মাগরিবের ফরজের পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত সালাত আদায় করার হুকুম

প্রশ্ন: মাগরিবের ফরজের পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত সালাত আদায় করার হুকুম কি? অনেকে বলেন মাগরিবের পূর্বে কোন সালাত নেই, তাদের বক্তব্য কতটুকু সঠিক? আজ আমরা মাগরিবের সুন্নত সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মাগরিবের ফরয সালাতের পূর্বে দুই রাকআত সালাত পড়া মুস্তাহাব এবং মাগরিবের ফরজ সালাতের পর দুই রাকআত সালাত আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। এগুলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) কাওলী, ফেয়লী এবং তাকরীরী হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মাগরিবের ফরজের পরের দুই রাকআত আদায় করা হলেও পূর্বের দুই রাকআত নফল সালাতকে বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মসজিদগুলোতে অবজ্ঞা করা হয়। এমনকি উক্ত সালাত সম্পর্কে অধিকাংশ মুসল্লী খবরই রাখে না।
.
◾আমরা প্রথমে মাগরিবের পূর্ব দুই রাকআত নফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
_____________________________________
আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত আদায় কর, তোমরা মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত আদায় কর। তৃতীয়বার বলেন, যার ইচ্ছা সে পড়বে। এজন্য যে লোকেরা যেন তাকে সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ না করে। (সহীহ বুখারী, হা/১১৮৩, ১/১৫৭ পৃ., (ইফাবা হা/১১১২ ও ১১১৩, ২/৩২৩ পৃ.); সহীহ মুসলিম, হা/৮৩৬, ১/২৭৮ পৃ., (ইফাবা হা/১৮০৮); , হা/১১৬৫, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১০৯৭, ৩/৯২ পৃ.)।

এ হাদীসটি সূর্যাস্তের পর মাগরিবের সালাতের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব হওয়ার দলীল। সহাবা (সাহাবা) ও তাবি‘ঈদের একদল আলিম এবং পরবর্তী যুগে ইমাম আহমাদ ও ইসহাক এবং আহলুল হাদীসগণ এই অভিমত গ্রহণ করেছেন। আর এটিই সঠিক। যারা বলেন, হাদীসটি মানসূখ তথা এর হুকুম রহিত হয়ে গেছে তাদের কথার কোন দলীল নেই।তাছাড়া নির্দেশটি তিনবার বলার মধ্যেই উক্ত নফল সালাতের গুরুত্ব বুঝা যায়। সাহাবী আনাস, আবদুর রহমান ইবনু আওফ, উবাই ইবনু কা‘ব, আবু আইয়ুব আল আনসারী, আবু দারদা, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ, আবূ মূসা আল আশ‘আরী ও আবু হুরায়রাহ্, আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) প্রমুখগণ সাহাবীগন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পরও এ সালাত আদায় করতেন। অতএব তা মুস্তাহাব হওয়ার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ পোষণ করা যায় না। (মিশকাতুল মাসাবিহ ১৬৬৫ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য)।
.
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা যখন মদীনায় থাকতাম তখন এমন হত যে, মুয়াযযিন মাগরিবের সালাতের যখন আযান দিত, তখন লোকেরা কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। অতঃপর তারা দুই রাক‘আত দুই রাক‘আত করে সালাত আদায় করত। এমনকি কোন অপরিচিত লোক মসজিদে প্রবেশ করলে ধারণা করত, অবশ্যই মাগরিবের সালাত হয়ে গেছে। এতে মানুষ উক্ত দুই রাক‘আত সালাত আদায় করত। (সহীহ মুসলিম, হা/৮৩৭, ১/২৭৮ পৃ., (ইফাবা হা/১৮০৯); মিশকাত, হা/১১৮০, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১১১২, ৩/৯৭ পৃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘সুন্নাত ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ)।
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রহ:) বলেন, এ হাদীসের প্রকাশমান শিক্ষা এই যে, মাগরিবের আযানের পর মাগরিবের ফরয সালাতের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করা এমন একটি বিষয় যা আদায় করতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের অনুমতি দিয়েছেন। ফলে তারা তা আদায় করেছেন এবং তা আদায় করতে দ্রুত ধাবমান হতেন। অতএব তা মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণ বহন করে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা আদায় না করাটা মুস্তাহাব না হওয়া বুঝায় না বরং তা নিয়মিত সুন্নাত নয় তাই বুঝায়। (মিশকাতুল মাসাবিহ,১১৮১ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য)।

হাফিয ইবন হাজার রাহিমাহুল্লাহ ইমাম তাবারী থেকে বর্ণনা করেন: এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাগরিবের পূর্বে দুই রাকআত সালাতকে মুস্তাহাব হওয়া অস্বীকার করা নয়। কারণ এমন হতেই পারেনা যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু করার জন্য আদেশ করছেন যা মুস্তাহাব নয়। বরং এই হাদীসটি মাগরিবের পূর্বে দুই রাকআত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে শক্তিশালী প্রমানের মধ্যে একটি। (ফাতহুল বারী ৩: ৬০)।
.
ইমাম নাওয়াওয়ি রাহিমাহুল্লাহ [৬৭৬ হি.] বলেন: এসব সহীহ ও স্পষ্ট হাদীসের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয় যে মাগরিবের পূর্বে দুই রাকআত নামায আদায় করা মুস্তাহাব। (শারহু মুসলিম, ১: ২৭৮)।
.
মারসাদ ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি একবার উক্ববাহ্ আল জুহানী (রাঃ) এর নিকট হাযির হয়ে বললাম। আমি কি আপনাকে আবু তামীম আদ্ দারীর (তাবি‘ঈ) একটি বিষ্ময়কর ঘটনা শুনাব না? তিনি (আবু তামীম আদ্ দারী) মাগরিবের সালাতের পূর্বে দু’ রাক‘আত নাফ্‌ল সলাত আদায় করেন। তখন ‘উক্ববাহ্ বললেন, এ সালাত তো আমরা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর যামানায় আদায করতাম। তখন তিনি বললেন, তাহলে এ সালাত এখন আদায় করতে আপনাদেরকে বাধা দিচ্ছে কে? জবাবে তিনি বললেন (দুনিয়ার) কর্মব্যস্ততায়। (সহীহ বুখারী ১১৮৪, মিশকাতুল মাসাবিহ হাদিস নং ১১৮১)।

এ হাদীসটি মাগরিবের পূর্বে দু’ রাক্‘আত সালাত আদায় করা বিধিসম্মত হওয়ার একটি দলীল। এ হাদীস আবু বাকর ইবনুল আরাবীর এ দাবীকে প্রত্যাখ্যান করে যে, সাহাবীদের পরে আর কেউ এ সালাত আদায় করতেন না। কেননা আবু তামীম আবদুল্লাহ ইবনু মালিক প্রখ্যাত তাবি‘ঈ, যিনি তার উপনাম আবু তামীম হিসেবেই প্রসিদ্ধ। তিনি এ দু’ রাকআত আদায় করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ হাদীসের ব্যাখ্যা নং ১১৮১)।
.
নিন্মলিখিত হাদীস থেকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলও প্রমাণিত। তিনি শুধু অন্যদেরকে নির্দেশই দেননি বরং তিনি নিজেও এই নামায আদায় করেছেন। যেমন: আবদুল্লাহ আল মুযানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের ফরয সালাতেরবপূর্বে দুই রাকআত সালাত আদায় করেন। তারপর তিনি বলেন: তোমরা মাগরিবের ফরয সালাতের পূর্বে দুই রাকআত সালাত আদায় করবে। লোকেরা এ আমলকে সুন্নাত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, তাই তৃতীয়বারে তিনি বললেন: এ তার জন্য যে ইচ্ছা করে। [সহীহ ইবন হিব্বান: আল ইহসান, ১৫৮৮]। ইমাম ইবনে হিব্বান ও গুলাম মুস্তাফা যাহীর আমানপুরিসহ অনেক ইমাম এই হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। অপরদিকে শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এ সালাত মহানবী (ﷺ) পড়েছেন বলে কোন সহীহ প্রমাণ নেই। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪২পৃ:)। বরং আনাস বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসুল (ﷺ) এর যুগে সূর্য ডোবার পর মাগরেবের নামাযের আগে ২ রাকআত নামায পড়তাম।’ এ কথা শুনে তাবেয়ী মুখতার বিন ফুলফুল তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কি ঐ ২ রাকআত নামায পড়তেন?’ উত্তরে আনাস (রাঃ) বললেন, ‘তিনি আমাদেরকে তা পড়তে দেখতেন। কিন্তু সে ব্যাপারে আমাদেরকে কিছু আদেশও করতেন না এবং নিষেধও করতেন না।’ (সহীহ মুসলিম, মিশকাত ১১৭৯)।
.
উল্লেখ্য যে মাগরিবের পূর্বে কোন নফল সালাত নেই মর্মে সমাজে যে কথা প্রচলিত আছে সে বর্ণনাটি মুনকার বর্ননাটি হলো: আব্দুল্লাহ ইবনু বুরায়দাহ (রাঃ) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয় প্রত্যেক আযানের পর দুই রাক‘আত সালাত রয়েছে। তবে মাগরিব ব্যতীত। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৪৬৬৯)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি মুনকার। ‘মাগরিব ব্যতীত’ শেষের অংশটুকু ভুলক্রমে সংযোজিত হয়েছে। ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, وَهَذَا مِنْهُ خَطَأٌ فِى الْإِسْنَادِ وَالْمَتْنِ جَمِيْعًا وَكَيْفَ يَكُوْنُ ذَلِكَ صَحِِيْحًا؟ ‘এর অতিরিক্ত অংশের সনদ ও মতন উভয়েই ভুল রয়েছে। কিভাবে সহীহ হতে পারে?’ অতঃপর তিনি বলেন, ইবনু বুরায়দা নিজেই মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। (বায়হাক্বী, সুনানুস ছুগরা হা/৫৬৮; সনদ সহীহ, সহীহ ইবনে হিববান হা/১৫৫৭; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬৬২-এর আলোচনা দৃষ্টব্য)।
.
◾মাগরিবের ফরজ সালাতের পর দুই রাকআত সালাত আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ:
______________________________________
পূর্বের পর্বে ও উল্লেখ হয়েছে যে, মাগরিবের পর ২ রাকআত সুন্নত মহানবী (ﷺ) ত্যাগ করতেন না। তবে এই সুন্নত তিনি ঘরে পড়তেন।যেমন কা‘ব ইবনু ‘উজরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (আনসার গোত্র) বানী আবদুল আশহাল-এর মাসজিদে আসলেন এবং এখানে মাগরিবের সালাত আদায় করেছেন। সালাত সমাপ্ত করার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছু মানুষকে নফল সালাত আদায় করতে দেখলেন। তিনি বললেন: এসব (নফল) সালাত বাড়িতে পরার জন্য। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক সূত্রে পাওয়া যায়, লোকেরা ফারয সলাত আদার করার পর নাফল সালাত আদায়ের জন্যে দাঁড়ালে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এসব সালাত তোমাদের বাড়ীতে আদায় করা উচিত’। (আবু দাঊদ ১৩০০, আত্ তিরমিযী ৬০৪, নাসায়ী ১৬০০, ইবনু খুযায়মাহ্ ১২০১,সহীহ আল জামি‘ ৭০১০। মিশকাতুল মাসাবিহ,১১৮২)।
.
মাগরিবের সুন্নতেও ফজরের সুন্নতের মতই প্রথম রাকআতে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া সুন্নত। আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মাগরিবের পরের দুই রাক’আতে এবং ফজরের পূর্বের দুই রাক’আতে “কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন” এবং “কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ” সূরা দুটি এত সংখ্যকবার পাঠ করতে শুনেছি যে, তা গণনা করে শেষ করতে পারব না। এ অনুচ্ছেদে ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতেও হাদীস বর্ণিত আছে। (তিরমিযী ৪৩১, ইবনে মাজাহ্‌ ১১৬৬)।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমানিত যে, মাগরিবের তিন রাকাআত ফরজ সালাতের পূর্বে দুই রাকআত নফল সালাত রয়েছে কেউ চাইলে আদায় করতে পারে কিন্তু নেই মর্মে যে কথা চালু আছে উক্ত বক্তব্য ভিত্তিহীন যেটা দলিলের আলোকে প্রমান করার চেষ্টা করেছি। অতএব সুযোগ ও সাধ্যমত উক্ত দুই রাকআত নফল সালাতের উপর আমল করা কর্তব্য। (আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।