গানের সুরে কুরআন তিলাওয়াত করার বিধান

প্রশ্ন: গানের সুরে কুরআন তিলাওয়াত করার বিধান কি? বিস্তারিত জানতে চাই
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আল-কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা। কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। এর সবচেয়ে বড় মু‘জিযা হল, এটি মহান আল্লাহর কালাম।এই কুরআনই নবী (ﷺ) এর সর্বশ্রেষ্ঠ ও জীবন্ত মু‘জিযা। এটাই একমাত্র মু‘জিযা, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। কেননা নবী (ﷺ)-ই শেষ নবী হওয়ায় তাঁর দাওয়াত ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। সুতরাং তাঁর শেষ্ঠ মু‘জিযা এই কুরআনও ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে।মহান আল্লাহ বলেন, এটি এক বরকতময় কিতাব।এটি আমরা আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা ছোয়াদ: ২৯)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘আমরা আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, সবকিছুর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে এবং মুসলিমদের জন্য হেদায়াত,রহমত ও সুসংবাদ স্বরূপ।’ (সূরা নাহল ৮৯, ১০২)। এজন্য কুরআনের প্রত্যেকটি অক্ষর, শব্দ, বাক্য, আয়াত ও সূরা, রহমত, বরকত, হেদায়াত, প্রশান্তি, মর্যাদাপূর্ণ ও নেকীতে পরিপূর্ণ। যখনই আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করা হয়, তখনই এগুলো নাযিল হয়। এতে মুমিন ব্যক্তির ঈমানও বৃদ্ধি পায়। কারণ কুরআন বরকতপূর্ণ।মহান আল্লাহ বলেন, আর কুরআন নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন আপনি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পারেন ধীরে ধীরে এবং আমরা তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০৬) যে অন্তর কুরআন মুখস্থ করেছে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না। (দারেমী, হা/৩৩১৯, সনদ সহীহ)। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে প্রত্যেক হরফের বিনিময়ে রয়েছে দশ নেকী। (মুসতাদরাক হাকিম: হা/২০৮০, সনদ সহীহ)। আবার যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে এবং তা তার জন্য কঠিন অনুভূত হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব।’ (সহীহ মুসলিম: হা/৭৯৮) সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিক্ষা করে ও তা অপরকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী, হা/৫০২৭)।
.
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল সুন্দর ও সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করা। সুমধুর কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব। কেননা সুমধুর সুর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহ তা‘আলাও তা পসন্দ করেন। তাছাড়া যে ব্যক্তি সুন্দর করে তেলাওয়াত করে না; সে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উম্মত না। রাসূল (ﷺ) বলেন, حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيدُ الْقُرْآنَ حُسْناً، ‘তোমরা কুরআনকে তোমাদের মধুর সুরে সুন্দর করে পড়বে। কারণ সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়।’ (আবূদাঊদ হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/২১৯৯, ২২০৮; সহীহাহ হা/৭৭১)।

অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন, مَا أَذِنَ اللهُ لِشَىْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِىٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ، মহান আল্লাহ অন্য কিছু এতো মনোযোগ দিয়ে শুনেন না, যেভাবে তিনি নাবীর সুমধুর কন্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে কুরআন পাঠ শুনেন। ’(মুসলিম হা/৭৯২; আবূদাঊদ হা/১৪৭৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৫২৫)।তিনি আরো বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ ‘যে ব্যক্তি (তারতীল সহকারে) সুর করে কুরআন পড়ে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৫২৭; মিশকাত হা/২১৯৪)।

পবিত্র কুরআন মাজীদকে সুন্দর কণ্ঠে তিলাওয়াত করা শারী‘আতের নির্দেশ। কুরআনকে সুর দিয়ে পড়লে আরো সুন্দর হয়। এ ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘সুমধুর কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আর তা নিষিদ্ধ নয়, কেননা সৌন্দর্য বর্ধক জিনিস সেই বস্ত্তরই অন্তর্ভুক্ত। ব্যাখ্যাকার আল-মানাবী (রহঃ) বলেন, আসলে উপরোক্ত হাদীস দ্বারা তারতীল সহ কুরআন তিলাওয়াতের উপর উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে। (ফায়যুল কাদীর ৪/৬৮, ৪৫৭৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا ‘আর ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত কর।’ (মুযযাম্মিল ৭৩/৪)। অর্থাৎ কুরআন তাজবীদসহ সুমধুর কণ্ঠে তিলাওয়াত কর। কালামুল্লাহকে সুর করে পড়লে মানুষ বিমোহিত হয়। একদা রাসূল (ﷺ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) এর তিলাওয়াত শুনে বললেন, لَقَدْ أُوتِيْتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيْرِ آلِ دَاوُدَ، ‘তোমাকে দাঊদ (আঃ) এর কণ্ঠস্বর দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারী হা/৫০৪৮; মুসলিম হা/৭৯৩; মিশকাত হা/৬১৯৪)।
.
সুললিত কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব হলেও গানের সুরে তিলাওয়াত করা শরীয়ত সম্মত নয়। বরং নিষিদ্ধ এবং এটি ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামত। রাসূল (ﷺ) বলেন, بَادِرُوْا بِالْمَوْتِ سِتًّا، إمْرَةَ السُّفَهَاءِ، وَكَثْرَةَ الشَّرْطِ، وَبَيْعَ الْحُكْمِ، وَاسْتِخْفَافٌ بِالدَّمِ، وَقَطِيعَة الرَّحِم وَنَشْوًا يَتَّخِذُونَ الْقُرْآنَ مَزَامِيرَ، يُقَدِّمُونَهُ لِيُغَنِّيَهُمْ، وَإِنْ كَانَ أَقَلَّهُمْ فِقْهًا. ‘ছয়টি বিষয় আসার পূর্বে মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর।

১. মূর্খদের নেতৃত্ব,

২. অধিকহারে পুলিশ নিয়োগ,

৩. বিচারের ফায়সালা ক্রয়-বিক্রয়,

৪. রক্তপাতকে হালকা মনে করা,

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও

৬. বাদ্যযন্ত্রের সুরে কুরআন তিলাওয়াত করা, গানের সুরে তিলাওয়াতের জন্য তাদের প্রাধান্য দেওয়া যদিও তারা জ্ঞানে স্বল্প।’’(আহমাদ হা/১৬০৮৩; সিলসিলা সহীহাহ হা/৯৭৯ সহীহুল জামে‘ হা/২৮১২)।
.
প্রসিদ্ধ তাবেঈ আ’মাশ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,এক ব্যক্তি আনাস (রাঃ) এর নিকট গানের সুরে কুরআন তেলোয়াত করল। আনাস (রাঃ) সেটা অপছন্দ করেলন। (সুনানে দারেমী হা/৩৫০২, ৩৫৬৬)।
.
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] আলী ইবনে সাঈদের বর্ননায় বলেন, তারা কুরআন কে গানের সুরে পড়াকে বিদআত মনে করতেন।(সুনানে দারেমী হা/৩৫০৩, ৩৫৬৭ সনদ জাইয়েদ (উত্তম) ইবনুল কাইয়ুম রহঃ যাদুল মা’আদ, প্রথম খন্ড পৃ৪৬৬)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে গানের সুরে কোরআন তেলাওয়াত করার বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গায়কদের পদ্ধতিতে কুরআন তেলোয়াত করা জায়েয নয়। বরং আমাদের উচিত রাসূল (ﷺ) এবং তার সাহাবী ও তাদের অনুসারীদের পদ্ধতিতে বিনয়ী হয়ে কুরআন তেলোয়াত করা। (শাইখ ইবনে বাজের মোট ফতোয়া ও প্রবন্ধ (৯/২৯০)।
.
পরিশেষে, উপরিউক্ত আলোচনা হতে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য এক অনন্য মু‘জিযায় ভরপুর। এবং সুললিত কন্ঠের কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর নিকটে পছন্দনীয়। তাই কুরআন মাজীদকে সুমধুর কণ্ঠে করুণ সুরে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। যাতে উপস্থিতির সংখ্যা বেড়ে যায়, আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং শ্রোতার মন প্রভাবিত হয়ে বিগলিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ইলমে তাজবীদের নিয়ম-কানুন এবং আয়াতের শব্দসমূহ ও বর্ণের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু কুরআনকে গানের সুরে পরিবর্তন করে পড়া নিঃসন্দেহে হারাম। মহান আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের মর্ম উপলদ্ধি করার তৌফিক দান করুক আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।