মহান আল্লাহ কোথায় আছেন এবং আরশ কী

প্রশ্ন: মহান আল্লাহ কোথায় আছেন? আরশ কী?
আরশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি ক্ষমতা ও রাজত্ব? আরশ সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা কি হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মহান আল্লাহ বলছেন, তিনি আরশের উপর সমুন্নত এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ৭টি আয়াত বর্ণিত হয়েছে। [আল-আ‘রাফ ৭/৫৪; ইউনুস ১০/৩; রা‘দ ১৩/২; ত্বোয়াহা ২০/৫; আল-ফুরক্বান ২৫/৫৯; সাজদাহ ৪; হাদীদ ৪; মুসলিম হা/৮৩৬, ‘মসজিদ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩৩০৩ ছহীহ বুখারী, হা/৭৪২০; তিরমিযী, হা/৩২১৩আবু দাঊদ, হা/৪৯৪১; তিরমিযী, হা/১৯২৪; মিশকাত, হা/৪৯৬৯, সনদ হাসান লিগাইরিহী। ইমাম ইবনু তায়মিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া ৩/১৩৫]।

মহান আল্লাহ বলেন, দয়াময় (আল্লাহ্) আরশের উপর উঠেছেন। [সূরা ত্বহা,৫]।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর উঠেছেন বলে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা আরশের উপর উঠেছেন রবের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনুযায়ী যেভাবে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া শোভা পায়, তিনি সেভাবেই আরশের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা সহীহ আক্বীদা। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয।কিন্তু তিনি কিভাবে উঠেছেন, কুরআন-সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য নাই বিধায় তা আমরা জানি না। এটা আল্লাহর একটি মহান কার্যগত গুণ।তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ধরনের প্রশ্ন কখনো করেননি। কারণ, তারা এর অর্থ বুঝতেন। শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা এ গুণে কিভাবে গুণান্বিত হলেন, তা শুধু মানুষের অজানা। এটি আল্লাহর একটি গুণ। আল্লাহ তা’আলা যে রকম, তার গুণও সে রকম। সুফিয়ান সওরী, ইমাম আওযায়ী, লাইস ইবনে সাদ, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ বলেছেনঃ যেসব আয়াত আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এগুলো হক এবং এগুলোর অর্থও স্পষ্ট। তবে গুণান্বিত হওয়ার ধরণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। বরং যেভাবে আছে সেভাবে রেখে কোনরূপ অপব্যাখ্যা ও সাদৃশ্য ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন, ইমাম যাহাবী রচিত আল-উলু]। তাছাড়া জৈনিক ব্যক্তি ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহকে (استواء) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেনঃ (استواء) শব্দের অর্থ তো জানাই আছে; কিন্তু এর স্বরূপ ও অবস্থা মানব বুদ্ধি সম্যক বুঝতে অক্ষম। এতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এর অবস্থা ও স্বরূপ জিজ্ঞেস করা বিদ’আত। [শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া, আর-রিসালা আত-তাদাম্মুরিয়্যাহ, পৃঃ ২০।]

আরশ কী? আরশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি ক্ষমতা ও রাজত্ব? আরশ সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা কি হবে?

পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত ও একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস থেকে প্রমাণ হয়, আরশ আল্লাহর এক বিরাট সৃষ্টি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং আরশের স্রষ্টা এবং তিনিই তাঁর পরিচালক।এ কারণে আল্লাহ তাআলা আরশকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করে বলেছেন ,তিনি সুউচ্চমর্যাদার অধিকারী, আরশওয়ালা। [সূরা গাফির, ৪০:১৫] আল্লাহর আরশ সমস্ত পৃথিবী ও আকাশসমূহে পরিব্যাপ্ত এবং সবার ছাদস্বরূপ উচ্চ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, প্রথমে“তিনি (আল্লাহ) ছিলেন, আর কেউ ছিল না। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। অতঃপর তিনি আকাশ-পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং প্রত্যেক বিষয় লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করেন। [সহীহ বুখারী ৭৪১৮, মিশকাত ৫৬৯৮ হাদিস সম্ভার,১১৯]।

পবিত্র কুরআনের সর্বমোট ২১টি আয়াতে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ হাদীসেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশের বিভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। সে সমস্ত হাদীস মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছে গেছে। মূলতঃ আরশ হলো আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। সেটা প্রকাণ্ড ও সর্ববৃহৎ সৃষ্টি।সাত আসমানের চেয়ে আল্লাহর আরশ বড়। [ইবনু আবী শায়বা, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৯]।

এটি সমস্ত সৃষ্টিজগতের ছাদস্বরূপ। আরশের সামনে কুরসী একটি রিং এর মতো, যেমনিভাবে আসমান ও যমীন কুরসীর সামনে রিং এর মতো। আরশের গঠন গম্বুজের মত। যা সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপরে রয়েছে। এমনকি জান্নাতুল ফেরদাউসও আরশের নীচে অবস্থিত। আরশের কয়েকটি পা রয়েছে। মূসা আলাইহিস সালাম হাশরের মাঠে তার একটি ধরে থাকবেন। [সহীহ মুসলিম,২৩৭৩ ইবনে মাজা,৪২৭৪]।

আব্দুল্লাহ্ বিন যায়িদ (রাঃ) হতে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন :কুরসীর মধ্যে সাত আকাশের অবস্থান যেন একটি ঢালের মধ্যে নিক্ষিপ্ত সাতটি দিরহামের ন্যায়। আর ‘আরশের মধ্যে কুরসীর অবস্থান ঠিক তেমন, যেমন খোলা ময়দানে পড়ে থাকা একটি আংটি। [তাফসীর ইবনু কাসীর সহীহ ফাযায়েলে আমল, হাদিস নং ৮]।

মহান আল্লাহর আরশের বহনকারী কিছু ফিরিশতা রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ঘোষণা দিচ্ছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আরশকে বহন করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। [সূরা মুমিন :৭]।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘সেদিন তোমার রবের আরশকে আটজন ফেরেশতা তাদের উপর বহন করবে।’ [সূরা আল-হাক্কাহ :১৭]।

ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ), ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) সহ অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, বর্তমানে আল্লাহর আরশ বহনকারী ফেরেশতার সংখ্যা ৪ জন। আর ক্বিয়ামতের দিন তাদের সংখ্যা হবে ৮ জন’।[তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৩০]।

তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত ও রয়েছে যে, আরশের বহনকারী ফিরিশতাগণ কি আট জন নাকি আট শ্রেণী নাকি আট কাতার। আয়াতে বর্ণিত পানির উপর আরশ থাকার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলার আরশ কোন কিছু সৃষ্টি করার আগে পানির উপর ছিল। এর দ্বারা পানি আগে সৃষ্টি করা বুঝায় না। তবে এখানে পানি দ্বারা দুনিয়ার কোন সমুদ্রের পানি বুঝানো হয়নি। কেননা, তা আরো অনেক পরে সৃষ্ট। বরং এখানে আল্লাহর সৃষ্ট সুনিদিষ্ট কোন পানি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ইবনে কাসীর প্রণীত আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১ম খণ্ড]।

আরশবহনকারী ফেরেশতাদের আকৃতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের একজনের শারীরিক গঠন বর্ণনা করতে আমাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তার কানের লতি হতে কাঁধ পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হল সাতশ’ বছরের দূরত্বের সমান’। [আবূ দাউদ, হা/৪৭২৭, সনদ সহীহ]।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় আরশের অবস্থান পানির ওপর। আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের ব্যাপারে হাদীসে বলা হয়েছে, তাদের একেক জনের কানের লতি ও কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান ৭ শ বছরের রাস্তার সমান। আরশের রয়েছে পায়া। তা আসলে জান্নাতুল ফিরদাউসের ছাদ। এসব বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। এসব থেকে প্রমাণিত হয়,আরশ আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি সমস্ত পৃথিবী ও আকাশসমূহে পরিব্যাপ্ত এবং সবার ছাদস্বরূপ উচ্চ। এতএব যারা বলেন, আরশ দ্বারা আল্লাহর ক্ষমতা ও রাজত্ব উদ্দেশ্য তাদের এ ব্যাখ্যা বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য।[আত-তালীক আলা শারহিল আকীদাতিত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৪ ফাতাওয়ায়ে আলবানী (তাওহীদ ও আকীদাহ)❜ পৃ. ৫৪]। আল্লাহু আলাম।
__________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।