মহিলাদের কণ্ঠের পর্দার হুকুম

প্রশ্ন: মহিলাদের কণ্ঠের পর্দার হুকুম কী? জরুরী প্রয়োজনে রিক্সা বা অটোতে যাতায়াত করলে কিংবা মার্কেটে গেলে, সেখানে গাইরে মাহরামদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মূলনীতি হচ্ছে নারীর কণ্ঠ পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়; যতক্ষণ না তার কণ্ঠ পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। যদিও নারীদের কণ্ঠের পর্দা সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামগণ মতভেদ করেছেন। তবে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হলো, নারীদের কণ্ঠ সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর বিশুদ্ধ হাদীসে জানা যায়; মহিলারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করতেন এবং ইসলামিক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। তারা সৎপথে পরিচালিত রাসূল (ﷺ)-এর খলীফাগণ এবং তাদের পরবর্তী শাসকদের সাথেও তা করেছেন। ইসলামের ইমামদের কেউই তাদের নিন্দা কিংবা বিরোধিতা করেননি। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজনে নারীদের জন্য পর পুরুষের সাথে কথা বলা জায়েজ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো নারীকে কথা বলার সময় আকর্ষণীয় ও আকৃষ্টকারী নরম কণ্ঠ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা পরিহার করতে হবে। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسۡتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیۡتُنَّ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِهٖ مَرَضٌ وَّ قُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا হে নবী-পত্নিগণ, তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা সদালাপ কর। স্বাভাবিকভাবে কথা বল। (সূরা আহযাব; ৩৩/৩২)
.
মহান আল্লাহ তাআলা যেরূপভাবে নারী জাতির দেহ-বৈচিত্রে পুরুষের জন্য যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন (যা থেকে হেফাযতের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে নারী পুরুষের জন্য ফেতনার কারণ না হয়ে পড়ে।) অনুরূপভাবে তিনি নারীদের কণ্ঠস্বরেও প্রকৃতিগতভাবে মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা, কোমলতা ও মধুরতা রেখেছেন, যা পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। সুতরাং সেই কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার ব্যাপারেও এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পর-পুরুষের সাথে বাক্যালাপের সময় ইচ্ছাপূর্বক এমন কণ্ঠ ব্যবহার করবে, যাতে কোমলতা ও মধুরতার পরিবর্তে সামান্য শক্ত ও কঠোরতা থাকে। যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরবিশিষ্ট লোক কণ্ঠের কোমলতার কারণে তোমাদের দিকে আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে এবং তাদের মনে কুবাসনার সঞ্চার না হয়। (অত্র আয়াতের তাফসির) তাছাড়া নারীরা বাসায় সালাত আদায়ের সময় আশেপাশে গায়ের মাহরাম পুরুষ থাকলে উচ্চস্বরে পড়া সালাতের কির’আত নীরবে পাঠ করার কথা বলা হয়েছে। (নববী আল-মাজমূ; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১০০; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব: ৯/৩৫)।
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, إنْ كَانَ صَوْتَ امْرَأَةٍ ، فَإِنْ كَانَ السَّامِعُ يَتَلَذَّذُ بِهِ ، أَوْ خَافَ عَلَى نَفْسِهِ فِتْنَةً حَرُمَ عَلَيْهِ اسْتِمَاعُهُ ، وَإِلاَّ فَلاَ يَحْرُمُ ، وَيُحْمَل اسْتِمَاعُ الصَّحَابَةِ رِضْوَانُ اللَّهِ عَلَيْهِمْ أَصْوَاتَ النِّسَاءِ حِينَ مُحَادَثَتِهِنَّ عَلَى هَذَا ، وَلَيْسَ لِلْمَرْأَةِ تَرْخِيمُ الصَّوْتِ وَتَنْغِيمُهُ وَتَلْيِينُهُ ، لِمَا فِيهِ مِنْ إثَارَةِ الْفِتْنَةِ ، وَذَلِكَ لِقَوْلِهِ تَعَالَى : فَلاَ تَخْضَعْنَ بِالْقَوْل فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ
নারীর কণ্ঠস্বরে যদি শ্রোতা আনন্দ পায় বা প্রলুব্ধ হওয়ার আশংকা করে, তবে তা শোনা তার জন্য হারাম। অন্যথায় তা হারাম নয়। এমন বর্ণনা এসেছে যে, মহিলারা যখন কথা বলতো তখন সাহাবীরা তাদের কথা শুনতেন। এই বর্ননাগুলোকে বোঝাতে হবে সেসব ক্ষেত্রে উল্লেখ করে, যেখানে ফিতনার ভয় ছিল না। একজন মহিলার তার কণ্ঠস্বর নরম এবং লোভনীয় করা উচিত নয়, কারণ এটি ফিতনার কারণ। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন;…সুতরাং পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা সদালাপ কর। স্বাভাবিকভাবে কথা বল। (সূরা আহযাব; ৩৩/৩২, আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ,খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৯০)
.
বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেন: “تحدث المرأة مع صاحب المتجر التحدث الذي بقدر الحاجة وليس فيه فتنة لا بأس به، كانت النساء تكلم الرجال في الحاجات والأمور التي لا فتنة فيها وفي حدود الحاجة .أما إذا كان مصحوبًا بضحك أو بمباسطة أو بصوت فاتن؛ فهذا محرم لا يجوز . يقول الله سبحانه وتعالى لأزواج نبيه صلى الله عليه وسلم ورضي الله عنهن : فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي في قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا [ سورة الأحزاب : آية 32 ] ، والقول المعروف ما يعرفه الناس وبقدر الحاجة، أما ما زاد عن ذلك؛ بأن كان على طريق الضحك والمباسطة، أو بصوت فاتن، أو غير ذلك، أو أن تكشف وجهها أمامه، أو تكشف ذراعيها، أو كفيها؛ فهذه كلها محرمات ومنكرات ومن أسباب الفتنة ومن أسباب الوقوع في الفاحشة ”
যদি কোন মহিলা দোকানের মালিকের সাথে প্রয়োজন অনুসারে কথা বলে যাতে কোন ফিতনা আশঙ্কা নেই, তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। মহিলারা পুরুষদের সাথে সাধারণ চাহিদা ( প্রয়োজনে ) এবং এমন বিষয় সম্পর্কে কথা বলতে পারে যেখানে ফিতনা নেই । কিন্তু যদি এর সাথে হাসি, ঠাট্টা কিংবা আকর্ষণীয় ভঙ্গি অর্থাৎ কণ্ঠস্বর কোমল থাকে তাহলে তা হারাম এবং জায়েয নয়। মহান আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন; তোমরা পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা সদালাপ কর।স্বাভাবিকভাবে কথা বল। (সূরা আহযাব; ৩৩/৩২)। কতটুকু তার প্রয়োজন রয়েছে সেটা প্রত্যেক মানুষ আপন আপন জানে। আর সে প্রয়োজন অনুসারে কথা বলতে হবে । এর থেকে বাড়তি কিছু কথা বলা যাবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু যদি এর সাথে অর্থাৎ হাসি বা আকর্ষণীয় সুরে কথা বলা ইত্যাদি জড়িত থাকে অথবা যদি সে তার সামনে তার মুখ উন্মোচন করে কিংবা তার বাহু বা হাত খুলে ফেলে, তবে এগুলি সবই হারাম এবং এটি একটি মন্দ কাজ এবং এমন একটি পদ্ধতি যা ফিতনার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং অনৈতিক কাজে নিপতিত হতে পারে৷ (আল-মুনতাকা মিন ফাতাওয়া আল-ফাওজান এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪০৩১৫)
.
অতএব, প্রশ্ন অনুযায়ী বলতে চাই, অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নারীর জন্য একাকী বাড়ির বাহিরে যাওয়া বৈধ নয়। কেননা মহান আল্লাহ বলেন; وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের প্রদর্শনীর মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। (সূরা আহযাব; ৩৩/৩৩)। একটি হাদীসে এসেছে,“নারী পৰ্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।”(সহীহ ইবন খুযাইমাহ হা/১৬৮৫,সহীহ ইবন হিব্বান হা/ ৫৫৯৯)। কিন্তু যদি একান্ত বাধ্য হয়ে বাহিরে যেতে হয় এবং মাহরাম পুরুষ না থাকে তাহলে নিরুপায় হয়ে কাছাকাছি দূরত্বে যাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন; فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা আত তাগাবুন; ৬৪/১৬)। তিনি আরো বলেছেন; لَا یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। (সূরা বাকারা; ২/২৮৬)
.
সুতরাং একান্ত বাধ্য হয়ে বাহিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে উক্ত নারীকে পরিপূর্ণ পর্দা করে যেতে হবে। কারণ কুরআন- সুন্নাহ এবং প্রসিদ্ধ সালাফদের বিশুদ্ধ বক্তব্য অনুযায়ী মহিলাদের মুখমণ্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং নারীর চেহারা পরপুরুষদের সামনে ঢাকা ফরজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন; يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا٩ অর্থাৎ হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মু’মিনদের নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। (সূরা আল- আহযাব, ৩৩/৫৯)। পর্দা বিষয়ে এ আয়াত অত্যন্ত পরিস্কার ও স্পষ্ট। কারণ, এ আয়াত থেকে জানা যায়- পর্দার নির্দেশের মধ্যে মুখমণ্ডলও অন্তর্ভুক্ত। এ আয়াতে ‘জালাবীব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। আরবী অভিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লিসানুল আরাব’ এ লেখা হয়েছে, ‘জিলবাব’ ওই চাদরকে বলা হয় যা মহিলারা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার জন্য ব্যবহার করে। (লিসানুল আরাব, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৭৩)। মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢাকা ফরয হলেও একান্ত জরুরি ক্ষেত্রে পর-পুরুষের সামনে সাময়িকভাবে মুখমণ্ডল খোলা জায়েয রয়েছে। যেমন, চিকিৎসার প্রয়োজনে বা নিরাপত্তা তল্লাশী করার সময় কিংবা হজ্ব-ওমরার জন্য পাসপোর্ট তৈরি এবং এ জাতীয় বিশেষ প্রয়োজনে। অতএব, তিনি যখন রিক্সায়, অটোতে বা কোন দোকানে যাবেন তখন প্রয়োজনীয় কথা বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে ঐ কথা যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত না হয় এবং কথা যেন অতি কর্কশ অথবা অতি কোমল কোনটিই না হয়। বরং দুইয়ের মাঝামাঝি হয়। অর্থাৎ যার সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলা হচ্ছে তিনি যেন উক্ত নারীর কথায় কষ্ট না পায় কিংবা বাজে মন্তব্য করতে না পারে। আবার কোমল কন্ঠের কারণে তার প্রতি অন্য পুরুষ যাতে আকৃষ্ট হতে না পারে সেটা খেয়াল রেখে কথা বলতে হবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।