জিহাদ কাকে বলে এবং জিহাদ কত প্রকার ও কি কি

প্রশ্ন: জিহাদ কাকে বলে? জিহাদ কত প্রকার ও কি কি? কা-ফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ হওয়া সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মানহাজ কী?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: জি-হা-দ (جِهَادٌ) শব্দটি আরবী ‘জাহাদা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া’। আরবদের কাছে শাব্দিকভাবে ‘জি-হাদ’-এর অর্থ হলো ‘কোনো কাজ বা মত প্রকাশ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা বা কঠোর সাধনা করা’ বা আল্লাহর পথে কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা। শরীআতের পরিভাষায়- কাফের, সীমালঙ্ঘনকারী এবং ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সাধ্য অনুযায়ী লড়াই (যু-দ্ধ) বা প্রচেষ্টা ব্যয় করা। মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী [২২৪- ৩১০ হি.] (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, জি-হা-দ অর্থ হলো- তাদের (কা-ফিরদের) বিরুদ্ধে কুরআন দ্বারা প্রবল সংগ্রাম করা। যাতে করে তারা আল্লাহ কুরআনে যা ফরয করেছেন, সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করে তার প্রতি আত্মসমর্পণ করে; তাঁর প্রতি অনুগত হয় এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সকল আমলের জন্য বশীভূত হয়। (জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল. কুরআন,খন্ড: ১৯,পৃষ্টা: ২৮১)। ইমাম কুরতুবী [৬০০- ৬৭১ হি.] (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, জি-হা-দ অর্থ হলো- ‘আল্লাহ তা‘আলার সকল নির্দেশের আনুগত্য করা এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য (প্রতিষ্ঠা করার জন্য) নফসের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করা এবং অন্তরকে প্রবৃত্তি হতে নিবৃত্ত করা। শয়তানের বিরুদ্ধে, তার কুমন্ত্রণাকে রদ করার জন্য; যু-লুমের বিরুদ্ধে, যু-লুমকে রদ করার জন্য এবং কা-ফিরদের বিরুদ্ধে তাদের কুফুরীকে রদ করার জন্য জি-হা!দ করা।(আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন,খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ৯৯)
.
▪️শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে জি-হা-দের প্রকারভেদ এবং একজন ব্যক্তির উপর জি-হা-দ ফরজ হওয়ার শর্তাবলী:
.
জিহা-দের বিভিন্ন প্রকার বা স্তর রয়েছে। জিহা!দের কিছু প্রকার আছে যা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদাভাবে ওয়াজিব বা জরুরী। আর কিছু প্রকার আছে যা পুরো জাতির জন্য সামষ্টিকভাবে জরুরী। যদি কিছু মানুষ আদায় করে তাহলে অন্যরা দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়। আবার কিছু প্রকারের জিহা-দ আছে যা মুস্তাহাব।
.
কুরআন-সুন্নাহ এবং প্রসিদ্ধ সালাফগনের মতামতের ভিত্তিতে থেকে কখন একজন ব্যক্তির উপর জি-হা-দ ফরজ হয় এই সম্পর্কে হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেনيشترط لوجوب الجهاد سبعة شروط ; الإسلام , والبلوغ , والعقل , والحرية , والذكورية , والسلامة من الضرر , ووجود النفقة “জিহাদ ফরজ হওয়ার শর্ত সাতটি। সেগুলো হল:
(১). ব্যক্তি মুসলিম হওয়া,
(২). প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া,(নাবালকের উপর ফরজ নয়),
(৩). সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া (পাগল না হওয়া),
(৪). স্বাধীন (কোন ব্যক্তির দাস বা গোলাম না হওয়া),
(৫). পুরুষ হওয়া,(নারীদের জন্য নরমালি ফরজ নয়),
(৬). শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা মুক্ত হওয়া (যেমন: অন্ধ, নেংড়া,বোধির, মারাত্মক অসুস্থ ইত্যাদি)
(৭). জিহাদের খরচ তথা প্রয়োজনীয় অর্থ থাকা।”[ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, কিতাবুল জিহাদ খন্ড:৯ পৃষ্ঠা: ১৬৩]
.
জিহা-দুন নাফস (নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহা-দ) এবং জিহা-দুস শায়তান (শয়তানের বিরুদ্ধে জিহা-দ) প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির জন্য ফরজ। মুনাফিক,কাফির, জালেম, ধর্মবিদ্বেষী তথা বিদআতের নেতৃত্বদানকারীদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ সমগ্র সম্প্রদায়ের উপর ফরয। কাফেরদের বিরুদ্ধে হাত দ্বারা জি-হা-দ করা প্রত্যেক সামর্থ্যবানের জন্য ওয়াজিব। জি-হা-দের এই পরিস্থিতিগুলো নিম্নে ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করা হলো:-
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেন; ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, জি-হা-দের চারটি স্তর রয়েছে। যেমন:
.
(১)। জিহা-দুন নাফস (নিজের বিরুদ্ধে জিহা-দ)।
(২)। জিহা-দুশ শায়তান (শয়তানের বিরুদ্ধে)।
(৩)। জিহা-দুল কুফফার (কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহা-দ)
(৪)। জিহা-দুল মুনাফিকিন (মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহা-দ)।
.
▪️প্রথমতঃ নিজ নফস তথা নিজের সাথে জিহা-দের চারটি স্তর রয়েছে। যথা:
.
(১)- ইলম, দ্বীনে হক ও হিদায়াতের তালাশের চেষ্টা করা এবং এর উপর নফসকে বাধ্য করা। কারণ দ্বীনে হকের জ্ঞান অর্জন ছাড়া সাফল্য অর্জনের কোন সুযোগ নেই। এবং জীবন-যাপনে কোন সুখ-শান্তি নেই, বান্দা তা অর্জনে ব্যর্থ হলে ইহকাল ও পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
.
(২)- বান্দা ইলম অর্জন করার পর অর্থাৎ দ্বীন এবং হেদায়াতের যাবতীয় বিষয়াবলী জানার পর ইলমকে আমলে পরিণত করবে। কারণ আমল ছাড়া ইলম তার কোন উপকারে আসবেনা।
.
(৩)- ইলম ও আমলের প্রতি বিচক্ষণতার সাথে মানুষকে দাওয়াত দিবে। অজ্ঞদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিবে। অন্যথায় সে আল্লাহর নাযিলকৃত হিদায়াত ও সত্য গোপন করার অপরাধে অপরাধী হবে এবং তার ইলম অন্যের উপকার করলেও তার নিজের কোন উপকার করবে না এবং তাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষাও করবেনা।
.
(৪)- আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজে যে সমস্ত বিপদ-আপদ আসে বান্দা তার উপর নফসকে ধৈর্যধারণ করতে বাধ্য করবে। মানুষেরা তাকে কষ্ট দিলেও সে ধৈর্যধারণ করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সে সব কিছুই মাথা পেতে মেনে নিবে। এটাও একটা জিহাদের প্রকার।
.
যার ভিতরে উপরোক্ত চারটি গুণ পাওয়া যাবে সে রাব্বানী তথা আল্লাহর প্রিয় অলী বা বান্দা হতে পারবে। সালাফগণের সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, কোন আলেমই ততক্ষণ পর্যন্ত রাব্বানী হওয়ার যোগ্য হয় না যতক্ষণ না সে সত্যকে ভালভাবে বুঝতে সক্ষম হয়, সে অনুযায়ী আমল করে এবং তা মানুষকে শিক্ষা দেয়। সুতরাং যে শিখল, আমল করল এবং শিক্ষা দিল তাকে উর্ধ্বাকাশে (জান্নাতে) মহা সম্মানের সাথে ডাকা হবে।
.
▪️দ্বিতীয়তঃ শয়তানের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করার দু’টি স্তর রয়েছে। যথা:
.
(১)- শয়তান ঈমানের ক্ষেত্রে বান্দার অন্তরে যে সমস্ত নিকৃষ্ট সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করে, তা দূর কিংবা প্রতিহত করতে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহা!দ করা।

(২)- শয়তান যে সমস্ত খারাপ আকাঙ্ক্ষা এবং প্রবৃত্তি বান্দার অন্তরে সৃষ্টি বা নিক্ষেপ করে তা প্রতিহত করতে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহা-দ করা।
.
মজবুত ঈমান ও দৃঢ় মনোবল দিয়ে প্রথমটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং ধৈর্যের মাধ্যমেই দ্বিতীয়টির মোকাবেলা করা সম্ভব। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُواْ وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ
‘‘তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।” (সূরা সাজদাহ-৩২: ২৪)। আর শয়তান সকল শত্রুর চেয়ে বেশি অনিষ্টকর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ.শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তোমরা তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে আহ্বান করে শুধু এ জন্য যে, তারা যেন উত্তপ্ত জাহান্নামের সাথী হয়। (সূরা আল-ফাত্বির: ৬)। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, দৃঢ় বিশ্বাস ও সবরের মাধ্যমেই নের্তৃত্ব পাওয়া যাবে, ধৈর্যই খারাপ নিয়ত ও কুপ্রবৃত্তিকে প্রতিহত করে এবং মজবুত ঈমান সন্দেহ বিদূরিত করে।
.
▪️তৃতীয়তঃ জিহা-দুল কুফফার ওয়াল মুনাফিকিন অর্থাৎ কাফের এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহা!দ করার চারটি স্তর রয়েছে। যথা:
.
(১) অন্তরের মাধ্যমে জিহা-দ।
(২) জবানের মাধ্যমে জিহা-দ।
(৩) মালের সাহায্যে জিহা-দ।
(৪) জান ও হাতের মাধ্যমে জিহা-দ।
.
কাফেরদের সাথে জিহা-দ করতে হবে অস্ত্রের সাহায্যে। আর জবানের সাহায্যে জিহা-দ করতে হবে মুনাফেকদের সাথে।
.
▪️চতুর্থতঃ জালিম, বিদ‘আতী, সীমালঙ্গনকারী ও খারাপ কাজকারীদের বিরুদ্ধে জিহা-দ করার তিনটি স্তর রয়েছে। যথা:
.
(১). ক্ষমতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে হাত (অর্থাৎ শারিরীক জিহা!দ বা লড়া) দ্বারা জিহা-দ করতে হবে।
.
(২). হাত দিয়ে করতে অক্ষম হলে জবান (অর্থাৎ কথা বা ভাষার দ্বারা) জিহা-দ করতে হবে।
.
(৩). আর তাতেও অক্ষম হলে অন্তর দিয়ে (অর্থাৎ মন্দকে ঘৃণা করা এবং তাকে ভুল মনে করা) জিহা-দ করতে হবে।
.
উপরের আলোচনা থেকে আমরা জি-হা-দের সর্বমোট ১৩টি স্তর খুঁজে পাচ্ছি। আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি, যে জি-হা-দের এ সকল প্রকারকে নিজের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে। জি-হা-দের স্তরগুলো পালনের ক্ষেত্রে তারতম্য করার কারণে আল্লাহর নিকট মানুষেরও মর্যাদার তারতম্য হবে। এই কারণেই সৃষ্টি জগতের পরিপূর্ণ মুমিন এবং আল্লাহর নিকট সম্মানিত ব্যক্তি হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসূল মুহাম্মদ (ﷺ)। কেননা তিনি নিজের মাঝে সকল প্রকারের জি-হা-দ অন্তর্ভুক্ত করেছেন (সব রকমের জিহাদ তিনি করেছেন) এবং তিনি আল্লাহর পথে উপযুক্তভাবে জি-হা-দ করেছেন। সুতরাং যতদিন দিনরাত আবর্তিত হবে ততদিন তার ওপর সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক। নাবী (ﷺ) বলেন- مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ نَفْسَهُ بِالغَزْوِ، مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنَ النَّفَاقِ যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেলো যে, সে জি-হা-দ করেনি এবং মনে জি-হা-দের আকাঙ্ক্ষাও রাখেনি, তবে সে মুনাফিক্বী অবস্থায় মারা গেলো। (আবু দাউদ হা/২৫০২)। হিজরত ব্যতীত জি-হা-দ পূর্ণ হয় না। ঈমান ব্যতীত জি-হা-দ ও হিজরত উভয়টিই মূল্যহীন। আল্লাহর রহমতকামীগণই এই তিনটি গুণে গুণান্বিত হয় এবং তা অর্জন করতে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- إنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَاجَرُواْ وَجَاهَدُواْ فِى سَبِيلِ اللهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللهِ، وَاللهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে আর আল্লাহর পথে লড়াই (জি-হা-দ) করেছে, তারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন ক্ষমাকারী, করুণাময়। (সূরা বাকারা-২: ২১৮)
.
ঈমান আনয়ন করা যেমন প্রতিটি মানুষের উপর ফরয ঠিক তেমনই প্রত্যেক মুমিনের উপর প্রতি মুহূর্তে দু’টি হিজরত করা আবশ্যক। এককভাবে ও ইখলাসের সাথে আল্লাহর ইবাদত, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহকে ভয় করা, আল্লাহর কাছেই আশা-আকাঙ্খা করা, আল্লাহকে ভালবাসা এবং একনিষ্টভাবে তাওবা করার মাধ্যমেই আল্লাহর দিকে হিজরত করতে হবে। আর রাসূলের অনুসরণ, তাঁর আদেশের সামনে নত হওয়া, তিনি যেই সংবাদ দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা এবং তাঁর আদেশকে অন্যদের আদেশের উপর প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে রাসূলের দিকে হিজরত করতে হবে। রাসূল (ﷺ) বলেন- ‘‘কারো হিজরত যদি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) এর উদ্দেশ্যেই হিজরত বলে গণ্য হবে। আর কারো হিজরত যদি দুনিয়া অর্জন অথবা কোন নারীকে বিবাহের উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তার হিজরত সেভাবেই গৃহীত হবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে। (সহীহ মুসলিম হা/১৯০৭)। ঠিক তেমনই আল্লাহর আনুগত্যে নফসকে বাধ্য রাখতে এবং শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য জি-হা-দ করা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরজে আইন। এখানে একজন অন্যজনের স্থলাভিষিক্ত হবে না। কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহা!দ করার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে উম্মাতের কোন একটি দল এই প্রকারের জিহা-দে আঞ্জাম দিলে এবং তাদের দ্বারা উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেলে অন্যদের উপর হতে ফরযিয়াত উঠে যাবে। (ইবনুল ক্বাইয়িম,যাদুল মা‘আদ,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা:৯-১১)
.
কখনো কখনো আল্লাহর বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করা বান্দার নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহা-দ করার শাখা হিসাবে গণ্য হয়। ফাযালাহ ইবনু উবাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন- আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না যে, মুমিন কে? (প্রকৃত মুমিন হল সেই), যার (অত্যাচার) থেকে লোকেরা নিজেদের জান-মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করতে পারে। (প্রকৃত) মুসলিম হলো সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত হতে লোকেরা শান্তি লাভ করতে পারে। (প্রকৃত) মুজা-হিদ হল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর আনুগত্য করতে নিজের মনের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করে। আর (প্রকৃত) মুহা|জির (হিজরতকারী) হলো সেই ব্যক্তি, যে সমস্ত পাপাচারকে ত্যাগ করে। (মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪০০৪; মিশকাত, হা/৩৩-৩৪, সনদ সহীহ)
.
এমতাবস্থায় আল্লাহর বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করার চেয়ে নিজ নফসের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করা অধিক উপযুক্ত হবে। সুতরাং যতক্ষণ না সে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালনার্থে এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জনার্থে নিজ নফসের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করবে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মার বিরুদ্ধে জি-হা-দের ঘোষণা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করতে সক্ষম হবে না। (প্রশ্ন হতে পারে) কিভাবে সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে সক্ষম হবে? তার দু’পাঁজরের মাঝে যে শত্রু রয়েছে (নফস) সে তো তার ওপর ক্ষমতাবান ও বিজয়ী হয়েই আছে। যতক্ষণ না সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করার জন্য নিজ নফসের বিরুদ্ধে আগে জি-হা-দ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জি-হা-দে বের হাতে সক্ষম হবে না। এই হলো দুই শত্রু (নফস ও অমুসলিম মানুষ)-এর মাঝে তৃতীয় আরো এক শত্রু রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জি-হা-দ করা ছাড়া কোন বান্দা এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে জি-হা-দ করতে পারবে না। সে উভয়ের মাঝে অবস্থান করে বান্দাকে উভয়ের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করতে বাধা প্রদান করে, ভয় দেখায় এবং নিরাশ করে। সে বান্দাকে সর্বদাই ভয় দেখায় এভাবে যে, উভয়ের বিরুদ্ধে জি-হা-দ করতে অনেক কষ্ট, আনন্দহীনতা এবং প্রবৃত্তিহীনতা রয়েছে। তাই কোন বান্দা এই তৃতীয় প্রকারের শত্রুর বিরুদ্ধে আগে জি-হা-দ করা ছাড়া আগের দুই প্রকারের শত্রুর বিরুদ্ধে জি-হা-দ করতে সক্ষম হয় না। আর এই তৃতীয় প্রকারের শত্রু হলো শয়তান।
.
জি-হা-দের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, “জিহা-দ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। অর্থাৎ জি-হা-দের অনেকগুলো প্রকার রয়েছে। জীবন দ্বারা, সম্পদ দ্বারা, দুআ করার দ্বারা, শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের দ্বারা, যে কোনো উপায়ে উত্তম কাজে সহায়তা করার দ্বারা। জিহা|দের সব থেকে বড় ধরন হচ্ছে আপন সত্ত্বা অর্থাৎ জান দ্বারা জিহা-দ (অর্থাৎ নিজে গিয়ে যুদ্ধ করা), এরপরে রয়েছে সম্পদ দ্বারা জিহা-দ করা, বক্তব্যের দ্বারা জিহা|দ করা এবং অন্যদেরকে দিক-নির্দেশনা দেয়া। কিন্তু আপন সত্ত্বা অর্থাৎ জিহা-দে লড়াই করার জন্য বের হওয়াই হচ্ছে, জিহা-দের সর্বোচ্চ ধরন।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৩৩৪-৩৩৫)
.
▪️দ্বিতীয় অবস্থা: মুসলিম উম্মাহ কী অবস্থায় রয়েছে এর উপর ভিত্তি করে কাফিরদের বিরুদ্ধে শারিরীকভাবে জিহাদ (যুদ্ধ)-এর বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন; সর্বপ্রথম যে ওহী আল্লাহ সুবহানা তায়ালা রাসূল (ﷺ) এর উপর নাজিল করেছেন তা হচ্ছে,
اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ
তুমি পড়ো তোমার সৃষ্টিকর্তার নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক্ব: ৯৬/১)। এটিই ছিল তাঁর নবুয়তের সূচনা, যেখানে আল্লাহ্‌ রাসূল (ﷺ)-কে পাঠ করতে বলেছিলেন কিন্তু তখনও তাকে প্রচার করার নির্দেশ দেননি। অতঃপর আল্লাহ সুবহানা তায়ালা নাযিল করলেন সূরা মুদ্দাসসিরের আয়াত। অর্থাৎ মহান আল্লাহ বলেন, یٰۤاَیُّہَا الۡمُدَّثِّرُ قُمۡ فَاَنۡذِرۡ হে বস্ত্ৰাচ্ছাদিত! উঠুন, অতঃপর সতর্ক করুন। (সূরা মুদ্দাসিসর: ৭৪/১-২)। সুতরাং তিনি নবী হলেন একটি শব্দ اقرَأ (ইকরা)-এর দ্বারা এবং রাসুল হলেন এই শব্দগুলো দ্বারা- يا أَيُّهَا المُدَّثِّرُ।. এরপর আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর কাছের আত্মীয়দের নিকট সতর্কবাণী প্রচারের নির্দেশ দেন। এরপর তাঁর গোত্রকে, এরপর সকল আরবকে এবং এরপর সমগ্র মানবজাতির প্রতি সতর্কবাণী প্রচারের নির্দেশ দেন। নবুয়তের শুরুর সময় থেকে দশ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি ক্রমাগত তাদের নিকট দাওয়াতী প্রচারকাজ চালিয়ে যান। এ সময় তিনি তাদের সাথে কোনো যু!দ্ধ করেননি, জিজিয়াও চাননি। এই সময় মহান আল্লাহ রাসূল (ﷺ)- কে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে, ধৈর্য ধরতে এবং সহনশীল হতে আদেশ করা হয়েছিল। অতঃপর তাঁকে হিজরত করার অনুমতি দেয়া হয়। এবং যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়। এরপর তাঁকে আদেশ দেয়া হয় তাদের সঙ্গে জিহা-দ করতে যারা তাঁর সঙ্গে লড়ে। এবং তাদের সাথে লড়াই হতে বিরত থাকতে যারা তাঁর সঙ্গে লড়াই করে না এবং এমন কিছু থেকে বিরত থাকে। অতঃপর আল্লাহ আদেশ করলেন মুশরিকদের সাথে জি-হা-দ করতে যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ দ্বীন আল্লাহর জন্য না হয়, কাফেরদের সাথে যুদ্ধের আদেশ দেওয়ার পরে মুসলিমদের সাথে কাফেরদের অবস্থান তিন ভাগে বিভক্ত ছিল-

(১). যাদের সাথে যুদ্ধ!বিরতি বা শান্তি চুক্তি হয়েছিল।

(২). আহলুয হারবিন অর্থাৎ যাদের সাথে যু-দ্ধ করা বৈধ ছিল।

(৩). আহলুয যিম্মাহ (অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রে সুরক্ষার অধীনে বসবাসকারী অমুসলিম)। (ইবনুল কাইয়ুম যাদুল মায়াদ: খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৫৯)
.
তৃতীয়তঃ কাফেরদের সাথে হাত দ্বারা জি-হা-দ করার বিধান হলো- এটি সামগ্রিকভাবে ফরজে কেফায়াহ অর্থাৎ সম্প্রদায়ের ওপর একটি ফরজ। যখন কিছু লোক আদায় করবে তখন সকলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন; জিহা|দ হচ্ছে ফরযে কিফায়াহ। যদি কিছু ব্যক্তি তা আদায় করে তাহলে অন্যরা দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়। ফরযে কিফায়াহ বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে- একটি সম্প্রদায়ের যখন কেউ জি-হা-দ করবে না, তখন সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু যদি যথেষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি তা আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে, অর্থাৎ বাকিরা দায় থেকে মুক্ত হবে। প্রাথমিকভাবে আদেশটি ছিল সকলকে সম্বোধন করে অর্থাৎ সকলের উপরে ফরযে আইন। অতঃপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে- এক নম্বর ফরজে কেফায়া যেটা কিছু মানুষ জিহা!দ করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়, দুই নাম্বার ফারযে আইন যেটা কিছু মানুষ আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয় না। আর আমভাবে, জি-হা-দ ফরযে কিফায়াহ এটাই অধিকাংশ আহলুল ইলমদের অভিমত। (ইবনে কুূাদামাহ আল মুগনি খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ১৬৩.)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন; আমরা আমরা ইতিপূর্বে একাধিকবার আলোচনা করেছি যে, জি-হা-দ ফরজে কেফায়াহ, ফরজে আইন নয়। সকল মুসলিমের উপর আবশ্যক তার ভাইদের সাহায্যের জন্য নিজের জান (দৈহিকভাবে যোগ দিয়ে), মাল, তরবারি ও দাওয়াত এবং পরামর্শের মাধ্যমে জিহা-দ করা। যদি তাদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি (যুদ্ধ করতে) বের হয়, তাহলে অন্যরা পাপ থেকে মুক্ত হয়। আর যদি তাদের সকলেই এ থেকে বিরত থাকে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। মামলাকাহ (সৌদি আরব), আফ্রিকা, মাগরিব (উত্তর আফ্রিকা) এবং অন্যান্য স্থানের আরও যে রাষ্ট্রগুলো রয়েছে, যদি এসব জায়গায় জিহা-দ হয়; তাহলে আশেপাশের নিকটতম ও দূরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মুসলিমদের জন্য তাদের সাধ্যানুযায়ী শক্তি ব্যয় করা কর্তব্য। যদি এর একটি, দুইটি, তিনটি অথবা এর চেয়ে বেশি দেশ তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে অন্যরা দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়। তাদেরকে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করা অপরিহার্য। তারা সাহায্য ও সমর্থনের হকদার। কেননা তারা মজলুম। আল্লাহ সকল মুসলিমকে জিহা|দের নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং মুসলিমদের উপর আবশ্যক হচ্ছে, তারা ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বে যতক্ষন না তাদের ভাইয়েরা বিজয়ী হয়। যদি তারা এ থেকে বিরত হয় তবে তারা পাপী বলে গণ্য হবে। আর যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যক্তি এর জন্য দাঁড়িয়ে যায় – তাহলে বাকিরা পাপ থেকে মুক্ত হয়। (বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৩৩৫)
.
▪️চতুর্থত: কা-ফে-র-দের বিরুদ্ধে শারিরীক জিহাদ চারটি ক্ষেত্রে ফরজে আইন হয়ে যায়। সেগুলো হলো-
.
(১). যখন কেউ জি-হা-দে অংশগ্রহণ করার জন্য জি-হা-দের ময়দানে উপস্থিত হয়ে যায়, তখন সে জি-হা-দে অংশগ্রহণ করা তার ওপর ফরয হয়ে যায়। (দেখুন সূরা আনফাল ৮/১৫, ৪৫)।
.
(২). যখন শত্রুবাহিনী বা কাফির যদি কোনো মুসলিম দেশে আক্রমণ করে, তাহলে তাদের হামলা প্রতিহত করার জন্য যে প্রতিরক্ষামূলক জি-হা-দ পরিচালনা করা হয়, সেই প্রতিরক্ষামূলক জি-হা-দে অংশগ্রহণ করা ফরযে আইন। (দেখুন সূরা তওবাহ ৯/১২৩)।
.
(৩) যখন খলীফা বা শাসক জনগনকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন, তখন সকল মুসলিমের জন্য সে জি-হা-দে অংশগ্রহণ করা তার জন্য ফরযে আইন। (দেখুন মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮)।
.
(৪). যদি দেখা যায়, জি-হা-দের এমন কিছুর প্রয়োজন হয়, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ সে-কাজ করতে সক্ষম নয়, তাহলে ওই কাজে সক্ষম ব্যক্তির ওপর উক্ত জি-হা-দে অংশগ্রহণ করা ফরযে আইন। (দেখুন তিরমিযী হা/১৪২১, মিশকাত হা/৩৫২৯)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন; যেসব স্থানে জি-হা-দ আবশ্যক হয়ে যাবে এবং ফরযে আইন হয়ে যাবে তার প্রথম পরিস্থিতি হলো- যদি কোনো ব্যক্তি এমন স্থানে উপস্থিত থাকে যেখানে কিতাল বা লড়াই চলছে। তখন জি-হা-দ একটি ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা হয়ে যায়। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ وَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِّقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কা-ফির বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তাদের মোকাবিলা করা হতে কখনোই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবেনা। আর যে ব্যক্তি সেদিন তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তাহলে সে আল্লাহর গযব নিয়ে ফিরে আসবে। তবে যুদ্ধের জন্য (কৌশলগত) দিক পরিবর্তন অথবা নিজ দলে আশ্রয় গ্রহণের জন্য হলে ভিন্ন কথা এবং তার আবাস জাহান্নাম। আর সেটি কতইনা নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল। (আল কুরআন, আনফাল ৮: ১৫-১৬)। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে- যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া ধধ্বংসাত্মক কাজগুলোর একটি। কেননা তিনি (ﷺ) সাতটি বিষয়কে মানুষের জন্য মারাত্মক বলেছেন। সেগুলোর মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া অন্তর্ভুক্ত। (সহীহ বুখারী হা/২৭৬৬, মুসলিম হা/৮৯)। এটাই সর্বসম্মত মত।
.
তবে দুই অবস্থায় যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানো যায়:
(ক). যখন একজন ব্যক্তির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এ পশ্চাদপসরণ হবে শুধুমাত্র যুদ্ধের কৌশল স্বরূপ, শক্রকে দেখাবার জন্য প্রকৃতপক্ষে এতে যুদ্ধ ছেড়ে পলায়নের কোন উদ্দেশ্য থাকবে না; বরং প্রতিপক্ষকে অসতর্কাবস্থায় ফেলে হঠাৎ আবার পাল্টা আক্রমণ করাই থাকবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য।
.
(খ). বিশেষ কোন অবস্থা- যখন কাউকে বলা হয় যে, মুসলিমদের অন্য একটি দল এই জায়গায় আছে এবং তারা হেরে যাচ্ছে। আর তখন সে পিছু হটে ঐ দলে যোগ দেয় যাতে তাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়। এক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে – সে যেই দলে ছিলো, এর দ্বারা সেই দল যেন কোনো ঝুঁকির মুখে না পড়ে। যদি এর দ্বারা ঐ দল ঝুঁকির মুখে পড়ে, তাহলে তার জন্য অন্য দলে যোগ দেয়া জায়েজ নয়। সেক্ষেত্রে এটি (জিহা|দ) তার জন্য ফরযে আইন এবং তার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা জায়েজ নাই।
.
দ্বিতীয় পরিস্থিতি হলো (জিহা-দ ফরযে আইন হবার জন্য), যখন কোনো শহর শত্রু দ্বারা অবরুদ্ধ হয়, তখন সে শহরকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ বা লড়াই করতে হবে। কেননা যখন কোনো শহরকে অবরোধ করা হয় তখন একে রক্ষার জন্য লড়াই ছাড়া উপায় থাকে না। শত্রুরা শহরের কাউকে ঢুকতে দেয় না বা শহর থেকে কাউকে বেরোতে দেয় না, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বা অন্য কোনো জিনিস ঐ শহরে পৌঁছাতে দেয় না। এই পরিস্থিতিতে সেই শহরের অধিবাসীদের জন্য জরুরী হচ্ছে নিজ শহর রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা।
.
তৃতীয় পরিস্থিতি হলো, যখন তাদের ইমাম (শাসক) সকল মুসলিমকে একত্রিত হবার আদেশ দেন। ইমাম হচ্ছেন একটি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অধিকারী। (এক্ষেত্রে তাঁর জন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইমাম হওয়া জরুরী নয়)। কেননা বহুকাল ধরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইমামত (অর্থাৎ খিলাফত) নেই। সুতরাং ইমাম ডাকলে তখন সকলের উপর জি-হা-দ ফরজ। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; তোমরা শুনো এবং আনুগত্য করো, যদিও তোমাদের ওপর হাবশী কৃতদাসকে শাসক নিযুক্ত করা হয়। (সহীহ বুখারী হা/৭১৪২)। তাই যখন কোন ব্যক্তি কোন দিক দিয়ে শাসক হবে তখন সে ইমামের স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং তখন সেই শাসকের কথা শুনতে হবে এবং তার আদেশ মেনে চলতে হবে। (ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি: খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৮-১০)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনায় যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মানহাজ অনুযায়ী জি-হা-দের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ খারেজি, শিয়া, এবং পথভ্রষ্ট বিদআতীদের আক্বীদা মানহাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জি-হা-দের শরীয়ত সম্মত সত্যাবলী বাদ দিয়ে নিজেদের মত করে ওয়াজ-মাহফিলসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় জি-হা-দের বিধিবিধান সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষদের মনে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ সঠিকটা না জানার কারণে হক পন্থী সালাফি আলেমদের বিরোধিতা করছে। তাই আপনারা ঐ সকল পথভ্রষ্ট বক্তাদের থেকে সর্বদা সাবধান থাকবেন এবং সালাফি আলেমদের কাছ থেকে মাসয়ালা-মাসায়েল জেনে নিবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তৌফিক দান করুন..আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।