শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে গায়েবানা জানাযা আদায় করার বিধান

গায়েব’ শব্দের অর্থ অনুপস্থিত। লাশের অনুপস্থিতিতে যে জানাযা পড়া হয় তাকে ‘গায়েবানা জানাযা বলে। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে থেকে গায়েবানা জানাযা আদায় করা জায়েজ কিনা এই মাসালায় আহালুল ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে অনেকগুলো মতামতের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বিশুদ্ধ মত হল যার জানাযা আদায় করা হয়নি অথবা মৃত ব্যক্তি যদি এমন দেশে থাকে যেখানে তার জানাযাহ আদায়ের কেউ নেই, যেমন নাজাশী,অথবা কেউ যদি সমুদ্রে ডুবে মারা যায় যার লাশ পাওয়া যায়নি কিংবা কাউকে হিংস্র কোন প্রাণী খেয়ে ফেলেছে ফলে তার জানাযা পড়া সম্ভব হয়নি এমন অবস্থায় তাদের গায়িবী জানাযাহ পড়া জায়েয এই মাসালায় আহালুল ইমামগনের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। যেমন: অমুসলিম দেশে জানাযা ছাড়াই দাফন হওয়ার কারণে রাসূল (ﷺ) বাদশাহ নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন। কারণ তিনি মুসলমান হয়েছিলেন।কিন্তু সেখানে তাঁর জানাযা পড়ার মত কেউ ছিল না। সুতরাং কোন ব্যক্তির জানাযা হয়ে থাকলে পুনরায় গায়েবানা জানাযা আদায়ের ব্যাপারে কুরআন হাদীসে কোন দলীল পাওয়া যায় না।যদিও কেউ কেউ বিখ্যাত আলেম, মুস্তাহিদ, অথবা মুসলিম শাসক ইত্যাদি সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া বৈধ মর্মে মত দিয়েছেন।কিন্তু তাদের মতের পক্ষে শুধুমাত্র বাদশাহ নাজাশী ছাড়া অন্য কোন দলিল নেই। আর আমরা জানি নাজাশী অমুসলিম দেশে মৃত্যুবরন করার কারনে তার জানাযা পড়া হয়নি বলেই রাসূল ﷺ সাহাবিদের নিয়ে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেছিলেন। দলিল হল:
.
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাবশার বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ তাঁর মৃত্যুর দিনই মানুষদেরকে জানিয়েছেন (অথচ তিনি মারা গিয়েছিলেন সুদূর হাবশায়)। তিনি সহাবা কিরামকে নিয়ে ঈদগায় গেলেন। সেখানে সকলকে জানাযার সালাতের জন্য কাতারবদ্ধ করলেন এবং চার তাকবীর বললেন। (সহীহ বুখারী ১৩৩৩, আবূ দাঊদ ৩২০৪, মুয়াত্ত্বা মালিক ২৫৭, ইবনু হিব্বান ৩০৬৮, ইরওয়া ৭২৯, মুসলিম ৯৫১মিশকাত হা/১৬৫২)।উক্ত হাদীসের আলোকে একদল আলেম বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাশীর জন্য গায়িবী জানাযাহ্ আদায় করিয়েছিলেন, এর প্রকৃতি ও বাস্তবতা নিয়ে মনীষীদের বক্তব্য হল ঐ সময় তার লাশ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল, তিনি তা প্রত্যক্ষ করে জানাযাহ্ আদায় করেছেন, তবে লোকেরা দেখতে পায়নি। অথবা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও লাশের মাঝের দূরত্বের ব্যবধান অথবা পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং তিনি তার লাশ প্রত্যক্ষ করেই জানাযাহ্ আদায় করেছিলেন। কেউ বলেছেন, গায়িবী জানাযাহ্ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য খাস ছিল,অন্যের বেলায় বৈধ নয়। (মিশকাতুল মাসাবিহ হা/১৬৫২ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য) তবে বিশুদ্ধ কথা হল গায়েবানা জানাযা শুধুমাত্র রাসূল ﷺ এর জন্য খাস নয় কেননা বাদশা নাজাশীর জানাযাা রাসূল ﷺ একাকী আদায় করেননি বরং সাহাবিদের সাথে নিয়ে আদায় করেছেন যদি এটি শুধুমাত্র তার জন্য খাস হত তাহলে তিনি সাহাবিদের নিয়ে আদায় না করে একাকী আদায় করতেন। সুতরাং যার জানাযা পড়া হয়নি তার জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ।
.
ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যদি গায়েবানা জানাযা জায়েয হ’ত, তাহ’লে রাসূল (ﷺ) নিশ্চয়ই নিজের ছাহাবীদের গায়েবানা জানাযা আদায় করতেন (যাদের জানাযায় তিনি শরীক হ’তে পারেননি)। অনুরূপভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলমানেরা তাদের প্রিয় চার খলীফার গায়েবানা জানাযা পড়ত। কিন্তু এরূপ কথা কারু থেকে কখনো বর্ণিত হয়নি’ (আল-জাওহারুন নাক্বী শরহ সুনানুল বায়হাক্বী: ৪/৫১)।
.
ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুসলমানদের মাঝে অনেক এমন ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দূরে তথা গায়েব ছিলেন। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কারোরই গায়েবানা জানাযা পড়েননি। [যাদুল মাআদ, ১/৫১৯]
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে গায়েবানা জানাযার বিধান কি?জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে শাইখ বলেন,

বিদ্বানদের মতামতের মধ্যে প্রাধান্যযোগ্য মত হচ্ছে গায়েবানা জানাযা শরীয়ত সম্মত নয়। তবে যে ব্যক্তির জানাযা হয়নি তার গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে। যেমন জনৈক মুসলমান কোন কাফের ভুখন্ডে মৃত্যু বরণ করল অথবা সমুদ্র বা নদীর পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করল কিন্তু তার লাশ পাওয়া গেল না। তখন তার গায়েবানা জানাযা আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু যার জানাযা পড়া হয়েছে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করা শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা এ ব্যাপারে নাজাশীর জন্য গায়েবানা জানাযা ছাড়া হাদীছে আর কোন দলিল নেই। কিন্তু নাজাশীর জানাযা তার নিজ দেশে পড়া হয়নি। এজন্য নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনায় তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে অনেক নেতৃবৃন্দ ও গোত্রপ্রধান মৃত্যু বরণ করেন কিন্তু এরকম কোন বর্ণনা নেই যে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের গায়েবানা জানাযা আদায় করেছেন। বিদ্বানদের মধ্যে আবার কেউ বলেন, মৃত ব্যক্তি যদি এমন পর্যায়ের লোক হয় যার সম্পদ, কার্যক্রম ও জ্ঞানবিদ্যা দ্বারা ধর্মের উপকার ও কল্যাণ সাধিত হয়েছে তবে তার গায়েবানা জানাযা পড়া যায়। আর এরূপ না হলে গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে না। আবার কেউ বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই সব ধরণের ব্যক্তির জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েয। এটি সর্বাধিক দুর্বল মত।(উসাইমীন ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম ও মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড: ১৭ পৃষ্ঠা:১৪৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।