মৃত মানুষের দাফনের পর কবরের উপর খেজুরের কাঁচা ডাল পুঁতে দেওয়ার শরীয়তী বিধান

প্রশ্ন: বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে অধিকাংশ মৃত মানুষের দাফনের পর কবরের উপর খেজুরের কাঁচা ডাল পুঁতে দেওয়া হয়; শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কবরের উপর
সুগন্ধি গুল্ম অর্থাৎ স্থায়ী কান্ডবিশিষ্ট ছোট-গাছ স্থাপন, বৃক্ষ রোপণ করা, এক প্রকার সুগন্ধি কাঠ দ্বারা কবরকে সুবাসিতকরণ, কবরস্থানে প্রদীপ জ্বালানো, কবর প্লাস্টার করা, কবরের উপর কোন কিছু লেখা, সেটা হোক মৃত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা বা মৃত্যুর তারিখ অথবা কুরআনের আয়াত কিংবা কোন প্রশংসা মূলক বাক্য যেমন: হে পথিক!একটু দাঁড়াও…. ইত্যাদিসহ আরও যে সমস্ত কর্মকান্ড প্রচলিত রয়েছে তার সবগুলোই সুস্পষ্ট বিদ‘আত বা ভ্রষ্টতা। এমনকি কবরের চারপাশে অথবা মাঝখানে খেজুরের কাঁচা ডালও পুঁতা যাবেনা। কেননা কবরের উপর এগুলো পুঁতা জায়েজ মর্মে পবিত্র কুরআনে অথবা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহয় কিংবা সাহাবীদের থেকে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই। আর ইসলামি শরীয়তে বিনা দলিলে সওয়াবের আশায় যেকোনো আমল করা বিদআত।
.
আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।(সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০)।অপর বর্ননায় এসেছে, যে ব্যক্তি এমন আমল করল যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য। (সহীহ মুসলিম; হা/১৭১৮)। তাছাড়া জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- রাসূল (ﷺ) কবর পাকা করতে, তার উপর কোন কিছু লিখতে বা কিছু নির্মাণ করতে এবং তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন। (তিরমিজি হা/১০৫২, আলবানী ইরওয়া হা/৭৫৭)। এই হাদীসের আলোকে আল্লামা শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ক্ববরের উপর কোন কিছু লিখা যে হারাম এ হাদীসটি হচ্ছে তার দলীল। এ ব্যাপারে মৃতের নাম অথবা অন্য কিছু লিখার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কি উদ্দেশে লেখা হচ্ছে সেটাও ধর্তব্য নয়। (মিসকাতুল মাসাবিহ, ১৭০৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
ভারত উপমহাদেশে অধিকাংশ মৃত মানুষের দাফনের পর কবরের উপর খেজুরের কাঁচা ডাল পুঁতা সম্পর্কে যে বর্ননাটি রয়েছে সেটি শুধুমাত্র রাসূল (ﷺ) এবং ঐ দুই ব্যক্তির সাথে খাস ছিল। এটি অন্য কারো জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়। যে হাদীসটির আলোকে ভ্রান্ত প্রথাটি চালু হয়েছে সেই হাদিসটি হলো:
.
যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৬৮ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে কবর দু’টির বাসিন্দাদের আযাব দেওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, এদের দু’জনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে অথচ তাদের এমন গুনাহর জন্য আযাব দেওয়া হচ্ছে না (যা থেকে বিরত থাকা) কঠিন ছিল। তাদের একজন পেশাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না আর অপরজন চোগলখুরী করে বেড়াত। এরপর তিনি খেজুরের একটি তাজা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগে বিভক্ত করলেন, তারপর প্রতিটি কবরে একটি করে পুঁতে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন এরূপ করলেন? তিনি বললেন; ডাল দু’টি না শুকানো পর্যন্ত আশা করি তাদের আযাব হালকা করা হবে। (সহীহ বুখারী হা/২১৮, সহীহ মুসলিম ২৯২, মিশকাত হা/৩৩৮)।
.
এই হাদীসটির আলোকে কতিপয় আলেম বলেছেন যে, তাদের জন্য আযাব কমানোর কারণ হলো যে- তাজা খেজুর পাতার ডাঁটা আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে,তাই এটি কবররে আযাব কম হওয়ার কারণ হবে। তবে এই মতামতগুলো দুর্বল এবং এটি আরও বিস্তারিত আলোচনার বিষয়।
.
শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, পবিত্র কুরআনের এই আয়াত অনুসারে অধিকাংশ মুফাসসিরীনের অভিমত: মহান আল্লাহ বলেন, এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রসংশায় তাসবীহ পাঠ করে না। (সূরা বনি ইসরাইল: ১৭/৪৪)। তারা বলেন, এ উক্তি এ কথা প্রমাণ করে যে, সকলেই আল্লাহর অনুগত এবং তারা স্ব স্ব নিয়মে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণায় ও প্রশংসায় লিপ্ত আছে। অতঃপর তারা আরো বলেন: সবকিছুর জীবন তার প্রকৃতি অনুযায়ী। একটি কাঠ ততক্ষণ জীবিত থাকে যতক্ষণ না শুকিয়ে যায় এবং একটি পাথর ততক্ষণ জীবিত থাকে যতক্ষণ না কাটা হয়। কিছু মুফাসসিরীন এবং অন্যদের অভিমত ছিল যে, এটি সাধারণ অর্থে বোঝা উচিত। অর্থাৎ,আল্লাহর তাসবীহ শুকনো বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কাচা বা তাজা পাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; বরং তাজা বা শুকনো সবকিছুই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা ও প্রশংসা করে। (নববী সরহে মুসলিম ও ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৮৯৫৮)।
.
ইমাম খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা এর উপর ধরা হবে যে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুই কবরবাসীর আযাব লাঘবের জন্য দো’আ করেছেন; যতক্ষণ তা তরতাজা থাকবে। এটা নয় যে, আযাব বন্ধ করার ব্যাপারে গাছের ডালে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে বা কাঁচা ডালে কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে,যা শুকনো ডালে নেই। (আউনুল মাবুদ:১/২৫)।
.
সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকার বিখ্যাত হাদীস বিশারদ, হাফিজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু-৮৫২ হি:] বলেছেন,”এটা শুধুমাত্র রাসূল (ﷺ)-এর জন্য ‘খাছ’ ছিল। কেননা ঐ দুই কবরে শাস্তি হওয়ার কথা এবং শাস্তি হালকার উপায়ের কথা অহীর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল (ফাতহুল বারী, ১/৩২০; আরো দেখুন হাশিয়াতুস সুয়ূতী ওয়াস সিন্দী ‘আলা সুনান নাসাঈ, ১/২৭)
.
তাছাড়া আহালুল আলেমগনের সর্বসম্মত মতে, জীবিত মানুষের পক্ষ থেকে দো’আ ঈমানদার মৃত মানুষের কাজে লাগে। এখানে ঐ দুই ব্যক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন তা দো’আর সমতুল্য। সুতরাং সেটা কাজে লাগবে। কিন্তু অন্য কারো জন্য এ ধরনের গাছ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারটি কোথাও বর্ণিত হয়নি। সুতরাং বর্তমানে কারো জন্য গাছ ভেঙ্গে রোপন করলে সেটা কার্যকরী হবে বলা যায় না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্ত কাজটি তার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট, অন্য কারো সাথে তা কার্যকারী হওয়ার প্রমাণ নেই। কারণ, এ হাদীসেরই স্পষ্টভাবে অপর বর্ণনায় যা সহীহ মুসলিমের শেষে জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল ﷺ)বলেছেন,“আমার সুপারিশের কারণে আল্লাহ তাদের শাস্তি গাছের ডালটি শুষ্ক হওয়া পর্যন্ত লাঘব করবেন।” (দেখুন সহীহ মুসলিম ৩০০৬) সুতরাং এর অর্থ এটি নয় যে, খেজুর ডালের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিংবা তাজা ডালের কোন বিশেষত্ব রয়েছে যার ফলে তাদের শাস্তি লাঘব হয়েছে।
.
উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে বলা যায়, এই কাজটি ছিল এমন কিছু যা কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য খাস। আর কবরের উপর খেজুর পাতার ডালপালা বা অন্য কিছু রাখা অন্য কারো জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা এটি যদি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত তাহলে রাসূল (ﷺ) জীবিত থাকা অবস্থায় বহু সাহাবী মৃত্যুবরণ করছেন কিন্তু রাসূল (ﷺ) কারো কবরের উপর এরুপ কাঁচা ডাল অথবা এজাতীয় কিছু পুঁতে দিয়েছেন বা দিতে বলেছেন অথরা রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর পর চার চার খলিফা এরূপ করেছেন মর্মে বিশুদ্ধ কোন দলিল পাওয়া যায় না তাছাড়া। যে দু ব্যক্তির জন্য রাসূল (ﷺ) এমনটি করেছেন ফলে তাদের শাস্তি হালকা হয়েছিল, এটা রাসূল (ﷺ)-এর বিশেষ সুপারিশের জন্য। কাঁচা ডালের জন্য নয়। যেটা সহীহ মুসলিমে জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদীস দ্বারা প্রমানিত।
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দু’টি কবরের উপর খেজুর পাতার ডাঁটা রেখে আশা করেছিলেন যে, যাদের কবরের উপর তিনি স্থাপন করেছেন তাদের আযাব কিছুটা লাঘব হবে, তখন এটি ছিল শুধুমাত্র সেই দুই বক্তির সাথে সম্পর্কিত একটি নির্দিষ্ট ঘটনা। এটি সাধারণভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় না; বরং এটা শুধুমাত্র সেই দু’জনের জন্য প্রযোজ্য, যাদের আযাবের গায়েবী খবর আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-কে জানিয়েছিলেন। এটি এমন একটি বিষয় যা কেবলমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য ছিল এবং এটি মুসলমানদের কবরের প্রতি করা সর্বজনীন সুন্নাত নয়। আমরা যদি হিসাব করি যে কতবার রাসূলুল্লাহ ﷺ এমটি করেছেন তাহলে দেখতে পাবো যে ইতিহাসে উক্ত ঘটনা শুধুমাত্র দুই তিন বার ঘটেছে।কোন সাহাবায়ে কেরাম তা করেছেন বলে জানা যায় না, অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ করতেন এবং মুসলমানদের উপকার করার জন্য সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে আগ্রহী ছিল। সাহাবী বুরায়দাহ্ বিন হুসায়ন থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যে তিনি তার মৃত্যুর পরে তার কবরে দু’টি খেজুর ডাল গেড়ে দেয়ার ওয়াসিয়্যাত করেছিলেন। কিন্তু আমরা এমন কোন সাহাবীকে জানি না যারা এতে বুরাইদার সাথে একমত ছিলেন।(ফাতওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ্ ও ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৮৯৫৮)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন- এটা অর্থাৎ (কবরের উপর গাছের কাঁচা ডাল রাখা) শরিয়ত সম্মত নয় বরং এটি একটি বিদআত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধুমাত্র খেজুর পাতার ডালপালা সেই লোকদের কবরের উপর রেখেছিলেন যাদের আযাব সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হয়েছিল যে,অমুক অমুক কবরে আযাব হচ্ছে, তাই তিনি ঐ দু’কবরের উপর খেজুরের ডালা স্থাপন করেছেন, যাতে কবর আযাব বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তিনি অন্য কোন কবরে ডালপালা স্থাপন করেননি। এ থেকে আমরা জানি যে সেগুলোকে কবরের উপর রাখা জায়েয নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত। সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি এমন আমল করল যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য। অনুরূপভাবে,অন্য একটি হাদীসে রাসূল (ﷺ) কবর পাকা করতে, তার উপর কোন কিছু লিখতে বা কিছু নির্মাণ করতে এবং তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন।(দেখুন সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/১৪০, মুসলিম হা/১৭১৮, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল- ইসলামিয়্যাহ খন্ড: ৬৮ পৃষ্ঠা: ৫০ বিন বায প্রণীত من أحكام الجنائز জানাযার কিছু বিধান পৃষ্ঠা নং ৭৫)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল দু’জন ব্যক্তিকে ক্ববরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। ফলে শাস্তি মাফের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ক্ববরে খেজুরের ডাল পুঁতে দিলেন’(সহীহ বুখারী হা/২১৮, সহীহ মুসলিম ২৯২, মিশকাত হা/৩৩৮) এই হাদীসের আলোকে ক্ববরের উপরে গাছের কাঁচা ডাল ইত্যাদি পোঁতা কি সুন্নাত নাকি এটি রাসূল (ﷺ) এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল? আর তার জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার দলীলইবা কি?
.
জবাবে শাইখ বলেন,ক্ববরের উপরে গাছের কাঁচা ডাল বা ঐ জাতীয় কিছু পোঁতা সুন্নাত নয়; বরং ইহা একদিকে যেমন বিদ‘আত, অন্যদিকে তেমনি মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণের শামিল। কেননা রাসূল (ﷺ)-সব ক্ববরে এরূপ রাখতেন না। শুধুমাত্র ঐ দুটি ক্ববরে তিনি রেখেছিলেন। কারণ তিনি ওহীর ভিত্তিতে জানতে পেরেছিলেন যে,তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অতএব, ক্ববরের উপরে খেজুর ডাল পোঁতা মৃতের প্রতি অন্যায় এবং তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ বৈ কিছুই নয়। আর কেউ তার মুসলিম ভাই সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতে পারে না। কেননা কেউ কারো ক্ববরের উপর খেজুরের ডাল পোঁতার অর্থই হচ্ছে, সে বিশ্বাস করে যে, ঐ ক্ববরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।কিন্তু আমরা তা জানি না। অথচ হতে পারে যে তাকে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অথবা এমনও হতে পারে যে এই মৃত ব্যক্তি তাদের মধ্যে একজন যাকে আল্লাহ ক্ষমা নিয়ে আসার অনেকগুলি জিনিসের মধ্যে কোন একটির কারণে মৃত্যুর আগে ক্ষমা দিয়েছিলেন।তাছাড়া এই চিন্তাধারা হকপন্থী সালাফের পথের পরিপন্থী। কেননা এই কাজটি তাদের পথের অংশ ছিল না। অথচ তারা মহান আল্লাহর শরীয়ত সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন।অপরদিকে আল্লাহ আমাদের এমন কিছু দেখিয়েছেন যা তার চেয়েও উত্তম। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কাউকে দাফন শেষ করতেন তখন কবরের উপর দাঁড়িয়ে বলতেন- তোমার ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাকে অবিচল থাকার জন্য অনুরোধ কর, কেননা তাকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সুতরাং সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়,ক্ববরের উপরে খেজুরের ডাল বা এ জাতীয় কিছু পোঁতা বিদ‘আত এবং মৃতব্যক্তি সম্পর্কে কু–ধারণা পোষণ। কেননা যে ডাল পুঁতে, সে মনে করে ক্ববরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আর সেজন্যই তো সে তার শাস্তি লাঘব করতে চায়। এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর সুপারিশ ক্ববূল করেছিলেন; কিন্তু তিনি মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশ ক্ববূল করবেন কিনা তা তো আমরা জানি না।(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩০ উসাইমিন প্রণীত ৭০টি প্রশ্নের জানাযার বিধিবিধান প্রশ্ন নাম্বার- ৪৬ এবং ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৮৯৫৮)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন,
.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্নিত হাদীসের আলোকে অনেকে মনে করেন, আযাব হালকা করা হয়েছিল উভয় ডালের আর্দ্রতা ও সজীবতার কারণে। তাদের এমন ধারণা সঠিক নয়। কেননা যদি বিষয়টি তাই-ই হ’ত তহ’লে তিনি ডালটি দুই ভাগে ভাগ করতেন না। কারন ডালটি দুইভাগে ভাগ করার কারণে আরও দ্রুত শুকিয়ে যাবার কথা, যা কারোই অযানা নয়। আসল কারণ ছিল ঐ কবর দু’টিকে ঐ ডাল দ্বারা চিহ্নিত করা যে, তিনি তাদের আযাব হালকা করার জন্য সুপারিশ করেছেন, মহান আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর সেই দু’আ ও সুপারিশ কবুল করেছিলেন ডাল শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। আর্দ্রতা ও সজীবতা ছিল আযাব হালকা হওয়ার আলামত; এটি কারণ নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে সহীহ মুসলিমে জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত লম্বা হাদীস।তাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,”দুটি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আমি দেখেছি তাদের কবরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আমি তাদের জন্য সুপারিশ করার ইচ্ছা করছি। সম্ভবত তাদের আযাব কমিয়ে দেওয়া হবে যতক্ষণ পর্যন্ত ডাল দুটি সতেজ থাকবে। ইতিহাসে সেই দিনটি ছাড়া রাসূল ﷺ কবর যিয়ারতের সময় আর ঐ কাজ করতেন বলে জানা যায় না। তাঁর সাহাবী এবং কোনো সালাফও এ কাজ করতেন বলে জানা যায় না। বরং এর বিপরীতে যারা বর্তমানে কবরের ওপর সজীব কিছু দেয়, ইমাম খাত্তাবী তাদের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এর কোনো ভিত্তি নেই।”আর আমি এ বিষয়ে ‘আহকামুল জানাইয ও বিদউহা’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।(দেখুন সহীহ মুসলিম হা/৭৪০৮ তিরমিযী ১/১০৩ মিশকাতুল মাসাবীহ,১/১১০ আহমাদ শাকিরের টীকা এবং
ফাতওয়ায়ে আলবানী ফাতাওয়া নং ২৮৪)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা আয়নার মত পরিস্কার যে,মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর তার কবরের উপর খেজুরের কাঁচা ডাল বা এজাতীয় কিছু পুঁতে দেওয়া শরীয়ত সম্মত নয়, অথচ আফসোসের বিষয় হচ্ছে, অনেক মুসলিমকে দেখা যায় তারা এই সুন্নাহ বিরোধী প্রথা জায়িয প্রমান করার জন্য সহীহ মুসলিমের হাদীসের অপব্যাখ্যা করে দলিল এবং যুক্তি পেশ করে,যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আদর্শের বিপরীত। তারা তাদের নিজেদের গুড়ামির কারণে এই ভ্রান্ত প্রথা টিকিয়ে রেখে কবরের উপর ফুল দিচ্ছে, খেজুরের কাঁচা ডাল পুঁতে দিচ্ছে যা কখনও জয়েয নয়, প্রথমত: এটাতো নাসারাদের কাজ। দ্বিতীয়ত: যদি এ হাদীস দলীল হয় তবে এ হাদীস তো প্রমাণ করছে যে, এখানে মৃতব্যক্তির আযাব হচ্ছে, তারা যেখানে ফুল দিচ্ছে কিংবা খেজুর ডাল পুঁতে দিচ্ছে তাদের কাছে কি এসব কবরে আযাব হওয়ার বিষয়টির সংবাদ এসেছে? কার মাধ্যমে তাদের নিকট এলো এই ওহীহ? তবে হা! কারো কবরকে চিহ্নিত করে রাখার প্রয়োজনবোধ করলে তাতে পাথর বা অন্য কোন শক্ত জিনিস দ্বারা চিহ্ন রাখা যায়। যেমন রাসূল (ﷺ) উসমান বিন মাযঊন (রাঃ)-এর কবরকে চিহ্নিত করার জন্য একটি পাথর রেখেছিলেন।এবং রাসূল ﷺ বলেছিলেন, যেন আমি বুঝতে পারি যে, এটি আমার ভাইয়ের কবর আর আমার পরিবারের কেউ মারা গেলে তার নিকট দাফন দিতে পারি।”(আবু দাউদ হা/ ৩২০৬ মিশকাত হা/১৭১১) অতএব মহান আল্লাহর এক নগণ্য গোলাম এবং রাসূল (ﷺ) এর এক নগণ্য উম্মত হিসাবে আমি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এতগুলো দলিল উপস্থাপন করার পরেও যারা মৃতের কবরের উপর খেজুরের ডাল পুঁতার প্রথাটি বর্জন না করে। তাহলে আমি সেটাই বলবো; যেটা মহান আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। অর্থাৎ মহান আল্লাহ বলেন,فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّمَا عَلَیۡکَ الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ
সুতরাং যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনার কর্তব্য তো শুধু স্পষ্টভাবে পৌছে দেয়া। (সূরা নাহল, ১৬/৮২)। তিনি আরো বলেছেন,فَاِنَّمَا عَلَیۡکَ الۡبَلٰغُ وَ عَلَیۡنَا الۡحِسَابُ তবে তোমার দায়িত্ব হল শুধুমাত্র পৌঁছে দেয়া, আর আমার দায়িত্ব হিসাব নেয়া। (সূরা রদ; ১৩/৪০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।