সালাতে হাত বাঁধার বিশুদ্ধ নিয়ম

প্রশ্ন: সালাতে হাত বাঁধার বিশুদ্ধ নিয়ম কোনটি?নাভীর নিচে বাঁধতে হবে না-কি বুকের উপর?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাতে হাত বাঁধার নিয়মের ব্যাপারে সমাজে দু’টি পদ্ধতি চালু রয়েছে। যেমন, নাভীর নীচে হাত বাঁধা এবং বুকের উপর হাত বাঁধা। তবে নাভীর নীচে হাত বেঁধে সালাত আদায় করার পক্ষে যতগুলো বর্ণনা পেশ করা হয়, সেগুলো সবই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ নাভীর নীচে হাত বাঁধার নিয়ম আমলযোগ্য নয়। বরং হাত বুকের উপর বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।সালাতে রাসূল (ﷺ) তাঁর দুই হাতের আংগুল সমূহ ক্বিবলামুখী খাড়াভাবে কাঁধ অথবা কান পর্যন্ত উঠিয়ে দুনিয়াবী সবকিছুকে হারাম করে দিয়ে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)’ বলে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ দিয়ে দু’হাত কান অথবা কাঁধ বরাবর উঠিয়ে বুকের উপর বাঁধবে।(মুসলিম হা/৯১২, ১/১৭০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৬৯); বুখারী হা/৬৬৬৭, ২/৯৮৬ পৃঃ; মিশকাত হা/৭৯০)। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন,রাসূল (ﷺ) বলেছেন-নিশ্চয় আমরা নবীদের দল। আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমরা যেন দ্রুত ইফতার করি এবং দেরিতে সাহারী করি। আর সালাতের মধ্যে আমাদের ডান হাত বাম হাতের উপর যেন রাখি। (ইবনু হিববান হা/১৭৬৭; সনদ সহীহ, ছিফাতু ছালাতিন নাবী, পৃঃ ৮৭; ইবনু ক্বাইয়িম, তাহযীব সুনানে আবী দাঊদ ১/১৩০)।
.
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হতো যেন তারা সালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে,সাহাবী সাহল বিন সা‘দ এই আদেশটিকে রাসূল (ﷺ)-এর দিকে সম্পর্কিত করতেন বলেই আমি জানি।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৪০, ১/১০২ পৃঃ, ইফাবা হা/৭০৪, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২, ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৭, মিশকাত হা/৭৯৮, সালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০)। ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى সালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ।’ (সহীহ বুখারী ১/১০২ পৃঃ)।
.
ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে সালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপরে রাখলেন।’ (সহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৭৯; আবুদাঊদ হা/৭৫৫, ইবনু মাস‘ঊদ হ’তে; ঐ, হা/৭৫৯, ত্বাঊস বিন কায়সান হ’তে; সালাত’ অধ্যায়-২, সালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা’ অনুচ্ছেদ-১২০)।

বুকে হাত বাঁধার তাৎপর্য:ত্বীবী বলেন, ‘হৃৎপিন্ডের উপরে বুকে হাত বাঁধার মধ্যে হুঁশিয়ারী রয়েছে এ বিষয়ে যে, বান্দা তার মহা পরাক্রান্ত মালিকের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে হাতের উপর হাত রেখে মাথা নিচু করে পূর্ণ আদব ও আনুগত্য সহকারে,যা কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না’। (মির‘আত ৩/৫৯ পৃঃ, হা/৮০৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

◾এবার যুগ শ্রেষ্ঠ কয়েকজন আলেমের ফতোয়া লক্ষ করুনঃ
_______________________________________
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,من السنة وضع كف اليمنى على كف اليسرى والرسغ والساعد فوق الصدر أثناء القراءة في القيام. দণ্ডায়মান অবস্থায় ক্বিরআত পাঠকালে ডান হাতকে বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রেখে বুকের উপর হাত বাঁধা সুন্নাত।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৬/৩৭০-৩৭২ পৃ.)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, সালাতের মধ্যে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা সুন্নাত। সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أنْ يَضَعَ الرَّجُلُ اليَدَ اليُمْنَى علَى ذِرَاعِهِ اليُسْرَى في الصَّلَاةِ قَالَ أَبُوْ حَازِمٍ لَا أَعْلَمُهُ إِلَّا يَنْمِي ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ قَالَ إِسْمَاعِيْلُ يُنْمَى ذَلِكَ. ‘লোকদের নির্দেশ দেয়া হত যে,সালাতে প্রত্যেকে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে।’ আবু হাযিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এ হাদীসটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করতেন বলেই জানি। ইসমাঈল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতেই বর্ণনা করা হত।’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৪০; মুওয়াত্তা মালিক, হা/৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৪৯)। এখন প্রশ্ন হল, হস্তদ্বয়কে কোথায় রাখতে হবে?বিশুদ্ধতার সর্বাধিক নিকটবর্তী ও অধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী হস্তদ্বয়কে বুকের উপর রাখতে হবে, যা ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের উপর রাখতেন। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৪৭৯, ১/২৪৩ পৃ.; বুলূগুল মারাম, হা/২৭৫)। অন্যান্য হাদীসের তুলনায় এটিই বিশুদ্ধতার সর্বাধিক নিকটবর্তী। অপরদিকে নাভীর নিচে হস্তদ্বয়কে রাখার ব্যাপারে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে যে আছার বর্ণিত হয়েছে, তা যঈফ। বরং ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসই এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ইবনে উসাইমীন, ১৩/৯৭ ও ৭৩ পৃ.; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৩/৩৬-৩৭ পৃ.)।

ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَلَا شَيْءَ فِي الْبَابِ أَصَحُّ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ الْمَذْكُوْرِ فِيْ صَحِيْحِ ابْنِ خُزَيْمَةَ. হাত বাঁধা বিষয়ে সহীহ ইবনু খুযায়মাতে ওয়াইল ইবনু হুজর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসের চাইতে বিশুদ্ধতম কোন হাদীছ আর নেই।’ (নায়লুল আওত্বার, ৩/২৫ পৃ.)।

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যিরার উপর ডান হাত রাখার আদেশ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, হাত বুকের উপরেই বাঁধতে হবে। নচেৎ তার নিচে ঐভাবে হাত রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ‘বুকের উপরে হাত বাঁধার পদ্ধতি সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। আর এর বিপরীত হয় যঈফ, না হয় ভিত্তিহীন।’ (সিফাতু সালাতিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, পৃ. ৮৮)। এছাড়া আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) আবু দাঊদের তাহক্বীক্বে বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস সহীহ বলেছেন (হা/৭৫৯)। তিনি তাঁর ‘সিফাতু সালাতিন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ গ্রন্থে হাত বাঁধা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শিরোনাম দিয়েছেন, وضعهما على الصدر ‘বুকের উপর দু’হাত রাখা’। অতঃপর হাদীস উল্লেখ করে নিচে টীকা লিখেছেন। যা বন্ধনীর মধ্যে দেখানো হল। ‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর ডান হাত রাখতেন।’ (আবূ দাঊদ, হা/৭২৩, ৭২৬-৭২৭, ৭৫৫, ৭৫৯, ৯৫৭; নাসাঈ, হা/৮৮৭-৮৮৮; ইবনু মাজাহ, হা/৮০৯-৮১১)। এ বিষয়ে তিনি স্বীয় সাহাবীগণকেও আদেশ প্রদান করেছেন। (সহীহ বুখারী, হা/৭৪০; মুওয়াত্তা মালিক, হা/৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৪৯)। তিনি কখনো ডান হাত দ্বারা বাম হাত আঁকড়ে ধরতেন। (নাসাঈ, হা/৮৮৭-৮৮৮, দারাকুত্বনী)।
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, বুকের উপর হাত বাঁধার বিষয়টি সুন্নাত থেকে প্রমাণিত। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৪৭৯, ১/২৪৩ পৃ.; বুলূগুল মারাম, হা/২৭৫; ছিফাতু ছালাতিন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃ. ৬৯)। এর বিপরীতে নাভীর নিচে হাত বাঁধার বিষয়টি হয় যঈফ না হয় ভিত্তিহীন। সুনানু ইবনু মাজার ভাষ্যকার মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল হাদী আস-সিন্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সুন্নাত অনুযায়ী হাত বাঁধার স্থান বুকের উপর ব্যতীত অন্য কোন স্থান নয়। পক্ষান্তরে সালাতের মধ্যে নাভীর নিচে হাতের পাতার উপর হাতের পাতা রাখা হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে যঈফ।’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫৯৯৫৭)।
.
উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন সাহাবী ও ২ জন তাবিঈ থেকে মোট ২০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এর বিপরীত কোন আমল বর্ণিত হয়নি এবং এটাই অধিকাংশ সাহাবী ও তাবিঈনের অনুসৃত পদ্ধতি (নায়লুল আওত্বার, ৩/২২ পৃ.; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১/১০৯ পৃ., কায়রো ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.)।পক্ষান্তরে নাভীর নিচে হাত বাঁধা সম্পর্কে আহমাদ, আবু দাঊদ, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ প্রভৃতি গ্রন্থে চারজন সাহাবী ও দু’জন তাবিঈ থেকে যে চারটি হাদীস ও দু’টি আছার বর্ণিত হয়েছে,সেগুলো সম্পর্কে মুহাদ্দিছীনের বক্তব্য হল, لَا يَصْلُحُ وَاحِدٌ مِنْهَا لِلْاِسْتِدْلَالِ ‘যঈফ হওয়ার কারণে এগুলোর একটিও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’ (মির‘আতুল মাফাতীহ, ৩/৬৩ পৃ.; তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/৮৯ পৃ.; ফিক্বহুস সুন্নাহ, পৃ,১০৯) বাজারে প্রচলিত ‘নামায শিক্ষা’ বইগুলোতে উক্ত যঈফ, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারা নাভীর নীচে হাত বাঁধার দলীল পেশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন প্রণীত ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ একটি। উক্ত লেখক শুধু বানোয়াট বর্ণনাই পেশ করেননি, বরং রীতি মত সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে রাসূল (ﷺ)-এর আমলকে যবাই করে নিজেদেরকে ‘প্রকৃত আহলে হাদীস’ বলে দাবী করেছেন। (দলিলসহ নামাযের মাসায়েল , পৃঃ ২৪) কথায় বলে ‘অন্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন’। কারণ অন্ধ মাযহাবের মরণ ফাঁদে পড়ে কেউ আহলে হাদীস পরিচয় ব্যক্ত করতে পারে না। এ জন্য ‘আহলে হাদীস’ পরিচয় দেয়ার সাহস হয় না। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।