নবী মূসা আলাইহিস সালাম কি তোতলা ছিলেন

নবী মূসা আলাইহিস সালাম কি তোতলা ছিলেন এবং আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন। (সূরা ত্বহা; ২০/২৭)। উক্ত আয়াতের সঠিক তাফসির।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
প্রথম কথা হল নবী মূসা (আঃ) কি তোতলা ছিলেন কি ছিলেন না এই এই প্রশ্নের উত্তর জানা আমাদের জন্য জরুরি নয়। কেননা এই প্রশ্নের উত্তর জানার মধ্যে কল্যাণ-অকল্যাণ কিছুই নেই। এমনকি কিয়ামতের ময়দানেও মূসা (আঃ) তোতলা ছিলেন কিনা আমাদেরকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। তাই এ ধরণের অনর্থক প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে সতর্ক করে বলেন,আমি যে সম্পর্কে তোমাদের বলিনি,সে সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। কারণ, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতগণ তাদের নবীগণের নিকট অধিক প্রশ্নের কারণে এবং তাঁদের সাথে মতবিরোধের কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতএব, আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা তা যথাসাধ্য পালন করো এবং কোন বিষয়ে আমি তোমাদের নিষেধ করলে তা থেকে তোমরা বিরত থাকো। (সহীহ বুখারী হা/৭২৮৮, সহীহ মুসলিম হা/১৩৩৭, তিরমিযী হা/২৬৭৯)। তাই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন পরিহার করে বরং যে প্রশ্নগুলো জানার মাধ্যমে ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক বিশুদ্ধ করা যাবে। আমাদের উচিত সালফে-সালেহীনের মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত সহীহ আক্বীদার আলেমদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট দলিল সহ সেই প্রশ্নগুলো জেনে নেওয়া। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এমনটাই বলেছেন। তিনি বলেন, যেটা তোমরা না জানো সেটা জেনে নাও যারা জানে তাদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণসহ। (সূরা নাহল; ১৬/৪৩-৪৪)
.
দ্বিতীয়ত, নবী মূসা (আঃ) কি তোতলা ছিলেন কিনা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে পবিত্র কুরআনে কিংবা রাসূল (ﷺ) থেকে মুতাওয়াতির পর্যায়ে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি। তবে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত এবং ঐতিহাসিক ভাবে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ইসরাঈলী বর্ণনা
থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, শৈশবে মূসা (আঃ)-এর জিহ্বায় কিছুটা জড়তা ছিল। পরে যৌবনে আল্লাহর কাছে দু’আ করলে আল্লাহ তার দু’আ কবুল করেন এবং জড়তা দুর করেন। মূসা (আঃ) যে কয়েকটি বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করেছিলেন আল্লাহ সেটা কুরআনে উল্লেখ করে বলেন, মূসা বলল: ‘হে আমার রব! আমার বক্ষ আমার জন্য খুলে দাও (অর্থাৎ আমার মনে সাহস যোগাও)। আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও। আর জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সূরা ত্বাহা, আয়াত; ২৫-২৮)
.
উপরোক্ত চারটি আয়াতের মধ্যে ২৭ নং আয়াতে মূসা (আঃ) তাঁর জিহ্বার জড়তা দূর করার জন্য দু’আ করেছিলেন। উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনে কাসীর ও ইমাম আত-তাবারী এবং আল্লামা ওহাবা জুহাইলি (রহ.)বলেন, আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে। কারণ রিসালাত ও দাওয়াতের জন্য স্পষ্টভাষী ও বিশুদ্ধভাষী হওয়াও একটি জরুরী বিষয়। শৈশবে মূসা (আঃ)-এর মুখে আগুনের কয়লা লেগে তাঁর জিভ পুড়ে গিয়েছিল। কেননা ফেরাঊনের দাড়ি ধরে চপেটাঘাত করার জন্য মূসাকে ফেরাঊন হত্যা করতে চেয়েছিল। তাকে বাঁচানোর জন্য ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে তিনি বেঁচে যান। সেটি ছিল এই যে, তাকে অবোধ শিশু প্রমাণ করার জন্য ফেরাঊনের স্ত্রী দু’টি পাত্র এনে মূসার সামনে রাখেন। মূসা তখন জিবরাঈলের সাহায্যে মণিমুক্তার পাত্রে হাত না দিয়ে আগুনের পাত্রে হাত দিয়ে একটা স্ফূলিঙ্গ তুলে নিজের গালে পুরে নেন। এতে তার জিভ পুড়ে যায় ও তিনি তোৎলা হয়ে যান। ওদিকে ফেরাঊনও বুঝে নেন যে মূসা নিতান্তই অবোধ। সে কারণে তাকে ক্ষমা করে দেন। এছাড়া ফিরআউন মুসা আলাইহিস সালাম এর চরিত্রে যেসব দোষারোপ করেছিল; তন্মধ্যে একটি ছিল এই, “সে তার বক্তব্য পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করতে পারে না”। (সূরা আয-যুখরুফ; ৫২)। মূসা আলাইহিস সালাম তার দোআয় জিহ্বার জড়তা এতটুকু দূর করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, যতটুকুতে লোকেরা তার কথা বুঝতে পারে। বলাবাহুল্য, সে পরিমাণ জড়তা দূর করে দেন। যদিও এসব কাহিনী তাফসীরে কুরতুবী,
মাযহারী প্রভৃতি প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তবুও এগুলোর কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই। তাই তোতলামির বিষয়টি স্বাভাবিক ত্রুটি ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর,৭/২৩২ আত-তাবারী,খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা ১৫৯, ইসলামী সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৬৭৭৬৭, ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-২০২৩৮৪)
.
যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] কর্তৃক নাসাঈতে বর্ণিত ‘হাদীছুল ফুতূনে’ এসেছে, মূসা (আঃ) তখন আগুনের পাত্রে হাত দিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি ফেরাঊনের হাতে নিহত হওয়া থেকে বেঁচে যান। এ ঘটনাকে উক্ত হাদীসে ৩নং ফিৎনা বা পরীক্ষা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই বর্ণনায় আগুনে মুখ দিয়েছিলেন এমন কথা নেই। (দেখুন, ইমাম নাসাঈ সুনানুল কুবরা হা/১১২৬৩, মাজমাউয জাওয়াইদ, খণ্ড ৭, পৃ.৫৬-৬৬, তাফসীর তাবারী, খণ্ড ১৬, পৃ. ৬৪-৬৯)। উক্ত বর্ণনাটি সম্পর্কে আল্লামা মিজ্জি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, কয়েকটি অংশ ছাড়াও সাইয়্যিদুনা ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে এই বর্ণনার অধিকাংশই হাদীস নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ইসরাঈলী বর্ণনা। ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) তার শিক্ষক আল-মিজ্জি (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন এবং এটি সেই ঐতিহাসিক ইসরাঈলী বর্ণনা
থেকে নেওয়া হয়েছে, যা আমরা উদ্ধৃত বা বর্ননা করার অনুমতি পেয়েছি। (তাফসিরে ইবনে কাসীর, সূরা ত্বহা, আয়াত; ৩৯)। এছাড়াও এই ঘটনাটি তাফসিরের নির্ভরযোগ্য কিতাবে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন: তাফসীরুল বাগাভী, কুরতুবী ইত্যাদি। (সূরা ত্বাহা, আয়াত; ২৭, ইসলামী সাওয়াল-জাওয়াব ইংরেজি ভার্সন ফাতওয়া নং-১২৩৪৬৮) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।