রদান ও কমেন্ট করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যেমন:
.
১. কোনও বিপরীত লিঙ্গের পোস্টে রিয়েক্ট বা কমেন্ট করার কারণে যদি তারা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে যার কারণে ক্রমান্বয়ে তারা ফিতনার দিকে ধাবিত হয়, তাহলে অবশ্যই ঐ সকল পোস্টে যেকোন ধরনের ইমোজি রিয়েক্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে-যদিও তা ইসলামি পোস্ট হয়। কারণ তা নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকা। অন্যথায় কমেন্ট কারী গুনাহগার হবে।
(২). কোনো পোস্টেই খারাপ ও বাজে বার্তাবাহী অথবা সে দিকে ইঙ্গিত করে এমন কমেন্ট করা বৈধ নয়।
(৩). পাপাচার, অশ্লীলতা ও ক্ষতিকর কাজে উৎসাহ ব্যঞ্জক কমেন্ট করা বা রিয়েক্ট দেওয়া হারাম।
(৪). কমেন্ট করার ক্ষেত্রে অশ্লীল ও অশালীন ভাষা প্রয়োগ করা বৈধ নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا তোমরা মানুষের সাথে সুন্দর ভাষায় কথা বলো। (সূরা বাকারা: ৮৩)
(৫). ভিন্নমতের কারো জবাব দিতে হলেও তা হতে হবে যৌক্তিক, প্রমাণ ভিত্তিক এবং শালীন ভাষায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ আপনি আপনার রবের পথে আহবান করুন প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে সেই পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন যা সবচেয়ে সুন্দর। নিশ্চয় আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশি জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালভাবেই জানেন। (সূরা আন নাহল: ১২৫ )। [কিছু নোট: আমার ওস্তাদ আব্দুল্লাহীল হাদী (হাফিজাহুল্লাহ) থেকে]
.
ইমোজি ব্যবহার করার বিধান সম্পর্কে মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মসজিদে নাববীর মুদার্রিস এবং মসজিদে কুবার সম্মাননীয় ইমাম ও খতিব, আশ-শাইখ, আল-আল্লামাহ, আল-ফাক্বীহ, ড. সুলাইমান বিন সালীমুল্লাহ আর-রুহাইলী (হাফিযাহুল্লাহ) প্রদত্ত ফতোয়া। প্রশ্ন: “আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দিন এবং আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন। এই প্রশ্নকারী প্রশ্ন করেছেন, বিভিন্ন ইলেক্ট্রোনিক প্রোগ্রামে বিদ্যমান ইমোটিকনস যেগুলো প্রাণীর রুহসম্পন্ন সেগুলো ব্যবহার করা কি হারাম, নাকি জায়েজ?”
.
উত্তরে তিনি বলেন; রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসে সাব্যস্ত নীতি হচ্ছে, ‘প্রকৃত ছবি মুখমণ্ডলের ছবি।’ এজন্য আমি বলেছি, প্রাণীর রুহসম্পন্ন ছবি হারাম, যদি সে ছবি পূর্ণাঙ্গ হয়ে থাকে। ফলে তাতে রুহ প্রবেশ করতে পারে। কিংবা তা চেহারার ছবি হয়ে থাকে। এমনকি এককভাবে চেহারার ছবিও হারাম। হ্যাঁ, স্রেফ মুখমণ্ডলে রুহ প্রবেশ করে না। কিন্তু যেহেতু রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘প্রকৃত ছবি মুখমণ্ডলের ছবি’, অথবা বলেছেন, ‘প্রকৃত ছবি হচ্ছে মস্তকের ছবি।’ (সাহীহুল জামি‘, হা/৩৮৬৪; সিলসিলাহ সাহীহাহ, হা/১৯২১; সনদ: সহিহ তাহকিক: আলবানি)। এখন হাদীসের আসল শব্দগুচ্ছের ব্যাপারে আমার সংশয় হচ্ছে। তবে শব্দ যা-ই হোক না কেন, উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। আমরা (এ থেকে) অবগত হয়েছি, যদি এককভাবে মুখমণ্ডল বা মাথার ছবি পাওয়া যায়, তাহলে তা হারাম ছবি হিসেবে বিবেচিত হবে। তাহলে চেহারার ইমোটিকনস, তথা সহাস্যমুখের অভিব্যক্তি (laughing imo), রোদনকারী (crying imo), কান্নারত আঁখি প্রভৃতি কি আসলেই চেহারার ছবি? আমার কাছে এগুলো স্বাভাবিক চেহারার ছবি হিসেবে প্রতিভাত হয়নি। বরং এগুলো নির্দিষ্ট আকৃতি মাত্র, এবং তাতে সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি রয়েছে। আমি এগুলোকে হারাম মনে করি না। কিন্তু আমি বলি, এগুলো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের সাথে ঠিক যায় না। সুতরাং কোনো তালিবুল ইলমের জন্য এসব ব্যবহার করা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে নিজের স্ত্রীর সাথে (কথোপকথনে তা ব্যবহার) করা হলে আলাদা কথা। আর কতিপয় আলিম এসবকে (ইমোজি ব্যবহার) হারাম বলে অভিহিত করেছেন। যে ব্যক্তি বিলকুল এসব বর্জন করবে, তার জন্য সেটাই উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি তা ব্যবহার করে, তার ব্যাপারে আমি মনে করি না যে, সে হারাম কাজ করেছে। (https://youtu.be/eFLeK7g94-o)। ফাতওয়াটি অনুবাদক: আমাদের ভাই মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা (হাফিজাহুল্লাহ)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমানিত যে- কোন প্রানীর চেহারা, চোখ, মুখ ও নাক কিংবা শারীরিক আকৃতি যদি স্পষ্টভাবে বোঝা না যায় তাহলে সেটি নিষিদ্ধ ছবির অন্তর্ভুক্ত হবে না। এই বক্তব্যের আলোকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে বিভিন্ন প্রকার ইমোজি যেমন, চেহারার ইমোটিকনস, তথা সহাস্যমুখের অভিব্যক্তি (laughing imo), রোদনকারী (crying imo), কান্নারত আঁখি, লাভ অভিব্যক্তি (Love imo) ইত্যাদি প্রভৃতিও নিষিদ্ধ ছবির আওতায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে এই ইমোজিগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে আর তা হচ্ছে, যদিও এগুলো ব্যবহার করা নিষিদ্ধ নয় কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে অর্থাৎ নন-মাহারাম নারীরা পুরুষদেরকে এবং পুরুষরা নারীদেরকে এই ধরনের ইমোজিগুলো লাইক-কমেন্টে কিংবা এসএমএসে দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। কারণ এতে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে, কোন বেগানা নারীর সাথে কোন পুরুষের নিভৃতে অবস্থান করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে; এমনকি সে ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাবকারী হলেও; হাদিসে এসেছে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন; “অবশ্যই কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নিভৃতে একত্রিত হবে না।” (ইমাম বুখারী হা/৩০০৬ ও ইমাম মুসলিম হা/১৩৪১)। অপর বর্ননায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন; “সাবধান! যদি কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হয় সেখানে শয়তান হয় তাদের তৃতীয়জন।” (সুনানে তিরমিযি হা/২১৬৫)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ) এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:-যুবক যুবতীর মাঝে চিঠি/sms আদান প্রদান করার হুকুম কী? অথচ তারা জানে এই চিঠি ফাসেক ও প্রেম প্রীতি থেকে মুক্ত নয়!
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরে বলেন,

-( لا يجوز لأي إنسان أن يراسل امرأة أجنبية عنه ؛ لما في ذلك من فتنة ، وقد يظن المراسل أنه ليست هناك فتنة ، ولكن لا يزال به الشيطان حتى يغريه بها ، ويغريها به. وقد أمر صلى الله عليه وسلم من سمع بالدجال أن يبتعد عنه ، وأخبر أن الرجل قد يأتيه وهو مؤمن ولكن لا يزال به الدجال حتى يفتنه.ففي مراسلة الشبان للشابات فتنة عظيمة وخطر كبير يجب الابتعاد عنها وإن كان السائل يقول : إنه ليس فيها عشق ولا غرام )

“কোন মানুষের জন্য বৈধ নয় যে, তিনি কোন অপরিচিত (নন মাহারাম) মহিলাকে চিঠি/এসএমএস প্রেরণ করবে। কারণ এর মধ্যে ফেতনা রয়েছে যদিও চিঠি প্রদানকারী মনে করে এতে কোন ফিতনা নেই। কিন্তু শয়তান তার সাথে সব সময় প্রস্তুত থাকে এমনকি তাকে এ বিষয়ে প্রলব্ধ বা আসক্ত করে তুলে। অপর পক্ষে যুবতীয় তার দ্বারা আসক্ত হয়ে পড়ে। আর এ জন্যই নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের কথা শ্রবণ করা থেকে দূরে থাকার আদেশ করেছেন এবং তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে একজন ব্যক্তি তার নিকটে আসবে অথচ সে মুমিন। কিন্তু দাজ্জাল তার সাথে সর্বদাই উপস্থিত থাকবে এমন কি তাকে ফিতনায় ফেলবে। অতএব একজন যুবক আরেকজন যুবতী মেয়েকে চিঠি/sms আদান-প্রদানে অনেক বড় ফিতনা রয়েছে এবং এট মারাত্মক একটি ভুল যা থেকে দূরে থাকা সকলের কর্তব্য। যদিও প্রশ্নকারী বলে থাকে যে তার মধ্যে কোন প্রেম-প্রীতি নেই। (জাম’য়ু মুহাম্মাদ মুসনাদ: পৃষ্ঠা/৯৬ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭৮৩৭৫) আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় ফেতনা থেকে হেফাজত করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।