রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: রাফ‘উল ইয়াদায়েন অর্থ কি? সালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের গুরুত্ব, পদ্ধতি এবং ফজিলত কি? একশ্রেণীর আলেম জোরালোভাবে প্রচার করেন যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীসগুলো মানসূখ বা হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তাদের বক্তব্য কতটুকু সঠিক?
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন অর্থ- দু’হাত উঁচু করা। এটি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণের অন্যতম নিদর্শন। (নায়লুল আওত্বার ৩/১৯ পৃঃ)। সালাতে রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করা সুন্নাত। তিন বা চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতে মোট চারস্থানে রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করতে হয়। যেমন:

1️⃣তাকবীরে তাহরীমার সময়,
2️⃣রুকূতে যাওয়ার সময়,
3️⃣রূকূ হতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময়
4️⃣এবং ৩য় রাক‘আতে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধার সময় [সহীহ বুখারী, হা/৭৩৫-৭৩৬, ৭৩৯; আবূ দাঊদ, হা/৭৪১; মিশকাত, হা/৭৯৩-৭৯৪]

বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,হাত উঠানোর স্থান চারটি: তাকবীরে তাহরীমার সময়, রুকু কালে, রুকু থেকে উঠার সময় এবং প্রথম তাশাহ্‌হুদ থেকে দাঁড়ানোর সময়।” [আল-শারহুল মুমতি’ (৩/২১৪]।

সালেম ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) যখন সালাত আরম্ভ করতেন, তখন কাঁধ বরাবর দুই হাত উত্তোলন করতেন। অনুরূপ যখন রুকু করার জন্য তাকবীর দিতেন এবং যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখনও দুই হাত উত্তোলন করতেন এবং ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলতেন। তিনি সিজদায় এমনটি করতেন না। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, সহীহ বুখারী হা/৭৩৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০২, ইফাবা হা/৬৯৯-৭০৩, ২/১০০-১০২ পৃঃ; এছাড়া হা/৭৩৬, ৭৩৭, ৭৩৮, ৭৩৯ দ্রঃ; সহীহ মুসলিম হা/৮৮৭, ৮৮৮, ৮৮৯, ৮৯০, ৮৯১, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৮, ইফাবা হা/৭৪৫-৭৪৯, ‘সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯ সুনানে আবু দাউদ – ৭২১, ৭২২, ৭২৩, ৭২৪, ৭২৫, ৭২৬, ৭২৭, ৭২৮,
সুনানে তিরমিজি – ২৫৫, ২৫৬, ২৫৭, সুনানে নাসাঈ – ১০২৬, ১০২৮ ইবনে মাজাহ ৮৫৮, ৮৫৯, ৮৬০, ৮৬১, ৮৬২, ৮৬৩, ৮৬৪, ৮৬৫, ৮৬৬, ৮৬৭, ৮৬৮ সুনানে আদ- দারেমী – ১২৬৯, ১২৮২, ১২৮৩, ১২৮৪)।

◾রাফ‘উল ইয়াদায়েনের গুরুত্ব ও ফযীলতঃ
______________________________________
ইবনু ওমর [রাযিয়াল্লাহু আনহুমা] যখন কোন ব্যক্তিকে দেখতেন যে, সে রুকুতে যাওয়া ও উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করছে না, তখন তিনি তার দিকে পাথর ছুড়ে মারতেন।[ইমাম বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদায়েন, হা/১৪, পৃ. ১৫; সনদ সহীহ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৪৩-এর আলোচনা দ্র.; বায়হাক্বী, মা‘রেফাতুস সুনান, হা/৮৩৯]।

ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হি.) বলেন, ‘সাহাবীদের মধ্যে কোন একজনের পক্ষ থেকেও প্রমাণিত হয়নি যে, রাসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] রাফ‘উল ইয়াদায়েন ছেড়ে দিয়েছিলেন। [ফৎহুল বারী, হা/৭৩৬-এর আলোচনা দ্র.]।

শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন, وَالَّذِيْ يَرْفَعُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّنْ لاَّ يَرْفَعُ فَإِنَّ أَحَادِيْثَ الرَّفْعِ أَكْثَرُ وَأَثْبَتُ ‘যে ব্যক্তি রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে, ঐ ব্যক্তি আমার নিকট অধিক প্রিয়-ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে না। কারণ রাফ‘উল ইয়াদায়েন এর হাদীস সংখ্যায় বেশী ও অধিকতর মযবুত।’ [হুজ্জাতুল্লা-হিল বালিগাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০]।

কিছু হানাফী ফকীহও এই অনস্বীকার্য সুন্নাহর উপর আমল করে গেছেন। যেমন ইমাম আবু ইউসুফের ছাত্র ইসাম বিন ইউসুফ, আবু ইসমাহ্‌ বালখী রুকু যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় ‘রাফ’উল য়্যাদাইন’ করতেন। (আল-ফাওয়াইদ ১১৬পৃ:)। বলাই বাহুল্য যে, তিনি দলীলের ভিত্তিতেই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর বিপরীতও ফতোয়া দিতেন। (আল-বাহ্‌রুর রাইক্ব ৬/৯৩, রসমুল মুফতী ১/২৮)।

ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ইমাম বুখারী ১৭ জন সাহাবী থেকে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাকেম ও আবুল ক্বাসেম মান্দাহ জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ১০ জন সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর হাফেয আবুল ফাযল অনুসন্ধান করে সাহাবীদের থেকে যে সমস্ত বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, তার সংখ্যা ৫০ জনে পৌঁছেছে।’ (ফৎহুল বারী হা/৭৩৬-এর আলোচনা দ্রঃ)।

রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা সম্পর্কে চার খলীফা সহ প্রায় ২৫ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস সমূহ রয়েছে। একটি হিসাব মতে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ এর হাদীসের রাবী সংখ্যা ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’ সহ অন্যূন ৫০ জন সাহাবী (ফাৎহুল বারী ২/২৫৮) এবং সর্বমোট সহীহ হাদীস ও আছারের সংখ্যা অন্যূন চার শত (সিফরুস সা‘আদাত ১৫ পৃঃ)। ইমাম বুখারী বলেন,কোন সাহাবী রাফ‘উল ইয়াদায়েন তরক করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি। তিনি আরও বলেন ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ এর হাদীস সমূহের সনদের চেয়ে বিশুদ্ধতম সনদ আর নেই।’ (ফাৎহুল বারী ২/২৫৭)।

উক্ববা ইবনু আমের আল-জুহানী [রাযিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, যখন মুসল্লী রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করবে, তখন তার জন্য প্রত্যেক ইশারায় দশটি করে নেকী হবে। (বায়হাক্বী, মা‘রেফাতুস সুনান, হা/৮৩৯; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নাবী, পৃ. ১২৯)।

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী [রহঃ] উক্ত হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন, একটি হাদীসে কুদসী এই কথার সাক্ষী। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি একটি নেকীর কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করবে অতঃপর তা করে ফেলবে, আল্লাহ তার জন্য ১০ থেকে ৭০০ নেকী লিপিবদ্ধ করবেন’। [বুখারী হা/৬৪৯১, ২/৯৬০ পৃঃ; মুসলিম হা/৩৪৯-৩৫৫- فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً فَإِنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ]।

◾এবার সমাজে প্রচলতি কতিপয় হাদীসের অপব্যাখ্যা ও তার জবাব:
_______________________________________

1️⃣জাবের ইবনু সামুরা [রাঃ] বলেন, আমরা যখন রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সালাত আদায় করতাম, তখন ‘আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’, ‘আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বলতাম। মুসল্লী তার দুই পার্শ্বে দুই হাত দিয়ে ইশারা করত। ফলে রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা কেন তোমাদের হাত দ্বারা ইঙ্গিত করছ, যেন তা অবাধ্য ঘোড়ার লেজ। তোমাদের কোন মুসল্লীর জন্য যথেষ্ট হবে তার হাত তার রানের উপর রাখা। অতঃপর তার ডানে ও বামের ভাইকে সালাম দেয়া। (সহীহ মুসলিম হা/৯৯৮, ৯৯৯, ৯৯৭, ১/১৮১ পৃঃ, ‘সালাত’ অনুচ্ছেদ-২৭; আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪)।

উপরোক্ত হাদীসটির সাধারণ মর্মার্থ: ইমাম নাওয়ভী (রাহিমাহুল্লাহ), এই হাদীসটিকে কেন্দ্র করে যে বাব [অনুচ্ছেদ] নির্ণয় করেছেন তা এমন: “অনুচ্ছেদ: স্বলাতে স্থির থাকার আদেশ এবং সালাম ফিরানোর সময় হাত দ্বারা ইঙ্গিত করা ও উত্তোলন করা নিষেধ এবং প্রথম কাতারগুলো পূরণ করা, সমান্তরাল হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়া। (শারহু স্বহীহ মুসলিম নওয়াভী, ৪/৩৭২)।

পর্যালোচনা: উক্ত মর্মে সহীহ মুসলিমে পরপর তিনটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটিতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তাশাহ্হুদের সময় হাত তুলে সালাম দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তিনটি হাদীস একই রাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। অথচ অপব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম মুসলিম যদি এই হাদীসকে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের বিরুদ্ধে পেশ করতে চাইবেন,তবে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করার পক্ষে কেন তিনি পাঁচটি হাদীস উল্লেখ করলেন? [সহীহ মুসলিম হা/৮৮৭, ৮৮৮, ৮৮৯, ৮৯০, ৮৯১, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৮, ইফাবা হা/৭৪৫-৭৪৯, ‘সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯]।

ইমাম নাওয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ)বলেন: “এখানে যেই উত্তোলন করা নিষেধ তা হচ্ছে, দুই দিকে সালাম ফিরানোর সময় হাত তুলা নিষেধ। যেমনটি দ্বিতীয় বর্ণনায় স্পষ্ট রূপে বর্ণিত হয়েছে”। [শারহু স্বহীহ মুসলিম ৪/৩৭২]।

2️⃣ আলক্বামা রাঃ থেকে বর্নিত, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) একদা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেভাবে সালাত আদায় করতেন আমি কি তোমাদের সেভাবে সালাত আদায় করে দেখাব না? অতঃপর তিনি সালাত আদায় করলেন। কিন্তু তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য কোন সময় দু’হাত উত্তোলন করলেন না।’ [তিরমিযী ১/৩৫ হাদীস নং২৫৭]। আবার বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ﷺ) তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত আর কখনো হাত উঠাতেন না।’ [আবু দাঊদ ১/১০৯ হাদীস নং/৭৫২]।

প্রশ্নে বর্ণিত ১ম হাদীসটি ইমাম আবু দাঊদ বর্ণনা করে বলেন, هَذَا مُخْتَصَرٌ مِنْ حَدِيثٍ طَوِيلٍ وَلَيْسَ هُوَ بِصَحِيحٍ عَلَى هَذَا اللَّفْظِ ‘এটা লম্বা হাদীসের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর এই শব্দে এটি সহীহ নয়।’ [দেখুন আবুদাঊদ হা/৭৪৮]। উল্লেখ্য যে, উপমহাদেশের ছাপা আবু দাউদে হাদীসের শেষে ইমাম আবু দাঊদের উক্ত মন্তব্যটি নেই। কিন্তু অন্যান্য ছাপা আবু দাঊদে তা রয়েছে। এদেশে ছাপা আবু দাঊদ থেকে উক্ত মন্তব্য তুলে দেওয়ার রহস্য অজ্ঞাত। দ্বিতীয় হাদীসটি সম্পর্কে তিনি বলেন, هَذَا الْحَدِيثُ لَيْسَ بِصَحِيحٍ ‘এই হাদীস সহীহ নয়।’ [আবু দাঊদ হা/৭৫২]। তাছাড়া বারা ইবনু আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত অন্য আরেকটি বর্ণনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অতঃপর তিনি আর হাত উঠাননি’ অংশটুকু অন্য সনদে তিনি বলেননি। সুফিয়ান বলেন, আমাদেরকে অনেক পরে কূফাতে ‘অতঃপর তিনি আর হাত উঠাননি’ অংশটুকু বলা হয়েছে। ইমাম আবু দাঊদ আরো বলেন, ইয়াযীদ থেকে হাদীসটি হুশাইম, খালেদ, ইবনু ইদরীসও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারা ‘অতঃপর তিনি আর হাত উঠাননি’ অংশটুকু বলেননি।’ [আবুদাঊদ হা/৭৫০]। এভাবে ইমাম আবু দাউদ (২০২-২৭৫) রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন না করার হাদীস সমূহকে নাকচ করে দিয়েছেন।

ইবনু হিব্বানে বলেন, ‘রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন’ না করার পক্ষে কুফাবাসীদের এটিই সবচেয়ে বড় দলীল হলেও এটিই সবচেয়ে দুর্বলতম দলীল, যার উপরে নির্ভর করা হয়েছে। কেননা এর মধ্যে এমন সব বিষয় রয়েছে, যা একে বাতিল বলে গণ্য করে। [নায়লুল আওত্বার ৩/১৪ পৃঃ, ফিকহুস সুন্নাহ ১/১০৮]।

ইমাম তিরমিযী (মৃঃ ২৭৯হিঃ) ১ম হাদীসটিকে সনদের দিক থেকে ‘হাসান’ বললেও তার আগের হাদীসে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, لم يثبت حديث ابن مسعود ‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর হাদীস প্রমাণিত হয়নি’ (তিরমিযী হা/২৫৫-এর আলোচনা)। আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদীসটিকে সহীহ মেনে নিলেও তা ‘রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন’ এর পক্ষে বর্ণিত সহীহ হাদীস সমূহের বিপরীতে পেশ করা যাবে না। কেননা এটি না বোধক এবং ঐগুলি হ্যাঁ বোধক। ইলমে হাদীসের মূলনীতি অনুযায়ী হ্যাঁ-বোধক হাদীস না-বোধক হাদীসের উপর অগ্রাধিকার পাবে।

3️⃣একদা আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর [রাযিয়াল্লাহু আনহু] এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সালাতে রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু হতে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করছে। তিনি তখন বললেন, তুমি এটা কর না। কারণ এগুলো সবই রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] করেছেন, তবে পরবর্তীতে বাদ দিয়েছেন।’ (সহীহ বুখারী, ১/১০২ পৃ, টীকা দ্র.)।অথচ উক্ত বর্ণনা মিথ্যা ও বাতিল। রাফ‘উল ইয়াদায়েনের প্রসিদ্ধ আমলকে প্রতিরোধ করার জন্য উক্ত মিথ্যা বর্ণনা রচনা করা হয়েছে। কারণ উক্ত বর্ণনা কোন হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না। যেমন মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদের ভাষ্যকার বলেন,
‘কিন্তু এই আছারের সন্ধান কোন মুহাদ্দিস কোন হাদীস গ্রন্থে পাননি। বরং ইমাম বুখারী তার ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর [রাযিয়াল্লাহু আনহু] রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন।’ [মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ, তাহক্বীক্ব : ড. তাক্বিউদ্দীন নাদভী হা/১০৪-এর ব্যাখ্যা দ্র.]। অথচ ‘হেদায়া’ কিতাবে বলা হয়েছে, وَاَلَّذِىْ يُرْوَى مِنْ الرَّفْعِ مَحْمُوْلٌ عَلَى الِابْتِدَاءِ كَذَا نُقِلَ عَنِ ابْنِ الزُّبَيْرِ ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে, তা মূলত ইসলামের প্রথম যুগের বিষয়। যেমন: ইবনু যুবাইর [রাযিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত হয়েছে’ [হেদায়া ১/১১১ পৃ.]। সেই সাথে হেদায়ার টীকাকার হাশিয়ার মধ্যে ইবনু যুবাইরের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। [হেদায়াহ ১/১১১ পৃ., টীকা নং-৬; আল-ইনায়াহ শারহুল হেদায়াহ ২/৪ পৃ.]। তাছাড়া বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদকমণ্ডলী টীকায় উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। [আল-হিদায়াহ ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৬]। অথচ তার যে কোন ভিত্তি নেই সে বিষয়টি লক্ষ্য করেননি। এই মিথ্যাচার সম্পর্কে অনুবাদক মণ্ডলীকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করলে তারা কী জবাব দিবেন?

আরো আফসোসের বিষয় হল,নইমাম বুখারী [রাহিমাহুল্লাহ] সহীহ বুখারীতে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের পাঁচটি হাদীস পেশ করেছেন। সেই হাদীসগুলোকে রদ করার জন্য তার টীকায় ভাষ্যকার আহমাদ আলী সাহারাণপুরী উক্ত মিথ্যা বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। [সহীহ বুখারী (ভারতীয় ছাপা) ১/১০২ পৃ., টীকা দ্র.]। অনুরূপভাবে আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল-বুখারীতে রাফঊল ইয়াদায়েনের হাদীস গুলোকে যবাই করার জন্য উক্ত বানোয়াট বর্ণনা পেশ করা হয়েছে এবং এই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতকে বাতিল আখ্যা দেয়া হয়েছে। [সহীহ আল-বুখারী ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২১-৩২২]। অনুবাদক মণ্ডলী এবং প্রকাশক বিচারের মাঠে আল্লাহর সামনে কী জবাব দিবেন?

সুধী পাঠক! এটাই হল ফেক্বহী গ্রন্থের আসল চেহারা। মাযহাবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হাদীসের উপর এভাবেই আক্রমণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর [রাযিয়াল্লাহু আনহু] এর উপর মিথ্যাচার করা হয়েছে। কারণ তিনি যে নিজেই রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন। তার প্রমাণে ইমাম বুখারী সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

আত্বা [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, আমি আবু সাঈদ খুদরী, ইবনু ওমর, ইবনু আব্বাস ও ইবনু যুবাইর [রাযিয়াল্লাহু আনহুম] কে দেখেছি, তারা সকলেই সালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন। [মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৪৪৫; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৫২৫; সনদ সহীহ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪-এর আলোচনা দ্র.; বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদায়েন হা/১৬ ও ৫৭]।
.
পরিশেষে, রাফ‘উল ইয়াদায়েনের আমল রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা অনুমোদিত। রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়েও রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে হবে। এটা তিন ইমামের মাযহাব এবং অন্যান্য অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফক্বীহর মাযহাব। ইমাম মালেকও এর উপরই মৃত্যু বরণ করেছেন।(আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নাবী, পৃঃ ১২৮-১২৯।)। তাই সকলকে সহীহ দলীলের দিকে ফিরে আসতে হবে। মনগড়া বানোয়াট বর্ণনা ও প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়ঃ
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।