চলার পথে হোঁচট খেলে কোন দুআ পাঠ করতে হয়

চলার পথে হোঁচট খেলে কিংবা শয়তানের পক্ষ থেকে কেউ আক্রমণের শিকার হলে বিসমিল্লাহ বলা এবং অভিশপ্ত শয়তানের কাছ থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। অতএব যদি কোনো মুসলিম চলাচলের পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় কিংবা কোন কারণে ভয়ে ভীত হয়, তাহলে তার জন্য শরীয়তের বিধান হলো: তার পালনকর্তা মহান রবকে স্মরণ করা এবং অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং বিসমিল্লাহ বলা। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন; اِمَّا یَنۡزَغَنَّکَ مِنَ الشَّیۡطٰنِ نَزۡغٌ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰهِ ؕ اِنَّهٗ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ যদি শয়তানের পক্ষ থেকে তুমি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব কর, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হও। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা আরাফ; ৭/২০০)
.
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম আল আমীন শানক্বীত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ” بين في هذه الآية الكريمة ما ينبغي أن يعامل به الجهلة من شياطين الإنس والجن، فبين أن شيطان الإنس يعامل باللين، وأخذ العفو، والإعراض عن جهله وإساءته، وأن شيطان الجن لا منجى منه إلا بالاستعاذة بالله منه ” তিনি (আল্লাহ) এই মহৎ আয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, কীভাবে মানব শয়তান এবং জ্বীন শয়তানের সাথে আচরণ করতে হবে। তিনি বর্ণনা করেছেন; মানব শয়তানের সাথে নম্রভাবে আচরণ করতে হবে, ক্ষমাকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার জাহালাত (অজ্ঞতা) আর কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আর জ্বীন শয়তানের ব্যাপারে বলেছেন আল্লাহ তাআলার নিকটে জ্বীন শয়তান থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। (আযওয়াউল বায়ান ফী ইযাহুল কুরআন বিল কুরআন, খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৯০)
.
তাছাড়া রাসূল (ﷺ) থেকে একটি বিশুদ্ধ হাদিস এসেছে, আবুল মালীহ (রাহিমাহুল্লাহ) এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন- আমি একটি সওয়ারীতে নবী করীম (ﷺ)-এর পিছনে বসা ছিলাম। হঠাৎ তার সওয়ারী হোঁচট খেলে আমি বললাম, শয়তান ধ্বংস হয়েছে। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, لَا تَقُلْ تَعِسَ الشَّيْطَانُ، فَإِنَّكَ إِذَا قُلْتَ ذَلِكَ تَعَاظَمَ حَتَّى يَكُونَ مِثْلَ الْبَيْتِ، وَيَقُولُ: بِقُوَّتِي، وَلَكِنْ قُلْ: بِسْمِ اللهِ فَإِنَّكَ إِذَا قُلْتَ ذَلِكَ تَصَاغَرَ حَتَّى يَكُونَ مِثْلَ الذُّبَابِ একথা বল না, যে শয়তান ধ্বংস হয়েছে। কেননা তুমি একথা বললে সে অহংকারে ঘরের মত বড় আকৃতির হয়ে যাবে এবং সে বলবে, আমার ক্ষমতা হয়েছে। অতএব বল, বিসমিল্লাহ বা আল্লাহর নামে। যখন তুমি বিসমিল্লাহ বলবে শয়তান ছোট হতে হতে মাছির মত হয়ে যাবে।(আবু দাউদ হা/৪৯৮২; মুসনাদে আহমাদ হা/২০৮৬৭; সহীহুল জামে ৭২৭৮; সহীহ আত-তারগীব হা/৩১২৮, ৩১২৯; সনদ সহীহ)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] অন্য হাদীসের আলোকে বলেন; وفى حديث آخر: ” إن العبد إذا لعن الشيطان يقول: إنك لتلعن ملعناً “. ومثل هذا قول القائل: أخزى الله الشيطان ، وقبح الله الشيطان، فإن ذلك كله يفرحه ويقول علم ابن آدم أني قد نلته بقوتي ، وذلك مما يعينه على إغوائه ، ولا يفيده شيئاً، فأرشد النبي صلى الله عليه وسلم من مسه شيء من الشيطان أن يذكر الله تعالى، ويذكر اسمه ، ويستعيذ بالله منه ، فإن ذلك أنفع له، وأغيظ للشيطان
যখন কোন বান্দা শয়তানকে অভিশাপ দেয়, তখন সে বলে; তুমি অভিশপ্ত ব্যক্তিকে অভিশাপ দিচ্ছ। অনুরূপ বলা হয়ে থাকে, আল্লাহ তাআলা শয়তানকে অপমান/অপদস্থ করেছেন। এ সবই তাকে খুশি করে এবং সে বলে, “আদম সন্তান জানে যে আমি আমার শক্তি (ক্ষমতা) দ্বারা তা অর্জন করেছি।” এটি তাকে প্রলুব্ধ করতে সাহায্য করে, কিন্তু এটি তার কোন উপকারে আসে না। তাই নবী ﷺ) বলেছেন; যে ব্যক্তিকে শয়তান স্পর্শ করে, সে যেন আল্লাহকে স্মরণ করে, বিসমিল্লাহ বলে এবং বিতাড়িত শয়তান থেকে পরিত্রাণ চায়। কারণ এটি তাঁর জন্য সর্বাধিক উপকারী ফলদায়ক।(এটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি) এবং শয়তানকে বিরক্ত করে, লাঞ্ছিত করে। (যাদুল মায়াদ; খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩৫৫ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৪৮৪৫)
.
ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন; শয়তান হচ্ছে দুই প্রকার। এক প্রকার শয়তানকে মানুষ চর্মচোখের মাধ্যমে দেখতে পায়। এরা হচ্ছে মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত শয়তান। আরেক প্রকার শয়তান হচ্ছে, যা মানুষ চোখে দেখতে পায়না। এটি হচ্ছে জিন জাতির শয়তান (ইবলীস ও তার চেলারা)। মানুষ শয়তানের খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা নাবীকে তাদের থেকে দূরে অবস্থান করতে বলেছেন, সুকৌশলে এবং উত্তমভাবে তাদের মোকাবেলা করতে বলেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের আচরণে চোখ বন্ধ করে থাকার আদেশ দিয়েছেন। আর জিন শয়তানের অনিষ্ট হতে বাঁচার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। কারণ সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে বলে বাহ্যিকভাবে তার মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। মানুষ তার মোকাবেলা করতে সক্ষমও নয়। তাই তার মোকাবেলায় এমন শক্তির প্রয়োজন, যিনি তার লাগাম ধরে টান দিতে সক্ষম এবং তার চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে খুবই পরাক্রমশালী। তিনি হচ্ছেন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা। সুতরাং এই প্রকার শয়তান থেকে বাঁচার জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই আশ্রয় চাইতে হবে। কারণ তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তার উপর শক্তিশালী নয়। এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহতে বর্ণিত সূরা নাস, ফালাক এবং বিভিন্ন যিকির-আযকার পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্ তা‘আলা সুরা আ’রাফ, মুমিনূন এবং ফুস্সিলাতে এই উভয় প্রকার শয়তানকে একত্রে উল্লেখ করেছেন। সূরা আরাফে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ‘এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নাবীর জন্যে শত্রু করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করতনা।’ (সূরা আনআম; ৬: ১১২)। কোন এক আরব কবি বলেন- فما هو إلا الإستعاذة ضارعاًأو الدفع بالحسنى هما خير مطلوبفهذا دواء الداء من شر ما يرى وذاك دواء الداء من شر محجوب ‘‘বিনয়ের সাথে আউযুবিল্লাহ পড়া কিংবা উত্তমভাবে প্রতিহত করাই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঐ রোগের মহা ঔষধ, যা চোখে দেখা যায়। আর প্রথমটি হচ্ছে এমন রোগের চিকিৎসা, যা থাকে চোখের আড়ালে। (যাদুল মায়াদ: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩৫৫-৩৫৬)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: শয়তানকে লানত/অভিশাপ করার বিধান কি? তিনি উত্তরে বলেছেন: لا يجوز؛ لأنه قد ورد أنه يتعاظم عند ذلك ، ولكن يستعاذ منه كما ذكر ذلك ابن القيم رحمه الله في زاد المعاد” এমনটি করা জায়েজ নয়। কেননা এমনটি করলে সে নিজেকে বড় মনে করে। তাই তার কাছ থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে যেমনটি ইবনুল কাইয়ুম রহ. “যাদুল মাআদে” বর্ণনা করেছেন। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৪৮৪৫)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে যা প্রতিয়মান হয় তা হচ্ছে- শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে মানুষের ভিতরে-বাইরে, শয়নে-স্বপনে, দিবা-নিশি সর্বাবস্থায় পথভ্রষ্ট করার সকল প্রকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।সে আমাদের পিতা আদম (আঃ)-কে জান্নাত থেকে বের করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে সফলতা অর্জন করেছে। সে আমাদের পিতা আদম (আঃ)-কে সিজদা না করায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তার প্রতি ছিল চরম অভিশাপ। তাই প্রত্যেক মুমিনের উঠতে, বসতে, হাঁটতে সর্বাবস্থায় সয়তানের যাবতীয় চক্রান্ত থেকে হেফাজতে থাকতে হবে এবং মহান আল্লাহর কাছে তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।