সালাতের সুতরা সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: সুতরা কাকে বলে? সুতরার বিধান কি?সুতরাহ্‌ কিসের হবে? মুসল্লির সামনে দিয়ে পারাপারের বিধান কি? মুসল্লীর সামনে সুতরা রেখে চলে যাওয়া যাবে কি? সুতরা বিহীন অবস্থায় একজন মুসুল্লীর কতটুকু সামনে দিয়ে অতিক্রম করা যাবে বিনা সুতরায় নামায কখন বাতিল হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সুতরাহ (আরবি: سترة‎‎): সুতরাহ শব্দের অর্থ আড়াল করার বস্তু। অর্থাৎ এটা হলো নামাজের সময় ব্যবহৃত একটি বস্তু,যা তার সামনে দিয়ে চলমান সবকিছু থেকে নামাজ অবস্থাকালীন তাকে আলাদা করে রাখে কমপক্ষে তিন হাত বা এর কম দুরত্বে সুতরা রেখে নামাজ পড়া হয়। এর উচ্চতা হয় কমপক্ষে এক হাত। প্রস্থে যেকোনো পরিমাণ হতে পারে।

➤সালাতে সুতরার রাখার বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
সালাত আদায়ের সময় নামাযীর সামনে বেয়ে কেউ পার হবে না, এমন ধারণা থাকলেও সামনে সুতরাহ্‌ রেখে নামায পড়া কারো মতে ওয়াজিব আবার কারো মতে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ।[সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮২পৃ: ইবনে উসাইমিন ফতোয়ায় আরকানুল ইসলাম]।

যেমন সফরে, বাড়িতে, মসজিদে, হারামের মসজিদদ্বয়ে সর্বস্থানে একাকী ও ইমামের জন্য সুতরাহ্‌ ব্যবহার করা জরুরী। মহানবী (ﷺ) বলেন,“সুতরাহ্‌ ছাড়া নামায পড়ো না।” [সহীহ ইবনে খুযাইমাহ্‌, ৮০০]।

➤সুতরাহ্‌ কিসের হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কর্তৃক বিভিন্ন প্রকার সুতরাহ্‌ প্রমাণিত। যেমন: কখনো তিনি মসজিদের থামকে সামনে করে নামায পড়তেন।[সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮২পৃ:]।

ফাঁকা ময়দানে নামায পড়লে এবং আড়াল করার জন্য কিছু না পেলে সামনে বর্শা গেড়ে নিতেন। আর লোকেরা তাঁর পিছনে বিনা সুতরায় নামায পড়ত। [বুখারী ৪৯৪, ৪৯৮] কখনো বা নিজের সওয়ারী উটকে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে তাকে সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়তেন। [বুখারী ৫০৭]। কখনো জিনপোশ (উটের পিঠে বসবার আসন) কে সামনে রেখে তার কাষ্ঠাংশের সোজাসুজি নামায পড়তেন।[বুখারী ৫০৭]।

তিনি বলতেন,“তোমাদের কেউ যখন তার সামনে জিনপোশের শেষে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত কিছু রেখে নেয় তখন তার উচিৎ (তার পশ্চাতে) নামায পড়া এবং এরপর তার সম্মুখ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে কোন পরোয়া না করা।” [সহীহ মুসলিম ৪৯৯]।

একদা তিনি একটি গাছকে সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়েছেন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ)। কখনো তিনি আয়েশা (রাঃ) এর খাটকে সামনে করে নামায পড়েছেন। আর ঐ সময় আয়েশা (রাঃ) তার উপর চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতেন। [বুখারী ৫১১]।

সুফয়্যান বিন উয়াইনাহ্‌ বলেন, তিনি শারীককে কোন ফরয নামায পড়ার সময় তাঁর টুপীকে সামনে রেখে সুতরাহ্‌ বানাতে দেখেছেন। [আবূদাঊদ, সুনান ৬৯১]।

প্রকাশ যে, কিছু না পেলে দাগ টেনে নেওয়ার হাদীস সহীহ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৩৪, যইফ ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১৯৬, ৯৪৩, যইফ জামে ৫৬৯নং)।

সুতরাহ্‌ হবে উটের পিঠে স্থাপিত জিনপোশের পেছনে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত (কম-বেশী একহাত, আধ মিটার বা ৪৭ সেমি. উঁচু) কোন বস্তু । কোন দাগ সুতরাহ্‌ বলে গণ্য হবে না। তবে যে বস্তু মাটি বা মুসাল্লা থেকে একটুও উঁচু হয়ে থাকে তাকেই সুতরাহ্‌ বলে ধরে নেওয়া যাবে।[আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৮৪) প্রকাশ যে, মুসাল্লা, চাটাই বা কার্পেটের শেষ প্রান্তকে সুতরাহ্‌ বলে গণ্য করা যাবে না। [ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৭ সালাতে মুবাশ্বির]।

➤মুসল্লীর সামনে দিয়ে পারাপারের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
মুসল্লীর সম্মুখ দিয়ে যাওয়া নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মুসল্লীর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রমকারী যদি জানত যে, এতে তার কত বড় পাপ রয়েছে, তাহলে তার জন্য সেখানে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ বছর দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম হতো অতিক্রম করে চলে যাওয়ার চাইতে। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৭ সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সুৎরা’ অনুচ্ছেদ-৯]।

ইমাম ও সুতরার মধ্য দিয়ে অতিক্রমকারীকে হাদীসে ‘শয়তান’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।[বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৭]। এজন্য কিবলার দিকে লাঠি, দেওয়াল, মানুষ বা যেকোন বস্ত্ত দ্বারা মুসল্লীর সম্মুখে সুতরা বা আড়াল করতে হয়। [সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৩,৭৭৯,৭৭৭ ‘সুৎরা’ অনুচ্ছেদ-৯]।

তবে জামা‘আত চলা অবস্থায় অনিবার্য কারণে মুক্তাদীদের কাতারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা জায়েয আছে। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৮০]।

সিজদার স্থান থেকে সুতরার মধ্যে একটি বকরী যাওয়ার মত ফাঁকা রাখা আবশ্যক। [বুখারী হা/৪৯৬; মুসলিম হা/১১৩৪; ছিফাত, পৃঃ ৬২]।অতএব মসজিদে বা খোলা স্থানে মুসল্লীর সিজদার স্থান হতে একটি বকরী যাওয়ার মত দূরত্ব রেখে অতিক্রম করা যেতে পারে। তবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাই উত্তম।

➤মুসল্লীর সামনে সুতরা রেখে চলে যাওয়া:
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে বিশেষ করে শহরের মসজিদ গুলোতে মুসল্লীর সামনে সুতরা রেখে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেশী দেখা যায়।অথচ শরীআতে এর কোন অনুমোদন নেই বা প্রমান নেই। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর যুগে এ ধরনের কৌশলের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং মুসল্লীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করার চেয়ে ৪০ বছর যাবৎ বসে থাকা উত্তম বলা হয়েছে। বর্তমান পদ্ধতিতে যাওয়া বৈধ হলে রাসূল (ﷺ) তা বলে যেতেন। সুতরাং মুসল্লীর সামনে সুতরা দিয়ে অতিক্রম করা আর এমনি চলে যাওয়া একই সমান। এই অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। তবে যদি মুসল্লীর অবস্থান দূরে থাকে, সেক্ষেত্রে সুতরা না থাকলেও মুসল্লীর সিজদার স্থান থেকে একটি বকরী যাবার দূরত্ব রেখে অথবা তিন হাত দূর থেকে অতিক্রম করলে দোষ নে। [সহীহ বুখারী, আহমাদ, মুসলিম, ছিফাত পৃঃ ৬২]। তবে অপেক্ষা করাই উত্তম।

➤সুতরা বিহীন সালাতরত অবস্থায় একজন মুসল্লীর কতটুকু সামনে দিয়ে অতিক্রম করা যাবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

উক্ত অবস্থায় যরূরী প্রয়োজনে মুসল্লীর সিজদার স্থানের বাহির দিয়ে অতিক্রম করা যাবে। [সহীহ বুখারী হা/৫০৯, মুসলিম হা/৫০৫)। উক্ত হাদীছে بين يدي المصلي দ্বারা মুসল্লীর সিজদার স্থান পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে। [ইবনু হাজার, ফৎহুলবারী ঐ হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ; ফাতাওয়া ওছায়মীন, মাসআলা নং ৬২৪]।

মসজিদ ছাড়া অন্যত্র একাকী সালাত আদায়কারী মুসল্লী সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করবেন। [আবুদাঊদ হা/৬৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪১]। যদি সুতরা না রেখে সালাত আদায় করেন, তবে তার সিজদার স্থান পর্যন্ত জায়গার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা যাবে না।[সহীহ বুখারী হা/৫১০; মুসলিম হা/৫০৭; মিশকাত হা/৭৭৬]।

রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোন বস্ত্তকে সম্মুখে রেখে সালাত আদায় করবে যা তাকে লোকদের থেকে সুৎরা বা পর্দা স্বরূপ হবে, এমন অবস্থায় তার সম্মুখ থেকে যদি কেউ অতিক্রম করতে চায়,তাহলে সে যেন তাকে বাধা দেয়।’[সহীহবুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৭ সালাত’ অধ্যায় ‘সুতরা’ অনুচ্ছেদ। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য; মির‘আতুল মাফাতীহ হা/৭৮৬-এর ব্যাখ্যা; উছায়মীন, আরকানুল ইসলাম ২/৪৯৩ পৃঃ, প্রশ্নোত্তর সংখ্যা ২৬৭]। নোট আত তাহরীক]।

➤বিনা সুতরায় কখন সালাত বাতিল হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
সুতরা রেখে নামায পড়লে এবং তার পশ্চাৎ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে নামাযীর নামাযে কোন ক্ষতি হয় না। [সহীহ বুখারী ৪৯৯, সহীহ মুসলিম ২২৫]।

সুতরার ভিতর দিয়েও কোন পুরুষ, শিশু বা পশু পার হয়ে গেলে নামাযীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে ঠিকই, তবে নামায একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না।পরন্তু বিনা সুতরায় নামায পড়লে এবং সামনে দিয়ে সাবালিকা মেয়ে, গাধা বা মিশমিশে কালো কুকুর পার হয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যায়।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “(সুতরাহ্‌ না হলে) সাবালিকা মেয়ে, গাধা ও কালো কুকুর নামায নষ্ট করে ফেলে।” আবূ যার বললেন,‘হে আল্লাহর রসূল! হ্‌লুদ ও লাল না হয়ে কালো কুকুরেই নামায নষ্ট করে তার কারণ কি?’বললেন, “কারণ, কালো কুকুর শয়তান।” [সহীহ মুসলিম ৫১০, তিরমিজি ৩৩৮, আবু দাউদ৭০২]।

ইমাম তিরমিজি রহঃ বলেন, আবু যার-এর হাদীসটি হাসান সহীহ। কিছু সংখ্যক বিদ্বান এ হাদিসের ভিত্তিতে বলেছেন, গাধা, স্ত্রীলোক ও কালো কুকুর নামাযীর সামনে দিয়ে গেলে নামায নষ্ট হয়ে যায়। ইমাম আহমাদ বলেন, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, কালো কুকুর নামায নষ্ট করে দেয়; কিন্তু গাধা এবং স্ত্রীলোকের ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। ইমাম ইসহাক বলেন, কালো কুকুর নামায নষ্ট করে দেয়। এছাড়া আর কোন কিছু নামায নষ্ট করতে পারে না। [টিকা জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৩৮]।

তবে নাবালিকা মেয়ে অতিক্রম করলে নামায নষ্ট হয় না। একদা বানী আব্দুল মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে তাঁর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। আর এতে তিনি নামায ভাঙ্গলেন না। [আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, নাসাঈ, সুনান ৭২৭]।

যেমন নিজের স্ত্রী বা কোন মহিলা নামাযীর সামনে ঢাকা নিয়ে অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রাত্রে তাহাজ্জুদ পড়তেন, আর আয়েশা (রাঃ) তাঁর সামনে জানাযার লাশের মত শুয়ে ঘুমাতেন। [বুখারী ৫০৮, মুসলিম, সহীহ ৫১২, মিশকাত ৭৭৯]।

যেমন তিনি কখনো কখনো চাদরের ভিতর থেকে পায়ের দিকে চুপে চুপে নিজের প্রয়োজনে বের হয়ে যেতেন। এতেও তাঁর নামাযের কোন ক্ষতি হ্‌তো না। (ঐ) এক বর্ণনায় আছে, ‘তখন ঘরে বাতি ছিল না।’ [সহীহ বুখারী ৫১৩, সহীহ মুসলিম,৫১২]।

প্রকাশ যে, কোন মহিলা-নামাযীর সামনে বেয়ে (বিনা সুতরায়) কোন (সাবালিকা) মেয়ে পার হলেও নামায নষ্ট হয় না। [আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২৩৫৬ মুহাল্লা ৪/১২, ২০,(নোট সালাতে মুবাশ্বির)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।