শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সাদাক্বাহ কাকে বলে? সাদাক্বাহ কত প্রকার?

প্রশ্ন: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সাদাক্বাহ কাকে বলে? সাদাক্বাহ কত প্রকার? দান এবং সাদাক্বার মধ্যে পার্থক্য কি? সাদাক্বাহ পাওয়ার হক্বদার কারা?
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সাদাক্বাহ আরবী শব্দ এর অর্থ হল, যাকাত, দান, খয়রাত এবং যাবতীয় কল্যান বা নেকীর কাজ।
.
ইসলামের পরিভাষায় সাদাক্বাহ হল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অভাবীকে কোন কিছু প্রদান। যেমন; টাকা-পয়সা,পোশাক, খাদ্যদ্রব্য,গবাদী পশু মোটকথা অন্যের জন্য কল্যাণ, উপকার বা সুবিধা পৌঁছে দেয়াকে সাদাক্বাহ বলা হয় (ইবনু তায়মিয়াহ, শারহুল আরবাঈন আন-নাবুবিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৩)।
.
জুরজানী বলেন: পারিভাষিক অর্থে সাদাকা বলা হয়, এমন দানকে যার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সওয়াব আশা করা হয়।(আত্ তা’রীফাত/১৩৭)
.
দান এবং সাদাক্বার মধ্যে মৌলিক ভাবে কোন পার্থক্য নেই যেটা সাদাক্বাহ সেটাই দান অর্থাৎ সাদাক্বাহ আরবী শব্দ আর বাংলা হল দান যেমন,আমরা বলি ইউনিভার্সিটি-বিশ্ববিদ্যালয় দুইটা একই। তবে প্রয়োগিক ভাবে দান এবং সাদাক্বার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। সাদাক্বাহ শব্দটি কখনো খাছ আর দান শব্দটি আম,যেমন,সাদাক্বাহ শব্দটি ফরয যাকাত এবং সাধারণ সাদাক্বাহ (দান) দু’টিকেই শামিল করে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ২৬তম খণ্ড, পৃ. ৩২৩) সাদাক্বাহ কখনো কখনো ফরজ যেটা আদায় করা বাধ্যতামূলক যেমন, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের জন্য যাকাত আদায় করা ফরজ,(যাকাত শব্দটি শুধুমাত্র নিছাব পরিমাণ সম্পদের সাথে সংশ্লিষ্ট (সহীহ বুখারী, হা/১৪৮৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১০) আবার সাদাক্বাতুল ফিতর ইত্যাদি।আর দান সবসময় একই রকম।দান সাদাক্বার মধ্যে ব্যবহারিক কিছুটা পার্থক্য থাকার কারনে দান বা সাদাক্বাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়,

▪️(১). ফরয সাদাক্বাহ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا
‘তাদের সম্পদ হ’তে ছাদাক্বা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি উহাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে’ (তওবা ৯/১০৩)জমহুর ওলামাদের মতে এই আয়াতে সাদাক্বা শব্দ দ্বারা যাকাত বুঝানো হয়েছে (ফাতহুল কাদীর সূরা তওবা১০৩ নং আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য)
.
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَ الۡمَسٰکِیۡنِ নিশ্চয় ফকীর ও মিসকীনদের জন্য সাদাক্বা বা যাকাতের মাল’(সুরা আত-তওবা : ৬০)।
.
আবার যাকাতুল ফিতর যেটা রামাযান মাসের সিয়ামকে যে কোনো ভুলভ্রান্তি হতে পবিত্র করার জন্য প্রত্যেক মুসলিমের পক্ষ থেকে এক সা‘ পরিমাণ বিশেষ খাদ্যদ্রব্য রামাযানের শেষে ও ঈদের সালাতের পূর্বে দান করা ফরজ(আবুদাঊদ, হা/১৬০৯; মিশকাত, হা/১৮১৮)
.
এটি ঈদের সালাতে লোকদের বের হবার পূর্বে আদায় করা সুন্নাত পরে সালাতের পরে দিলে সাধারণ দান হবে। কারন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে, সেটি কবুল সাদাক্বা হিসাবে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি এটি সালাতের পরে আদায় করবে সেটি সাধারণ সাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে’।(মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/১৪৮৮। আবূদাঊদ হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ হা/১৮২৭; বুলূগুল মারাম হা/২৬৫৬)
এই হাদীসে দান এবং সাদাক্বার একটি পার্থক্য পরীক্ষিত হয় অর্থাৎ সালাতের পূর্বে দিলে সাদাক্বা হিসেবে কবুল হবে কিন্তু পরে দিলে সাধারণ দান হবে।
.
▪️(২). নফল বা সাধারণ সাদাক্বাহ। নফল সাদাক্বাহ বা দান শব্দটি সম্পদসহ সকল নেক কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট (সূরা নিসা,১১৪ তওবা,১০৪ সহীহ বুখারী, হা/৬০২১; সহীহ মুসলিম, হা/২৩৭৫)। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা ভাল; আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্থকে দাও তা তোমাদের জন্য আরও ভাল; এবং এতে তিনি তোমাদের জন্য কিছু পাপ মোচন করবেন আর তোমরা যে আমল কর আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে সম্মক অবহিত(সূরা বাকারা,২৭১)
.
মহান আল্লাহ আরো বলেন,তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় সাদাক্বাহ, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমরা মহা পুরস্কার দেব।(সূরা নিসা,১১৪)
.
হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন হতে খেজুর সাদাক্বাহ করবে’ আল্লাহ তা কবূল করবেন(সহীহ বুখারী, হা/১৪১০)।
.
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন তার সম্পূর্ণ পবিত্র সম্পদ থেকে কোন একটি খেজুর সদকা করে তখন সেটি আল্লাহ নিজ ডান হাতে গ্রহণ করেন, তারপর সেটা আল্লাহর হাতে এমনভাবে বেড়ে উঠে যে পাহাড়ের মত প্রকাণ্ড হয়ে পড়ে।’ [সহীহ মুসলিম: ১০১৪]
.
অপর এক বর্ননায় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ প্রতিদিন ভোরে (আকাশ থেকে) দু’জন মালাক (ফেরেশতা) নেমে আসে। এদের একজন দু’আ করে ‘হে আল্লাহ! দানশীলকে তুমি বিনিময় দাও। আর দ্বিতীয় মালাক এ বদদু‘আ করে, হে আল্লাহ! কৃপণকে ক্ষতিগ্রস্ত করো।(সহীহ বুখারী ১৪৪২, মুসলিম ১০১৩, সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী ৯১৩৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৮১৬ সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৫৭৯৭। মিশকাতুল মাসাবিহ,হাদিস নং ১৮৬০)
.
পরিশেষে, সাদাক্বাহ পাওয়ার হক্বদার হল সমাজের আট শ্রেনীর মানুষ। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,সাদাক্বাহ হল কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক্ব এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (ব্যয়ের জন্য) আর মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত ফরয। আর আল্লাহ তা‘আলা সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী’ (সূরা আত-তওবা : ৬০)। তবে এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি যদি নিজে অসহায় হয় তাহলে সে নিজেই সাদাক্বার বেশি হক্বদার যেমন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা সদাকাহ প্রদান কর। জনৈক ব্যক্তি বললেনঃ হে আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার নিকট একটি দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) আছে। তিনি বললেন- তুমি ওঁটা নিজেকেই দান কর (রেখে দাও)। লোকটা বললঃ আমার নিকট আরও একটি আছে। তিনি উত্তরে বললেনঃ এটা তোমার ছেলেদের (সন্তানদের) জন্য খরচ কর। লোকটা বললো আমার নিকট আরও একটি আছে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ওঁটা তোমার স্ত্রীর জন্য খরচ কর। সে বলল, আমার আরো একটি আছে। তিনি বললেনঃ তোমার খাদিমের জন্য সদাক্বাহ কর। লোকটা বললো আমার নিকট আরও একটি আছে। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমিই ভাল জানো (এটা কোথায় খরচ করবে)। আবূ দাউদ, নাসায়ী, আর ইবনু হিব্বান ও হাকিম একে সহিহ বলেছেন।(আবূ দাঊদ, হা/১৬৯১; নাসাঈ, হা/২৫৩৫)। অতঃপর গরীব আত্মীয়-স্বজন (সহীহ বুখারী, হা/২৭৬৯, ৫৬১১; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৯৮) এবং মিসকীন (ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫৫; নাসাঈ, হা/২৬০৪)। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।