ইসলামে গণতন্ত্র

প্রশ্ন: ইসলামে গণতন্ত্র কি হারাম? যদি হারাম হয়,তাহলে হারাম প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের অত্যাচারী কর্মকাণ্ডে আনুগত্য করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: গণতন্ত্র ইংরেজি (Democracy) শব্দের বাংলা অর্থ গণতন্ত্র। এটি গ্রিক ভাষার শব্দ। শব্দটি Demos & Kratia শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। Demos শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষ বা জনগণ আর Kratia শব্দের অর্থ শাসন বা ক্ষমতা। সুতরাং উভয় শব্দের মিলিত অর্থ দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ বা জনগণের শাসন ক্ষমতা। গণতন্ত্র একটি মানব রচিত ধর্মহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা।সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে বুঝায়, এমন এক মতবাদ বা ব্যবস্থাকে যেখানে সমাজ-রাষ্ট্রের আইন-বিধান প্রণয়ণের চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় জনগণের উপর বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর। মোটকথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে শাসন কার্য পরিচালনাকে গণতন্ত্র বলে। (ডঃ এমাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথা, পৃঃ ৩৬৫)। আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় ‘গণতন্ত্র’ এর আধুনিক সংজ্ঞা দেন এভাবে যে, Democracy is the government of the people by the people and for the people. অর্থাৎ গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা জনগণের উপর জনগণের দ্বারা পরিচালিত জনগণের শাসন ব্যবস্থা বুঝায়।(সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পৃঃ ২৮৫) মোটকথা জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসনের নামই গণতন্ত্র। অন্য কথায় গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণরূপে জনসমষ্টির ইচ্ছাধীনে পরিচালিত। (আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, গণতন্ত্র বনাম ইসলাম, আহলে হাদীস যুবসংঘ স্মারক গ্রন্থ ২০১১, পৃঃ ১৬৮)।
.
গণতান্ত্রিক এই সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাটি তিনটি মতাদর্শের সমন্বয়। (১) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (২) গণতন্ত্র ও (৩) জাতীয়তাবাদ। মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম বলেন, ‘বর্তমান দুনিয়ায় যে কয়টি রাজনৈতিক মতবাদ প্রচলিত আছে, তন্মধ্যে ধর্মহীন জাতীয় গণতন্ত্র অন্যতম। ধর্মহীন জাতীয় গণতন্ত্র মতবাদটি ধর্মহীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এই তিনটি মতাদর্শের সমন্বয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই তিনটি মতবাদ একটি সুদৃঢ় যোগসূত্রে বাঁধা। একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। গণতন্ত্র অবশ্যই জাতীয়তাবাদী হবে এবং তা ধর্মহীনতার ভিত্তিতেই চলতে পারে’। (ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, পৃঃ ২৬)।
.
প্রচলিত গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি মতবাদ। এই তন্ত্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণের হাতে অথবা তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধি (পার্লামেন্ট সদস্য) এর হাতে অর্পণ করা হয়। তাই এ মতবাদের মাধ্যমে গায়রুল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ জনগণ ও জনপ্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে আইন ও শাসন জনগণ মেনে চলতে বাধ্য, যদিও মানব প্রকৃতি ও ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবুও। উদাহরণস্বরূপ: এই তন্ত্রের অধীনে গর্ভপাত করা, সমকামিতা, সূদী মুনাফার বিধান ইত্যাদি জারী করা হয়েছে। অথচ ইসলামে এগুলো হারাম ও বাতিল। জনগণের আইনে ব্যভিচার ও মদ্যপানকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। অথচ ইসলামে এগুলো চূড়ান্তভাবে হারাম করা হয়েছে। এ ধরণের অসংখ্য সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। মূলকথা এই তন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম ও ইসলাম পন্থীদেরকে প্রতিহত করা হয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে জানিয়েছেন, ‘হুকুম বা শাসনের মালিক একমাত্র তিনি এবং তিনিই হচ্ছেন উত্তম হুকুমদাতা বা শাসক।’ (সূরা আল-গাফির:১৩)। পক্ষান্তরে অন্যকে তাঁর শাসনে অংশীদার করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়েছেন তাঁর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কেউ নেই। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেয়ার অধিকার নেই। (সূরা ইউসুফ: ৪০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘আল্লাহ কি হুকুমদাতাদের শ্রেষ্ঠ নন?’ (সূরা আত্ব-ত্বীন: ০৮)। তিনি আরো বলেন, তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি নিজ হুকুমে কাউকে অংশীদার করেন না। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২৬)। ঈমানদারগণ সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম কোন আইন নেই। আল্লাহর আইন বিরোধী সকল বিধান জাহিলী বিধান। (সূরা আল-মায়িদাহ: ৫০)।
.
আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা। তিনি জানেন, কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত, কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। নিজের জন্য কোনটা উপযোগী মানুষ সেটাই জানে না, তাহলে অন্যের জন্য কোনটা উপযুক্ত সেটা কি করে জানবে। এ কারণে যে দেশগুলোতে জনগণের প্রণীত আইনে শাসন চলছে সে দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলা, চারিত্রিক অবক্ষয়, সামাজিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।

‘মাউসূআতুল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিব আল-মুআসিরা’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড, পৃ. ১০৬৬-১০৬৭-তে) এসেছে, ‘কোন সন্দেহ নেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আল্লাহর আনুগত্য ও আইনপ্রণয়ন অধিকারের ক্ষেত্রে একটি নব্য শিরকের স্বরূপমাত্র। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় স্রষ্টা হিসাবে আল্লাহর আইন প্রণয়ন করার একক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয় এবং মাখলুককে এ অধিকার প্রদান করা হয়। (সূরা আন‘আম :৫৮ ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-৯৮১৩৪)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দেয়া ও ভোট দেয়া জায়েয আছে কি? উল্লেখ্য, আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনে নয় অর্থাৎ আইন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক। জবাবে তাঁরা বলেন: যে সরকার আল্লাহর নাযিলকৃত আইন দিয়ে শাসন করে না, শরিয়াহ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না কোন মুসলমানের জন্য সে সরকারে যোগ দেয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে মনোনীত করা জায়েয নয়। তাই এ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য কোন মুসলমানের নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করা জায়েয নেই। তবে কোন মুসলমান যদি এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয় কিংবা অন্যকে নির্বাচিত করে যে, এর মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে তারা বর্তমান শাসনব্যবস্থার উপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সেটা জায়েয। তবে, সে ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি প্রার্থী হবেন তিনি এমন কোন পদ গ্রহণ করতে পারবেন না যা ইসলামী শরিয়ার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান, শাইখ আব্দুল্লাহ কুয়ুদ।(স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ থেকে সংকলিত (২৩/৪০৬, ৪০৭)।
.
শায়খ আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টি বিপরীতমুখী ব্যবস্থা। যা কখনো এক হবার নয়। একটি আল্লাহর উপর ঈমান ও আল্লাহ নির্দেশিত পন্থায় জীবন পরিচালনার নির্দেশ দেয়, অপরটি ত্বাগুতের (আল্লাহ বিরোধী অনুশাসন) প্রতি ঈমান ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার উপর নির্ভরশীল। (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, রেকর্ড নং-৩৫৩)।

◾হারাম প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের অত্যাচারী কর্মকাণ্ডে আনুগত্য করা যাবে কি?
_______________________________________
মহান আল্লাহর উপর ঈমান ও রাসূলদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনার পর আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন গ্রহণ করার প্রবণতাকে আল্লাহ তা‘আলা ‘বিস্ময়কর’ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।’ (সূরা আন-নিসা: ৬০)।
.
তাই গণতন্ত্র পদ্ধতি ইসলাম বিরোধী এবং এর দ্বারা নির্বাচিত সরকারের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের আনুগত্য করা যাবে না। এমনকি তার অন্যায় কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। বরং যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিবাদ করতে হবে, শাসকের সামনে হক্ব কথা বলতে হবে, সঠিক পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করতে হবে এবং হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَاطَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই।’ (শারহুস সুন্নাহ, সনদ সহীহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়)।
.
অন্য হাদীসে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে অনেক আমীর হবে, যাদের কোন কাজ তোমরা ভাল মনে করবে, কোন কাজ মন্দ মনে করবে। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজের প্রতিবাদ করবে, সে মুক্তি পাবে। যে ব্যক্তি ঐ কাজকে অপছন্দ করবে, সেও নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজে সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসরণ করবে (সে মুক্তিও পাবে না, নিরাপত্তাও পাবে না)। সাহাবীগণ বললেন, তাহলে কি আমরা তখন ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করে’ (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৪; মিশকাত, হা/৩৬৭১ ‘নেতৃত্ব ও পদ মর্যাদা’ অধ্যায়; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৭/২৩৩ পৃ.)।
.
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আর তোমরা যখন তোমাদের শাসকদের নিকট থেকে এমন কিছু দেখবে, যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কাজকে অপছন্দ কর; কিন্তু তাদের থেকে আনুগত্যের হাত ছিনিয়ে নিয়ো না।’ (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৫)। দাওরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে ইবনু তীন বর্ণনা করেন, ‘স্বৈরাচার শাসকদের সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হল, বিশৃংখলা-বিপর্যয় এবং সীমালংঘন ছাড়াই যদি তার থেকে আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করা যায়, তাহলে তা অবশ্যই করা যাবে। অন্যথা ধৈর্যধারণ করা ওয়াজিব।’ (ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১০)। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلصَّبْرُ عَلَى جَوْرِ الْأَئِمَّةِ أَصْلٌ مِّنْ أُصُوْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ ‘স্বৈরাচার শাসকদের উপর ধৈর্যধারণ করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি মূলনীতি।’ (মিনহাজুস সুন্নাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫২৭ কিছু নোট আল ইখলাস থেকে)। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।