সূরা যিলযাল তেলাওয়াতের মর্যাদা ও ফজিলত

❑ সুরা যিলযাল পবিত্র কুরআনের ৯৯ নং সূরা। এটি সূরা নিসার পরে মদীনায় নাজিল হয়েছে। সূরাটির আয়াত ৮, শব্দ ৩৬, বর্ণ ১৫৬ এবং যিলযাল শব্দের অর্থ “ভূমিকম্প”। সূরাটির মূল বিষয়বস্তু হলো ক্বিয়ামত অনুষ্ঠান। যা দুটি ভাগে আলোচিত হয়েছে। সূরাটির প্রথমভাগে ক্বিয়ামত অনুষ্ঠানের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।(সূরা যিলযাল; ৯৯/১-৫ আয়াত)। আর দ্বিতীয়ভাগে বলা হয়েছে যে, মানুষকে ঐদিন স্ব স্ব আমলনামা দেখানো হবে। অতঃপর সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে তার যথাযথ প্রতিদান দেওয়া হবে।(সূরা যিলযাল: ৯৯/৬-৮ আয়াত)।
.
▪️সূরা যিলযালের গুরুত্ব ও মর্যাদা:
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা যিলযালের শেষ দুটি আয়াতকে একত্রে ‘‘অনন্য ও সারগর্ভ আয়াত’’ বলে অভিহিত করেছেন।(সহীহ মুসলিম হা/ ৯৮৭, সহীহ আত তারগীব হা/৭৫৪, সহীহ আল জামি আস-সগীর হা/৫৭২৯, মিশকাত হা/১৭৭৩)। অপর বর্ণনায় আরো এসেছে, এই সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার পর এর প্রভাবে আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কাঁদতে থাকেন। কারণ, এর আয়াতগুলো খুবই স্পর্শকাতর। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘‘যদি তোমরা গুনাহ না করতে, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ আরেকটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করতেন, যারা গুনাহ্ করতো (এরপর তাঁর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবাহ্ করতো) এবং তিনি তাদের ক্ষমা করে দিতেন।’’ (ত্বাবারানি, মাজমাউয যাওয়াইদ: ১১৫১২; হায়সামী বলেন, এর সকল রাবী সহীহ-এর রাবী এবং এর দুর্বলতাটুকুর জন্য শাওয়াহেদ রয়েছে, যা তাকে শক্তিশালী করে। কুরতুবী হা/৬৪৩৬; হাদীসের শেষের অংশটি (لَوْلاَ أَنَّكُمْ تُذْنِبُونَ الخ) সহীহ মুসলিম হা/২৭৪৮ ও তিরমিযী হা/৩৫৩৯- হাদিসটি গ্রহণযোগ্য)।
.
তবে সূরা যিলযাল তেলাওয়াতের প্রতিটি হরফের বিনিময় ১০ নেকি ছাড়া আলেদা কোন ফজিলত রয়েছে মর্মে বিশুদ্ধ হাদীস নেই। যা আছে সবই সনদের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল; যেমনটি একটি হাদীস তিনজন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যার সবগুলো সনদ জয়ীফ। যেমন:
.
(১). ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত আছে; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সূরা ইযা যুলযিলাতিল আরদু অর্থাৎ সূরা যিলযাল কুরআনের অর্ধেকের সমান।(তিরমিজি হা/২৮৯৪, মুস্তাকরাকে হাকেম হা/১/৭৫৪, মিশকাত হা/ ২১৫৬)।
.
সনদ: হাদীসটির সনদ ইয়ামান ইবনু মুগীরাহ আল-আনাযী হতে, তিনি আতা ইবনু আবী রাবাহ হতে, তিনি ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন; রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; (সাওয়াবের দিক দিয়ে) সূরা ‘ইযা- যুলযিলাত’ কুরআনের অর্ধেকের সমান।
.
তাহক্বীক: হাদীসটি মুনকার। কারণ, হাদীসর সনদে ইয়ামান ইবনু মুগীরাহ আল-আনাযী রয়েছে। যার সম্পর্কে ইমাম বুখারী এবং আবু হাতিম বলেছেন; তার হাদীসটি মুনকার। ইবনে হিব্বান বলেছেন: তার হাদীসটি খুবই মুনকার; তিনি এমন মুনকার হাদীস বর্ণনা করেন যার কোন ভিত্তি নেই এবং তা উপেক্ষা করার যোগ্য। (তাহদীব আল-তাহদীব; ৪/৪৫২)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, হাদীসটিকে ইমাম তিরমিযী নিম্নলিখিত ভাষায় দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন; এ হাদীসটি গারীব। একমাত্র ইয়ামান ইবনু মুগীরাহ কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকেই এটিকে আমরা চিনি। আমি (আলবানী) বলছি- তিনি দুর্বল যেমনটি হাফিয ইবনু হাজার “আত-তাকরীব” গ্রন্থে বলেছেন। বরং তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেন; তিনি মুনকারুল হাদীস। তার থেকে এ মন্তব্য তার খুবই দুর্বল হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। নাসাঈ বলেন; তিনি নির্ভরযোগ্য নন। তবে হাকিম বলেছেনঃ; হাদীসটির সনদ সহীহ। এ কারণে হাফিয যাহাবী তার সমালোচনা করে বলেছেন; ইয়ামানকে মুহাদ্দিসগণ দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। (দেখুন সিলসিলা জয়ীফাহ হা/১৩৪২)।
.
(২). আনাস ইবনু মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি সূরা “ইযা যুলযিলাত” পাঠ করবে তাকে অর্ধেক কুরআনের সমান। (তিরিমিজি হা/২৮৯৩)
.
তাহক্কীক: হাদীসটি সর্বসম্মতি ক্রমে জয়ীফ। কারন, এই হাদীসের সনদে হাসান ইবনু সালম আল-আজালি রয়েছেন। তিনি একজন মাজহুল অর্থাৎ অপরিচিত। হাফিয যাহাবী বর্ণনাকারী হাসান ইবনু সালম আল-আজালি সম্পর্কে বলেন; তাকে চেনা যায় না আর তার হাদীস মুনকার। ইবনু হিব্বান বলেন- তিনি নির্ভরযোগ্যদের উদ্ধৃতিতে এককভাবে এমন হাদীস বর্ণনা করেন যা নির্ভরশীলদের হাদীসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। (তাহদীব আল-তাহদীব; ১/৩৯৬)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; আমি (আলবানী) বলছি- হাদীসটিকে আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হতে মারফু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (২/১৪৬) ও ওকায়লী “আয-যুয়াফা” গ্রন্থে (পৃঃ ৮৯) হাসান ইবনু সালাম ইবনে সালেহ আজালী হতে, তিনি সাবেত বুনানী হতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেন; হাদীসটি গারীব। একমাত্র (এ শাইখ) হাসান ইবনু সালামের হাদীস হতেই এটিকে চিনি। আমি (আলবানী) বলছি- ওকায়লী বলেন; এ হাসান মাজহুল (অপরিচিত) তার হাদীস নিরাপদ নয়। (দেখুন, সিলসিলা জয়ীফা হা/১৩৪২)।
.
(৩). আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এক রাতে ‘যখন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে’ অর্থাৎ সূরা যিলযাল পাঠ করবে। এটা তার জন্য কুরআনের অর্ধেক সমতুল্য হবে। (ইবনুল সুন্নী থেকে আবু উমাইয়্যাহ তারসূসী “মুসনাদু আবী হুরাইরাহ” ২/১৯৫)।
.
তাহক্বীক; হাদীসট ঈসা ইবনু মায়মূন হতে, তিনি ইয়াহইয়া হতে, তিনি আবু সালামাহ হতে তিনি আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। এটিও জয়ীফ।ইমাম ইবনে হাজার নাতায আল-আফকার (৩/২৬৮) গ্রন্থে বলেছেন; এর সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যিনি অত্যন্ত দুর্বল।
.
ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; আমি (আলবানী) বলছি- কিন্তু এ সনদটি খুবই দুর্বল। বাহ্যিক অবস্থা থেকে বুঝা যায় যে ঈসা ইবনু মায়মূন হচ্ছেন মাদানী যিনি অসেতী নামে প্রসিদ্ধ। তাকে একদল মুহাদ্দিস দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। আর আবু হাতিম প্রমুখ বলেছেন; তিনি মাতরূকুল হাদীস।স্বয়ং আবু উমাইয়্যাহ সত্যবাদী সন্দেহ পোষণকারী। যেমনটি হাফিয ইবনু হাজার বলেছেন। অতএব এটি শাহেদ হওয়ার যোগ্য নয়। ( সিলসিলা জয়ীফা হা/১৩৪২, আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭১৩৫৯)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।