জুমুআর সালাতের আগে ও পরে কত রাকাত সুন্নাত নামাজ পড়তে হবে

প্রশ্ন: জুমুআর সালাতের আগে ও পরে কত রাকাত সুন্নাত নামাজ পড়তে হবে? বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামী শরীয়তে জুমআর খুতবার পূর্বে ‘কাবলাল জুমুআহ’ বলে কোন নির্দিষ্ট রাকআত সুন্নত সালাত নেই। কোন মুছল্লী যখন মসজিদে প্রবেশ করবে,তখন তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ ২ রাকআত সুন্নত পড়তে হবে। কেননা এই দুই রাকাত সালাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূল (সাঃ)-এর খুৎবা চলাকালীন জনৈক সাহাবী মসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়াতুল মসজিদ না পড়ে বসে পড়লে রাসূল (সাঃ) তাকে সংক্ষেপে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করার নির্দেশ দেন (বুখারী হা/১১৬৬; মুসলিম হা/৮৭৫; মিশকাত হা/১৪১১) সুতরাং মসজিদের হক দুই রাকাত তাহিয়াতুল মসজিদ পড়ে কেউ চাইলে বসে যেতে পারে এবং দুআ, দরুদ তাসবীহ-যিকর বা কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে।আবার কেউ চাইলে ইমাম খুৎবা আরম্ভ করার পূর্ব পর্যন্ত যত ইচ্ছা তত সালাত আদায় করতে পারবে।তবে এই সালাত হবে নফল এবং অনির্দিষ্ট সংখ্যায় নিদিষ্ট করে শুধু ৪ রাকাআত নয়।(সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৫৮, ১৩৮৪, ৮৭)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.)বলেন,
সাহাবীদের থেকে এটাই বর্ণিত হয়েছে যে, তারা জুমার দিন যখন মসজিদে যেতেন তখন মসজিদে প্রবেশের পর যথাসাধ্য সালাত পড়তেন। কেউ পড়তেন দশ রাকআত, কেউ পড়তেন বারো রাকআত, কেউ পড়তেন আট রাকআত আর কেউ পড়তেন তার চেয়ে কম।(ইবনে তায়মিয়া মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৪/১৮৯)
.
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের প্রায় মসজিদে মুছল্লীরা জুমার সালাতের পূর্বে নিদিষ্ট করে মাত্র চার রাক‘আত সালাত আদায় করে থাকে। অথচ উক্ত মর্মে যে হাদীস প্রচলিত আছে তার সবগুলো বর্ণনা জয়ীফ এই বিষয়ে প্রায় সকল মুহাদ্দিসগন একমত।বর্ণনাগুলো হল,

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) জুম‘আর পূর্বে চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। কিন্তু এর মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না।(ইবনু মাজাহ হা/১১২৯, পৃঃ ২০২ সালাত’ অধ্যায়-২, ‘জুম‘আর পূর্বে সালাত’ অনুচ্ছেদ-৯৪।সনদ জয়ীফ)

অন্য বর্ণনায় রয়েছে,ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুম‘আর ছালাতের আগে ও পরে ৪ রাক‘আত করে সালাত পড়তেন। কিন্তু মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না।(ত্বাবারাণী কাবীর হা/১২৬৭৪)

তাহক্বীক্ব : উভয় বর্ণনাই জয়ীফ। এই বর্ণনার প্রায় সকল রাবীই ত্রুটিপূর্ণ। আল্লামা যায়লাঈ বলেন, এর সনদ নিতান্তই দুর্বল। মুবাশশির ইবনু উবাইদ মিথ্যা হাদীস রচনাকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আর হাজ্জাজ ও আতিইয়াহ দুইজনই যঈফ।(নাছবুর রাইয়াহ ২/২০৬ পৃঃ)বুছাইরী বলেন, বাক্বিয়াহ বিন ওয়ালীদও যঈফ।(সিলসিলা যঈফাহ হা/১০০১)ইমাম নববী বলেন, হাদীসটি বাতিল।(আলবানী, আল-আজবেবাতুন নাফে‘আহ আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামে‘আহ, পৃঃ ৩০)

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে আরো একটি বর্ননায়,নবী (সাঃ) জুম‘আর আগে চার রাক‘আত এবং জুম‘আর পরে চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন।(ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত হা/৩৯৫৯ ও ১৬১৭।)

তাহ্ক্বীক্ব : বর্ণনাটি মুনকার বা সহীহ হাদীস বিরোধী। ত্বাবারাণী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, আত্তাব বিন বুশাইর ছাড়া এই হাদীছ খুছাইফ থেকে কেউ বর্ণনা করেনি।(মু‘জামুল আওসাত হা/৩৯৫৯)উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন সাহাবীর নামে উক্ত মর্মে আরো কিছু বর্ণনা রয়েছে। তবে কোন বর্ণনাই বিশুদ্ধ নয়।(সিলসিলা যঈফাহ হা/৫২৯০ ও ১০১৬)

◾জুমআর পরে বা বা’দাল জুমআর ৪ অথবা ২ রাকআত সুন্নত :
___________________________________
জুম‘আর সালাতের পরে মসজিদে চার রাক‘আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ অথবা বাড়ীতে দু’রাক‘আত সুন্নাত আদায় করা যায়। তবে মসজিদেও চার বা দুই কিংবা দুই ও চার মোট ছয় রাক‘আত সুন্নাত ও নফল পড়া যায়।(মুসলিম, মিশকাত হা/১১৬৬ ‘সুন্নাত ছালাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০; তিরমিযী হা/৫২২-২৩ ‘জুম‘আ’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-২৪; মির‘আত ২/১৪৮; ঐ, ৪/১৪২-৪৩।)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমআর পর নামায পড়ে, সে যেন ৪ রাকআত পড়ে।”(আবূ দাঊদ,সহীহুল জামে ৬৪৯৯)

অপর বর্ননায় বলেন,তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমআর নামায পড়ে সে যেন তার পর ৪ রাকআত নামায পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, জামে ৬৪০)

তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমুআহ পড়ে, সে যেন তার পর কোন কথা না বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোন নামায না পড়ে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম,সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩২৯)

জুমার পর ছয় রাক‘আতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-এর আমল পাওয়া যায়। তারা জুম‘আর সালাতের পর প্রথমে দু’রাক‘আত, এরপর চার রাক‘আত আদায় করতেন এবং আদায়ের নির্দেশ দিতেন (সুনানে তিরমিযী হা/৫২৩; মিশকাত হা/১১৮৭)। অতএব জুম‘আর পর দুই, চার ও ছয় রাক‘আত সুন্নাত সালাত রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত।কিন্তু জুমার পূর্বে ৪ রাকাআত কাবলাল জুমা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়।
.
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃএহ্তিয়াত্বী জুম‘আ বা ‘আখেরী যোহর’ নামে জুম‘আর সালাতের পরে পুনরায় যোহরের চার রাক‘আত একই ওয়াক্তে পড়ার যে রেওয়াজ এদেশে চালু আছে, তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। কেননা জুম‘আর পরে যোহর পড়ার কোন দলীল নেই। তাছাড়া যে ব্যক্তি জুম‘আ পড়ে, তার উপর থেকে যোহরের ফরযিয়াত উঠে যায়। কারণ জুম‘আ হ’ল যোহরের স্থলাভিষিক্ত। এক্ষণে যে ব্যক্তি জুম‘আ আদায়ের পর যোহর পড়ে, তার পক্ষে কুরআন, সুন্নাহ এবং কোন বিদ্বানের সমর্থন নেই। গ্রামে জুম‘আ হবে কি হবে না, এই সন্দেহে পড়ে কিছু লোক দু’টিই পড়ে থাকে।(আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১২০, ৩২৭পৃ: সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৭) যেমন বিদআত রমযানের শেষ জুমআকে জুমআতুল বিদা নাম দিয়ে কোন খাস মসজিদে ঐ জুমুআহ পড়তে যাওয়া।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।