শাওয়াল শব্দের অর্থ কি এবং শাওয়ালের ৬ টি সিয়ামের ফজিলত কি?

প্রশ্ন: শাওয়াল শব্দের অর্থ কি? শাওয়ালের ৬ টি সিয়ামের ফজিলত কি? ৬ সিয়ামে কীভাবে ১ বছরের নেকি হয়? শাওয়ালের সিয়াম আগে রাখা যাবে নাকি কাজা সিয়াম আগে রাখতে হবে? বিরতিহীন নাকি ভেঙে ভেঙে রাখা যাবে?
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উত্তর:

➤ শাওয়াল : شوال শব্দটি ‘شول’ মাসদার থেকে উদ্গত। অর্থ উত্তোলিত হওয়া, উত্তোলন করা বা বহন করা ইত্যাদি। এ মাসে উটনী বাচ্চা প্রসব করত এবং লেজ পিঠে করে রাখত। এ জন্যেই এই মাসের নাম হয়ে যায় শাওয়াল। প্রাক-ইসলামী যুগে এ মাসের নামকরণের সময় সম্ভবত: সবুজ ঘাসের অভাবজনিত কারণে উষ্ট্রের দুগ্ধ হত না, শুকিয়ে যেত। তাই একে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।শাওয়াল মাস হজ্জের মাসগুলোর প্রথম মাস। এ মাস থেকে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়।এছাড়া সহীহ হাদীস দ্বারা এ মাসের একটি ফযীলত প্রমাণিত। যে ব্যক্তির রমাযানের সিয়াম পূর্ণ হয়ে যাবে, তার জন্য শওয়াল মাসের ৬টি সিয়াম রাখা মুস্তাহাব। আর এতে তার জন্য রয়েছে বৃহৎ সওয়াব।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের সিয়াম পালন শেষে শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল’[সহীহ মুসলিম হা/১১৬৪; মিশকাত হা/২০৪৭]

➤ শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখা দ্বারা কীভাবে এক বছরের সিয়াম রাখার সমান সওয়াব হয়?
.
এক বছরের হিসাব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এভাবে দিয়েছেন যে, ‘রামাযানের একমাস সিয়াম (১০ গুণ নেকী ধরলে) ১০ মাসের সমান এবং (শাওয়ালের) ছয়টি সিয়াম দু’মাসের সমান’[ইবনু মাজাহ হা/১৭১৫; ইরওয়া ৪/১০৭ পৃঃ হা/৯৫০-এর আলোচনা] মহান আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “যে কোন সৎকাজ নিয়ে এসেছে, তার জন্য প্রতিদান হবে তার দশগুণ [সুরা আনআ’মঃ ১৬০] এভাবে মোট বারো মাস বা সারা বছর।
.
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, রামাযানের ৩০টি সিয়ামকে ১০ দিয়ে গুণ করলে (৩০´১০)=৩০০ দিন হয়। আর শাওয়াল মাসের ৬টি সিয়ামকে ১০ দিয়ে গুণ করলে (৬´১০)=৬০ দিন হয়। মোট ৩৬০ দিন হয়। আর আরবী গণনা হিসাবে ৩৬০ দিনে এক বছর। সুতরাং রামাযানের ৩০টি সিয়াম পালন করে যে ব্যক্তি শাওয়ালের ৬টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল। মূলতঃ এখানে উদ্দেশ্য হ’ল সওয়াব বর্ণনা করা [ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ২/৮১-৮২]
.
➤ উপরোক্ত হাদিসের ভাষ্য এবং আলিমগণের অনেকের মত হলো, যদি কেউ সারা বছর সিয়ামের ফজিলত অর্জন করতে চায়, তবে প্রথমেই তাকে রামাদানের কাজা সিয়ামগুলো রাখতে হবে, এরপর শাওয়ালের ৬ টি সিয়াম রাখবে। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি রামাদানের রোজা রাখলো, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম রাখলো, সে যেন সারা বছর সিয়াম রাখলো। [মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৪]
.
হাদিসটিতে বলা হয়েছে—প্রথমে রামাদানের সিয়াম রাখা, অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখা। সুতরাং, আগে রামাদানের সিয়াম পূর্ণ করতে হবে, এরপর শাওয়ালের সিয়াম রাখতে হবে। তাহলেই হাদিসে বর্ণিত প্রতিদান পাওয়া যাবে। তাছাড়া কাজা আদায় করা ফরজ, পক্ষান্তরে শাওয়ালের ৬ টি সিয়াম নফল। সুতরাং, নফলের উপর ফরজ স্বাভাবিকভাবেই অগ্রগণ্য হবে এটি জমহুর ওলামাদের মত।
.
➤শাওয়াল মাসের ছয় সিয়াম সম্পর্কিত কিছু বিষয়ঃ
.
➤(১) এই সিয়াম রাখার বিশেষ কোন নিয়ম নেই, শাওয়াল মাসের যেকোন ছয় দিনই রাখা যায়। ইচ্ছা হলে একবারে ছয়টি, ইচ্ছা হলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিরতি দিয়ে রাখতে পারবেন।
.
➤(২) তবে উত্তম হলো, রোজাগুলো বিরতিহীন রাখা; তবে মাঝখানে গ্যাপ দিলেও কোনো অসুবিধা নেই। (এ ব্যাপারে মোটামুটি সব আলেমই এমন মত দিয়েছেন) এর স্বপক্ষে দলিল আল্লাহ্ বলেন, “আর, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, সে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।”[সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাজা পালনের ক্ষেত্রে বিরতিহীন রাখার শর্ত আরোপ করেননি। সুতরাং এতে প্রশস্ততা রয়েছে।[ইমাম নববি, আল-মাজমু’: ৬/১৬৭; ইবনু কুদামাহ, আল মুগনি: ৪/৪০৮; ইবনু বায, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ১৫/৩৫]
.
➤(৩) বোনদের জন্য বা যাদের ভাংতি রোযা আছে, তাদের জন্য নিয়ম হচ্ছে, আগে কাযা রোয়া দ্রুত রেখে এরপর শাওয়ালের সিয়ামগুলো রাখা শুরু করবেন। কেননা হাদীসে আগে রমযানের সিয়াম রেখে এরপর শাওয়ালের সিয়াম রাখার কথা বলা হয়েছে।কারণ শাওয়াল পার হ’লে শাওয়াল মাসের সিয়াম পালনের সুযোগ থাকে না। আর রামাযানের ক্বাযা সিয়াম বছরের যেকোন সময়ে আদায় করা যায়[সূরা বাক্বারাহ ২/১৮৫]।
.
➤(৪)আর যেসকল বোনদের রমজানের বেশি রোযা মিস হয়ে গেছে অথবা যেই সমস্ত বোনদের পিরিয়ডের দিন এতো বেশি যে, কাযা সিয়াম রেখে এরপরে শাওয়ালের ছয় সিয়াম রাখার মতো মাসের দিন আর বাকী থাকবে না, তাহলে তারা প্রথমে শাওয়ালের ছয় সিয়াম রেখে পরে কাযা শুরু করতে পারেন এবং এইভাবে শাওয়ালের সিয়াম ফযীলত পাওয়ার আশা করতে পারেন ইনশাআল্লাহ।কেননা মহান আল্লাহ বলেন তুমি তোমার সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো[সূরা তাগা বুন,১৬] আল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ কারো উপর সাধ্যের বাইরে বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন না [সূরা বাকারা,২৮৬] তাছাড়া ব্যস্ততার কারণে আয়েশা (রাঃ) তাঁর রামাযানের ছুটে যাওয়া সিয়াম পরবর্তী শা‘বান মাসে আদায় করতেন[ সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩০]
তাহলে অনুমান করা যায়—আয়শা (রাঃ) রামাদানের কাজা রোজা না রেখেই শাওয়ালের রোজা রাখতেন। আমরা বলব, যেহেতু সব আলেমের মতে, আগে কাজা রাখা ও পরে শাওয়ালের রোজা রাখা উত্তম, তাই সাধ্যানুযায়ী এভাবে আমল করে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা ভাল
কেননা ফরযের ক্বাযা যত দ্রুত সম্ভব আদায় করাই উচিৎ
[মির‘আত ৫/২৩]
.
➤(৫) কেউ যদি শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখার জন্য আইয়ামে বীজের তিন দিন বা সোম ও বৃহস্পতিবারকে বেছে নেয়, তাহলে নিয়তের কারণে দুইটি সওয়াব একসাথে পাবে ইন শা আল্লাহ।
.
➤(৬) শাওয়াল মাসের ৬ টি সিয়াম রাখা ছাড়া আর কোনো বিশেষ ফযীলত নেই।উল্লেখ্য যে সমাজে প্রচলিত আছে যে ব্যক্তি রামাযান, শাওয়াল, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৪৭২]উক্ত হাদীস সহীহ নয় শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসের সনদে আরীফ আল-কুরাশী অজ্ঞাত হওয়ার কারণে হাদীছটি যঈফ [সিলসিলা যঈফাহ, হা/৪৬১২]

অবশেষে ,প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা! প্রস্তুতি নিন, রমযানের সিয়ামের পর সামান্য আজরের বিনিময়ে বিরাট সওয়াব অর্জন করার জন্য। আল্লাহ আমাদের সকলকে তোওফিক দান করুন, আমীন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।