শাবান মাস

শাবান শব্দের অর্থ কি? শাবান মাসে আমাদের করণীয় কী? রাসূল (ﷺ) কেন শাবান মাসে অধিক সিয়াম রাখতেন? ১৫ই শাবানের পর সিয়াম রাখার বিধান কি? ১৫ই শাবান শবে-বরাত পালন করার হুকুম কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আরবী হিজরী সনের অষ্টম মাস হলো শাবান মাস। শাবান শব্দের বহুবচন হলো শা’বানাত ও শা’বিন। শব্দটি এসেছে আরবি ধাতু “শ’আবান” শব্দ থেকে শব্দটির দুটি অর্থ হয়,বিভক্ত করা বা পৃথক করা। এই দুটি অর্থের দিক থেকে শাবান মাসের নামটির উদ্ভব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, রজব মাসের শান্তির পর আরবের লোকেরা যুদ্ধের জন্য শাবান মাসে বেরিয়ে পরতো,আবার পানির সন্ধানে আরবের মানুষ এই সময় ছড়িয়ে পরতো বলে এই মাসের নাম শাবান। আবার কেউ বলেন,গাছ তার শাখা ছড়িয়ে দিতো বলে এই মাসের নাম শাবান। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭২৬)

▪️শাবান মাসে আমাদের করণীয় কী?
___________________________________
বছরের বারোটি মাসের মধ্যে সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ রামাযান মাসের আগমনবার্তা নিয়ে যে মাসটি আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়; তা হলো শাবান মাস। যা খানিকটা ফরয সালাতের পূর্বে নফল সালাত আদায়ের ন্যায়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক বেশি সিয়াম পালন করতেন। তাই রাসূল (ﷺ)-এর উম্মত হিসেবে আমাদের জন্য এমাসে অধিক সিয়াম পালন করা মুস্তাহাব। সিয়ামের পাশাপাশি আর যতো দূর পারা যায় অন্যান্য নফল ইবাদত করার চেষ্টা করা। যেমন: কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত আদায় করা, দান-সাদাক্বা ইত্যাদি।
.
আম্মাজান আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একাধারে নফল সিয়াম পালন করে যেতেন, এমনকি আমরা বলাবলি করতাম যে, হয়তো তিনি সিয়াম ছাড়বেন না। আবার কখনো তিনি লাগাতার সিয়াম রাখতেন না। অবস্থা এমন হতো যে আমরা গুঞ্জন করতাম, মনে হয় তিনি আর সিয়াম রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে একমাত্র রামাযান মাস ব্যতীত কখনো পূর্ণ সিয়াম পালন করতে দেখিনি। আমি তাঁকে শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে অধিক সংখ্যক সিয়াম পালন করতে দেখিনি। (সহীহ বুখারী হা/১৯৬৯; সহীহ মুসলিম হা/১১৫৬)। উম্মু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রমযান ও শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে একাধিক্রমে রোযা রাখতে দেখিনি। (সুনানে নাসাঈ হা/২১৭৫; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৬০৪; শারহুস সুন্নাহ হা/১৭২০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১০২৫,শামায়েলে তিরমিযি হা/২২৭)। অপর বর্ননায় উসামা ইবনু যায়েদ বললেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি শাবান মাসে যে পরিমাণ সিয়াম পালন করেন অন্য কোনো মাসে আমি আপনাকে ঐ পরিমাণ সিয়াম পালন করতে দেখিনি। তিনি বললেন, ‘এটা এমন একটি মাস যে ব্যাপারে মানুষ বেখবর, যা রজব ও রামাযানের মধ্যকার একটি মাস। এটা এমন একটি মাস যাতে বান্দার আমলনামা রব্বুল আলামীনের নিকট উঠানো হয়। সুতরাং আমি ভালোবাসি যে, আমার আমল সিয়ামরত অবস্থায় আল্লাহর ‍নিকট উঠানো হোক। (মুসনাদে আহমদ হা/২১৭৫৩, নাসাঈ হা/২৩৫৭)। আরেক বর্ণনায় এসেছে আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) শাবান মাসে যত সিয়াম পালন করতেন অন্য কোনো মাসে তত সিয়াম পালন করতেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের সাধ্যে যতদূর সম্ভব আমল করো। কেননা, তিনি নেকী দেওয়া বন্ধ করবেন না, যতক্ষণ না তোমরা আমল করে ক্লান্ত হয়েছো…। (সহীহ বুখারী হা/১৯৭০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫০১১)। উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে শাবান মাসে সিয়াম রাখা।

▪️রাসূল ﷺ শাবান মাসে অধিক সিয়াম রাখতেন কেন?
_______________________________________
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শা’বান মাসে এত বেশি সিয়াম রাখার কারণ সম্পর্কে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। তাদের কয়েকটি মতামত নিম্নরূপ:
.
(১). শাবাস মাসে রাসূল (ﷺ)-এর অধিক সিয়াম রাখার কারন হিসবে একদল আলেম বলেন, রাসূল (ﷺ) সফরে ভ্রমণের জন্য বা অন্য কোন কারণে প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম রাখতে অক্ষম হয়েছিলেন, তাই তিনি শা’বানে সবগুলোকে একত্র করে রাখতেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোন স্বেচ্ছায় কাজ করতে শুরু করতেন, তখন তিনি তাতে অটল থাকতেন এবং যদি তিনি তা মিস করেন তবে পরে তা পূরণ করতেন।
.
(২). বলা হয় যে, রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীরা শা’বান মাসে রমজানের যে দিনগুলো সিয়াম রাখা মিস করত সেগুলি শাবানে পূরণ করতেন, তাই রাসূল (ﷺ)-এর জন্য সিয়াম রাখতেন। এটি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত বিষয়ের বিপরীত যে, তিনি রমজানে যে দিনগুলো মিস করেছেন তা শা’বান পর্যন্ত বিলম্বিত করতেন। কারণ, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে ব্যস্ত থাকতেন। (সহীহ বুখারী ১৯৫০, মুসলিম হা/১১৪৬)
.
(৩). বলা হয়েছিল যে, এটা এমন একটি মাস যার প্রতি মানুষ মনোযোগ দেয় না। উপরে উদ্ধৃত উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিসের কারণে এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সঠিক মত, যেখানে বলা হয়েছে: এটা এমন একটি মাস যে ব্যাপারে মানুষ বেখবর, যা রজব ও রামাযানের মধ্যকার একটি মাস। এটা এমন একটি মাস যাতে বান্দার আমলনামা রব্বুল আলামীনের নিকট উঠানো হয়। সুতরাং আমি ভালোবাসি যে, আমার আমল সিয়ামরত অবস্থায় আল্লাহর ‍নিকট উঠানো হোক। (মুসনাদে আহমদ হা/২১৭৫৩, নাসাঈ হা/২৩৫৭, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭২৬)
.
▪️১৫ই শাবানের পর সিয়াম রাখার বিধান কি?
_______________________________________
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত সিয়াম পালন করেন না,তাদের জন্য শেষের পনের দিন সিয়াম পালন করা উচিত নয়। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যখন শা‘বানের অর্ধেক হবে, তখন তোমরা সিয়াম রেখো না।’ (আবু দাঊদ হা/২৩৩৭; তিরমিযী হা/৭৩৮; মিশকাত হা/১৯৭৪।) উক্ত হাদীসে নিষেধাজ্ঞার অর্থ নিয়ে আহালুল আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, অধিকাংশ আলেমের মতে, এখানে নিষেধের অর্থ হলো হারাম। (দেখুন, আল-মাজমু’, ৬/৩৯৯-৪০০; ফাতহুল বারী ৪/৪২৯)। আবার কেউ কেউ, বলেছেন এখানে নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো এটি মাকরূহ, হারাম নয়।(আল-নাওয়াবী (রহঃ), রিয়াদ আল-সালিহিন পৃ.৪১২ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭২৬)।সুতরাং, এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ১৫ই শাবানের পর নতুন করে নফল সিয়াম শুরু করা যাবে না। যদি মানতের সিয়াম বাকি থাকে অথবা সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম, দাঊদী সিয়াম (একদিন পর পর যে সিয়াম রাখা হয়), ফরজ সিয়ামের কাজা প্রভৃতি রাখা যাবে সেগুলো এই হাদীসে উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়।

উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞার হাদীস সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞেস করা হলে,শাইখ বলেন, রাসূল (ﷺ) পুরো শাবান মাস সিয়াম রাখতেন, আবার কখনো কখনো তারচেয়ে কিছু কম সংখ্যক সিয়াম রাখতেন। যেমনটি আইশাহ ও উম্মে সালামাহর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে যে হাদীসে শাবান মাসের অর্ধেক অতিবাহিত হওয়ার পর রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে, সে হাদীসটি সহীহ। যেমনটি বলেছেন আল্লামাতুশ শাইখ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)। এই হাদীসের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অর্ধ শাবানের পর রোজা শুরু করা নিষিদ্ধ। অপরদিকে যে ব্যক্তি এই মাসের বেশিরভাগ দিন বা সম্পূর্ণ মাসই রোজা রাখে, সে সুন্নাহ পালন করে। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৩৮৫)

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] রিয়াদ আল-সালিহিনের তাফসীরে বলেছেন: “হাদিসটি সহীহ হলেও এতে নিষেধের অর্থ এই নয় যে এটি হারাম, বরং এটি কেবল মাকরূহ, যেমন কিছু আলেম হাদীসটির অর্থ বুঝেছেন। তবে যার নিয়মিত সিয়াম রাখার অভ্যাস আছে সে সিয়াম রাখবে, যদিও তা শা’বানের অর্ধেক পরেই হয়। (রিয়াদ আল-সালিহিনের তাফসীর,৩/৩৯৪)।উপসংহারে বলা যায়, শা’বানের দ্বিতীয়ার্ধে সিয়াম রাখা জায়েয নয় এবং তা হয় মাকরূহ বা হারাম, তবে যে ব্যক্তি নিয়মিত রোজা রাখার অভ্যাস রাখে বা যে শা’বানের প্রথমার্ধে রোজা রাখার পর অব্যাহত থাকে। নিষেধাজ্ঞা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। আর আল্লাহই ভালো জানেন। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭২৬)

▪️১৫ই শাবানের পর সিয়াম রাখা নিষেধ কেন?
_______________________________________
এই নিষেধাজ্ঞার কারণ এই যে, ক্রমাগত ধারাবাহিক ভাবে সিয়াম রাখলে একজন ব্যক্তিকে রমজানের সিয়াম রাখতে দুর্বল করে দিতে পারে। যদি বলা হয় যে, মাসের শুরু থেকে সিয়াম রাখলে সে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, তার জবাব হলো যে, যে ব্যক্তি শা’বানের শুরু থেকে সিয়াম রাখবে সে সিয়াম রাখতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তাই সিয়াম রাখা তার জন্য কম কঠিন হবে।আল-কারী বলেছেন: এখানে নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো এটি অপছন্দনীয়, এই উম্মাহর জন্য রহমত স্বরূপ। যাতে তারা রমজান মাসে তাদের রোজা রাখার দায়িত্বটি উদ্যমীভাবে পালনে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা সারা শাবান মাসে সিয়াম রাখবে তারা সিয়াম রাখতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তাই তাদের জন্য কষ্ট হবে না।(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭২৬)

▪️১৫ই শাবান শবে-বরাত পালন করার হুকুম কি?
_______________________________________
আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে ‘শবেবরাত’ বা ‘লায়লাতুল বারাআত’ বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফারসী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে শবেবরাত ‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়। লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়। সারা বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। এই রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে। এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা হয়। অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। আত্মীয়-স্বজন সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়। হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লে­ড়ে রাত কাটিয়ে দেয়। যারা কখনো সালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে সালাতে আল্ফিয়াহ’ বা ১০০ রাক‘আত সালাত আদায়ে রত হয়। যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করা হয়। সংক্ষেপে এই হলো এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র। (নোট আত তাহরীক)। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে উপরোক্ত সকল কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। কারণ, মহান আল্লাহর কিতাব পবিত্র কুরআন এবং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহয় ১৫ই শাবান তথা শবে-বরাত উপলক্ষে কোনো ইবাদত সাব্যস্ত হয়নি। তাই শবেবরাত উদযাপন করা এবং এ উপলক্ষে কোনো ইবাদত করা নিষিদ্ধ বিদ‘আত। শবেবরাত উদযাপনের সমর্থনে যে সমস্ত হাদীস পেশ করা হয়, তার সবগুলোই যঈফ অথবা মাওযূ‘। এটি উদযাপনে যদি বিশেষ কোনো ফযীলত থাকতো, তাহলে রাসূল (ﷺ) এবং তার ছাহাবীগণ অবশ্যই তা উদযাপন করতেন এবং ছহীহ সূত্রে তা বর্ণিত হতো। কিন্তু রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের যামানায় শবে-বরাতের নির্দিষ্ট কোন আমলের অস্তিত্ব ছিল না। রাসূল (ﷺ) বলেন,‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল,যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।'(সহীহ বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন; অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং সর্বোত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো দ্বীনে (মনগড়াভাবে) নতুন জিনিস সৃষ্টি করা এবং (এ রকম) সব নতুন সৃষ্টিই গুমরাহী (পথভ্রষ্ট)। (সহীহ মুসলিম হা/ ৮৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান হা/১০, সহীহ আত ষ-তারগীব হা/৫০, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ্ ১৭৮৫)। এ হাদীসগুলো ইসলামের মৌলিক নীতিমালার মূল এবং সকল প্রকার বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করার সুস্পষ্ট দলীল। ইমাম নাবাবী বলেছেনঃ অশ্লীল ও অপছন্দকর বিষয়কে বর্জন করার ব্যাপারে এ হাদীসটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য হাদীসটির সংরক্ষণ একান্তই প্রয়োজন। সহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, (مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدُّ) অর্থাৎ- যে ব্যক্তি এমন কাজ করলো যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং যাতে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুমোদন নেই, তা দীন বহির্ভূত এবং পরিত্যাজ্য। (সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮ ও ৪৩৮৫)
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটি (সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড) প্রদত্ত ফাতওয়া
প্রশ্ন: “আমার প্রশ্ন মধ্য শাবানের রাত প্রসঙ্গে। সূরাহ দুখানের এই আয়াত—‘এই রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয় (দুখান: ৪)’ দ্বারা কি মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য, নাকি বরকমতময় রমজান মাসের ২৭শের রাত তথা কদরের রাত উদ্দেশ্য? আর মধ্য শাবানের রাতে ইবাদত, জিকির, ক্বিয়াম ও কুরআন পাঠ করা এবং ১৪ই শাবানের দিনে রোজা রাখা কি মুস্তাহাব (বিধেয়)?” উত্তর: “প্রথমত, বিশুদ্ধ মতানুসারে এই আয়াতে উল্লিখিত রাতটি কদরের রাত, মধ্য শাবানের রাত নয়। দ্বিতীয়ত, আপনি যা উল্লেখ করেছেন তা ও অন্য কোনো ইবাদতের মাধ্যমে মধ্য শাবানের রাতকে নির্দিষ্ট করা মুস্তাহাব নয়। বরং এটি অন্য রাতগুলোর মতোই একটি (সাধারণ) রাত। এই রাতকে কোনো ইবাদতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত। আর আল্লাহই তাওফীক্বদাতা। হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগণের উপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।” ফাতওয়া প্রদান করেছেন— চেয়ারম্যান: শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)। ভাইস চেয়ারম্যান: শাইখ আব্দুর রাযযাক্ব আফীফী (রাহিমাহুল্লাহ)। মেম্বার: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন গুদাইয়্যান (রাহিমাহুল্লাহ)। মেম্বার: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ক্বাঊদ (রাহিমাহুল্লাহ)। [ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ; ফাতওয়া নং: ৭৯২৯; প্রশ্ন নং: ১; গৃহীত: সাহাব (sahab) ডট নেট] ·
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির আরেকটি ফাতওয়ায় বলা হয়েছে, মধ্য শাবানের রাতকে কোনো দু‘আ বা ইবাদতের মাধ্যমে নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ দলিল সাব্যস্ত হয়নি। এই রাতকে এসবের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত। যেহেতু নাবী (ﷺ) বলেছেন, “নিশ্চয় প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয় হলো বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা।” (সাহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭)। ফাতওয়া প্রদান করেছেন— চেয়ারম্যান: শাইখ আব্দুল আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)। মেম্বার: শাইখ সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) মেম্বার: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন গুদাইয়্যান (রাহিমাহুল্লাহ)। মেম্বার: শাইখ বাকার আবু যাইদ (রাহিমাহুল্লাহ)। [ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ; ফাতওয়া নং: ২১২৬৪; প্রশ্ন নং: ৮; গৃহীত: সাহাব (sahab) ডট নেট, ফাতওয়া দুটি অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ মৃধা] ·
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল সিয়াম পালন করা মুস্তাহাব। এছাড়া দৈনিক যে আমল ইবাদতগুলো কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত; যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, কুরআন তেলোয়াত, সকাল-সন্ধা যিকির, আইয়ামে বীযের সিয়াম ইত্যাদি সেগুলো নিয়মিত পালন করতে পারেন। এর বাহিরে নির্দিষ্ট করে ১৫ই শাবান কোন ইবাদত করা জায়েজ নয়। কারণ শবে-বরাত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জয়ীফ অথবা জাল। আর শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে সিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ। তবে হা যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল সিয়ামে অভ্যস্ত, তারা এমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে উক্ত নিয়তেই সিয়াম পালন করবেন, শবে-বরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হলে কেবল কষ্ট করা বিফলেই যাবে। কেননা বিদ‘আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত।(নাসাঈ হা/১৫৭৮, মিশকাত হা/১৬৫)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।