রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সালাত আদায় করতেন

প্রশ্ন: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ) যেভাবে সালাত আদায় করতেন বিস্তারিত বর্ননা সহ জানতে চাই?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষ-নারীন,ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলের জন্যই বলেছেন, صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ ‘তোমরা ঠিক সেভাবেই সালাত কর,যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখছ।’(সহীহ বুখারী, হা/৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬) উক্ত হাদীসের আলোকে আমরা রাসূল (ﷺ) এর সালাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
সর্বপ্রথম সালাতের জন্য ওযু-গোসল করে পবিত্র হয়ে পরিচ্ছন্ন পোষাক ও দেহ-মন নিয়ে কা‘বা গৃহ পানে মুখ ফিরিয়ে মনে মনে সালাতের দৃঢ় সংকল্প করে স্বীয় প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় তাঁর সম্মুখে বিনম্রচিত্তে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।কেননা সালাতের শুরুতে নিয়ত করা অপরিহার্য।আর সকল কাজ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই-ই পাবে,যার জন্য সে নিয়ত করবে’ (সহীহ বুখারী: ১)। অতঃপর দুনিয়াবী সবকিছুকে হারাম করে দিয়ে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করে বলবে ‘আল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)’ বলে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ সহ দু’হাত কান অথবা কাঁধ বরাবর উঠিয়ে বুকের উপর বাঁধবে। (মুসলিম হা/৯১২, ১/১৭০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৬৯); বুখারী হা/৬৬৬৭, ২/৯৮৬ পৃঃ; মিশকাত হা/৭৯০)। এ সময় বাম হাতের উপরে ডান হাত কনুই বরাবর রাখবে অথবা বাম হাতের কব্জির উপরে ডান হাতের কব্জি রেখে বুকের উপরে হাত বাঁধবে। [সহীহ বুখারী হা/৭৪০, ১/১০২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭০৪, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২); নাসাঈ হা/৮৮৯, ১/১০২ পৃঃ; আবুদাঊদ হা/৭২৭, ১/১০৫ পৃঃ) জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করলে কাতারের মাঝে পরস্পরের পায়ের সাথে পা, টাখনুর সাথে টাখনু এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে।(আবু দাঊদ হা/৬৬৬, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৭, সনদ সহীহ; মিশকাত হা/১১০২, পৃঃ ৯৯)। সেই সাথে সিজদা বা তার এরিয়ার মধ্যে দৃষ্টি রাখবে।(মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৭৬১; বায়হাক্বী, সনানুল কুবরা হা/১০০০৮)। অতঃপর সানা’ (الثناء) অর্থ ‘প্রশংসা’। এটা মূলতঃ ‘দো‘আয়ে ইস্তেফতা-হ’ (دعاء الاستفتاح) বা সালাত শুরুর দো‘আ। বুকে জোড় হাত বেঁধে সিজদার স্থানে দৃষ্টি রেখে বিনম্রচিত্তে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে মুসল্লী তার সর্বোত্তম ইবাদতের শুভ সূচনা করবে اَللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِىْ وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ اَللَّهُمَّ نَقِّنِىْ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الْأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ اَللَّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَد. অনুবাদ: হে আল্লাহ! আপনি আমার ও আমার গোনাহ সমূহের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন, যেমন দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে পরিচ্ছন্ন করুন গোনাহ সমূহ হতে,যেমন পরিচ্ছন্ন করা হয় সাদা কাপড় ময়লা হতে। হে আল্লাহ! আপনি আমার গুনাহ সমূহকে ধুয়ে সাফ করে দিন পানি দ্বারা,বরফ দ্বারা ও শিশির দ্বারা।’(বুখারী হা/৭৪৪, ১/১০২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭০৮, ২/১০৩ পৃঃ); মিশকাত হা/৮১২, পৃঃ ৭৭)। সানা পাঠ শেষ করে ‘আ‘ঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্ব-নির রজীম মিন হামযিহী, ওয়া নাফখিহী ওয়া নাফছিহী। (আবু দাঊদ হা/৭৭৫, ১/১১৩ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৪২) ও ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ সহ সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।(সহীহ বুখারী হা/৭৫৬, ১/১০৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭২০, ২/১০৯ পৃঃ)। প্রকাশ থাকে যে, ‘আঊযুবিল্লাহ’ কেবল ১ম রাক‘আতে পড়বে।পরের রাক‘আতগুলো ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ বলে সূরা ফাতিহা শুরু করবে। জেহরী-সির্রী উভয় সালাতে ‘বিসমিল্লাহ’ নীরবে পড়বে।(বুখারী হা/৭৪৩, ১/১০৩ পৃঃ. (ইফাবা হা/৭০৭, ২/১০৩ পৃঃ); মুসলিম হা/৯১৪; মিশকাত হা/৮২৪ ও ৮২৩) এবং ফাতিহা শেষে উচ্চৈঃস্বরে ‘আমীন’ বলবে। (বুখারী হা/৭৮০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০৭, (ইফাবা হা/৭৪৪ ও ৭৪৬, ২/১২১ পৃঃ)। জেহরী-সালাতে মুক্তাদীগণ ইমামের সাথে সাথে শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে। (বুখারী হা/৭৫৬, ১/১০৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭২০, ২/১০৯ পৃঃ) ক্বিরাআত শেষে ইমাম আমীন বলা শুরু করলে মুক্তাদীও তার সাথে মিলে এক সঙ্গে আমীন বলবে। (বুখারী হা/৭৮০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০৭, (ইফাবা হা/৭৪৪ ও ৭৪৬, ২/১২১ পৃঃ) উল্লেখ্য, ইমামের আমীন বলার আগেই মুক্তাদীর আমীন বলার যে অভ্যাস চালু তা বর্জন করতে হবে।

◾ক্বিরাআত: সূরা ফাতিহা পাঠ শেষে ইমাম হলে কিংবা মুসল্লী একাকী হলে প্রথম দু’রাক‘আতে কুরআন থেকে অন্য সূরা বা কিছু আয়াত পাঠ করবে। তবে মুক্তাদী হলে জেহরী সালাতে ইমামের সাথে সাথে শুধু সূরা ফাতিহা পড়বে। অতঃপর ইমামের ক্বিরাআত মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে। (বুখারী হা/৭৫৬, ১/১০৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭২০, ২/১০৯ পৃঃ)। আর যোহর ও আসরের সালাতে ইমাম মুক্তাদী উভয়ে প্রথম দুই রাক‘আতে সূরা ফাতিহা সহ অন্য সূরা পড়বে। (ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩, পৃঃ ৬১; সনদ ছহীহ, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৬, ২/২৮৮ পৃঃ)। আর শেষের দু’রাক‘আতে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। (বুখারী হা/৭৭৬, ১/১০৭ পৃঃ; মিশকাত হা/৮২৮, পৃঃ ৭৯)। অবশ্য মুক্তাদী প্রথম দুরাকাতে শুধু সূরা ফাতেহা পড়লেও সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। (সহীহ বুখারী: ৭৫৬)।

◾রুকূ: ক্বিরাআত শেষে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে দু’হাত কান কিংবা কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করে রুকূতে যাবে।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, সহীহ বুখারী হা/৭৩৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০২)। হাঁটুর উপরে দু’হাতে ভর দিয়ে পিঠ ও মাথা সোজা রাখবে। এ সময় বাহুসহ দুই হাত ও হাঁটুসহ দুই পা শক্ত করে সোজা রাখবে।(মুসলিম হা/১১৩৮; মিশকাত হা/৭৯১; বুখারী হা/৮২৮; মিশকাত হা/৭৯২; আবুদাঊদ হা/৮৫৯)। আর নামাযে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হত সিজদার স্থানে। (মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল,৩৫৪)। অতঃপর রুকূর দু‘আ পড়বে দোয়াটি হল سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمউচ্চারন: সুবহা-না রাব্বিয়াল আযীম।অর্থ:-আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতাঘোষণা করছি।এটি ৩ বার পাঠ করবে। (বুখারী হা/৭৯৪ ও ৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/৮৮৮)। এছাড়া সাথে আরো দোয়া পড়তে পারেন দেখুন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৭১)। নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) রুকূতে স্থিরতা অবলম্বন করতেন। এ ব্যাপারে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশও করেছেন। আর তিনি বলতেন, “তোমরা তোমাদের রুকূ ও সিজদাকে পরিপূর্ণরুপে আদায় কর। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, আমি আমার পিঠের পিছন থেকে তোমাদের রুকু ও সিজদাহ করা দেখতে পাই। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৬৮)।

◾কওমা: অতঃপর রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে প্রশান্তির সাথে দাঁড়াবে এবং কান বা কাঁধ বরাবর দুই হাত উঠিয়ে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/৭৩৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০২) উক্ত কওমায় রাসূল( ﷺ) এরুপ খাড়া হতেন যে,মেরুদন্ডের প্রত্যেক (৩৩ খানা) হাড় নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যেত। (বুখারী ৮২৮, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯২)। এ সময় ‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’ বলে দু‘আ পাঠ করবে। (বুখারী হা/৭৯৫)। তারপর বলবে رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ ‘রববানা লাকাল হাম্দ’ বলবে। অথবা বলবে رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ ‘রববানা ওয়া লাকাল হাম্দু হাম্দান কাছীরান ত্বাইয়েবাম মুবা-রাকান ফীহি’। (বুখারী হা/৭৯৯; মিশকাত হা/৮৭৭)।সেই সাথে দুই হাত স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে দিবে। (বুখারী হা/৮২৮, ১/১১৪ পৃঃ; মিশকাত হা/৭৯২)। উল্লেখ যে,বর্ণনা থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু’ বললে মুক্তাদী ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বলবে। তবে এখানে এ কথা নিশ্চিত নয় যে,মুক্তাদী ‘সামিআল্লাহু’ বলবে না। বরং মুক্তাদীও উভয় বাক্যই বলতে পারে। যেহেতু আল্লাহর নবী (ﷺ) উভয়ই বলেছেন। (দেখুন, মুসলিম, আবূদাঊদ,প্রভৃতি, মিশকাত ৭৯৩ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৩৫-১৩৬পৃ:)
উল্লেখ্য যে,শাইখ ইবনে উসাইমীন ও বিন বাযসহ (রহঃ) কতিপয় বিদ্বানের অভিমত হ’ল ইমাম ‘সামি‘আল্লাহ’ এবং ‘রববানা’ ঊভয়টি বলবে। আর মুক্তাদী কেবল ‘রববানা লাকাল হামদ’ বললেই যথেষ্ট হবে (উসাইমীন,লিকাউল বাবিল মাফতুহ,৩২০/১; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৭/৯৩-৯৪)। তবে উভয়ের জন্য দু’টি বাক্য বলার বিষয়টিই সহীহ হাদীসের অধিক নিকটবর্তী (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬২; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন্নবী ১৩৫ পৃ)।
.
◾সিজদা: অতঃপর ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে প্রথমে দু’হাত ও পরে দু’হাঁটু মাটিতে রেখে সিজদায় যাবে ও দু‘আ পড়বে এই মর্মে হাদীসগুলো বেশি এবং সহীহ। (আবুদাঊদ হা/৮৪০, ১/১২২ পৃঃ; নাসাঈ হা/১০৯১, ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৮৯৯)। আবার প্রথমে হাঁটু রাখার হাদীসও বহু উলামার নিকট শুদ্ধ। তাই তাঁদের নিকট উভয় আমলই বৈধ। সুবিধামত হাত অথবা হাঁটু আগে রাখতে পারে নামাযী। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ ২২/৪৪৯, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৯১, উদ্দাহ্‌ ৯৬পৃ:)। এ সময় হাত দু’খানা ক্বিবলামুখী করে মাথার দু’পাশে কাঁধ বরাবর মাটিতে রাখবে।(আবুদাঊদ হা/৭৩৪, ১/১০৭ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৭০, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৮০১, পৃঃ ৭৬)।কপালের সাথে নাকটিকেও মাটি বা মুসাল্লার সঙ্গে লাগিয়ে দিতেন। (আবুদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল,৩০৯ )।হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবে। (হাকেম হা/৮১৪;বালাগুল মারাম হা/২৯৭, সনদ সহীহ) কনুই উঁচু রাখবে ও বগল ফাঁকা রাখবে। (বুখারী হা/৮০৭, (ইফাবা হা/৭৭০, ২/১৩৫ পৃঃ), হাঁটু বা মাটিতে ঠেস দিবে না।(বুখারী হা/৮২২, (ইফাবা হা/৭৮৪, ২/১৪১ পৃঃ)। সিজদা লম্বা হবে ও পিঠ সোজা থাকবে। যেন নীচ দিয়ে একটি বকরীর বাচ্চা যাওয়ার মত ফাঁকা থাকে। (মুসলিম হা/১১৩৫; আবুদাঊদ হা/৮৯৮; মিশকাত হা/৮৯০, পৃঃ ৮৩)।দুই পা খাড়া করে এক সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে।(সহীহ মুসলিম হা/১১১৮, ১/১৯২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৯৭২) এ সময় আঙ্গুলগুলো ক্বিবলামুখী করে রাখবে। (বুখারী হা/৮২৮, ১/১১৪ পৃঃ; মিশকাত হা/৭৯২)।গোড়ালি দু’টিকে একত্রে মিলিয়ে রাখবে। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৬৫৪ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২২৮)। অতঃপর سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى বলবে কমপক্ষে তিনবার বলবে। (ইবনু মাজাহ হা/৮৮৮; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল হা/৩৩৩) সিজদাতে পঠিতব্য আরো দু‘আ আছে। চাইলে পড়তে পারেন।(সহীহ মুসলিম,৪৮৩-৪৮৬) জেনে রাখা ভাল যে, ধীর-স্থিরভাবে সিজদাহ করা ওয়াজিব। তাড়াহুড়ো করে নামায শুদ্ধ হয় না। সিজদায় গিয়ে ধীরতা ও স্থিরতা অবলম্বন করে পিঠ সোজা না করলে এবং প্রত্যেক হাড় তার নিজের জোড়ে স্থিরভাবে বসে না গেলে মুরগীর দানা খাওয়ার মত নামায পড়া হয় ও নামায চুরি করা হয়। আর সিজদায় পিঠ সোজা না করলে নামাযও বাতিল পরিগণিত হয়। সিজদা থেকে উঠে বাম পায়ের পাতার উপরে বসবে ও ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে। (বুখারী, বায়হাকী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৫১পৃ:)। আর এই পায়ের আঙ্গুল গুলোকে কেবলামুখী করে রাখতেন। (সহিহ, নাসাঈ, সুনান ১১০৯ )। আবার কখনো কখনো রাসূল (ﷺ) এই বৈঠকে দুই পায়ের পাতাকে খাড়া রেখে পায়ের দুই গোড়ালির উপর বসতেন। এই প্রকার বৈঠক প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘এরুপ বসা সুন্নত।’ (মুসলিম, সহীহ ৫৩৬ আবূদাঊদ, ৮৪৫)।এ সময় প্রশান্তির সাথে বসবে এবং বলবেاَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَاجْبُرْنِىْ وَاهْدِنِىْ وَعَافِنِىْ وَارْزُقْنِىْ ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার উপরে রহম করুন, আমার অবস্থার সংশোধন করুন, আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, আমাকে সুস্থতা দান করুন ও আমাকে রূযী দান করুন।’(তিরমিযী হা/২৮৪, ১/৬৩ পৃঃ; আবুদাঊদ হা/৮৫০, ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৯০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৮৪০, ২/৩০১ পৃঃ)।প্রকাশ থাকে যে, এই বৈঠকে আঙ্গুল ইশারা করার হাদীস সহীহ নয়।(মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ৮২পৃ)। অতঃপর ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে দ্বিতীয় সিজদায় যাবে ও দু‘আ পড়বে। ২য় ও ৪র্থ রাক‘আতে দাঁড়ানোর সময় সিজদা থেকে উঠে শান্তভাবে বসবে। দ্বিতীয় সিজদাহ্‌ থেকে মাথা তুলে নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) পুনরায় বাম পায়ের উপর সোজা হয়ে বসে যেতেন। এতে তাঁর প্রত্যেক হাড় নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যেত।(সহীহ বুখারী ৬৭৭, ৮২৩)।এই বৈঠক-কে ‘জালসা-এ ইস্তিরাহাহ্‌’ আরামের বৈঠক বলা হয়। কারণ, এতে প্রথম ও তৃতীয় রাক্‌আত শেষ করে দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাকআত শুরু করার পূর্বে একটু আরাম নেওয়া হয় তাই। অবশ্য সুন্নতের এই বৈঠকটি দুই সিজদার মাঝের বৈঠকের মত লম্বা হবে না। কেবল সোজা হওয়ার মত হাল্কা একটু বসতে হবে। তবে এতে পঠনীয় কোন যিক্‌র বা দুআ নেই। অতঃপর মাটিতে দু’হাত রেখে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (বুখারী হা/৮২৩, ১/১১৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৮৫ ও ৭৮৬, ২/১৪১ পৃঃ); মিশকাত হা/৭৯৬) উল্লেখ্য যে,রুকূ ও সিজদায় কুরআন থেকে কোন আয়াত পড়বে না।(মুসলিম হা/১১০২; মিশকাত হা/৮৭৩)।
.
◾বৈঠক: ২য় রাক‘আত শেষ করার পর বৈঠকে বসবে। ১ম বৈঠক হলে কেবল ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়বে। (মুসলিম হা/১১৩৮; মিশকাত হা/৭৯১; সিফাতু সালাতিন নাবী, পৃঃ ১৬০)। তারপর মাটির উপর দুই হাত রেখে ভর দিয়ে ৩য় রাক‘আতের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে।(বুখারী হা/৮২৩, ১/১১৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৮৫ ও ৭৮৬, ২/১৪১ পৃঃ); মিশকাত হা/৭৯৬)আর যদি শেষ বৈঠক হয়, তবে ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ার পরে দরূদ, দু‘আয়ে মাসূরাহ পড়বে। (বুখারী হা/৮৩৫, ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৫০; মুসলিম হা/১৩৫৪)। যে বৈঠকের শেষে সালাম ফিরাতে হয়,তাকে শেষ বৈঠক বলে। এটি ফরয, যা না করলে সালাত বাতিল হয়। তবে ১ম বৈঠকটি ওয়াজিব, যা ভুলক্রমে না করলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়। ২য় রাক‘আত শেষে বৈঠকে বসবে। ১ম বৈঠকে বাম পায়ের পাতার উপরে বসবে এবং শেষ বৈঠকে ডান পায়ের তলা দিয়ে বাম পায়ের অগ্রভাগ বের করে নিতম্বের উপরে বসবে এবং ডান পা খাড়া রাখবে ও আঙ্গুলগুলো ক্বিবলামুখী করবে। (বুখারী হা/৮২৮, ১ম খন্ড, পৃঃ ১১৪, (ইফাবা হা/৭৯০, ২/১৪৪ পৃঃ); মিশকাত হা/৭৯২)।এ সময় আঙ্গুলগুলো সাধারণভাবে খোলা রাখবে।(আবুদাঊদ হা/৭৩০; মিশকাত হা/৮০১) জোড়-বেজোড় যেকোন সালাতের সালামের বৈঠকে নারী-পুরুষ সকলকে এভাবেই বাম নিতম্বের উপর বসতে হয়। একে ‘তাওয়ার্রুক’ (التورك) বলা হয়।(সহীহ ইবনু হিববান হা/১৮৬২,৬৭,৭৩; বুখারী হা/৮২৮)। বৈঠকের সময় বাম হাতের আঙ্গুল বাম হাঁটুর উপর ক্বিবলামুখী করে রাখবে। আর ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল মধ্যমা আঙ্গুলের পিঠে রেখে মুষ্টিবদ্ধ করে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ইশারা করবে। (সহীহ মুসলিম হা/১৩৩৬, ১৩৩৮, ১/২১৬ পৃঃ) অন্য হাদীছে এসেছে, ৫৩-এর ন্যায় মুষ্টিবদ্ধ রেখে সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত শাহাদাত অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করতে থাকবে।(সহীহ মুসলিম হা/১৩৩৮, ১/২১৬ পৃঃ, (ইফাবা হা/১১৮৬); মিশকাত হা/৯০৬) এ সময় শাহাদাত আঙ্গুলের দিকে দৃষ্টি রাখবে। (নাসাঈ হা/১২৭৫, ১১৬০, ১/১৩০ পৃঃ ও ১/১৪২ পৃঃ)। দুই তাশাহ্হুদেই ইশারা করবে। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/২৯০৩; সনদ সহীহ, সিফাতু সালাতিন নবী, পৃঃ ১৫৯) সুতরাং দুআ শেষ না করা (সালাম ফিরার পূর্ব) পর্যন্ত তর্জনী হিলানো সুন্নত। যেহেতু দুআ সালাম ফিরার পূর্বেই শেষ হয়ে থাকে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৫৮-১৫৯ পৃ:) নাবী (ﷺ),বলতেন, “অবশ্যই ঐ তর্জনী শয়তানের পক্ষে লোহা অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক (খোঁচার দন্ড)। (আহমাদ, মুসনাদ ২/১১৯, বাযযার, মাক্বদিসী,প্রমুখ)।ইবনে উমার (রাঃ) বলেন,‘ঐ আঙ্গুলটি শয়তানের জন্য আঘাত-দন্ড। যে এইভাবে ইশারা করে,সে (নামাযে) উদাসীন হয় না।’ ‘আত্তাহিইয়া-তু’, ‘দরূদ’, দু‘আ মাসূরা ও অন্যান্য দু‘আ পড়া শেষ করে ডানে ও বামে ‘আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম ফিরাবে। (বুখারী হা/৮৩৪ ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছে-১৪৯; মিশকাত হা/৯৪২, পৃঃ ৮৭)। উল্লেখ্য যে, প্রথম সালামের সাথে ‘ওয়া বারাকা-তুহু’ যোগ করা যায়। (আলবানী, সহীহ আবু দাঊদ হা/৯১৫, ১/১৪৩ পৃঃ; উল্লেখ্য যে, আবু দাঊদের কোন ছাপায় ‘ওয়া বারাকাতুহু’ অংশটুকু নেই। (আবুদাঊদ হা/৯৯৭)। উল্লেখ্য যে, সালাম ফিরার সময় হাত দ্বারা ইশারা বৈধ নয়। একদা সাহাবাদেরকে এমন ইশারা করতে দেখলে তিনি বললেন, “কি ব্যাপার তোমাদের? দুরন্ত ঘোড়ার লেজের মত করে হাত দ্বারা ইশারা করছ? যখন তোমাদের কেউ সালাম ফিরবে, তখন সে যেন তার (পার্শ্ববর্তী) সঙ্গীর প্রতি চেহারা ফেরায় এবং হাত দ্বারা ইশারা না করে।” অতঃপর সাহাবাগণ এরুপ ইশারা করা হতে বিরত হয়ে যান। অন্য এক বর্ণনায় আছে,তিনি বললেন,“তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, (সালাম ফিরার সময়) হাত নিজ ঊরুর উপর রাখবে। অতঃপর ডানে ও বামে (উপবিষ্ট) ভাই-এর প্রতি সালাম দেবে।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩১, আহমাদ, মুসনাদ, সিরাজ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৭৩৩ ত্বাবারানীরানী, মু’জাম)। উক্ত হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে,জামাআতের নামাযে নামাযী সালাম দেয় পাশের নামাযীকে। কিন্তু একা নামাযে সালাম দেওয়া হয় ফেরেশতাকে। পরন্তু পাশের নামাযী সালাম ফিরলে তার জওয়াব দিতে হয় না। কারণ, সে সময় সকলেই একে অপরকে সালাম দিয়ে থাকে। অতএব জওয়াব থাকে তাতেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৮৮-২৮৯)। সালাম ফিরেই নামাযের কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে খেয়াল রাখার বিষয় যে, যে তরতীব ও পর্যায়ক্রমে মহানবী (ﷺ) নামায ও তার সকল আমল সম্পন্ন করেছেন, সেই পর্যায়ক্রমেই নামায পড়া নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত অথবা ফরয। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৯৫পৃ:)। সালাম ফিরিয়ে প্রথমে সরবে তিনবার বলবে أَسْتَغْفِرُ الله আস্তাগফিরুল্লা-হ’। অর্থাৎ আমি আল্লাহ নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সেই সাথে বলবে اَللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ. ‘হে আল্লাহ আপনিই শান্তি,আপনার থেকেই আসে শান্তি। বরকতময় আপনি, হে মর্যাদা ও সম্মানের মালিক।’ (সহীহ মুসলিম হা/১৩৬২, ১/২১৮ পৃঃ; মিশকাত হা/৯৬১)। এ সময় ইমাম হলে প্রত্যেক সালাতে ডানে অথবা বামে ঘুরে সরাসরি মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে বসবে।(সহীহ বুখারী হা/৮৪৫, ১/১১৭ পৃঃ (ইফাবা হা/৮০৫, ২/১৫২ পৃঃ)। অতঃপর ইমাম মুক্তাদী সকলে সালামের পরের যিকির সমূহ পাঠ করবে। (বুখারী হা/৮৪৪, ১/১১৭ পৃঃ; মুসলিম হা/১৩৬৬, ১/২১৮ পৃঃ; মিশকাত হা/৯৬২)।সালাম ফিরানোর পর পরই দ্রুত উঠে যাবে না। এটা বদ অভ্যাস। (আহমাদ হা/২৩১৭০; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/২৫৪৯)। বরং এ সময় ‘আয়াতুল কুরসী’সহ অন্যান্য দু‘আ পাঠ করবে। (নাসাঈ, আল-কুবরা হা/৯৯২৮, ৬/৩০ পৃঃ; সনদ সহীহ, সিলসিলা ছহীহাহা হা/৯৭২)।দেশের অধিকাংশ মসজিদে ফরয সালাতের সালাম ফিরানোর পর পরই দুই হাত তুলে প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাত করা হয়। অথচ এই প্রথার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মত, এভাবে সম্মিলিত মুনাজাত করা বিদআত।বরং সবাই নিজের মত করে কুরআন সুন্নাহর দোয়াগুলো পড়বে।(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৭/১০৩-১০৫ পৃ. ফৎওয়া নং-৩৫৫২ এবং ৫৭৬৩)।
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।