শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজি ধরার হুকুম

প্রশ্ন: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজি ধরার হুকুম কী?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা জায়েয। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:لَا سَبَقَ إِلَّا فِي نَصْلٍ أَوْ خُفٍّ أَوْ حَافِرٍ অর্থাৎ তীর নিক্ষেপ এবং উট ও ঘোড়দৌড় ব্যতীত অন্য কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই। (আবূ দাঊদ হা/২৫৭৪, নাসায়ী হা/ ৩৫৮৫, তিরমিযী হা/১৭০০, ইবনু মাজাহ হা/২৮৭৮, মুসনাদে আহমাদ হা/১০১৩৮, সহীহ আল জামি হা/৭৪৯৮ সনদ বিশুদ্ধ)।
.
হাদীসটির ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসের শব্দ السبق অর্থ: প্রতিযোগিতা অর্থাৎ : العوض أو الجائزة পুরস্কার কিংবা ক্ষতিপূরণের প্রতিযোগিতা। সুতরাং (لَا سَبَقَ إِلَّا فِىْ نَصْلٍ) অর্থ: কোন প্রতিযোগিতা করা বৈধ নয় তীরন্দাজী উট ও ঘোড়দৌড় ব্যতীত। অর্থাৎ- এখানে প্রতিযোগিতা বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা হল: প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ব্যক্তিকে অর্থ প্রদান বা পুরস্কার দেওয়া উক্ত হাদীসে বর্ণিত তিন প্রকারের বস্তুর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৈধ। কারন এ তিনটি জিনিস জিহাদে কাজে লাগে, তাই তাতে সকল প্রকার পুরষ্কার বৈধ করা হয়েছে।
.
ইবনু মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে তাতে জিতে গিয়ে মাল গ্রহণ করা বৈধ নয় হাদীসে উল্লেখিত তিন প্রকার প্রতিযোগিতা ব্যতীত। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৫ম খন্ড, পৃঃ ৩৯৮; শারহে নাসায়ী ৩য় খন্ড, হাঃ ৩৫৮৭)।
.
ইমাম খত্ত্বাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এই হাদীসে উল্লেখিত প্রতিযোগিতা এজন্য বৈধ তাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ততি এবং জিহাদের জন্য উৎসাহ প্রদান রয়েছে। কিন্তু যে প্রতিযোগিতায় যুদ্ধের প্রস্ততি নেই তাতে অংশগ্রহণ করে মাল গ্রহণ করা নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাই তা বৈধ নয় (আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৫৭১)। সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব এর অভিমতও এটাই (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৭০০)।
.
সুতরাং উক্ত হাদিস প্রমাণ করে যে, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার পেছনে অর্থ ব্যয় করা জায়েয; চাই সেই অর্থ দুই প্রতিযোগীর কারো একজনের পক্ষ থেকে হোক কিংবা অগ্রগণ্য মতানুযায়ী উভয়জনের পক্ষ থেকে হোক কিংবা তৃতীয় কোন পক্ষ যেমন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হোক।
.
তবে এই বৈধতার মধ্যে প্রতিযোগীদের কোন একজন বিজয়ী হওয়া নিয়ে বাজি ধরা কিংবা কোন এক ঘোড়া বিজয়ী হওয়া নিয়ে বাজি ধরা অন্তর্ভুক্ত হবে না; যেমনটি মানুষ করে থাকে। কেননা এটি হারাম জুয়াখেলা। এর সাথে শরিয়ত যে প্রতিযোগিতা বৈধ করেছে তার কোন সম্পর্ক নেই। এই হারাম বাজি পৃথিবীর অনেক দেশে বিদ্যমান। এই বাজির কারণে কত অর্থ নষ্ট হয়েছে এবং কত সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। যদি একদল মানুষের সম্মিলিত ফান্ডে হারাম বাজির অর্থ রাখা হয় তাহলে এই ফান্ডে অংশ গ্রহণ করা নাজায়েয। যেহেতু এর মাধ্যমে যেই জুয়া খেলায় সহযোগিহতা করা হয়; যে খেলা আল্লাহ্‌ হারাম করেছেন এবং মদের সাথে একত্রে সেটাকে উল্লেখ করেছেন। যেমনটি আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি ভাগ্য নির্ণয়ের তীর এগুলো বস্তুত শয়তানের একটি ঘৃণ্য কাজ; অতএব এসব থেকে দূরে থাক; যাতে তোমরা সফল হতে পার।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৯০]।
.
শাইখ আব্দুল মাজিদ সেলিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

. ومنه يعلم أن الرهان المعروف الآن سواء كان رهانا على سباق الخيل أم غيره من أنواع الرهان من القمار المحرم شرعا الذي ليس هناك نصوص تبيحه ، بل قد دلت النصوص التي ذكرناها على حرمته ، وإنما حرم الشارع الميسر الشامل لأنواع الرهان الموجودة الآن لما يترتب عليه من المفاسد العظيمة التي نشاهدها كل يوم . فقد أفضى إلى ضياع أموال كثيرة من المتراهنين ، وخراب بيوت لأسر كريمة، كما حمل الكثير من المقامرين على ارتكاب شتى الجرائم من السرقة والاختلاس ، بل والانتحار أيضا، فالمطلع على ذلك وغيره مما أدى ويؤدي إليه القمار يزداد إيمانا بأن من رحمة اللّه وفضله وباهر حكمته أن حرمه على عباده ، كما حرم عليهم كثيرا من الأشياء لما يترتب عليها من المفاسد والمضار

“এর থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে প্রচলিত বাজি; সেটি ঘোড়দৌড়ের ক্ষেত্রে হোক কিংবা অন্যান্য বাজি হোক; সেগুলো শরিয়তে নিষিদ্ধ জুয়ার অর্ন্তভুক্ত। এমন কোন দলিল নেই যা এ বাজিগুলোর বৈধতা দেয়। বরং যে দলিলগুলো আমরা উল্লেখ করেছি সেগুলো এই ধরণের বাজি হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। বরঞ্চ শরিয়ত বর্তমানে বিদ্যমান সব ধরণের বাজিকে হারাম করেছে; যেহেতু এগুলোর কারণে বড় ধরণের অনিষ্ট ঘটে যা আমরা প্রতিদিনই দেখছি। বাজি ধরে বিপুল সম্পদ নষ্ট হয়েছে। বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার ধ্বংস হয়েছে। অনুরূপভাবে এটি অনেক জুয়াডিকে চুরি-ছিনতাই এর মত বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করেছে। এমনকি আত্মহত্যা করতেও। জুয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যা ঘটেছে কিংবা ঘটে থাকে সে সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তির ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় যে আল্লাহ্‌র রহমত, অনুগ্রহ ও প্রজ্ঞা থেকে তিনি তাঁর বান্দাদের ওপর জুয়া হারাম করেছেন। যেমনিভাবে তিনি তাদের ওপর এমন অনেক বিষয় হারাম করেছেন যেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষতি ও অনিষ্ট ঘটে।”[ফাতাওয়াল আযহার থেকে সমাপ্ত দেখন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৬৮৬৬)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমাদের এখানে একদল মানুষ রয়েছে যারা ‘আল-শারক্বুল আওসাত’ পত্রিকা থেকে প্রকাশিত ‘স্পোর্টস ম্যাগাজিন’ খরিদ করে। উদ্দেশ্য হলো: এই ম্যাগাজিনে থাকা ঘোড়দৌড়ের কূপনটি পূরণ করা। এতে তারা প্রত্যেক চক্করে যে ঘোড়াটি বিজয়ী হবে সেটি নির্বাচন করে। তারা একাধিক ম্যাগাজিনের একাধিক কূপন পূরণ করে। উদ্দেশ্য হলো পুরস্কার জেতা। এর ফলে তারা বিপুল সম্পদ হারায়। আমরা আপনার কাছে এ বিষয়ে ফতোয়া চাচ্ছি। কেননা আমাদের ফতোয়াটি খুব প্রয়োজন যাতে করে এ ব্যক্তিরা এ বিষয়ের শরয়ি হুকুম জানতে পারে। আল্লাহ্‌ আপনাদেরকে তাওফিক দিন এবং আপনাদের ইল্‌মের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে উপকৃত করুন।

জবাবে তারা বলেন:

“هذا العمل لا يجوز؛ لأنه من الرهان المحرم الذي يدخل في الميسر، والله تعالى يقول: ( يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ) .وعليه فهو أكل للمال بالباطل ، وبالله التوفيق، وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم”

এই কাজ নাজায়েয। কেননা এটি হারাম বাজির অন্তর্ভুক্ত; যা জুয়ার মধ্যে পড়ে। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি ভাগ্য নির্ণয়ের তীর এগুলো বস্তুত শয়তানের একটি ঘৃণ্য কাজ; অতএব এসব থেকে দূরে থাক; যাতে তোমরা সফল হতে পার।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৯০] অতএব, এটি হচ্ছে অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ। আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা। আমাদের নবী মুহাম্মদের ওপর আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২২৪) আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।