বিতর সালাতের সঠিক নিয়ম, রাকআত সংখ্যা ও আদায়ের সময়

প্রশ্ন: বিতর সালাতের সঠিক নিয়ম কি? বিতর সালাতের রাকআত সংখ্যা, আদায়ের সময় এবং বিতরের কুনুত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই?▬▬▬▬▬▬▬▬◖◗▬▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: রাতের সর্বশেষ সালাত হল সালাতুল বিতর। আজ আমরা বিতর সালাতের রাকআত সংখ্যা, আদায়ের সময়, সঠিক পদ্ধতি এবং বিতরের কুনুত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

বিতর (وتر) শব্দটি একটি আরবি শব্দ ‘বিতর’ শব্দের অর্থ বেজোড়। বিতর সালাত আদায় করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৪৩; নাসাঈ হা/১৬৭৬; মির‘আত ২/২০৭)। যা এশার ফরয সালাতের পর হতে ফজর পর্যন্ত সুন্নাত ও নফল সালাত সমূহের শেষে আদায় করতে হয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি অতিরিক্ত নামায প্রদান করেছেন। আর তা হল বিতরের নামায। সুতরাং তোমরা তা এশা ও ফজরের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ে নাও।” (আহমাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ,১০৮ ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৪; সহীহ আত-তারগীব হা/৫৯২-৯৩) সাহাবী গুযাইফ বিন হারেস বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘নবী (ﷺ) বিতরের নামায প্রথম রাত্রিতে পড়তেন, নাকি শেষ রাত্রিতে?’ তিনি বললেন, ‘কখনো তিনি প্রথম রাত্রিতে বিত্‌র পড়তেন, আবার কখনো শেষ রাত্রিতে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ২০৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৬৩)। তবে যদি কেউ বিতর পড়তে ভুলে যায় অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে স্মরণ হলে কিংবা রাতে বা সকালে ঘুম হতে জেগে উঠার পরে সুযোগ মত তা আদায় করবে। [তিরমিযী, আবুদাঊদ মিশকাত হা/১২৬৮, ১২৭৯; নায়ল ৩/২৯৪, ৩১৭-১৯, মির‘আত ৪/২৭৯]।

বিতর সালাতের রাকাআত সংখ্যা:

বিতর সালাত এক, তিন, পাঁচ, সাত ও নয় রাক‘আত পর্যন্ত পড়া যায়। তিন রাক‘আত বিতর পড়লে এক তাশাহ্হুদে অথবা ২ রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে পরে এক রাকাআত আদায় করতে হবে। দু’রাক‘আত শুধু তাশাহুদ পড়ার জন্য বসা যাবে না। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪)। পাঁচ রাক‘আত পড়লেও মধ্যে না বসে এক তাশাহ্হুদে পড়তে হবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৬)। সাত রাক‘আত পড়লে ছয় রাক‘আতের পর তাশাহ্হুদ পড়ে আবার শেষ রাক‘আত পড়ে দ্বিতীয় তাশাহ্হুদ পড়ে সালাম ফেরাবে। (আবুদাঊদ হা/১৩৪২ , নাসাঈ,১৭১৯) আবার কোন কোন বর্ণনা মতে ষষ্ঠ রাকআতে না বসে একটানা ৭ রাকআত পড়ে সর্বশেষে তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (নাসাঈ, সুনান ১৭১৮)। নয় রাক‘আত পড়লে আট রাক‘আত পড়ে তাশাহ্হুদ পড়তে হবে এবং শেষের রাক‘আত পড়ে সালাম ফিরাবে। (সহীহ ইবনু মাজাহ হা/১১৯১ সহীহ নাসাঈ হা/১৭১৯ মিশকাত ১২৫৭)। বিতর এক রাকআতও পড়া যায়।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রচলিত হানাফিরা ১ রাকাআত বিতর অস্বীকার করেন। অথচ স্বয়ং রাসূল (ﷺ) এক রাকআত বিতর পড়তেন। তিনি বলেন, “রাতের নামায দু রাকআত দু রাকআত। অতঃপর তোমাদের কেউ যখন ফজর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তখন সে যেন এক রাকআত বিত্র পড়ে নেয়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৫৪)। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রে দুই দুই রাক‘আত করে সালাত আদায় করতেন এবং এক রাক‘আত বিতর পড়তেন। (সহীহ বুখারী, হা/৯৯৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৬, ইফাবা হা/৯৪১, ২/২২৭ পৃ., ‘বিতর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২ সহীহ মুসলিম, হা/৭৪৯, ১/২৫৪ পৃ., ইফাবা হা/১৫৮৮, ‘মুসাফিরের সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; তিরমিযী, হা/৪৬১; ইবনু মাজাহ, হা/১১৭৪)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক রাক‘আত বিতর পড়ার নির্দেশও দিয়েছেন।(সহীহ মুসলিম, হা/৭৫২, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৭, ইফাবা হা/১৬২৭-১৬৩৩,’ অধ্যায়-৭, ‘রাত্রির সালাত দুই দুই রাক‘আত’অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাত, হা/১২৫৫, পৃঃ ১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১১৮৬, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩১)।

৩ রাকাআত বিতরের সালাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি:
ভারত উপমহাদেশে তিন রাকাআত বিতরের সালাত আদায়ের তিনটি নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে দুটি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত, অন্যটি বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। যেমনঃ

◾১ম পদ্ধতি: অনান্য সালাতের মতো প্রথমে ২ রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেন। অতঃপর পৃথকভাবে আরেক রাকাআত পড়ে রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়ে সিজদা শেষে আবার বসে সালাম ফিরাবেন। [সহীহ মুসলিম: ১২৫২]।

◾২য় পদ্ধতি: অনান্য নামাযের মতোই ১ম ও ২য় রাকাআত পড়বে। তৃতীয় রাকাআতে কিরাআত পাঠ শেষে রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়ে সিজদায় চলে যাবে। তবে ২য় রাকাআতের পর তাশাহুদের জন্য না বসে সরাসরি দাড়িয়ে যাবে।শুধু মাত্র তৃতীয় রাকাআতের পর বসে আত্তাহিয়্যাতু, দুরুদ ও দুআ মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেবে।[মিশকাত হা/১২৫৪] আম্মাজান আয়েশা [রা] বলেছেন, রাসূল (ﷺ) তিন রাকাআত বিতর সালাত আদায় করতেন। এর মাঝে তাশাহুদের জন্য বসতেন না। একাধারে তিন রাকাআত ই পড়ে শেষ রাকাআতে বসতেন ও তাশাহুদ পড়তেন। এভাবে ওমর (রা.) ও বিতর পড়তেন।[মুস্তাদরাকে হাকেম: ১১৪০]।

◾৩য় পদ্ধতি: তিন রাকাত বিতরের ক্ষেত্রে উল্লেখিত দু’টি পদ্ধতি ছাড়া আরো একটি পদ্ধতি আছে। তা হল বিতর নামাযকে মাগরিবের নামাযের মত করে পড়া। অর্থাৎ দু’রাকআত পড়ে তাশাহুদ পড়ে সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া ও এক রাকাত পড়া। যেমন আমাদের সমাজে সচরাচর হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিটির পক্ষে দলীল হল আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, রাতের বিতর তিন রাকাত, উহা হল দিনের বিতর মাগরিবের মত। (দারাকুৎনী হা/১৬৩৭, বায়হাকী ৪৮১২) এ হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়, যঈফ।কারন উক্ত বর্ণনাতে ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া কূফী ইবনু আবিল হাওয়াজিব নামে দুর্বল রাবী আছেন। ইমাম বাইহাক্বী বলেন, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হলেও তা মূলতঃ ইবনে মাসউদের নিজস্ব কথা হিসেবে প্রমাণিত। [নাসবুর রায়া ২/১১৬]।

বিতর নামায মাগরিবের মত আদায় করার ব্যাপারে আরেকটি যুক্তি পেশ করা হয়। তা হচ্ছেঃ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ মাগরিব হচ্ছে দিনের বিতর নামায। অতএব তোমরা রাতের নামাযকে বিতর কর। এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, রাতের বিতর মাগরিবের মত করেই আদায় করতে হবে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এখানে রাকআতের সংখ্যার দিক থেকে যেমন মাগরিব নামায বিতর তথা বেজোড় করা হয়, অনুরূপ রাতেও বিতর তথা বেজোড় নামায আদায় করবে উক্ত নামায আদায় করার জন্য মাগরিবের মত দু’ই তাশাহুদে পড়তে হবে একথা বলা হয়নি। এখানে রাকআতের সংখ্যার দিক থেকে বিতরকে মাগরিবের মত বলা হয়েছে পদ্ধতির দিক থেকে নয়। এই কারণেই অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিতর নামাযকে মাগরিবের সাথে সাদৃশ্য করে পড়তে নিষেধ করেছেন। (দারাকুৎনী হা/১৬৩৪-৩৫ সনদ সহীহ)। আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তোমরা মাগরিবের নামাযের সাথে সাদৃশ্য করে তিন রাকাত বিতর পড়োনা; বরং পাঁচ রাকআত দ্বারা বা সাত রাকআত দ্বারা বা নয় রাকআত দ্বারা কিংবা এগারো রাকাত দ্বারা বিতর পড়ো। শায়খ আলবানী বলেন, ‘তিন রাকাত বিতর দু’তাশাহুদে পড়লেই তা মাগরিবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। আর হাদীসে এটাকেই নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু যদি একেবারে শেষ রাকাতে বসে তবে কোন সাদৃশ্য হবে না। হাফেয ইবনু হাজার ফাতহুল বারীতে একথাই উল্লেখ করেছেন এবং ছানআনী সুবুলস্‌ সালামে এই পদ্ধতিকে উত্তম বলেছেন। ইমাম ইবনুল কায়্যিম ‘যাদুল মাআদে’ প্রচলিত পদ্ধতির আলোচনায় আনেন নি। [দেখুন মিরক্বাত ৩/১৬০-৬১, ১৭০; মির‘আত হা/১২৬২, ১২৬৪, ১২৭৩ -এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্যঃ ৪/২৬০-৬২, ২৭৫] সুতরাং আমরা তিন রাকাত বিতিরে উপরের প্রথম দুইটি পদ্ধতির যে কোনো একটি গ্রহন করবো, সেটাই আমাদের জন্য উত্তম হবে।

বিতর নামাযের মুস্তাহাব ক্বিরাআত:
এ নামাযে সূরা ফাতিহার পর যে কোন সূরা পড়া যায়। তবে মুস্তাহাব হল, প্রথম রাকআতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকআতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১২৭০-১২৭২)। মহানবী (ﷺ) কখনো কখনো তৃতীয় রাকআতে সূরা ইখলাসের সাথে সূরা নাস ও ফালাকও পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৫)।

বিতরের কুনুতের দোয়া কখন পড়তে হয়:

বিতিরে দুআ কুনুত পড়া সুন্নাত। কুনূতের দুআ (শেষ রাকআতের) রুকুর আগে বা পরে যে কোন স্থানে পড়া যায়। হুমাইদ বলেন, আমি আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কুনূত রুকূর আগে না পরে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমরা রুকূর আগে ও পরে কুনূত পড়তাম।’ (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৯৪)। অনুরুপ (দুআর মত)হাত তোলা ও না তোলা উভয় প্রকার আমলই সালাফ কর্তৃক বর্ণিত আছে। (তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১/৪৬৪)। দুআর পরে মুখে হাত বুলানো সুন্নত নয়। কারণ, এ ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে সবগুলোই দুর্বল। (ইর: ২/১৮১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৫)। বলা বাহুল্য, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন সুন্নত প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাই কিছু উলামা স্পষ্টভাবে তা (অনুরুপ বুকে হাত ফিরানোকে) বিদআত বলেছেন। (ইর: ২/১৮১, মু’জামুল বিদা’ ৩২২পৃ:)। বিতরের বিশুদ্ধ কুনুত হল:اَللَّهُمَّ اهْدِنِيْ فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِيْ فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِيْ شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِيْ وَلَا يُقْضَى عَلَيْكَ وَإِنَّهُ لَا يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، وَلَا يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ تَبارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ.আল্লা-হুম্মাহ্ দিনী ফীমান হাদাইতা, ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফাইতা, ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লাইতা, ওয়া বা-রিক লী ফীমা- আ’অ্‌তাইতা, ওয়া ক্বিনী শার্‌রা মা- ক্বাদ্বাইতা, ফাইন্নাকা তাক্বদ্বী, ওয়ালা- ইউক্বদ্বা ‘আলাইকা, ওয়া ইন্নাহু লা- ইয়াযিল্লু মান ওয়া-লাইতা, ওয়ালা- ইয়া’ইঝ-ঝু মান ‘আ-দাইতা, তাবা-রাক্‌তা রাব্বানা ওয়া তা’আ-লাইতা। অর্থ: হে আল্লাহ্‌, আমাকে হেদায়েত দান করুন, যাদেরকে আপনি হেদায়েত করেছেন তাদের সাথে। আমাকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও সুস্থতা দান করুন, যাদেরকে আপনি নিরাপত্তা দান করেছেন তাদের সাথে। আমাকে ওলী হিসাবে গ্রহণ করুন (আমার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করুন), যাদেরকে আপনি ওলী হিসাবে গ্রহণ করেছেন তাদের সাথে। আপনি আমাকে যা কিছু প্রদান করেছেন তাতে বরকত প্রদান করুন। আপনি যা কিছু আমার ভাগ্যে নির্ধারণ করেছেন তার অকল্যাণ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। কারণ আপনিই তো ভাগ্য নির্ধারণ করেন, আপনার বিষয় কেউ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। আপনি যাকে ওলী হিসাবে গ্রহণ করেছেন সে অপমানিত হবে না। আর আপনি যাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ করেছেন সে কখনো সম্মানিত হবে না। মহামহিমান্বিত বরকতময় আপনি, হে আমাদের প্রভু, মহামর্যাদাময় ও সর্বোচ্চ আপনি। এ কুনুতটি সম্পর্কে হাসান ইবন আলী (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ্‌ (ﷺ) আমাকে এ বাক্যগুলো শিক্ষা দিয়েছেন বিতরের সালাতে বা বিতরের কুনুতে বলার জন্য।” (রেফারেন্স: সহিহ, আবু দাউদঃ ১৪২৫)।

উল্লেখ যে, আমাদের দেশে বিতিরে কুনুত হিসেবে আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা’ পড়া হয় এটি মূলত কুনুতে নাযেলা যা ফরজ সালাতে পড়া হয়। কেননা এই দো‘আটি কুনূতে নাযেলায় পড়ার ব্যাপারে এসেছে। [বায়হাক্বী ২/২১০, হা/২৯৬৩]। আলবানী (রহঃ) বলেন, আমি এ দো‘আটি বিতরের কুনূতে পড়ার ব্যাপারে কোন রেওয়ায়াত পাইনি।’ (ইরওয়া হা/৪২৫)।

বিতর সালাতের কাযা আদায়:
বিতরের সালাত যথা সময়ে না পড়া হলে তা কাযা পড়া বিধেয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি বিত্‌র না পড়ে ঘুমিয়ে যায় অথবা তা পড়তে ভুলে যায় সে ব্যক্তি যেন তা স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ,আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও সহীহুল জামে ৬৫৬২)। তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে থেকে বিত্‌র না পড়তে পারে সে ব্যক্তি যেন ফজরের সময় তা পড়ে নেয়।” (তিরমিযী, সুনান, ইর: ৪২২, জামে ৬৫৬৩)। খোদ মহানবী (ﷺ) এর কোন রাত্রে বিত্‌র না পড়ে ফজর হয়ে গেলে তখনই বিত্‌র পড়ে নিতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৪৩, বায়হাকী ১/৪৭৯, ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/২৪৬)। একদা এক ব্যক্তি মহানবীর দরবারে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ তিনি বললেন, “বিত্‌র তো রাত্রেই পড়তে হয়।” লোকটি পুনরায় বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ এবারে তিনি বললেন, “এখন পড়ে নাও।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৭১২)। এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, ফজর হয়ে গেলেও বিতর নামায বিতরের মতই কাযা পড়া যাবে। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৪/২৮৯ দ্র:)।

অপরদিকে বিতরের ক্বাযা দিনে কাযা পড়লে জোড় পড়তে হবে। অর্থাৎ সূর্য উঠার পরে বিতর সালাত পড়লে জোড় পড়তে হবে। বিতর এক রাক‘আত পড়ার অভ্যাস থাকলে এক সঙ্গে দুই রাক‘আত পড়বে এবং সালাম ফিরাবে। তিন রাক‘আত পড়ার অভ্যাস থাকলে দুই সালামে চার রাক‘আত পড়বে। আর পাঁচ রাক‘আত পড়ার অভ্যাস থাকলে তিন সালামে ছয় রাক‘আত পড়বে। আরো অতিরিক্ত পড়তে হলে এভাবেই পড়তে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবেই পড়তেন। প্রায় সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের সালাত ১১ রাক‘আত আদায় করতেন। কোন কারণে রাত্রে আদায় করতে না পারলে দিনের বেলায় বারো রাক‘আত পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হা/১৬২৮)। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ হিসাবে এটাই উম্মাহর জন্য করণীয়। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ১১/৩০০) আরো দেখুন সুনানে নাসায়ী:(১৭১০-১৭১৩; মুসনাদে আহমাদঃ ১৪২২,২৩০৩৩; সুনানে দারিমীঃ ১৫৮২, মিশকাতঃ ১২৬৫ ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮; নায়লুল আওত্বার ৩/৩১৮-১৯)।

বিতরের সালাত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ন ১০টি মাসআলা:
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
(১). এ সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। [ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৩; নাসাঈ হা/১৬৭৬; মির‘আত ২/২০৭]।

(২). বিতর সালাত ৩,৫,৭,৯,১১,১৩ এমনকি ১ রাকাআতও পড়া যায়। [ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৫; আবুদাঊদ ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৬৩-৬৫]।

(৩). বিতিরে দুআ কুনুত পড়া সুন্নাত। রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়া যায়। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৮৯; ইবনু মাজাহ হা/১১৮৩-৮৪]।

(৪). দুআ কুনূত পড়ার শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার মতো পুনরায় হাত উঠানোর পক্ষে কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। কাজেই এটা করা অনুচিত। [ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৭; মির‘আত ৪/২৯৯, ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ-৩৬]।

(৫). দুআ কুনূত এর সময় হাত তোলা (মুনাজাতের মতো) জায়েয যেহেতু এটি দোয়া। অনেক সাহাবী বুক বরাবর দু হাত তুলতেন।[বায়হাক্বী ২/২১১-১২, মির‘আত ৪/৩০০; তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৫৬৭, ইরওয়াউল গালীল ২/১৮১]।

(৬). বিতিরে ১ম রাকআতে সূরা আ’লা। ২য় রাকাআতে সূরা কাফিরুন এবং ৩য় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া সুন্নাত। তবে যে কোনো সূরা পড়া বৈধ। [হাকেম ১/৩০৫, আবুদাঊদ, দারেমী, মিশকাত হা/১২৬৯, ১২৭২]।

(৭). দুআ কুনূত এক বা একাধিক পড়া যায়। হাদীসে বর্ণিত যত দুআ আছে সেগুলি এমনকি নিজ থেকে বানিয়েও আরবীতে দুআ করা জায়েয। [বিতিরের কুনুত হিসবেে বিশুদ্ধ দেয়াটি হচ্ছে আল্লা-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদায়তা, ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফায়তা, ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লায়তা,,,,,,,[দেখুন সহিহ আবু দাউদঃ ১৪২৫ তিরমিযী ৪৬৪, নাসায়ী ১৭৪৫, ইবনু মাজাহ্ ১১৭৮মিশকাত,১২৭৩]।

ওমর (রাঃ) এর যুগে সাহাবীগণ দীর্ঘ সময় ধরে কুনূতের দো‘আ পাঠ করতেন। [সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১১০০; মিশকাত হা/১৩০১, সনদ সহীহ]।

ইমাম নববী বলেন: জেনে রাখুন, অগ্রগণ্য মাযহাব মতে, কুনুতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন দোয়া নেই। তাই যে কোন দোয়া পড়লে এর দ্বারা কুনুত হয়ে যাবে; এমনকি দোয়া সম্বলিত এক বা একাধিক কুরআনের আয়াত পড়লেও কুনুতের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। তবে, হাদিসে যে দোয়া এসেছে সেটা পড়া উত্তম।[ইমাম নববীর ‘আল-আযকার, পৃষ্ঠা-৫০]। সৌদি আরবের যুগ অন্যতম আলেম ইবনে উসাইমিন (রহঃ) বলেন, বর্ণিত দো‘আর সাথে মিলিয়ে অন্য দো‘আ বৃদ্ধি করাতে কোন বাঁধা নেই। [মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৪/৮১, প্রশ্ন নং ৭৭৮]।

উল্লেখ্য যে, আল্লা-হুম্মা ইন্না নাস্তা‘ঈনুকা ওয়া নাস্তাগফিরুকা…’ বলে বিতরে যে কুনূত পড়া হয়, সেটার হাদীস ‘মুরসাল’ বা যঈফ।[মারাসীলে আবুদাঊদ হা/৮৯; বায়হাক্বী ২/২১০; মিরক্বাত ৩/১৭৩-৭৪; মির‘আত ৪/২৮৫]। কেননা এটি কুনূতে নাযেলাহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, কুনূতে রাতেবাহ হিসাবে নয়।[ইরওয়া হা/৪২৮-এর শেষে, ২/১৭২ পৃঃ]। তবে কারো কারো মতে, এটি বিতিরে কুনুত হিসেবে পড়াও জায়েজ কিন্তু উত্তম নয়। কুনুতে নাজেলা হিসেবে পড়তে পারেন,আল্লা-হুম্মাগফির লানা ওয়া লিল মু’মিনীনা ওয়াল মু‘মিনা-তি ওয়াল মুসলিমীনা ওয়াল মুসলিমা-তি, ওয়া আল্লিফ বায়না কুলূবিহিম,,,,,,,[দেখুনবায়হাক্বী ২/২১০-১১, বায়হাক্বী অত্র হাদীসকে ‘সহীহ মওছূল’ বলেছেন]।

(৮). বিতরের সালাম ফিরানোর পর ‘সুবহানাল মালিকিল কুদ্দূস’ শব্দ করে ৩বার বলা সুন্নাত।[নাসাঈ হা/১৬৯৯ সনদ সহীহ]।

(৯). অন্যান্য সুন্নাত-নফলের ন্যায় বিতরের ক্বাযাও আদায় করা যাবে। তবে দিনে কাযা পড়লে জোড় পড়তে হবে। [ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮; নায়লুল আওত্বার ৩/৩১৮-১৯]।

(১০). রমজানসহ যেকোন মাসে বিতর সালাত জামা‘আতে আদায় করা যায়। কারণ এটি নফল সালাত। আর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) নফল সালাত রাসূল(ﷺ) এর সাথে জামা‘আতে আদায় করেছেন। তাছাড়া সালমান ও আবু দ্দারদা (রাঃ) জামা‘আতে নফল সালাত আদায় করেছেন। [সহীহ বুখারী হা/৬৮, ১১৭; মুসলিম হা/৭৬৯, ৭৭২, ৭৭৩]। তবে নিয়মিত করা যাবে না। কারণ রাসূল (ﷺ) বা সাহাবীগণ কেউ এরূপ আমল নিয়মিত করেননি। [ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ১/১৭৪]। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।