আরবি রজব মাস উপলক্ষে করনীয় কোন বিশেষ আমল আছে কী

আরবি রজব মাস হারাম মাসসমূহের একটি। যে হারাম মাস সমূহের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন; اِنَّ عِدَّۃَ الشُّهُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰهِ اثۡنَا عَشَرَ شَهۡرًا فِیۡ کِتٰبِ اللّٰهِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡهَاۤ اَرۡبَعَۃٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡهِنَّ اَنۡفُسَکُمۡ وَ قَاتِلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ کَآفَّۃً کَمَا یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ کَآفَّۃً ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ. নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ্‌র বিধানে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারটি। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এর মধ্যে তোমর নিজেদের প্রতি যুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। (সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)। হারাম মাসগুলো হচ্ছে- রজব, যুলক্বদ, যুলহজ্জ ও মুহররম মাস। বিদায় হজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন; তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক— যিলকদ, যিলহজ ও মহররম, অপরটি হলো রজব। (সহীহ বুখারী হা/৩১৯৭; সহীহ মুসলিম হা/১৬৭৯)
.
প্রখ্যাত সাহাবী আবু বাকরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বছর হচ্ছে- বার মাস। এর মধ্যে চার মাস- হারাম (নিষিদ্ধ)। চারটির মধ্যে তিনটি ধারাবাহিক: যুলক্বদ, যুলহজ্জ, মুহররম ও (মুদার গোত্রের) রজব মাস; যে মাসটি জুমাদাল আখেরা ও শাবান মাস এর মধ্যবর্তী।” (সহীহ বুখারি হা/৪৬৬২ ও সহীহ মুসলিম হা/১৬৭৯)
.
এ মাসগুলোকে ‘হারাম’ আখ্যায়িত করা হয় দুইটি কারণে:
.
(১). এ মাসগুলোতে যুদ্ধ হারাম হওয়ার কারণে। তবে শত্রু যদি প্রথমে যুদ্ধের সূত্রপাত করে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
.
(২). এ মাসগুলোতে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া অন্য মাসে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে বেশি গুনাহ। তাই আল্লাহ তাআলা এ মাসগুলোতে গুনাহতে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন; “এগুলোতে তোমরা নিজেদের উপর জুলুম করো না।”[ সূরা তওবা, আয়াত: ৩৬]। যদিও এ মাসগুলোতে পাপে লিপ্ত হওয়া যেমন নিষিদ্ধ তেমনি অন্য যে কোন মাসে পাপে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ; তদুপরি এ মাসগুলোতে পাপে লিপ্ত হওয়া অধিক গুনাহ।
.
শাইখ সা’দী (রাহিমাহুল্লাহ) তার তাফসীরে সা’দীতে
বলেন, (فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ) يحتمل أن الضمير يعود إلى الاثني عشر شهرا، وأن اللّه تعالى بَيَّن أنه جعلها مقادير للعباد، وأن تعمر بطاعته، ويشكر اللّه تعالى على مِنَّتِهِ بها، وتقييضها لمصالح العباد، فلتحذروا من ظلم أنفسكم فيها. ويحتمل أن الضمير يعود إلى الأربعة الحرم، وأن هذا نهي لهم عن الظلم فيها خصوصاً، مع النهي عن الظلم كل وقت، لزيادة تحريمها، وكون الظلم فيها أشد منه في غيرها. এগুলোতে তোমরা নিজেদের উপর জুলুম করো না; এখানে সর্বনামের একটা নির্দেশনা হতে পারে- বার মাস। আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এ মাসগুলো মানুষের হিসাব রাখার সুবিধার্থে সৃষ্টি করেছেন। এ মাসগুলোতে তাঁর ইবাদত করা হবে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে এবং মানুষের কল্যাণের মাধ্যমে অতিবাহিত করা হবে। অতএব, এ মাসগুলোতে স্বীয় আত্মার উপর জুলুম করা থেকে সাবধান হোন। আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে এখানে সর্বনামটি চারটি হারাম মাসকে নির্দেশ করছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে- এ মাসগুলোতে জুলুম করা থেকে বিরত থাকার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারী করা। যদিও যে কোন সময় জুলুম করা নিষিদ্ধ। কিন্তু এ মাসগুলোতে জুলুমের গুনাহ বেশি মারাত্মক। (তাফসীরে সা’দী, পৃষ্ঠা-৩৭৩)
.
▪️রজব মাসের বিশেষ কোন ফজিলত আছে কী?
______________________________________
আরবি রজব মাসের ফজিলতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে কোন বর্ণনা সাব্যস্ত হয়নি। এই মাসে বিশেষ ফজিলত সংক্রান্ত যত বর্ণনা রয়েছে; যা আছে সবগুলোই জাল-জয়ীফ, মিথ্যা। আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ পাঁচ রাতে দুআ কবুল হওয়া সংক্রান্ত হাদীসটি বানোয়াট। বর্ননাটি হল: আবু উমামা আল বাহেলি (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, خَمْسُ لَيَالٍ لا تُرَدُّ فيهن الدعوةُ : أولُ ليلةٍ من رجبٍ ، وليلةُ النِّصفْ من شعبانَ وليلةُ الجُمُعةِ ، وليلةُ الفِطْرِ ، وليلةُ النحرِ ‘পাঁচটি রাত এমন আছে, যেগুলোতে বান্দার দু’আ প্রত্যাখ্যাত হয় না, (অর্থাৎ অবশ্যই কবুল করেন।) রাতগুলো হল রজবের প্রথম রাত, অর্ধ শাবানের রাত, জুমার রাত, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার রাত।’(তারিখে দিমাস্ক-ইবনে আসাকির, খন্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ২৭৫-২৭৬; মুসনাদুল ফিরদাউস ২/১৯৬)
.
হাদীসটির সনদ: হাদীসটিকে ইবনু আসাকির তার “তারীখু দেমাস্ক” গ্রন্থে আবু সাঈদ বুন্দার ইবনে উমর ইবনে মুহাম্মাদ রূইয়ানী হতে, তার সনদে ইবরাহীম ইবনু আবী ইয়াহইয়া হতে, তিনি আবু কা’নাব হতে, তিনি আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
.
তাহক্বীক: হাদীসটি বানোয়াট কারন, এ বর্ননাটির মূল ভিত্তি হল, ইবরাহিম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবি ইয়াহিয়া (১৮৪ হি.) নামক একজন মুহাদ্দিস। ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ বিন হাম্ভল, ইমাম বুখারি, ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন, ইয়াহিয়া আল-কাত্তান, ইমাম নাসাঈ, ইমাম দারাকুতনী, ইমাম যাহাবী, ইবনে হিব্বান ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তাকে “রাফেজি শিয়া, মুতাজিলি ও ক্বাদরিয়া আকিদায় বিশ্বাসী” বলে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি মিথ্যাবাদী এবং অপবিত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ ছাড়াও এর বর্ণনা সূত্রে আবু সাঈদ বুনদার বিন উমর (بندار بن عمر الروياني) নামে একজন বর্ণনাকারী আছে। যে মুহাদ্দিসগণের নিকট ‘মিথ্যাবাদী ও হাদিস জাল কারী’ বলে পরিচিত।(ইমাম যাহাবি-মিযানুল ইতিদাল, ২/৭০, ইবনে হাজার-লিসানুল মিযান,২/৬৪)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, موضوع, وإبراهيم بن أبي يحيى كذاب أيضا كما قال يحيى وغيره. وهو من شيوخ الشافعي الذين خفي عليه حالهم وأبو قعنب، لم أعرفه হাদিসটি বানোয়াট কারন, ইবরাহীম ইবনু আবী ইয়াহইয়াও মিথ্যুক যেমনটি ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন প্রমুখ বলেছেন। তিনি হচ্ছেন ইমাম শাফে’ঈর সেই শাইখদের অন্তর্ভুক্ত যাদের অবস্থা তার নিকট গোপনই রয়ে যায়। আর আবু কানাবকে আমি চিনি না।(সিলসিলা যঈফাহ হা/১৪৫২ এবং যঈফুল জামে হা/২৮৫২)সুতরাং এই বানোয়াট ‌হাদিসের অবস্থা বর্ণনা পূর্বক মানুষকে এ সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্য ছাড়া তা প্রচার করা হারাম।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, لم يرد في فضل رجب حديثٌ صحيح ، ولا يمتاز شهر رجب عن جمادى الآخرة الذي قبله إلا بأنه من الأشهر الحرم فقط ، وإلا ليس فيه صيام مشروع، ولا صلاة مشروعة، ولا عمرة مشروعة ولا شيء، هو كغيره من الشهور. “রজব মাসের ফজিলতের ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। ‘রজব’ মাসের আগের মাস ‘জুমাদাল আখেরা’ মাসের উপর রজব মাসের ভিন্ন কোন মর্যাদা নেই; শুধু এইটুকু রজব মাস হারাম মাসগুলোর একটি। রজব মাসে বিশেষ কোন রোজা নেই। বিশেষ কোন নামাজ নেই। বিশেষ কোন উমরা নেই। অন্য কোন ইবাদত নেই। রজব মাস অন্য যে কোন মাসের মতোই।” (উসাইমীন; লিকাউল বাব আল-মাফতুহ, ২৬/১৭৪)
.
➤রজব মাসের দু’আ:
______________________
আব্দুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ ‘যাওয়ায়িদুল মুসনাদ’ এ, ইমাম তাবারানি তাঁর ‘আল- আওসাত’ এ, ইমাম বায়হাকি তাঁর ‘শুয়াবুল ঈমান’ এ,এবং আবু নুআইম তাঁর ‘আল-হিলয়া’ গ্রন্থে যায়েদা বিন আবু রিকাদ এর সূত্রে তিনি বলেন: যিয়াদ আল-নুমাইরি, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন; যখন রজব মাস প্রবেশ করত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, (اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ)। উচ্চারণ:আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ও শাবান ওয়া বাল্লিগ না রমজান। (অর্থ-হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন)। (আব্দুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ ‘যাওয়ায়িদুল মুসনাদ’ হা/২৩৪৬; তাবারানি ‘আল-আওসাত’ হা/৩৯৩৯; বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান’ হা/ ৩৫৩৪)
.
তাহক্বীক: এ হাদিসটির সনদ বা সূত্র দুর্বল। সনদের বর্ণনাকারী যিয়াদ আল-নুমাইরি যয়ীফ (দুর্বল)। ইবনে মাঈন তাকে যয়ীফ আখ্যায়িত করেছেন। আবু হাতিম বলেছেন; তাকে দিয়ে দলিল পেশ করা যাবে না। ইবনে হিব্বান তাকে দুর্বলদের বই এ উল্লেখ করে বলেছেন; তাকে দিয়ে দলিল পেশ করা যাবে না। [মিযানুল ইতিদাল (২/৯১)]। বর্ণনাকারী যায়িদা বিন আবু রিকাদ আরও যয়ীফ (দুর্বল)। বুখারি বলেন; ‘মুনকার উল হাদিস’। নাসাঈ বলেন; ‘মুনকার উল হাদিস’। নাসাঈ ‘আল-কুনা’ গ্রন্থে বলেন; তিনি ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) নন। ইবনে হিব্বান বলেন: বিখ্যাত রাবীদের থেকে মুনকার (অখ্যাত) হাদিস বর্ণনা করেন। তার হাদিস দিয়ে দলিল দেয়া যাবে না। তার হাদিস অন্য হাদিসের সহায়ক হাদিস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ইবনে আদি বলেন; “তিনি আল-মুকাদ্দামি ও অন্যদের থেকে ‘ইফরাদ’ হাদিস বর্ণনা করেন। তার কিছু হাদিস সমালোচিত।” [তাহযিবুত তাহযিব ৩/৩০৫-৩০৬]। ইমাম নববী তাঁর ‘আল-আযকার’ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-১৮৯) এ, ইবনে রজব তাঁর ‘লাতায়িফুল মাআরিফ’ (পৃষ্ঠা- ১২১) এ এবং আলবানি তাঁর ‘যয়িফুল জামে’ (পৃষ্ঠা-৪৩৯৫) এ হাদিসটিকে ‘যয়িফ’(দুর্বল) আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম হাইছামি বলেন; বায্যার হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসটির সনদে ‘যায়িদা বিন আবু রিকাদ’ রয়েছেন। বুখারি বলেন; হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে অখ্যাত এবং অনেক ইমাম তাকে ‘মাজহুল’ (অপরিচিত) বলেছেন।(মাজমাউল যাওয়েদ (২/১৬৫)
.
অর্থাৎ হাদিসটি দুর্বল; তদুপরি এ হাদিসের মধ্যে এমন কোন দলিল নেই যা প্রমাণ করবে যে, রজব মাসের প্রথম রাত্রিতে এটি বলা হবে। বরং এটি বরকতের জন্য সাধারণ দু’আ। এ দু’আ রজব মাসে বা রজব মাসের আগেও বলা যাবে। পক্ষান্তরে কোন মুসলমানের রমজান মাস পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে কোন অসুবিধা নেই।
.
হাফিয যাইনুদ্দীন আবুল ফারজ আব্দুর রহমান বিন শিহাব—যিনি ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ—রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত:৭৯৫ হি:] বলেছেন, قال معلى بن الفضل: كانوا يدعون الله تعالى ستة أشهر أن يبلغهم رمضان، ويدعونه ستة أشهر أن يتقبل منهم. وقال يحيى بن أبي كثير: كان من دعائهم: اللهم سلمني إلى رمضان، وسلم لي رمضان وتسلمه مني، متقبلا. “মুয়াল্লা বিন ফজল বলেন তাঁরা ছয়মাস দু’আ করতেন রমজান মাস পাওয়ার জন্য এবং ছয়মাস দু’আ করতেন তাদের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য।” ইয়াইয়া বিন কাছির বলেন; তাদের দু’আর মধ্যে ছিল ‘হে আল্লাহ! আমাকে রমজান পর্যন্ত নিরাপদ রাখুন। রমজানকে আমার জন্য নিরাপদ করুন এবং রমজানের আমলগুলো কবুল করে আমার কাছ থেকে রমজানকে বিদায় করবেন। (লাতায়িফুল মাআরিফপৃষ্ঠ- ১৪৮)
.
সৌদি আরবের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, আব্দুল কারীম আল-খুদাইর (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৭৪ হি:] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ও শাবান ওয়া বাল্লিগ-না রমজান” হাদিসটির শুদ্ধতা কি?
.
তিনি জবাবে বলেন; ” هذا حديث لا يثبت، لكن إن دعا المسلم بأن يبلغه الله عز وجل رمضان، وأن يوفقه لصيامه وقيامه، وأن يوفقه لإدراك ليلة القدر، أي بأن يدعو أدعية مطلقة فهذا إن شاء الله لا بأس به “এ হাদিসটি সাব্যস্ত নয়। কিন্তু কোন মুসলিম যদি রমজান পাওয়ার জন্য, রোজা পালন ও কিয়াম সাধনার তাওফিকের জন্য এবং লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য দু’আ করে অর্থাৎ সাধারণ দু’আ করে- ইনশাআল্লাহ এতে কোন অসুবিধা নেই। (শাইখের ওয়েব সাইট থেকে সংকলিত। ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০২০১৭)
.
➤ রজব মাসে সিয়াম পালন করা:
_________________________________
রজব মাসে রোজা রাখা বা রজব মাসের কিছু অংশে রোজা রাখার ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। কিছু কিছু মানুষ রজব মাসের বিশেষ ফজিলত রয়েছে মনে করে এ মাসের বিশেষ কিছু দিনে যে রোজা রাখে এ ধরণের বিশ্বাসের কোন শাঈই ভিত্তি নেই। তবে হারাম মাসসমূহে (রজব একটি হারাম মাস) রোজা রাখা মুস্তাহাব মর্মে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিস বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; “হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখ; এবং রোজা ভঙ্গও কর।” (আবু দাউদ, হাদিস নং- ২৪২৮, আলবানী হাদিসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলেছেন, কারন এর সনদে একাধিক অজ্ঞাত ব্যক্তি রয়েছে। সনদে মুজীবাহ আল-বাহিলিয়া, তার পিতা এবং তার চাচা সকলেই অজ্ঞাত) সুতরাং এ হাদিসটি যদি সাব্যস্ত হয় তাহলে হারাম মাসে রোজা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণ হবে। অতএব, যে ব্যক্তি এই দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে রজব মাসে রোজা রাখে এবং অন্য হারাম মাসেও রোজা রাখে এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে রজব মাসকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রোজা রাখা যাবে না। বরং প্রতি মাসে আইয়ামে বীজের তিনটি সিয়াম এবং স্বাভাবিকভাবে সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম অথবা কাযা সিয়াম রাখা যায়। কিন্তু রজব মাসকে কেন্দ্র করে কোন আলেদা সিয়াম নেই।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] তার মাজমুউল ফাতাওয়া গ্রন্থে বলেন; وأما صوم رجب بخصوصه فأحاديثه كلها ضعيفة، بل موضوعة، لا يعتمد أهل العلم على شيء منها، وليست من الضعيف الذي يروى في الفضائل، بل عامتها من الموضوعات المكذوبات. وفي المسند وغيره حديث عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه أمر بصوم الأشهر الحرم: وهي رجب وذو القعدة وذو الحجة والمحرم. فهذا في صوم الأربعة جميعا لا من يخصص رجبا.”
পক্ষান্তরে রজব মাসে রোজা রাখা সংক্রান্ত সবগুলো হাদিস দুর্বল; বরঞ্চ মাওযু (বানোয়াট)। আলেমগণ এর কোনটির উপর নির্ভর করেন না। ফজিলতের ক্ষেত্রে যে মানের দুর্বল হাদিস বর্ণনা করা যায় এটি সে মানের নয়। বরং এ সংক্রান্ত সবগুলো হাদিস মাওজু (বানোয়াট) ও মিথ্যা। মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হারাম মাসসমূহে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হারাম মাসগুলো হচ্ছে- রজব, যুলক্বদ, যুলহজ্জ, মুহাররম। এটি চারটি মাসের ব্যাপারেই এসেছে। বিশেষভাবে রজব মাসের ব্যাপারে নয়। (মাজমুউল ফাতাওয়া; খন্ড: ২৫, পৃষ্ঠা: ২৯০ সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত)

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, كل حديث في ذكر صيام رجب وصلاة بعض الليالي فيه فهو كذب مفترى “রজব মাসে রোজা রাখা ও নফল নামায পড়ার ব্যাপারে যে কয়টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে সব ক’টি মিথ্যা।” [আল মানার আল-মুনিফ, পৃষ্ঠা- ৯৬]। ইবনে হাজার (রহঃ) ‘তাবয়িনুল আজাব’ গন্থে বলেন; لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه ولا صيام شيء منه معين، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه حديث صحيح يصلح للحجة. রজব মাসের ফজিলত, এ মাসে রোজা রাখা বা এ মাসের বিশেষ বিশেষ দিনে রোজা রাখার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। অথবা এ মাসের বিশেষ কোন রাত্রিতে নামায পড়ার ব্যাপারে সহিহ কোন হাদিস নেই। (তাবয়িনুল আজাব; পৃষ্ঠা: ১১)
.
শাইখ সাইয়্যেদ সাবেক (রাহিমাহুল্লাহ) “ফিকহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে বলেন; وصيام رجب ليس له فضل زائد على غيره من الشهور، إلا أنه من الأشهر الحرم، ولم يرد في السنة الصحيحة أن للصيام فضيلة بخصوصه، وأن ما جاء في ذلك مما لا ينتهض للاحتجاج به. অন্য মাসগুলোর উপর রজব মাসের বিশেষ কোন ফজিলত নেই। তবে এটি হারাম মাসসমূহের একটি। এ মাসে রোজা রাখার বিশেষ কোন ফজিলত কোন সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়নি। এ বিশেষ যে ক’টি বর্ণনা রয়েছে এর কোনটি দলিল হিসেবে গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ; খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৮৩)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে ২৭ শে রজব সিয়াম ও কিয়াম পালনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন; صيام اليوم السابع العشرين من رجب وقيام ليلته وتخصيص ذلك بدعة، وكل بدعة ضلالة.” সবিশেষ মর্যাদা দিয়ে ২৭ শে রজব সিয়াম ও কিয়াম পালন- বিদআত। আর প্রত্যেকটি বিদআতই ভ্রান্তি। (উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ৪৪০)
.
➤ রজব মাসে উমরাহ পালন:
____________________________
কিছু কিছু লোক যে, বিশেষ ফযিলত মনে করে রজব মাসে উমরা পালন করে; এটি বিদআত। কেননা কোন মুমিনের জন্য শরয়ী দলিল ছাড়া বিশেষ কোন সময়কে বিশেষ কোন ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সঙ্গত নয়। ইমাম নববীর ছাত্র ইবনুল আত্তার (রহঃ) বলেন; ومما بلغني عن أهل مكة زادها الله شرفاً اعتياد كثرة الاعتمار في رجب، وهذا مما لا أعلم له أصلاً، بل ثبت في حديث أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (عمرة في رمضان تعدل حجة)”
“আমার কাছে মক্কাবাসীদের (আল্লাহ্‌ মক্কার সম্মান বৃদ্ধি করুন) সম্পর্কে সংবাদ এসেছে যে, রজব মাসে তারা বেশি বেশি উমরা করে থাকেন। এমন আমলের কোন ভিত্তি আমার জানা নেই। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “রমযান মাসে একটি উমরা পালন করা হজ্জের সমান।” (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৭৬৬)
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] তাঁর ফতোয়াসমগ্রে বলেন; أما تخصيص بعض أيام رجب بأي شيء من الأعمال الزيارة وغيرها فلا أصل له، لما قرره الإمام أبو شامة في كتاب “البدع والحوادث” أن تخصيص العبادات بأوقات لم يخصّصها بها الشرع لا ينبغي، إذ لا فضل لأي وقت على وقت آخر إلا ما فضله الشرع بنوع من العبادة، أو فضل جميع أعمال البر فيه دون غيره، ولهذا أنكر العلماء تخصيص شهر رجب بكثرة الاعتمار فيه. রজব মাসের কিছু দিনকে কিছু কিছু আমলের জন্য খাস করা, যেমন- যিয়ারত ও অন্যান্য আমল; এর কোন ভিত্তি নেই। আবু শামা ‘আল-বিদা ওয়াল হাওয়াদিস’ গ্রন্থে যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন সে সিদ্ধান্তের কারণে। সেখানে এসেছে- “শরীয়ত যে সময়ের সাথে কোন ইবাদতকে খাস করেনি সে সময়ের সাথে কোন একটি ইবাদতকে খাস করা অনুচিত। কেননা কোন এক সময়ের উপর অপর সময়ের বিশেষ কোন মর্যাদা নেই; যদি না শরীয়ত বিশেষ কোন ইবাদতের মাধ্যমে কিংবা সব ধরণের ইবাদতের মাধ্যমে বিশেষ সময়কে অন্য সময়ের উপর মর্যাদা দিয়ে থাকে সেটা ছাড়া। এ কারণে আলেমগণ রজব মাসে বেশি বেশি উমরা করার নিন্দা করেছেন।(শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রহঃ)-এর ফতোয়াসমগ্রে,খন্ড: ৩,পৃষ্ঠা: ১৩১) আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৭৬৬,২০২০১৭)
.
পরিশেষে, মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করছি, মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে ইসলামের নামে যাবতীয় শরীয়ত বিরোধী কার্যক্রম এবং সব ধরণের বানোয়াট ‌মানুষের তৈরী আমল থেকে থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।