সালাতে কাতার সোজা করা এবং কাতারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিধান ও হুকুম

প্রশ্ন: সালাতে কাতার সোজা করা এবং কাতারের ধারাবাহিকতা তথা ইত্তিছালুছ ছফূফ বজায় রাখার বিধান ও হুকুম কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আল্লাহ তা’আলা বলেন, إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَ فِي سَبِيْلِهٖ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوْصٌ অর্থাৎ ’’নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ সমস্ত লোকদের ভালোবাসেন যারা তার পথে কাতারবন্দী হয়ে যুদ্ধ করে’’ (সূরাহ্ আস্ সফ ৬১: ৪)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَإِنَّا لَنَحْنُ الصَّافُّوْنَ অর্থাৎ ’’অবশ্যই আমরা কাতারবন্দী’’(সূরাহ্ আস্ সা-ফ্‌ফা-ত ৩৭: ১৬৫)। আর তিনি আমাদেরকে ঐভাবে কাতারবন্দী হওয়ার কথা বলেছেন যেভাবে মালায়িকাহ্ তাদের পালনকর্তার সামনে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ায়। আর কাতার সোজা করার অর্থ হচ্ছে একই পদ্ধতিতে সোজা লাইন,কাতারের মাঝখানের ফাঁকা বন্ধ করে কাঁধের সঙ্গে কাঁধ, পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো। ইবনু আবদুল বার ইসতিযকার গ্রন্থে বলেন, কাতার সোজা করার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ এবং পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশিদীনদের আ’মালের ব্যাপারে বিভিন্ন সানাদে অনেক আসার রয়েছে এবং এটা এমন বিষয় যাতে বিদ্বানদের মাঝে কোন মতানৈক্য নেই। তবে বিদ্বানগণ এর হুকুম ওয়াজিব না মানদুব এ ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন।
.
আয়নী বলেন,তা ইমাম আবূ হানীফাহ্,শাফি’ঈ ও মালিক এর নিকট সালাতের সুন্নাত। ইবনু হাযম দাবি করেন, নিশ্চয় তা ফরয। কারো মতে মানদূব। ইমাম বুখারী ওয়াজিব এর দিকে গিয়েছেন। যেমন তিনি তার সহীহ গ্রন্থে (যারা কাতার সোজা করবে না তাদের গুনাহ) এভাবে একটি অধ্যায় বেঁধেছেন। আয়নী বলেন, ইমাম বুখারী অধ্যায় বাঁধার বাহ্যিক দিক ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করছে যে, তিনি কাতার সোজা করা ওয়াজিব মনে করতেন। বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,‘সালাতে কাতার সোজা করা ওয়াজিব‌। (উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/৩, ৭/৩-১৩)। তবে সঠিক কথা এ ব্যাপারে এ ধরনের বর্ণনা কঠোর ধমক স্বরূপ। অন্যত্র বলেন, নির্দেশসূচক শব্দের দাবি অনুপাতে কাতার সোজা করা ওয়াজিব কথাটি ঠিক। কিন্তু তা সালাতের ওয়াজিবাতের অন্তর্ভুক্ত নয় যে, যখন কেউ তা ছেড়ে দিবে তার সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) বাতিল হয়ে যাবে অথবা সালাতে ঘাটতি হয়ে যাবে।(মিশকাতুল মাসাবিহ ১০৮৫ নং হাদীসের পরিচ্ছেদঃ দ্রষ্টব্য)।
.
জামা‘আতে সালাত আদায়ের সময় ইমাম ও মুক্তাদী কাতারে কখন এবং কিভাবে দাঁড়াবে?প্রথম কাতারের ফজিলত এবং ইক্বামত কখন দিতে হবে?
__________________________________
সালাতের নির্ধারিত সময় হলে ইমাম সাহেব সালাতের জন্য দাঁড়াবেন, তবে মুসল্লীদের দাঁড়ানোর ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে। শরী‘আতে মুসল্লীদের দাঁড়ানোর নির্ধারিত সময় উল্লেখ করা হয়নি, তারা চাইলে ইক্বামতের শুরুতে দাঁড়াতে পারেন, মাঝখানে অথবা শেষেও দাঁড়াতে পারেন। তবে মুয়াযযিন যদি ইমাম সাহেবের আগমনের পূর্বেই ইক্বামত শুরু করেন, সেক্ষেত্রে মুসল্লীরা ইমাম সাহেবকে দেখার পর দাঁড়াবেন। (ইবনে উসাইমীন, মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৩ তম খণ্ড,পৃ. ১৬)।
.
আবু ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, সালাতের ইক্বামত হলে আমাকে না দেখা পর্যন্ত তোমরা দাঁড়াবে না।’ (সহীহ বুখারী, হা/৬৩৭, ৬৩৮;সহীহ মুসলিম, হা/৬০৪; আবূ দাঊদ, হা/৫৩৯; মিশকাত, হা/৬৮৫)। এক্ষেত্রে সামনের কাতারগুলি আগে পূর্ণ করতে হবে। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১০৯৪, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ ২৪)। কেননা ফেরেশতাগণ আল্লাহর সম্মুখে এভাবেই কাতার দিয়ে থাকেন।(আবুদাঊদ হা/৬৬১ সালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৪)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যদি লোকেরা জানতো ১ম কাতারে কি নেকী আছে,তাহলে তারা লটারী করত। (বুখারী হা/৭২১, ফাৎহুল বারী সহ, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬২৮, সালাতের ফযীলতসমূহ’ অনুচ্ছেদ এ৩)। অবশ্য ১ম কাতারে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ ইমামের নিকটবর্তী থাকবেন, অতঃপর মর্যাদা অনুযায়ী অন্যান্যগণ। এ সময় মসজিদে বাজারের মত শোরগোল করা নিষেধ। (إِيَّاكُمْ وَهَيْشَاتِ الأَسْوَاقِ)। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/১০৮৮-৮৯ ‘সালাত’ অধ্যায় ৪, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ ২৪)।
.
কাতার সোজা করতে হবে এবং কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলাতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, سَوُّوا صُفُوفَكُمْ فَإِنَّ تَسْوِيَةَ الصُّفُوفِ مِنْ إِقَامَةِ الصَّلاَةِ ‘তোমরা কাতার সোজা কর, কেননা কাতার সোজা করা সালাত প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত‌।’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৮৭, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ ২৪)।আবু মাসঊদ আনসারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতের শুরুতে আমাদের কাঁধগুলিতে হাত দিয়ে পরস্পরে মিলিয়ে দিতেন এবং বলতেন, اسْتَوُوا وَلاَ تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ ‘তোমরা কাতার সোজা কর,বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ো না। তাতে তোমাদের অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যাবে।’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৮৮, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ ২৪) আনাস (রাঃ) বলেন, وَكَانَ أَحَدُنَا يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَ قَدَمَهُ بِقَدَمِهِ ‘আমাদের মধ্য থেকে একজন পরস্পরের কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলিয়ে দিতেন।’ সাহাবী নুমান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَرُكْبَتَهُ بِرُكْبَةِ صَاحِبِهِ وَكَعْبَهُ بِكَعْبِهِ ‘অতঃপর দেখলাম যে, একজন ব্যক্তি মুসল্লীদের পরস্পরের কাঁধে কাঁধ, হাঁটুতে হাঁটু ও গোড়ালিতে গোড়ালি মিলিয়ে দিচ্ছেন।'(আবুদাঊদ হা/৬৬২ ‘সালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৪)।যার ভিত্তিতে ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে بَابُ إِلْزَاقِ الْمَنْكِبِ بِالْمَنْكِبِ وَالْقَدَمِ بِالْقَدَمِ فِى الصَّفِّ ‘সালাতের কাতারে কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো অনুচ্ছেদ।’ (বুখারী হা/৭২৫, ফৎহুল বারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৭৬)।এখানে পা মিলানো অর্থ পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দেওয়া। যাতে কোনরূপ ফাঁক না থাকে এবং কাতারও সোজা হয়। বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে أَقِيْمُوْا صُفُوْفَكُمْ وَ تَرَاصُّوْا ‘তোমরা কাতার সোজা কর এবং পরস্পরে ভালভাবে (কাঁধ ও পা) মিলাও।’ (বুখারী হা/৭১৯, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৭২; ঐ, মিশকাত হা/১০৮৬ ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪; মির‘আত ৪/৪)।
.
আবুদাঊদের অন্য বর্ণনায় এসেছে, حَاذُوْا بَيْنَ الْمَنَاكِبِ وَسُدُّوا الْخَلَلَ… وَلاَ تَذَرُوْا فُرُجَاتٍ لِلشَّيْطَانِ ‘কাঁধগুলি সমান কর ও ফাঁক বন্ধ কর এবং শয়তানের জন্য কোন জায়গা খালি ছেড়োনা। ‘কেননা আমি দেখি যে,শয়তান ছোট কালো বকরীর ন্যায় (كأَنَّها الْحَذَفُ) তোমাদের মাঝে ঢুকে পড়ে।’ (আবুদাঊদ হা/৬৬৬-৬৭; মিশকাত হা/১১০২, ১০৯৩, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪) ইবনু হাজার বলেন, নু‘মান বিন বাশীরের বর্ণনার শেষাংশে كَعْبَه بكَعْبِه ‘গোড়ালির সাথে গোড়ালি’ কথাটি এসেছে। এর দ্বারা পায়ের পার্শ্ব বুঝানো হয়েছে, পায়ের পিছন অংশ নয়, যেমন: অনেকে ধারণা করেন।’ (আবুদাঊদ হা/৬৬২; বুখারী হা/৭২৫; ফাৎহুল বারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, ‘কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো’ অনুচ্ছেদ-৭৬, ২/২৪৭ পৃঃ)। এখানে মুখ্য বিষয় হলো দু’টি: কাতার সোজা করা ও ফাঁক বন্ধ করা। অতএব পায়ের সম্মুখভাগ সমান্তরাল রেখে পাশাপাশি মিলানোই উত্তম। পুরুষ ও মহিলা মুসল্লী স্ব স্ব কাতারে দু’পা স্বাভাবিক ফাঁক করে দাঁড়াবেন। যাতে পায়ের মাঝখানে নিজের জুতা জোড়া রাখা যায়। (আবুদাঊদ হা/৬৫৪-৫৫ ‘সালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯০)। দেহের ভারসাম্যের অধিক পা ফাঁক করবেন না। মহিলা মুসল্লী তার দুই গোড়ালি একত্রিত করে দাঁড়াবেন না। এগুলি স্রেফ কুসংস্কার মাত্র। পরস্পরে কাঁধ, হাঁটু ও গোড়ালি মিলানোর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে বানোয়াট যুক্তিতে নিয়মিতভাবে পরস্পরে পা ফাঁক করে কাতার দাঁড়ানোর মধ্যে কোন নেকী নেই, স্রেফ গোনাহ রয়েছে। এই বাতিল রেওয়াজ থেকে দ্রুত তওবা করে পায়ে পা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই ভাই হয়ে কাতার দাঁড়ানো কর্তব্য। উল্লেখ্য যে, দুই পিলারের মাঝখানে কাতার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। (আবুদাঊদ হা/৬৭৩, ‘সালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।