সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান

প্রশ্ন: সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান কি? কেউ বলে সালাত পরিত্যাগকারী কাফের; আবার কেউ বলে ফাসেক। দলিলের আলোকে কোনটি সঠিক?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ইসলামী শরীয়তে তাওহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার পর দ্বিতীয় রুকন এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো সালাত। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণকে হৃদয়ে জাগ্রত রাখার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। সালাত এমন একটি ইবাদত, কালেমায়ে শাহাদতের পরেই যার স্থান। কেউ মুসলমান হলে তাকে প্রথমেই সালাতে অভ্যস্ত হওয়া আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও সত্য ইসলামের এই মহা গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদতটি নিয়ে বর্তমানে বহু মানুষের মধ্যে অবহেলা দেখা যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় অনেকের হয়, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায়ের সময় তাদের হয় না। অথচ সালাতে অবহেলা, অলসতা ও তা পরিত্যাগের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল (ﷺ)-এর যুগে সাহাবীগণের মধ্যে কেউ সালাতে না আসলে তাকে কাফের মনে করা হতো। সালাত ত্যাগ করা কাফের ও মুনাফিকদের কাজ। যারা সালাত ত্যাগ করবে তাদের হাশর হবে বড় বড় কাফেরদের সাথে। আর পরকালে বড় কাফেরদের অবস্থা হবে ভয়াবহ। আমাদের আজকের আলোচনার প্রধান বিষয় হলো সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান কি? কেউ বলে সালাত পরিত্যাকারী কাফের আবার কেউ বলে ফাসিক; কুরআন-সুন্নাহর দলিল এবং প্রসিদ্ধ সালাফদের মতামত অনুযায়ী কোনটি সঠিক?
.
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ থেকে সালাত পরিত্যাগকারীর বিধানের ব্যাপারে কয়েক ধরনের মতামত লক্ষ করা যায়। তবে তাদের সবগুলো মতামত পর্যালোচনা করলে যা প্রতিমান হয় তা হলো সালাত পরিত্যাগ করা সম্পর্কে তারা প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছেন। যেমন:

(১). সালাত ইসলামের ফরজ রোকন এটি অস্বীকার করা এবং এটি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা।

(২). সালাত ইসলামের ফরজ রোকন; এটি স্বীকার করা কিন্তু ইচ্ছাকৃত সর্বদা পরিত্যাগ করা।

(৩). সালাত ইসলামের ফরজ বিধান এটি স্বীকার করা এবং নিয়মিত আদায় করা তবে মাঝে মধ্যে ত্যাগ করা। কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে গবেষণা করলে মোটামুটি এই তিন শ্রেণীর সালাত পরিত্যাগকারী দেখা যায়। এবার আমরা প্রত্যেকটি হুকুমের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
.
▪️(ক). সালাত ইসলামের বিধান; এটি অস্বীকার করা এবং এই ফরজ বিধান নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা।
.
কুরআন-সুন্নাহ এবং আহালুল ইমামগণের ঐক্যমতে ইসলামের রুকনসমূহ হতে কোন একটি রুকন বা ভিত্তি-অস্বীকার করা যেমন: সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাত। অথবা ঈমানের ভিত্তিসমূহের কোন একটি ভিত্তি অস্বীকার করা। যেমন: আল্লাহ, তাঁর রাসূলগণ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাকদীরের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ হতে এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা। এছাড়াও দ্বীনের অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় কার্যসমূহ যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে সর্বজন বিদিত। এসবগুলোর উপর ঈমান আনয়ন করা ফরজ এর কোন একটিকে অস্বীকার কিংবা এগুলো নিয়ে হাসি ঠাট্টা বা মশকরা করা কুফরি। ইসলামের এই বিধানগুলোর থেকে কেউ কোন একটি বিধান অস্বীকার করলে কিংবা স্ব-জ্ঞানে কোন একটি বিধান নিয়ে হাসি ঠাট্টা করলে মুসলিম আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং সে ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে। সুতরাং সালাত যেহেতু শরীয়তের একটি বিধান সে হিসাবে ইচ্ছাকৃত কেউ সালাতের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করলে ওই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে। এটি নিয়ে কোন মতানৈক্য নেই। এই মর্মে শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] বলেন; أَمَّا تَارِكُ الصَّلَاةِ. فَهَذَا إنْ لَمْ يَكُنْ مُعْتَقِدًا لِوُجُوبِهَا فَهُوَ كَافِرٌ بِالنَّصِّ وَالْإِجْمَاعِ، ‘সালাত পরিত্যাগকারী যদি এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে; তাহলে সে কুরআন- সুন্নাহর দলীল ও ইজমা দ্বারা কাফের সাব্যস্ত হবে। (আল-ফাতাওয়াল কুবরা: ২/১৮)।
.
এই মর্মে পবিত্র কুরআন থেকে দলিল। আল্লাহ তাআলা বলেন; یَحۡذَرُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ اَنۡ تُنَزَّلَ عَلَیۡهِمۡ سُوۡرَۃٌ تُنَبِّئُهُمۡ بِمَا فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ ؕ قُلِ اسۡتَهۡزِءُوۡا ۚ اِنَّ اللّٰهَ مُخۡرِجٌ مَّا تَحۡذَرُوۡنَ وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَهُمۡ لَیَقُوۡلُنَّ اِنَّمَا کُنَّا نَخُوۡضُ وَ نَلۡعَبُ ؕ قُلۡ اَ بِاللّٰهِ وَ اٰیٰتِهٖ وَ رَسُوۡلِهٖ کُنۡتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُوۡنكللَا تَعۡتَذِرُوۡا قَدۡ کَفَرۡتُمۡ بَعۡدَ اِیۡمَانِکُمۡ ؕ اِنۡ نَّعۡفُ عَنۡ طَآئِفَۃٍ مِّنۡکُمۡ نُعَذِّبۡ طَآئِفَۃًۢ بِاَنَّهُمۡ کَانُوۡا مُجۡرِمِیۡنَ “মুনাফেকরা এ ভয়ে থাকে যে, না জানি তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা নাযিল হয় যা ওদের অন্তরের গোপন বিষয় ব্যক্ত করে দিবে। বলুন, তোমরা বিদ্রূপ করতে থাক; তোমরা যে ভয় করছ নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন। আর আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করলে অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও খেল-তামাশা করছিলাম।’ বলুন, তোমরা কি আল্লাহ্‌, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা ওজর পেশ করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরী করেছ। আমরা তোমাদের মধ্যে কোন দলকে ক্ষমা করলেও অন্য দলকে শাস্তি দেব; কারণ তারা অপরাধী। (সূরা তাওবা, আয়াত: ৬৪-৬৬)।
.
উক্ত আয়াতের আলোকে ইমাম ইবনে হাজম আল-যাহেরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; صَحَّ بِالنَّصِّ أَن كل من اسْتَهْزَأَ بِاللَّه تَعَالَى ، أَو بِملك من الْمَلَائِكَة ، أَو بِنَبِي من الْأَنْبِيَاء عَلَيْهِم السَّلَام ، أَو بِآيَة من الْقُرْآن ، أَو بفريضة من فَرَائض الدّين بعد بُلُوغ الْحجَّة إِلَيْهِ ، فَهُوَ كَافِر “. انتهى من ” الفصل في الملل والأهواء والنحل অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধভাবে সাব্যস্ত: যে ব্যক্তির নিকট দলিল পৌঁছার পরও সে ব্যক্তি যদি মহান আল্লাহকে কিংবা কোন ফেরেশতাকে কিংবা কোন নবীকে কিংবা কুরআনের কোন আয়াতকে কিংবা ইসলামের কোন একটি ফরজ বিধানকে বিদ্রূপ করে সে ব্যক্তি কাফের।(আল-ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল: খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৪২)।
.
শাইখ সুলাইমান আলে-শাইখ বলেন; من استهزأ بالله ، أو بكتابه، أو برسوله ، أو بدينه : كفر ، ولو لم يقصد حقيقة الاستهزاء ، إجماعاً “. انتهى من “تيسير العزيز الحميد অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে, কিংবা আল্লাহর কিতাবের সাথে কিংবা তাঁর রাসূলের সাথে, কিংবা তাঁর ধর্মের সাথে বিদ্রূপ করে; সকল আলেমের ইজমার ভিত্তিতে সে কাফের। যদিও সে এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে বিদ্রূপ করা উদ্দেশ্য না করে থাকুক। (তাইসীরুল আযিযিল হামিদ, পৃষ্ঠা-৬১৭)।
.
আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁর তাফসির গ্রন্থে বলেন; لا يخلو أن يكون ما قالوه من ذلك جدا أو هزلا، وهو كيفما كان : كفر؛ فإن الهزل بالكفر : كفر، لا خُلْف فيه بين الأمة، فإن التحقيق أخو الحق والعلم، والهزل أخو الباطل والجهل” انتهى. অর্থাৎ তারা যা বলেছিল তা হয়তো মন থেকে বলেছিল কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল। যেভাবেই বলুক না কেন, এটা কুফরি। কেননা কুফরি দিয়ে ঠাট্টা করাও কুফরি। এ নিয়ে উম্মতের মাঝে কোন মতভেদ নেই। আর বাস্তব তথ্য হচ্ছে হক্ক ও জ্ঞানের ভাই। আর ঠাট্টা-মশকরা হচ্ছে- বাতিল ও অজ্ঞতার ভাই। (আবু বকর ইবনুল আরাবী তাঁর তাফসির, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৫৪৩)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন; تَارِكُ الصَّلَاةِ فَإِنْ كَانَ مُنْكِرًا لِوُجُوبِهَا فَهُوَ كَافِرٌ بِإِجْمَاعِ الْمُسْلِمِينَ خَارِجٌ مِنْ مِلَّةِ الْإِسْلَامِ সালাত পরিত্যাগকারী যদি এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে তাহলে সে মুসলিমদের ঐক্যমতে কাফের এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কৃত। (সারহুন নববী আলা মুসলিম, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭০)।
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, تارك الصلاة جحدا لوجوبها كافر بإجماع أهل العلم، وتاركها تساهلا وكسلا كافر على الصحيح من قولي أهل العلم، وعليه فلا تجوز الصلاة عليه، ولا تشييع جنازته من العلماء ولا غيرهم، ولا دفنه في مقابر المسلمين. ‘ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি বিদ্বানগণের ঐক্যমতে কাফের। আর অলসতা বা উদাসীনতা বশত সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি বিদ্বানদের বিশুদ্ধ মতে কাফের। এই ফাতওয়া মতে তার জানাযার সালাত আদায় করা যাবে না, কোন আলেম বা অন্য কেউ তার জানাযার অনুগমন করবে না এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা যাবে না। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৪১৩)।
.
▪️(খ). সালাত ইসলামের ফরজ রোকন; এটি স্বীকার করা কিন্তু সর্বদা পরিত্যাগ করা।
.
দৈনিক সর্বনিম্ন ১৭ রাকাআত সালাত আদায় করা ফরয এবং সালাত ইসলামের দ্বিতীয় রুকন একজন মুখাল্লাফ’ ব্যক্তি, অর্থাৎ যার উপরে শরয়ী শাস্তি প্রদান করার মতো শর্ত পূরণ হয়, এমন ব্যক্তি সেটা অস্বীকার করে না বরং স্বীকার করে কিন্তু সর্বদা ইচ্ছেকৃত ত্যাগ করে,অর্থাৎ জীবনে কখনো আদায় করেনা। এরাও প্রথম শ্রেনীর মত কাফের,প্রথম শ্রেণীর ক্ষেত্রে যে সকল বিধান প্রযোজ্য এদের ক্ষেত্রে একই বিধান প্রযোজ্য হবে। প্রসিদ্ধ সালাফগনের মধ্যে এই বিষয়ে কোন মতানৈক্য নেই। ইমাম আহমাদ (রহ:)বলেন: অলসতা করে নামায বর্জনকারী কাফের এবং এটাই অগ্রগণ্য মত। কুরআন-হাদিস, সালফে-সালেহীন এর বাণী ও সঠিক কিয়াস এর দলিল এটাই প্রমাণ করে। (উসাইমীন আল-শারহুল মুমতি আলা-যাদিল মুসতানকি, ২/২৬)। তাছাড়া কেউ যদি কুরআন-সুন্নাহর দলিলগুলো গবেষণা করে দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন, দলিলগুলো প্রমাণ করছে যে, বে-নামাযী ইসলাম নষ্টকারী বড় কুফরিতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কুরআনের দলিল হচ্ছে-فَاِنۡ تَابُوۡا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ فَاِخۡوَانُکُمۡ فِی الدِّیۡنِ “অতএব তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। (সূরা তওবা, আয়াত: ১১)
.
উক্ত দলিলের বিশ্লেষণ হচ্ছে-আল্লাহ্‌ তাআলা মুশরিকদের মাঝে ও আমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব সাব্যস্তের জন্য তিনটি শর্ত করেছেন। অর্থাৎ শির্ক থেকে তাওবা করা, নামায কায়েম করা ও যাকাত আদায় করা। যদি তারা শির্ক থেকে তওবা করে কিন্তু নামায কায়েম না করে, যাকাত প্রদান না করে তাহলে তারা আমাদের ভাই নয়। আর যদি তারা নামাযও কায়েম করে কিন্তু যাকাত আদায় না করে তাহলেও তারা আমাদের ভাই নয়। কেননা কেউ দ্বীন থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে না গেলে তার দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব রহিত হবে না। পাপের কারণে কিংবা ছোট কুফরির কারণে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব রহিত হয় না। আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: অতঃপর তাদের পরে এলো কিছু অপদার্থ উত্তরাধিকারী, তারা নামায নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। কাজেই অচিরেই তারা ক্ষতিগ্রস্ততার সম্মুখীন হবে। কিন্তু তারা নয় যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে। তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।” (সূরা মারিয়াম, আয়াত: ৫৯)। এই দলিলের বিশ্লেষণ হচ্ছে- নামায নষ্টকারী ও কুপ্রবৃত্তির অনুসারীদের ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন; “কিন্তু তারা নয় যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে”- এতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নামায নষ্টকালীন ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণকালীন অবস্থায় তারা ঈমানদার ছিল না।
.
▪️পরিপূর্ণ সালাত পরিত্যাগকারী কাফের হওয়ার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) সুন্নাহর দলিল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “মুমিন ব্যক্তি এবং শির্‌ক-কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণকারী হচ্ছে- নামায বর্জন।”(সহিহ মুসলিম হা/৮২)।অপর বর্ননায় বুরাইদা বিন আল-হাসিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মধ্যে প্রতিশ্রুতি হলো নামাযের। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করল, সে কুফরি করল।”(সুনানে তিরমিযি হা/২৬২১, সুনানে নাসাঈ হা/৪৬৩ ও সুনানে ইবনে মাজাহ হা/১০৭৯)।আমিরুল মু’মিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন,“যে ব্যক্তি সালাত ত্যাগ করে, তার জন্য ইসলামে কোন অংশ নেই।”(বায়হাকীঃ ৬৭৩৪, ইবনে আবি শায়বাহঃ ৩৭০৭৪)। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু, “যার সালাত নেই, তার দ্বীন নেই।” (সহীহ তারগীবঃ ৫৭৪)। আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেন, “যার সালাত নেই, তার ইমান নেই।”(সিলসিলা সহীহাহঃ ৫৭৫)
.
এখানে কুফর দ্বারা মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কারকারী কুফর উদ্দেশ্য। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযকে ঈমানদার ও কাফেরদের মাঝে পার্থক্য নির্ধারক বানিয়েছেন। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায় কাফের সম্প্রদায় থেকে আলাদা হয়ে গেল। সুতরাং যে ব্যক্তি এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে না সে কাফের। এ বিষয়ে আওফ বিন মালেক (রাঃ)-এর হাদিস রয়েছে যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; “তোমাদের নেতাদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে তোমরা যাদেরকে ভালোবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর। আর তোমাদের সর্বনিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তোমরা যাদেরকে অপছন্দ কর এবং তারাও তোমাদেরকে অপছন্দ করে, তোমরা তাদের উপর লানত কর এবং তারাও তোমাদের উপর লানত করে। জিজ্ঞেস করা হলো: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করব না। তিনি বললেন: না; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামায কায়েম করে।” (সহীহ মুসলিম ১৮৫৫, আহমাদ ২৩৯৮১, দারিমী ২৮৩৯, সহীহাহ্ ৯০৭, সহীহ আল জামি ৩২৫৮)। শাসকবর্গ যদি নামায কায়েম না করে তখন তাদের নেতৃত্ব মেনে না নেওয়া ও তাদের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করার পক্ষে এই হাদিসে দলিল রয়েছে। শাসকবর্গের বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত অস্ত্র ধারণ করা বৈধ নয় যতক্ষণ না তারা সুস্পষ্ট কুফরিতে লিপ্ত হয়; যে কুফরি কুফরি হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে।
.
যেহেতু উবাদা বিন সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দাওয়াত দিলেন। আমরা তাঁর হাতে বাইআত করলাম। তিনি যে যে বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে বাইআত বা অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন এর মধ্যে ছিল, সুসময় ও দুঃসময়, আনন্দ ও বিষাদে এবং নিজেদের উপর অন্যদের অগ্রাধিকার প্রদান করলেও শাসকের আদেশ শ্রবণ ও আনুগত্য করা। তিনি আরও অঙ্গীকার নিলেন যে, (রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে) আমরা যেন যোগ্য ব্যক্তির সাথে (গদি নিয়ে) বিবাদে লিপ্ত না হই। তিনি বলেন; তবে তখন লিপ্ত হতে পার যদি দেখতে পাও যে, শাসক সুস্পষ্ট কুফরিতে লিপ্ত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কাছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল থাকে। (সহীহ বুখারী ৭০৫৫, মুসলিম ১৭০৯, নাসায়ী ৪১৫২, ইবনু মাজাহ ২৮৬৬, সহীহাহ্ ৩৪১৮, সহীহ আত্ তারগীব ২৩০৩)। এ হাদিসের ভিত্তিতে জানা গেল যে, নামায বর্জন করা সুস্পষ্ট কুফরি; যে ব্যাপারে আমাদের কাছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দলিল রয়েছে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাসকদের সাথে মতভেদ করা ও তাদের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করাকে নামায বর্জন করার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
.
এখন যদি কেউ বলে যে, এই দলিলগুলোকে এই অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা যে, এখানে নামায বর্জন করা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- নামাযের ফরযিয়তকে বা আবশ্যকতাকে অস্বীকার করে নামায বর্জন করা। উত্তরে আমরা বলব: না; এমন ব্যাখ্যা করা জায়েয নয় এবং তা দুইটি সমস্যার কারণে:
.
প্রথম সমস্যা: এতে করে শরিয়তপ্রণেতা যে কারণটির সাথে বিধানকে সম্পৃক্ত করেছেন, সে কারণটিকে বাতিল করে দিতে হয়। কেননা শরিয়তপ্রণেতা কুফরের হুকুমকে সম্পৃক্ত করেছেন নামায বর্জনের সাথে; নামাযকে অস্বীকার করার সাথে নয়। অনুরূপভাবে দ্বীনি ভ্রাতৃত্বকে সম্পৃক্ত করেছেন নামায কায়েমের সাথে; নামাযের ফরযিয়তে স্বীকৃতি দেয়ার সাথে নয়। আল্লাহ্‌ তাআলা এ কথা বলেননি যে, যদি তারা তওবা করে এবং নামাযের ফরযিয়াতের স্বীকৃতি দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা বলেননি যে, “মুমিন ব্যক্তি এবং শির্‌ক-কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণকারী হচ্ছে- নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকৃতি।” কিংবা তিনি এ কথাও বলেননি যে, “আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মধ্যে প্রতিশ্রুতি হলো নামাযের ফরযিয়াতের স্বীকৃতি। সুতরাং যে ব্যক্তি নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করল, সে কুফরি করল।” যদি এর দ্বারা আল্লাহ্‌ ও আল্লাহ্‌র রাসূলের উদ্দেশ্য হতো নামাযের ফরযিয়াতের অস্বীকৃতি; তাহলে এভাবে উল্লেখ না করে অন্যভাবে উল্লেখ করায় সেটা স্পষ্ট বিবৃতি হত না; যে স্পষ্ট বিবৃতি নিয়ে কুরআন আগমন করেছে। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন; “আর আমরা আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ।” (সূরা নাহল, আয়াত: ৮৯)। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর নবীকে সম্বোধন করে বলেন; আর আপনার প্রতি আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন।” (সূরা নাহল, আয়াত: ৪৪)
.
দ্বিতীয় সমস্যা: এমন একটি কারণকে বিধানের সাথে সম্পৃক্ত করা; শরিয়তপ্রণেতা যেটাকে বিধানের সাথে সম্পৃক্ত করেননি। যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে, সে ব্যক্তি যদি অজ্ঞতার কারণে যাদের ওজর গ্রহণযোগ্য এমন শ্রেণীর লোক না হয় তাহলে অস্বীকারের কারণেই তার কুফরী সাব্যস্ত হবে; চাই সে নামায আদায় করুক কিংবা নামায বর্জন করুক। যদি ধরে নিই, এক ব্যক্তি নামাযের যাবতীয় শর্ত, রুকন, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব পরিপূর্ণ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছে; কিন্তু সে কোন প্রকার ওজরগ্রস্ত না হয়েও নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে সে ব্যক্তি কাফের; অথচ সে নামায বর্জন করেনি। এতে করে জানা গেল যে, এ দলিলগুলোকে নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করার অর্থে গ্রহণ করা সঠিক নয়। সঠিক অভিমত হচ্ছে নামায বর্জনকারী কাফের; এমন কাফের যে কুফরি ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে দেয়। ইবনে আবু হাতিম কর্তৃক সংকলিত ‘সুনান’ গ্রন্থে উবাদা বিন সামেত এর হাদিসে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন; রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ওসিয়ত করে গেছেন আমরা যেন আল্লাহ্‌র সাথে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত না করি, ইচ্ছাকৃতভাবে নামায বর্জন না করি, কেননা যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায বর্জন করবে সে ব্যক্তি (মুসলিম) মিল্লাত থেকে বেরিয়ে যাবে।” এ ছাড়া আমরা যদি এ দলিলগুলোকে নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করার অর্থে গ্রহণ করি তাহলে এ দলিল গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে নামাযকে উল্লেখ করার তো কোন অর্থ থাকল না। কারণ এই হুকুম তো যাকাত, সিয়াম, হজ্জ এগুলোর ক্ষেত্রেও আম। কেউ যদি ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে এ আমলগুলোর কোন একটিকে বর্জন করে; সে যদি অজ্ঞতার কারণে যাদের ওজর গ্রহণযোগ্য এমন শ্রেণীভুক্ত না হয় তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।
.
ইচ্ছাকৃত সর্বদা নামায বর্জনকারীর কাফের হওয়া যৌক্তিক দলিলেরও দাবী; যেমনটি শ্রুত দলিলের দাবী। কিভাবে কোন ব্যক্তির ঈমান থাকবে যদি সে দ্বীনের মূল ভিত্তি নামাযকেই বর্জন করে। অথচ নামাযের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকারী এমন কিছু দলিল এসেছে, যেগুলোর দাবী হচ্ছে- প্রত্যেক আকলসম্পন্ন ঈমানদার নামায আদায় করবে, এক্ষেত্রে কোন গড়িমসি করবে না এবং নামায বর্জনের ব্যাপারে এমন কিছু দলিল এসেছে যেগুলোর দাবী হচ্ছে- প্রত্যেক আকলসম্পন্ন ঈমানদার নামায বর্জন করা থেকে বিরত থাকবে। সুতরাং দলিলের এমন দাবী প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও নামায বর্জন করলে সে বর্জনের সাথে আর ঈমান থাকে না। যদি কেউ বলে: নামায বর্জনকারীর কুফরি দ্বারা নেয়ামতকে কুফর করা তথা নেয়ামতকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নেয়া যায় কিনা? কিংবা বড় কুফরকে উদ্দেশ্য না নিয়ে ছোট কুফরকে উদ্দেশ্য নেয়া যায় কিনা? যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ বাণীর মত: “মানুষের মাঝে দুইটি কুফরি রয়েছে। একটি হচ্ছে- বংশের উপর অপবাদ দেয়া ও মৃতব্যক্তির জন্য বিলাপ করা” এবং ঐ বাণীর মত: “মুসলমানকে গালি দেয়া পাপের কাজ; আর মুসলমানের সাথে লড়াই করা কুফরি” এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদিস?
.
উক্ত বক্তব্যের উত্তরে আমরা বলব, এমন ব্যাখ্যা করা নিম্নোক্ত কারণে সঠিক নয়:
.
(১)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুফর ও ঈমানের মাঝে এবং ঈমানদার ও কাফেরদের মাঝে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে সীমারেখার কারণে নির্ধারিত বিষয়ের একটি অপরটি থেকে আলাদা হয়ে গেছে। তাই নির্ধারিত বিষয়ের একটি অপরটির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
.
(২)। নামায হচ্ছে ইসলামের অন্যতম একটি রোকন। তাই নামায বর্জনকারীকে কাফের বলার দাবী হচ্ছে এ কুফর ইসলাম নষ্টকারী কুফর। কেননা নামায বর্জনকারী ইসলামের একটি রোকনকে ধ্বংস করেছে। পক্ষান্তরে, কোন ব্যক্তির কুফরি কাজকে কুফরি বলা এ রকম নয়।
.
(৩)। এছাড়া আরও কিছু দলিল রয়েছে যে দলিলগুলো প্রমাণ করে যে, নামায বর্জনকারী কাফের, মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কৃত। যাতে করে, দলিলগুলো একটি অপরটির সাথে খাপ খায়, সাংঘর্ষিক না হয়।
.
(৪)। নামায বর্জনকারীর ক্ষেত্রে যখন কুফর বলা হয়েছে তখন كفر শব্দের শুরুতে الْ যুক্ত করে الكفر বলা হয়েছে। ال যুক্ত করে الكفر বলাতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এখানে কুফর দ্বারা এর হাকীকী বা প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে, نكرة এর শব্দ হিসেবে এর كُفْرٌ শব্দের ব্যবহার কিংবা فعل হিসেবে كَفَرَ শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করে যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়টি কুফরি কিংবা সংশ্লিষ্ট কাজটির মাধ্যমে সে ব্যক্তি কুফরি করেছে। কিন্তু, এ কুফরি মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কারকারী কুফরি নয়।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর রচিত ‘ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম’ গ্রন্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী; اثنتان في الناس هما بهما كفر (অর্থ- মানুষের মধ্যে দুইটি অভ্যাস রয়েছে; যে দুইটি কুফরি) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন- তাঁর বাণী: هما بهما كفر এর অর্থ এ দুইটি অভ্যাস মানুষের মধ্যে বিদ্যমান কুফরি। যেহেতু এ অভ্যাস দুইটি কুফরি যামানার কর্ম; তাই এ অভ্যাসদ্বয় কুফরিকর্ম। এ দুইটি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। তবে, কারো মধ্যে কুফরির কোন একটি শাখা বিদ্যমান থাকলে এর অর্থ এ নয় যে, সে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত কাফের; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মধ্যে প্রকৃত কুফরি পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে কারো মধ্যে যদি ঈমানের কোন একটি শাখা পাওয়া যায় এর দ্বারা সে ব্যক্তি ঈমানদার হয়ে যাবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মধ্যে ঈমানের মৌলিক বিশ্বাস ও হাকীকত পাওয়া যায়। الكُفْر শব্দটি ال দিয়ে ব্যবহৃত হওয়া যেমন হাদিসে এসেছে- ” ليس بين العبد وبين الكفر أو الشرك إلا ترك الصلاة”, এবং نكرة হিসেবে হ্যাঁ-বোধক বাক্যে ব্যবহৃত হওয়া এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম: ৭০)
.
এর মাধ্যমে পরিষ্কার হলো যে, এই দলিলগুলোর দাবী হচ্ছে- কোন ওজর ছাড়া পরিপূর্ণ ভাবে নামায বর্জনকারী ইসলাম ত্যাগকারী কাফের। সুতরাং ইমাম আহমাদের অভিমতই সঠিক এবং ইমাম শাফেয়ির দুই অভিমতের একটি অভিমতও এটা। ইবনে কাসির (রহঃ) তাঁর তাফসির গ্রন্থে আল্লাহ্‌র বাণী; (তাদের পরে এলো অযোগ্য উত্তরসূরীরা, তারা নামায নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল)। [সূরা মারিয়াম, আয়াত: ৫৯]-এর তাফসির করার সময় এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘আস-সালাত’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, এটি শাফেয়ী মাযহাবের দুইটি অভিমতের একটি। ইমাম তাহাবি ইমাম শাফেয়ী থেকে এ অভিমতটি উদ্ধৃত করেছেন। জমহুর বা অধিকাংশ সাহাবীর অভিমতও এটাই। বরং কেউ কেউ এ মতের উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু শাক্বীক্ব আল-উক্বাইলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ সালাত ব্যতীত অন্য কোন আমাল ছেড়ে দেয়াকে কুফুরী মনে করতেন না। (অর্থাৎ সালাত ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন) (তিরমিযী, হা/২৬২২; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১/২২৭-৫৬৪ হাকেম বলেছেন, এ বাণীটি সহীহাইনের শর্তে উত্তীর্ণ প্রসিদ্ধ ইমাম ইসহাক বিন রাহুইয়া বলেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ সনদে সাব্যস্ত হয়েছে যে- নামায বর্জনকারী কাফের। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানা থেকে আমাদের সময়কাল পর্যন্ত এটাই হচ্ছে আলেমদের অভিমত যে, কোন ওজর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে নামায বর্জনকারী; নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে গেলে কাফের। ইবনে হাযম উল্লেখ করেছেন যে, এ মতটি উমর (রাঃ), আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ), মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে। তিনি আরও বলেন: আমরা এ সাহাবীদের সাথে মতবিরোধকারী কোন সাহাবীর কথা জানি না। মুনযিরি তাঁর তারগীব ও তারহীব নামক গ্রন্থে এ উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি আরও কিছু সাহাবীর নাম বৃদ্ধি করেন। তাঁরা হচ্ছেন- আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ), আব্দুল্লাহ্‌ বিন আব্বাস (রাঃ), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ), আবুদ দারদা (রাঃ)। তিনি আরও বলেন; সাহাবী ছাড়া অন্যদের মধ্যে রয়েছেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ), ইসহাক বিন রাহুইয়া (রহঃ), আব্দুল্লাহ্‌ বিন মুবারক (রহঃ), নাখায়ি (রহঃ), আল-হাকাম বিন উতাইবা (রহঃ), আইয়ুব আল-সিখতিয়ানি (রহঃ), আবু দাউদ আত-তায়ালিসি (রহঃ), আবু বকর ইবনে আবু শাইবা (রহঃ) ও যুহাইর বিন হারব (রহঃ) প্রমুখ। (বিস্তারিত জানতে শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন লিখিত ‘রিসালাহ ফি হুকমি তারিকিস সালাহ’ বইটি পড়ুন। আরো দেখুন, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৫২০৮)।
.
(৩). সালাত ইসলামের ফরজ বিধান এটি স্বীকার করা এবং নিয়মিত আদায় করা, তবে মাঝে মধ্যে ত্যাগ করা।
.
যে ব্যক্তি নিয়মিত সালাত আদায় করে তবে মাঝেমধ্যে তার দুই এক ওয়াক্ত ছুটে যায় বা ক্বাযা করে আদায় করে, এই ব্যক্তি কাফের কিনা তার হুকুমের ব্যাপারে আহালুল আলেমগন মতভেদ করেছেন। আলেমগণের একটি পক্ষের মতামত অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগকারীও কাফের, যে এমনটি করবে সে ইসলামের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যাবে এবং মৃত্যুর পর কাফের-মুশরিকদের ন্যায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। অপরদিকে আরেকদল আলেমদের মতে সালাত ইসলামের রুকন এটি অস্বীকার না করে অলসতা বসত মাঝেমধ্যে সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি ফাসিক, সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে না। উভয় দলের আলেমদের পক্ষেই কুরআন-হাদীসের দলিল এবং সালাফদের থেকে বক্তব্য রয়েছে। তবে কুরআন-সুন্নাহর দলিল এবং অধিকাংশ আহালুল আলেমগনের মতে,একজন ব্যক্তি যদি সালাত শরীয়তের বিধান এটি অস্বীকার না করে কিন্তু মাঝে মধ্যে দুই এক ওয়াক্ত পরিত্যাগ করে তাহলে সে ব্যক্তি ফাসিক,তথা কবীরা গুনাহগার। এমন ব্যক্তি তওবা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে, আল্লাহ চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন অথবা ক্ষমা করবেন। সে জাহান্নামে গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবেনা বরং নির্দিষ্ট সময় শাস্তি ভোগ করে কোন এক সময় আল্লাহর দয়ায় জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।কুরআন সুন্নার দলিলের আলোকে এটাই গ্রহণযোগ্য মত। কারণ সালাত ত্যাগের ব্যাপারে যেমন কুফর শব্দের ব্যবহার হাদীসে রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে একই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর ক্ষেত্রে কাফের বলা হয় না। যেমন, মুসলিম ভাইয়ের সাথে মারামারি করা কুফুরী। (সহীহ বুখারী, হা/৪৮)। যে মুসলিম ভাইকে কাফের বলল, সে কুফরী তার দিকেই ফিরে আসল।(সহীহ বুখারী, হা/৬১০৩)। যে হায়েযা স্ত্রীর সাথে মিলন করল, সে কুরআনের প্রতি কুফরী করল। (মিশকাত, হা/৫৫১)। যে তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করল, সে কাফের হয়ে গেল। (সহীহুল জামে হা/৭০২৮)। যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কসম করল, সে শিরক করল। (মিশকাত হা/৩৪১৯) উপরোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা বিষয়টির ভয়াবহতা তথা কবীরা গুনাহের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং জমহূর বিদ্বানের অভিমতটি হাদীসসম্মত হওয়ায় উক্ত অভিমতই অগ্রাধিকারযোগ্য। কারণ, কুফরী করা ও কাফের হয়ে যাওয়া এক বিষয় নয়। নিম্নের হাদীসগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। যেমন:
.
রাসূল (ﷺ) বলেন, إنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إلَهَ إلَّا اللهُ، يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللهِ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে। (সহীহ বুখারী হা/৪২৫; মুসলিম হা/৩৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেন; مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ. ثُمَّ مَاتَ عَلَى ذَلِكَ، إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ. ‘যে ব্যক্তি (অন্তরে বিশ্বাস নিয়ে) লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ বলবে অতঃপর এ বিশ্বাসের উপর তার মৃত্যু হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহীহ বুখারী হা/৫৮২৭; মুসলিম হা/৯৪; মিশকাত হা/২৬) তিনি আরো বলেেন, যে ব্যক্তি (আন্তরিকভাবে) এ সাক্ষ্য দিবে যে- আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং ঈসা আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, আল্লাহর কালিমা- যা তিনি মারিয়াম (আঃ)-এর প্রতি প্রেরণ করেছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ। জান্নাত-জাহান্নাম সত্য। তার আমল যা-ই হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (সহীহ বুখারী হা/৩৪৩৫; মিশকাত হা/২৭)। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ ঈমান রয়েছে, সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ পাঠ করবে এবং তার অন্তরে একটি গম পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। অনুরূপ ঐ ব্যক্তিও জাহান্নাম থেকে বের হবে, যে লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ পাঠ করবে এবং তার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা/৪৪)
.
আবু সাঈদ (রাঃ) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন যে, তোমাদের পূর্বের এক লোক, আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এল তখন সে তার ছেলেদেরকে জড়ো করে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাদের কেমন পিতা ছিলাম? তারা বলল, আপনি আমাদের উত্তম পিতা ছিলেন। সে বলল, আমি জীবনে কখনো কোন নেক আমল করিনি। সুতরাং আমি যখন মারা যাব তখন তোমরা আমার লাশকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিও এবং প্রচন্ড ঝড়ের দিন ঐ ছাই বাতাসে উড়িয়ে দিও। লোকটি মারা গেলে ছেলেরা অসিয়ত অনুযায়ী কাজ করল। আল্লাহ তা‘আলা তার ছাই জড়ো করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন অসিয়ত করতে কিসে তোমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল? সে বলল, হে আল্লাহ! তোমার শাস্তির ভয়। ফলে আল্লাহর রহমত তাকে ঢেকে নিল। (বুখারী হা/৩৪৭৮; মুসলিম হা/২৭৫৬)। লোকটির কোন ভালো কাজ ছিল না তাওহীদে বিশ্বাস ছাড়া। আর কেবল তাওহীদে বিশ্বার থাকার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
.
নিম্নে বর্ণিত হাদীস গুলোও প্রমাণ করে যে, কেবল সালাত পরিত্যাগ করলেই কাফের হয়ে যাবে না এবং ইসলামের গন্ডী থেকে বের হয়ে যাবে না। বরং কবীরা গুনাহগার হবে। জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু তাওহীদে বিশ্বাস থাকার কারণে এক সময় সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন; ইসলাম পুরাতন হয়ে যাবে, যেমন কাপড়ের উপরের কারুকার্য পুরাতন হয়ে যায়। শেষে এমন অবস্থা হবে যে, কেউ জানবে না, সাওম কি, সালাত কি, কুরবানী কি, যাকাত কি? এক রাতে পৃথিবী থেকে মহান আল্লাহর কিতাব বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং একটি আয়াতও অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের (মুসলিমদের) কতক দল অবশিষ্ট থাকবে। তাদের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা বলবে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু (আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই)-এর অনুসারী দেখতে পেয়েছি। সুতরাং আমরাও সেই বাক্য বলতে থাকব। (তাবেঈ) ছিলা (রহঃ) হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ’ বলায় কি তাদের কোন উপকার হবে না? কারণ তারা জানে না সালাত কি, সিয়াম কি, হজ্জ কি, কুরবানী কি এবং যাকাত কি? ছিলা ইবনে যুফার (রহঃ) তিনবার কথাটির পুনরাবৃত্তি করলে হুযায়ফা (রাঃ) প্রতিবার তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। তৃতীয় বারের পর তিনি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে ছিলা! এই কালেমা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে। কথাটি তিনি তিনবার বলেন। (ইবনু মাজাহ হা/৪০৪৯; সহীহাহ হা/৮৭; সহীহুল জামে হা/৮০৭৭)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন, وفي الحديث فائدة فقهية هامة وهي أن شهادة أن لا إله إلا الله تنجي قائلها من الخلود في النار يوم القيامة ولو كان لا يقوم بشيء من أركان الإسلام الخمسة الأخرى كالصلاة وغيرها ‘এই হাদীসে গুরুত্বপূর্ণ ফিক্বহী উপকারিতা রয়েছে। আর সেটি হলো -কালেমায়ে শাহাদাতের সাক্ষ্য প্রদানকারী ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামে স্থায়ী অবস্থান থেকে মুক্ত করবে। যদিও সে সালাত বা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের কোন একটি রুকন প্রতিষ্ঠা না করে। তিনি আরো বলেছেন, فهذا نص من حذيفة رضي الله عنه على أن تارك الصلاة، ومثلها بقية الأركان ليس بكافر، بل هو مسلم ناج من الخلود في النار يوم القيامة. ‘হুযায়ফার হাদীস থেকে এই দলীল গ্রহণ করা যায় যে, সালাত পরিত্যাগকারী এবং অনুরূপ রুকনগুলো ত্যাগকারী কাফের নয়। বরং, সে মুসলিম এবং ক্বিয়ামতের দিন স্থায়ী জাহান্নামী হওয়া থেকে মুক্তি লাভকারী। (সিলসিলা সহীহাহ হা/৮৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)
.
ওবাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন;আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি- আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি তা আদায় করবে এবং তুচ্ছ মনে করে এর কোন প্রকার হক নষ্ট করবে না, তার জন্য আল্লাহর নিকট এই প্রতিজ্ঞা রইল যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে তা আদায় করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোন অঙ্গীকার থাকবে না। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিবেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে জান্নাতেও দাখিল করাতে পারেন। (নাসাঈ হা/৪৬১; ইবনু মাজাহ হা/১৪০১; সহীহুত তারগীব হা/৩৭০)। যদি সালাত পরিত্যাগকারী মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যেত তাহলে আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে আসত না। বরং তারা বিনা হিসাবে জাহান্নামে চলে যেত, যেমন কাফেররা চলে যাবে।
.
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেন, خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللهُ تَعَالَى مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلَّاهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ وَأَتَمَّ رُكُوعَهُنَّ وَخُشُوعَهُنَّ كَانَ لَهُ عَلَى اللهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عَلَى اللهِ عَهْدٌ، إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ- ‘আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দর করে ওযু করবে এবং পরিপূর্ণরূপে রুকূ-সিজদা ও একাগ্রতাসহ সময়মত সালাত আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার রয়েছে যে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি এ কাজ করবে না তার জন্যে আল্লাহর কোন অঙ্গীকার নেই, তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন এবং ইচ্ছা করলে শাস্তি দিবেন। (তাবারানী আওসাত্ব হা/৪৬৫৮; সহীহুল জামে হা/৩২৪২,৩২৪৩)। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন; مَنْ صَلَّى الصَّلاةَ لِوَقْتِهَا، وَحَافَظَ عَلَيْهَا، وَلَمْ يُضَيِّعْهَا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهَا، فَلَهُ عَلَيَّ عَهْدٌ، أَنْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ، وَمَنْ لَمْ يُصَلِّهَا لِوَقْتِهَا، وَلَمْ يُحَافِظْ عَلَيْهَا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهَا فَلا عَهْدَ لَهُ عَلَيَّ إِنْ شِئْتُ عَذَّبْتُهُ، وَإِنْ شِئْتُ غَفَرْتُ لَهُ، ‘যে ব্যক্তি সময়মত সালাত আদায় করবে এবং তার প্রতি যত্নবান হবে। আর কোন একটি সালাতের অধিকারকে হালকা মনে করে তা বিনষ্ট করবে না। তাহলে তার জন্যে আমার উপর অঙ্গীকার হলো আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। আর যে ব্যক্তি সময়মত সালাত আদায় করবে না, তার প্রতি যত্নবান হবে না এবং এর অধিকারকে হালকা মনে করে বিনষ্ট করবে, তাহলে তার জন্যে আমার উপর কোন অঙ্গীকার নেই। ইচ্ছা করলে আমি তাকে শাস্তি দিব এবং ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে দিব।’ (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৬৭৮; সহীহুত তারগীব হা/৪০১)।
.
ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই হাদীসের আলোকে আবু আব্দুল্লাহ ইবনে বাত্ত্বা (তার ‘আশ-শারহু ওয়াল ইবানা আন উছূলে আহলিস সুন্নাহ ওয়াদ দিয়ানাহ’ গ্রন্থে) বলেন, وَلَا يُخْرِجُهُ مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اَلشِّرْكُ بِاللهِ أَوْ بِرَدِّ فَرِيضَةٍ مِنْ فَرَائِضِ اَللهِ عَزَّ وَجَلَّ جَاحِدًا بِهَا فَإِنْ تَرَكَهَا تَهَاوُنًا وَكَسَلاً كَانَ فِي مَشِيئَةِ اَللهِ عَزَّ وَجَلَّ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ، ‘শিরক ব্যতীত কোন কিছুই মানুষকে ইসলাম থেকে বের করতে পারে না। অথবা আল্লাহ যা ফরয করেছেন তা অস্বীকার করে প্রত্যাখ্যান করলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। আর যদি কোন ফরয শিথিলতা ও অলসতাবশত: পরিত্যাগ করে, তবে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীনে থাকবে। ইচ্ছা করলে তিনি তাকে শাস্তি দিবেন এবং ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন। (ইবনু বাত্ত্বাহ, মুতূনু কিতাবিশ শরহে ওয়াল ইবানা আলা উছূলিস সুন্নাহ ওয়াদ দিয়ানাহ, ১৮৩ পৃ.)। ইচ্ছাকৃত সালাত পরিত্যাগ করার ব্যাপারে যে সকল হাদীস এসেছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্বীকার, সীমালঙ্ঘন ও অহংকার করে সালাত পরিত্যাগ করা। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) একই কথা বলে অছিয়ত করেছিলেন তার ছাত্র মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদকে। (আলবানী, হুকমু তারিকিছ সালাত ১/১০)।
.
প্রিয় পাঠক! আমরা উপরে আলোচনা করেছি, যে ব্যক্তি নিয়মিত সালাত আদায় করে কিন্তু অলসতা, প্রবৃত্তির তাড়নায় মাঝে মধ্যে দুই এক ওয়াক্ত ছুটে যায় বা ক্বাযা করে আদায় করে, এরূপ ব্যক্তির বিধান সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে এই ব্যক্তি কাফের নয় বরং ফাসেক। এবার ইতিহাস বিখ্যাত কয়েকজন সালাফদের ফতোয়া দেখুন:
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, সালাত পরিত্যাগকারী যদি এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে তাহলে সে মুসলিমদের ঐক্যমতে কাফের এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কৃত। তবে সে যদি নতুন মুসলিম হয় এবং মুসলমানদের সাথে না মেশার কারণে সালাতের ফরযিয়াতের বিষয়টি তার নিকটে না পৌঁছে তাহলে ভিন্ন কথা। আর যদি সালাতের ফরযিয়াতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে কিন্তু অলসতাবশতঃ সালাত ত্যাগ করে, যেমনটা বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমানের অবস্থা তাহলে এব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইমাম মালেক, শাফেঈ সহ পূর্ববর্তী-পরবর্তী জমহূর সালাফ মনে করেন, সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফের বলা যাবে না, বরং সে ফাসেক। এরূপ ব্যক্তিকে তওবা করতে বলতে হবে। যদি সে তওবা করে তো ভালো। অন্যথা আমরা তাকে হদ্দ বা দন্ড হিসাবে হত্যা করব, যেমন বিবাহিত ব্যভিচারীকে হত্যা করা হয়। আর তাকে তরবারী দ্বারা হত্যা করা হবে। (শরহুন নববী আলা মুসলিম, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭০)
.
ইমাম ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, কেউ অলসতাবশত পঞ্চ ইবাদতের কোন একটি ছেড়ে দিলে তাকে কাফের বলা যাবে না। (আশ-শারহুল কাবীর; ১০/৭৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, যদি কেউ অলসতা বা উদাসীনতা বশত ফরয সালাত ছেড়ে দেয়, তবে তাকে তা আদায় করার জন্য আহবান জানাতে হবে। তাকে বলতে হবে, তুমি সালাত আদায় কর, অন্যথা আমরা তোমাকে হত্যা করব। সে সালাত আদায় করলে ভালো অন্যথা তাকে হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তবে তার পূর্বে তাকে তিনদিন বন্দি করে রাখতে হবে এবং বন্দিশালায় তার জীবনকে সংকটময় করে তুলতে হবে। প্রতি ওয়াক্ত সালাত আদায়ের জন্য তাকে আহবান জানাতে হবে এবং হত্যার ভয় দেখাতে হবে। যদি সে সালাত আদায় করে তাহলে রক্ষা পাবে। অন্যথা তাকে তরবারী দ্বারা হত্যা করতে হবে। (ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩২৯)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন,فَأَمَّا مَنْ كَانَ مُصِرًّا عَلَى تَرْكِهَا لَا يُصَلِّي قَطُّ، وَيَمُوتُ عَلَى هَذَا الْإِصْرَارِ وَالتَّرْكِ، فَهَذَا لَا يَكُونُ مُسْلِمًا، لَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ يُصَلُّونَ تَارَةً، وَيَتْرُكُونَهَا تَارَةً، فَهَؤُلَاءِ لَيْسُوا يُحَافِظُونَ عَلَيْهَا، وَهَؤُلَاءِ تَحْتَ الْوَعِيدِ، অর্থাৎ যে ব্যক্তি সালাত পরিত্যাগ করার ব্যাপারে যিদ করে, কখনই সালাত পড়ে না এবং এই যিদ ও পরিত্যাগের উপর তার মৃত্যু হয়, তাহলে এরূপ ব্যক্তি মুসলমান নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ মাঝে-মধ্যে সালাত আদায় করে এবং মাঝে-মধ্যে পরিত্যাগ করে। এরা সালাত হেফাযতকারী নয়। আর এরাই হুমকির আওতাভুক্ত। আল্লাহ চাইলে এদেরকে ক্ষমা করবেন আবার চাইলে শাস্তি প্রদান করবেন। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ খন্ড: ২২ পৃষ্ঠা: ৪৯)।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘অনেক শহরে অসংখ্য এমন মানুষ আছে যারা পাঁচ ওয়াক্তের সালাত নিয়মিতভাবে কঠোরতার সঙ্গে সঙ্গে আদায় করে না। আবার তারা সালাতকে সম্পূর্ণরূপে ছেড়েও দেয় না। বরং তারা কখনো কখনো পড়ে আবার কখনো কখনো ছেড়ে দেয়। এরাই তারা যাদের মধ্যে ঈমান ও নিফাক্ব দু’টোই বিদ্যমান। এদের উপর মিরাছের ও অন্যান্য বিষয়ের প্রকাশ্য ইসলামিক বিধি-বিধান জারি হবে (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ৭/৬১৭ ও ২২/৪৯ পৃ.; শারহুল উমদাহ, ২/৯৪ পৃ.)।
.
শাইখুল ইসলাম আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগ করল সে মহাপাপে লিপ্ত হলো। সে যেন যত দ্রুত সম্ভব তওবা করে এবং সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে। কারণ, কেবল কাযা আদায় করার মাধ্যমে সে গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। এ ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা বা ঐক্যমত রয়েছে। (মিনহাজুস সুন্নাহ, খণ্ড,৫ পৃষ্ঠা:২৩১)। তিনি আরো বলেন, ‘বিনা কারণে ওয়াক্তের বাইরে সালাত বিলম্ব করা কবীরা গুনাহ। আর ওমর (রাঃ) বলতেন, বিনা কারণে দুই ওয়াক্তের সালাত একত্রে আদায় করা কবীরা গুনাহ।(মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, খন্ড: ২২ পৃষ্ঠা: ৫৩)
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, تارك الصلاة جحدا لوجوبها كافر بإجماع أهل العلم، وتاركها تساهلا وكسلا كافر على الصحيح من قولي أهل العلم، وعليه فلا تجوز الصلاة عليه، ولا تشييع جنازته من العلماء ولا غيرهم، ولا دفنه في مقابر المسلمين. সালাতের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি বিদ্বানগণের ঐক্যমতে কাফের। আর অলসতা বা উদাসীনতা বশত সালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি বিদ্বানদের বিশুদ্ধ মতে কাফের। এই ফৎওয়া মতে তার জানাযার সালাত আদায় করা যাবে না, কোন আলেম বা অন্য কেউ তার জানাযার অনুগমন করবে না এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা যাবে না। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খব্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৪১৩)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, সঠিক কথা হলো সালাত পরিত্যাগ করা বড় কুফর, যদিও সে এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার না করে। এটিই দলীল সমূহের দাবী। যদিও জমহূর বিদ্বান এর বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। (ইমাম বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ২৪১)
.
শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ ও সালেহ আল-ফাওযানও শায়খ বিন বাযের মতই সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফের ও হত্যাযোগ্য অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করেছেন। (শরহে আবীদাউদ ৩/৩১৫; সালেহ ফাওযান, মাজমূ ফাতাওয়া ১/৩৩০)
.
দীর্ঘ গবেষণার পর সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,

,الذي يظهر لي أنه لا يكفر إلا بالترك المطلق بحيث لا يصلى أبداً وأما من يصلى أحياناً فإنه لا يكفر لقول الرسول عليه الصلاة والسلام (بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة) ولم يقل ترك صلاةٍ قال ترك الصلاة وهذا يقتضي أن يكون الترك المطلق وكذلك قال (العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها أي الصلاة فقد كفر) وبناءً على هذا نقول إن الذي يصلى أحياناً ويدع أحياناً ليس بكافر وحينئذٍ يرث من قريبه المسلم.
আমার নিকট যেটা প্রতিভাত হয়েছে তা হলো- পুরোপুরি সালাত পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তাকে কাফের বলা যাবে না। এর অর্থ হলো যে, সে কখনও সালাত আদায় করে না। পক্ষান্তরে যে মাঝে-মধ্যে সালাত আদায় করে তাকে কাফের বলা যাবে না। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘মানুষ ও শিরক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত।’ (সহীহুত তারগীব হা/৫৬৩)। তিনি বলেননি, এক ওয়াক্ত সালাত ছেড়ে দিলে বরং তিনি বলেছেন, একেবারে সালাত পরিত্যাগ করলে, যা প্রমাণ করে যে এর অর্থ পুরোপুরি ছালাত পরিত্যাগ করলে।অনুরূপভাবে রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত। অতএব, যে সালাত ছেড়ে দিল সে কুফুরী করল। (তিরমিযী হা/২৬২১; মিশকাত হা/৫৭৪; সহীহুত তারগীব হা/৫৬৪)। এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলব, যে ব্যক্তি মাঝে-মধ্যে সালাত পড়ে এবং মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দেয় সে কাফের নয়। এক্ষেত্রে সে নিকটতম মুসলিম আত্মীয়-স্বজনের মীরাছ পাবে। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ৫৫-৫৬, উসামীন ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ২/১৭)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,وأنا أرى أن الصواب رأي الجمهور، وأن ما ورد عن الصحابة ليس نصا على أنهم كانوا يريدون بـ (الكفر) هنا الكفر الذي يخلد صاحبه في النار ولا يحتمل أن يغفره الله له،
অর্থাৎ আমি মনে করি জমহূর বিদ্বানের অভিমতই সঠিক। (অর্থাৎ সালাত ত্যাগ করলে এমন কাফের হয়ে যাবে না, যা তাকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়)। সাহাবীগণ থেকে যে সকল বর্ণনা এসেছে, সেগুলোতে একটাও এ মর্মে নেই যে, তারা এক্ষেত্রে কুফর দ্বারা সেই কুফর উদ্দেশ্য নিয়েছেন যা স্থায়ী জাহান্নামী করে দেয় এবং এটাও সম্ভাবনা নেই যে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। (সিলসিলা সহীহাহ হা/৮৭-এর আলোচনা, ১/১৭৫)। তিনি আরো বলেন, ‘এজন্য আবহমানকাল থেকে মুসলমানেরা সালাত ত্যাগকারীর ওয়ারিশ হয়ে আসছে এবং তারাও মুসলমানদের মীরাছ পেয়ে আসছে। যদি সালাত পরিত্যাগকারী নিরেট কাফের হয়ে যেত তাহলে তাদের ক্ষমা করা হত না, তারা মীরাছ পেত না এবং তাদের সম্পত্তিতে অন্য মুসলমানেরা ওয়ারিছ হত না। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৮৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য) শায়খ আলবানী (রহঃ) আরো বলেন, সারকথা হলো- কেবল সালাত ত্যাগ করা একজন মুসলিমকে কাফের সাব্যস্ত করার দলীল হতে পারে না। বরং সে ফাসেক। আর তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট ন্যস্ত। তিনি চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন এবং চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। আর হাদীসের অধ্যায় নির্বাচন এই ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল। একে প্রত্যাখ্যান করা কোন মুসলমানের জন্য ঠিক হবে না। (আলবানী, সহীহাহ হা/৩০৫৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; হুকমু তারিকিছ সালাত, খন্ড:১, পৃষ্ঠা: ৫১)
.
ভারতবর্ষে হাদীসশাস্ত্রের আরেক দিকপাল, মিশকাতুল মাসাবীহ’র বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ’র সম্মানিত মুসান্নিফ,ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, আল-আল্লামাহ, ইমাম উবাইদুল্লাহ বিন আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] বলেছেন,والحق عندي: أن تارك الصلاة عمداً كافر ولو لم يجحد وجوبها، لصحة الأحاديث في إطلاق الكفر عليه، لكنه كفر دون كفر أي: كفر غير الكفر المخرج من الملة
অর্থাৎ আমার নিকট সঠিক হলো এই যে,ইচ্ছাকৃত সালাত পরিত্যাগকারী কাফের। যদিও সে এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার না করে। কারণ সালাত পরিত্যাগকারীর ক্ষেত্রে কুফর শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তবে এটি বড় কুফরের নিম্ন স্তরের কুফর। অর্থাৎ এটি ঐ কুফরী নয়, যা কোন মুসলমানকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়।(মির‘আতুল মাফাতীহ খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৭৫)
.
ভারতবর্ষের আরেক প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, সুনানুত তিরমিযীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী’র সম্মানিত মুসান্নিফ (লেখক), আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান বিন আব্দুর রহীম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) দীর্ঘ আলোচনার পর বলেছেন, হমান মুবারকপুরী (রহঃ) দীর্ঘ আলোচনার পরে বলেন,لَوْ تَأَمَّلْتَ فِي مَا حَقَّقَهُ الشَّوْكَانِيُّ فِي تَارِكِ الصَّلَاةِ مِنْ أَنَّهُ كَافِرٌ وَفِي مَا ذَهَبَ إِلَيْهِ الْجُمْهُورُ مِنْ أَنَّهُ لَا يَكْفُرُ لَعَرَفْتَ أَنَّهُ نِزَاعٌ لَفْظِيٌّ لِأَنَّهُ كَمَا لَا يُخَلَّدُ هُوَ فِي النَّارِ وَلَا يُحْرَمُ مِنَ الشَّفَاعَةِ عِنْدَ الْجُمْهُورِ كَذَلِكَ لَا يُخَلَّدُ هُوَ فِيهَا وَلَا يحرم منها عند الشوكاني أيضا،
অর্থাৎ তুমি সালাত পরিত্যাগকারী কাফের হওয়ার ব্যাপারে শাওকানীর গবেষণা এবং কাফের না হওয়ার ব্যাপারে জমহূর বিদ্বানের অভিমত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে তুমি জানতে পারবে যে, এই মতপার্থক্য শব্দগত। কারণ যেমন জমহূর বিদ্বানের মতে সালাত পরিত্যাগকারী স্থায়ী জাহান্নামী নয় এবং শাফা‘আত থেকেও বঞ্চিত হবে না, তেমনি শাওকানীর নিকটেও সে স্থায়ী জাহান্নামী হবে না এবং শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে না। (তুহফাতুল আহওয়াযী, খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৩১১)
.
হাফেয ইরাকী (রহঃ) বলেন, এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগ করলেই কী তাকে হত্যা করা হবে, নাকি একাধিক ওয়াক্ত? জমহূর বিদ্বান মনে করেন, এক ওয়াক্ত সালাত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় না করলেই তাকে হত্যা করা হবে। ইবনুল আরাবীও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (তারহুছ তাছরীব ২/১৪৮ ফাৎহুল বারী ২/১৩০)। ইবনু হাযম আন্দালুসী বলেন; ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, আব্দুর রহমান বিন আওফ, মু‘আয বিন জাবাল, আবু হুরায়রা প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত ফরয সালাত সময়ের মধ্যে পরিত্যাগ করবে, এমনকি তার নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে। সে কাফের ও মুরতাদ। (আল-মুহাল্লা, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:১৫)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
أما تركها بالكلية فإنه لا يقبل معه عمل كما لا يقبل مع الشرك عمل فإن الصلاة عمود الإسلام كما صح عن النبي صلى الله عليه وسلم وسائر الشرائع، وإذا لم يكن للفسطاط عمود لم ينتفع بشيء من أجزائه فقبول سائر الاعمال موقوف على قبول الصلاة، فإذا ردت ردت عليه سائر الأعمال، ‘
অর্থাৎ পুরোপুরি সালাত পরিত্যাগ করা এমন বিষয় যে, এ অবস্থায় তার কোন আমল কবুল হবে না। যেমন শিরক মিশ্রিত কোন আমল কবুল করা হয় না। কেননা সালাত ইসলাম এবং শরীআতের সকল বিধানের খুঁটি, যেমনটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাঁবুর মূল খুঁটি না থাকলে যেমন অন্যান্য অংশ দ্বারা কোন উপকার পাওয়া যায় না, তদ্রূপই সকল আমল কবুলের বিষয়টি নির্ভর করে সালাত কবুলের উপর। সালাত প্রত্যাখ্যাত হলে সকল আমল প্রত্যাখ্যাত হবে। (তারিকুছ সালাত ওয়া আহকামুহা পৃষ্ঠা: ৬৪)। তিনি আরো বলেন,لا يختلف المسلمون أن ترك الصلاة المفروضة عمدا من أعظم الذنوب وأكبر الكبائر وأن اثمه أعظم من إثم قتل النفس وأخذ الأموال ومن إثم الزنا والسرقة وشرب الخمر وأنه متعرض لعقوبة الله وسخطه وخزيه في الدنيا والآخرة،
অর্থাৎ এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে ফরয সালাত পরিত্যাগ করা মহাপাপ এবং সর্ববৃহৎ গুনাহ। সালাত পরিত্যাগের গুনাহ মানব হত্যা, সম্পদ আত্মসাৎ, যেনা, চুরি এবং মদ্যপানের গুনাহ অপেক্ষা মারাত্মক। আর সে আল্লাহর শাস্তি এবং ক্রোধের সম্মুখীন হবে। অনুরূপভাবে সে দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছিত হবে। (তারিকুছ সালাত ওয়া আহকামুহা, পৃষ্ঠা: ৩১, আলবানী, হুকমু তারিকিছ সালাত পৃষ্ঠা: ৫)।
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি একথা বিশ্বাস করে যে, ছালাত ইসলামের দ্বিতীয় অপরিহার্য রুকন বা স্তম্ভ এবং সে নিয়মিত ছালাত আদায় করে কিন্তু মাঝে মধ্যে দুই এক ওয়াক্ত ছুটে যায় কিংবা অলসতার কারণে ক্বাযা করে ফেলে এবং পরে আদায় করে। এই ব্যক্তি সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, কারো কারো মতে এটিও কুফরি। তবে অধিকাংশ আলেমদের মতে এই ব্যক্তি কাফির নয় বরং সে কাবীরা গুনাহগার, ফাসিক্ব মুসলিম’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৮৫৬১৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।