১০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করলে জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে মর্মে বর্ণিত হাদীসটি কি সহীহ

হাদীসটির পরিপূর্ণ বর্ননাটি হলো: عن معاذ بن أنس الجهني صاحب النبي صلى الله عليه وسلم، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: ” من قرأ: قل هو الله أحد حتى يختمها عشر مرات، بنى الله له قصرا في الجنة ” فقال عمر بن الخطاب: إذا نستكثر يا رسول الله؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ” الله أكثر وأطيب
রাসূল (ﷺ) এর বিশিষ্ট সাহাবী মোয়াজ বিন আনাস আল-জুহানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘যে ব্যক্তি দশবার সূরা ইখলাস পাঠ করবে,”কুল হুয়াল্লাহু আহাদ” আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করবেন।’ এ কথা শুনে ওমর ইবনে খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন: তাহলে আমরা বেশি বেশি করে পড়বো হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল (ﷺ) বললেন, আল্লাহও বেশি দানশীল ও বেশি পবিত্র। (মুসনাদে আহমাদ, ৩/৪৩৭, হা/১৫৬১০; সিলসিলা সহীহা, হা/৫৮৯; সহীহুল জামে‘, হা/৬৪৭২)।
.
হাদীসটির সনদ: এই হাদিসটি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) তার মুসনাদে আহমেদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর হাদিসের সানাদ হলো: আব্দুল্লাহ আমাদেরকে বলেছেন, আমার পিতা আমাকে বলেছেন, আমাদেরকে হাসান বলেছেন, আমাদেরকে ইবনে লাহিয়া বলেছেন, তিনি বলেছেন, ইয়াহইয়া বিন গাইলান আমাদেরকে বলেছেন, রাশদীন আমাদেরকে বলেছেন। জাবান বিন ফায়েদ আল-হাবরানী, আমাদেরকে সাহল বিন মোয়াজ বিন আনাস আল-জুহানি থেকে তাঁর পিতা রাসূল সা. এর বিশিষ্ট সাহাবী মোয়াজ বিন আনাস আল-জুহানীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৮১৫২)
.
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ-জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মতে হাদীসটি জয়ীফ। কারণ হাদীসটির সনদে ইবনে লাহইয়া,রাশদীন ইবনে সা’দ এবং জাবান ইবনে ফায়েদ থাকার কারণে হাদিসটি যয়ীফ হয়েছে। মিসরীয় মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক আলেম আবুল হাসান নূরুদ্দীন আলী ইবনু আবি বকর আল-হায়ছামী (মৃ.৭৩৫-৮০৭হিঃ) বলেন,এ সনদের মধ্যে রাশদীন ইবনে সা’দ এবং জাবান ইবনে ফায়েদ থাকার কারণে হাদিসটি যয়ীফ হয়েছে। তারা দুইজনই শৈথিল্যবাদী।(মাজমুয়াজ জাওয়ায়েদ,৭/১৪৫)
.
মুসনাদে আহমদের ভাষ্যকার মুহাক্কিক শু‘আইব আরনাউত্ব (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতেও এই হাদীসটি দুর্বল।(তাখরীজ আল-মুসনাদ শুয়াইব:২৪/৩৭৭)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমামআব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] হাদীসটির সনদ সহ উল্লেখ করে বলেন, আমার কথা হলো: জাবান ইবনে ফায়েদ একজন দুর্বল রাবী যেমনভাবে “তাক্বরীবে” বর্ণিত হয়েছে। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) “তাহযীবুত তাহযীব” এ একই কথা বলেছেন।ইমাম আহমদ বলেছেন তার সমস্ত বর্ণনাগুলো হলো মুনকার। ইবনে মাঈন বলেছেন; সে একজন জয়ীফ রাবী। ইবনে হিব্বান বলেছেন- তিনি মুনকিরুল হাদিস। আবু হাতেম বলেছেন; তিনি একজন সৎ আলেম। ইমাম শাজি বলেছেন- তার বর্ণনাগুলো মুনকার।সুতরাং উপরে উল্লেখিত সকল ইমামদের কাছ থেকে জানা গেল যে,জাবান ইবনে ফাইদ একজন দুর্বল রাবী। এটা সার্বজনীন বিদিত যে সূরা ইখলাসের অনেক ফজিলত রয়েছে; যার বর্ণনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেকগুলো সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। যেমন: সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। এছাড়াও এই সূরার ফজিলত সম্পর্কে আরও অনেক হাদিস আছে। (বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ২৬ পৃষ্ঠা: ২৮১)
.
অপরদিকে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]
উক্ত হাদীসের ত্বাবারানী হা/৩৯৭ ও দারেমী, ২/৪৫৯-এ শাওয়াহেদ থাকার কারনে হাদীসটি আমলযোগ্য বলেছেন। (সিলসিলা সহীহা, হা/৫৮৯; সহীহুল জামে‘, হা/৬৪৭২)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস দশবার পাঠ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন এই মর্মে বর্নিত হাদীসটি অধিক বিশুদ্ধ মতে, জয়ীফ। যা আমি তাহক্বীকসহ উল্লেখ করেছি। তবে হাদীসটি জয়ীফ হলেও একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা সূরা ইখলাসের ফজিলত প্রমানিত। যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সূরা ইখলাস একবার পড়লে এক-তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠের সমান সওয়াব পাওয়া যায়।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৮১১;সহীহ বুখারী, হা/৫০১৩; মিশকাত, হা/২১২৭)। এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ইখলাসকে পছন্দ করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’ (তিরমিযী, হা/১৯০১; মিশকাত, হা/২১৩০)। পাশাপাশি জেনে রাখা ভাল যে, সূরা ইখলাস ৫০, ১০০, কিংবা ২০০ বার পাঠ করার ফযীলত সম্পর্কে কয়েকটি বর্ননা রয়েছে তবে তার সবগুলোই যঈফ একটিও সহীহ নয়।(দেখুন তিরমিযী, হা/২৮৯৮; সিলসিলা যঈফা, হা/৩০০; মিশকাত, হা/২১৫৮-৫৯)। অএতব, আমাদের উচিত জাল-জয়ীফ হাদীসের আমল বর্জন করে বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে আমল করা। আর সূরা ইখলাস যেহেতু ফজিলতপূর্ণ একটি সূরা তাই এই সূরাটির অর্থ এবং মর্ম উপলব্ধি করে অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয়,আশা এবং ভালোবাসা রেখে অধিক হারে তেলাওয়াত করে মহান আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের উত্তম প্রতিদান প্রত্যাশা করা। কারণ আল্লাহর ভালোবাসা জান্নাতে যাওয়ার কারণ। আর আল্লাহ কাউকে জান্নাত দিলে তিনি তাকে ভালোবেসেই জান্নাতে দিবেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।