রাতে স্ত্রী সহবাস করে ফজরের সময় পর্যন্ত অযু কিংবা গোসল বিলম্বিত করলে কি গুনাহ হবে

কুরআন হাদীসের দলিল এবং জমহুর সালাফদের অধিক বিশুদ্ধ মতে স্ত্রী সহবাস, স্বপ্নদোষ ইত্যাদির কারণে গোসল ফরজ হলে তৎক্ষণাৎ গোসল করা অপরিহার্য তথা ওয়াজিব নয়। বরং ঘুম, ব্যস্ততা কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে বিলম্ব করা জায়েজ রয়েছে ইনশাআল্লাহ। তবে রাতে স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে ঘুমের আগে অযু করে নেওয়া মুস্তাহাব তথা উত্তম। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেন,যে এই বিষয়ে (অর্থাৎ সহবাসের পর অযু করা মুস্তাহাব) ইমামগনের মধ্যে ঐক্যমত ছিল।(আল কাফী খন্ড; ১ পৃষ্ঠা; ১৭৩ নববী মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যাব, খন্ড; ১ পৃষ্ঠা; ৩৩ ইবনে কুদামাহ আল মুগনী; খন্ড; ১ পৃষ্ঠা: ২২৯)
.
জমহুর আলেমগনের মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে,
আম্মাজান আয়িশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] থেকে বর্ণিত, রাসুলূল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يَنَامَ وَهُوَ جُنُبٌ تَوَضَّأَ وُضُوءَهُ لِلصَّلاَةِ قَبْلَ أَنْ يَنَامَ “নাপাকী অবস্থায় যখন ঘুমাতে ইচ্ছা করতেন তখন ঘুমাবার আগে সলাতের জন্য যেমন ওযু করতে হয় তেমন ওযু করতেন।” (সহিহ মুসলিম হা/৫৮৬; ই.ফা. ৫৯০, ই.সে. ৬০৬)
.
অপর হাদীসে প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৭৩ হি.] থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, (আমার পিতা) উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, أَنَّهُ تُصِيبُهُ الْجَنَابَةُ مِنَ اللَّيْلِ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم”‏ تَوَضَّأْ وَاغْسِلْ ذَكَرَكَ ثُمَّ نَمْ ‏ “রাতে কোন সময় তাঁর গোসল ফরয হয় তখন কী করতে হবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেন, ওযু করবে, লজ্জাস্থান ধুয়ে নিবে তারপর ঘুমাবে।” (সহিহ বুখারী হা/২৯০)। এই দুটি হাদীসটি প্রমাণ করে কেউ স্ত্রী সহবাস করলে সাথে সাথে গোসল কিংবা অযু করা ওয়াজিব নয়। বরং স্বাভাবিক ভাবে অযু করে ঘুমানো মুস্তাহাব। যদিও মালেকী মাজহাবের মধ্যে জাহিরিয়া ও ইবনে হাবীব (রাহিমাহুল্লাহ) মনে করেন যে,উপরে উল্লেখিত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হাদীসের ভিত্তিতে অপবিত্র ব্যক্তির জন্য অযু করা ওয়াজিব বলেছেন। তবে অধিক বিশুদ্ধ মতে এই হুকুমটি ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব পর্যায়ের। আল ইমামুল আল্লামাহ আবু উমার ইউসুফ ইবনু আব্দিল বার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৬৩ হি.] বলেছেন, ذهب الجمهور إلى أنه ـ أي: الأمر بالوضوء للجنب الذي يريد النوم – للاستحباب “জুমহুর তথা অধিকাংশ আলেম এই মত ব্যক্ত করেছেন যে,জুনুবি (নাপাক) ব্যক্তি যদি ঘুমাতে চায়, তার জন্য ওজু করার নির্দেশ টি মুস্তাহাব পর্যায়ের”।(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৬৭২৫)
.
সুতরাং হুকুমটি যেহেতু মুস্তাহাব পর্যায়ের সে হিসেবে কেউ অযু না করে ঘুমালেও তার কোন গুনাহ হবেনা ইনশাআল্লাহ।কারন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের বিশুদ্ধ আক্বীদা হচ্ছে,মুস্তাহাব আমল পালনকারী সওয়াব পাবেন; তবে বর্জনকারী শাস্তি পাবে না। তবে হা এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সহবাসের পর অযু করে ঘুমানোটা অধিক উত্তম এবং নিরাপদ।(এই মাসালায় বিস্তারিত জানতে; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৯৬৩)
.
সহবাসের পর অযু বা গোসল করার পেছনের হিকমত হলো- এটা নাপাকী দূর করে এবং শরীরের জন্য উত্তম। যেমন; অন্য হাদীসে এসেছে, أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَافَ ذَاتَ يَوْمٍ عَلَى نِسَائِهِ يَغْتَسِلُ عِنْدَ هَذِهِ وَعِنْدَ هَذِهِ فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ أَلاَ تَجْعَلُهُ غُسْلاً وَاحِدًا؟ قَالَ: هَذَا أَزْكَى وَأَطْهَرُ وَأَطْيَبُ.‘একদা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের সাথে সহবাস করলেন। তিনি এর কাছে গোসল করলেন এবং ওর কাছেও গোসল করলেন। রাবী বলেন, আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি তাকে একটি গোসলে পরিণত করতে পারলেন না? তিনি বললেন, এটা অধিকতর পরিচ্ছন্ন, অতি উত্তম ও সর্বাধিক পবিত্রতা। (মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৩৫০; আবু দাঊদ হা/২১৯; মিশকাত হা/৪৭০,হাদীসটি হাসান)। এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমবার স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করে পুনরায় সহবাস করা মুস্তাহাব; প্রতি সহবাসে তাঁর গোসল বর্জন করা বৈধতার জন্য এবং উম্মাতের উপর সহজতার জন্য। এবং প্রত্যেক সহবাসের পর গোসল করাটা অধিক পবিত্রতা ও পরিছন্নতার জন্য। তবে জেনে রাখা ভালো যে, সালাতের সময় হলে অবশ্যই গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার পর সালাত আদায় করা আবশ্যক। আর অসুস্থ থাকলে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করতে হবে। কেননা সালাতের জন্য পাক-পবিত্রতা অর্জন করা পূর্বশর্ত। এবং সালাত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সালাত আদায় করা ফরজ।(সূরা নিসা;৪/১০৩)।
.
উল্লেখ যে,আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,ثَلَاثَةٌ لَا تَقْرَبُهُمُ الْمَلَائِكَةُ: جِيفَةُ الْكَافِرِ وَالْمُتَضَمِّخُ بِالْخَلُوقِ، وَالْجُنُبُ، إِلَّا أَنْ يَتَوَضَّأَ “তিন প্রকার ব্যক্তির নিকট (রহমতের) ফিরিশতারা আসেন না। (১) কাফিরের লাশের নিকট (জানাযায়). (২) জাফরান রঙ ব্যবহারকারী এবং (৩) জুনুবি (নাপাক) ব্যক্তির নিকট, তবে সে উযু করলে ভিন্ন কথা।(আবু দাউদ হা/৪১৮০) এই হাদীসটি সহীহ জয়ীফ নিয়ে মুহাদ্দিসগনের মতানৈক্য রয়েছে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি হাসান বলেছেন।(সহীহ আত-তারগীব হা/১৭৩) তবে বহু আলেম হাদীসটি জয়ীফ বলেছেন। কারন হাদীসটির সনদে ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার নামক একজন বারী রয়েছেন, যিনি প্রখ্যাত সাহাবী আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে সরাসরি হাদীস শুনেননি।(দেখুন: ইমাম আহমেদ মুসনাদে আল রিসালা, খন্ড: ৩১ পৃষ্ঠা; ১৮২, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৫২১২) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।