ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন ধরনের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ এবং কোন ধরনের পানি দ্বারা বৈধ নয়

প্রশ্ন: ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন ধরনের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ এবং কোন ধরনের পানি দ্বারা বৈধ নয়। বিস্তারিত বর্ননাসহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামী শরীয়তে যে কোন প্রকার নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ঐ পানির প্রয়োজন,যে পানি নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করতে সক্ষম। উল্লেখ্য যে,পানি তিন প্রকার। যথা-

▪️(ক) طَهُوْرٌ (ত্বাহূর):অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করতে সক্ষম। অর্থাৎ যে পানির রং, স্বাদ, গন্ধ কিছুই পরিবর্তন হয়নি। যেমন- বৃষ্টির পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বরফের পানি, কূপের পানি, ঝরণার পানি, নলকূপের পানি ইত্যাদি। কেবলমাত্র এই প্রকার পানি দ্বারাই পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ ‘আর আকাশ হ’তে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করেন।’(সূরা আনফাল ১১)

▪️খ) طَاهِرٌ (ত্বাহের): অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র। কিন্তু অন্যকে পবিত্র করতে পারে না। যেমন-পেপসি, ফলের জুস, দুধ মিশানো পানি ইত্যাদি। এগুলো নিজে পবিত্র কিন্তু কোন অপবিত্রকে পবিত্র করতে পারে না। অর্থাৎ এগুলো দ্বারা ওযু বৈধ নয় এবং শরীরে কোন নাপাকী লেগে গেলে এগুলো দ্বারা ধৌত করাও বৈধ নয়।আল্লাহ তা‘আলা বলেন,আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও,তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং,তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ কর।’(সূরা মায়েদা,৬)। অতএব যদি পানি ব্যতীত জুস, পেপসি ইত্যাদি দ্বারা ওযু জায়েয হতো, তাহ’লে পানি না পেলে আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিতেন না। বরং পানি জাতীয় জিনিস দ্বারা ওযু করার নির্দেশ দিতেন।

▪️(গ) نجس (নাজাস):অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র নয় এবং অন্যকেও পবিত্র করতে পারে না।এমন পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা জায়েয নয়।

◾পানির সাথে পবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণ হ’লে তার হুকুম : পানির সাথে যদি কোন পবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণ হয়। যেমন- বৃক্ষের পাতা, সাবান, কুল বা বরই ইত্যাদি এবং রং, স্বাদ, গন্ধ এই তিনটি গুণের সবগুলোই ঠিক থাকে তাহ’লে তা পবিত্র বলে গণ্য হবে এবং তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। কিন্তু যদি উলিলখি তিনটি গুণের কোন একটি নষ্ট হয়ে যায় তাহ’লে সেই পানি طَاهِرٌ তথা পবিত্র বটে কিন্তু তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ নয়।(সহীম বুখারীর,হা/১২৫৩)

◾গরম পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের হুকুম : (ক) যদি কোন অপবিত্র বস্ত্তকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করা হয়। অর্থাৎ যদি কেউ গাধা বা ঘোড়ার পায়খানা জমা করে এবং তাকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করে এবং পাত্রের মুখ খোলা থাকে, তাহ’লে তা মাকরূহ বা অপসন্দনীয়। কেননা অপবিত্র বস্ত্ত নিসৃত ধোঁয়া ঐ পানিতে পতিত হওয়ার ফলে তার গন্ধ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পক্ষান্তরে যদি পাত্রের মুখ বন্ধ করা থাকে, তাহ’লে তাতে কোন সমস্যা নেই।(শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/৩৩-৩৪)

(খ) যদি কোন পবিত্র বস্ত্তকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করে অথবা সূর্যের তাপে পানি গরম করে, তাহ’লে তাতে কোন সমস্যা নেই।(শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/৩৫)
.
◾ব্যবহারিক পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের হুকুম :
ব্যবহারিক পানি অর্থাৎ ওযু অথবা গোসল করার সময় ওযুর অঙ্গসমূহ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। তবে শর্ত হ’ল রং,স্বাদ ও গন্ধ ঠিক থাকতে হবে।হাদীসে এসেছে,উরওয়া (রহঃ) মিসওয়ার (রহঃ) প্রমুখের নিকট হ’তে হাদীস বর্ণনা করেন। এ উভয় বর্ণনা একটি অন্যটির সত্যায়ন স্বরূপ। নবী (ﷺ) যখন ওযু করতেন তখন তাঁর ব্যবহৃত পানির উপর তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম) যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তেন’।(সহীহ বুখারী,১৮৯ আঃ প্রঃ১৮৩ ইঃ ফাঃ১৮৯)এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীগণ তাঁদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে একই পাত্র হতে ওযু করতেন।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৯৩,আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ১৯৩)
.
◾মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র কি?
_____________________________________
প্রথমত: মানুষের উচ্ছিষ্ট, অর্থাৎ খাওয়া ও পান করার পরে যা অবশিষ্ট থাকে তা পবিত্র। হাদীসে এসেছে,
আয়িশাহ্ (রাঃ) যেখানে মুখ রেখে পানি পান করতেন
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও সেই জায়গায় মুখ রেখেই পানি পান করতেন।(সহীহ : মুসলিম ৩০০, নাসায়ী ২৮২, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৩৬০,ইবনু মাজাহ্ ৬৪৩, আবূ দাঊদ ২৫৯, ইরওয়া ১৯৭২। মিশকাত, ৫৪৭)।অতএব মানুষের উচ্ছিষ্ট সর্বাবস্থায়ই পবিত্র।
.
দ্বিতীয়ত:পশুর উচ্ছিষ্ট,গৃহপালিত পশু যার মাংস খাওয়া হালাল তার উচ্ছিষ্ট পবিত্র। যা ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত।পক্ষান্তরে যে সকল পশুর গোশত খাওয়া হারাম সে সকল পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র অথবা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে সহীহ মত হ’ল, কুকুর এবং শুকর ব্যতীত অন্য সকল পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র। যেমন হাদীসে বিড়ালের উচ্ছিষ্ট পবিত্র বলা হয়েছে (মুসনাদে আহমাদ ২২০৭৪, আবূ দাঊদ ৭৫, তিরমিযী ৯২, নাসায়ী ৬৮, ইবনু মাজাহ্ ৩৬৭, দারিমী ৭৩৬, ইরওয়া ১৭৩। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৪৮২) তবে পানির পরিমাণ যদি দুই কুল্লা-( প্রায় ২২৭ কেজি) এর কম হয় এবং ঐ সকল পশুর খাওয়া ও পান করার ফলে রং,স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহ’লে তা অপবিত্র হবে।(মুসনাদে আহমাদ ৪৯৪১, আবূ দাঊদ ৬৩, ৬৫, তিরমিযী ৬৭, নাসায়ী ৫২, ইবনু মাজাহ্ ৫১৭,মিশকাত,৪৭৭)
.
অপরদিকে কুকুর এবং শুকরের উচ্ছিষ্ট অপবিত্র।কারণ,আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের কারো পাত্রে যখন কুকুর পানি পান করে, তখন সে যেন তা সাতবার ধুয়ে নেয়।(সহীহ : বুখারী ১৭২, মুসলিম ২৭৯,সহীহ আল জামি‘ ৬২৭, ইবনু মাজাহ ৩৬৪)
.
মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন, তোমাদের কারো পাত্রে কুকুর মুখ দিলে সে যেন তা সাতবার ধুয়ে নেয় এবং এর প্রথমবার মাটি দিয়ে।(সহীহ : মুসলিম ২৭৯।মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৪৯০)।অতএব কুকুরের উচ্ছিষ্ট অপবিত্র না হ’লে রাসূল (ﷺ) সাতবার ধৌত করার নির্দেশ দিতেন না। আর শুকরের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, فَإِنَّهُ رِجْسٌ ‘নিশ্চয়ই তা অপবিত্র।’(সূরা আন‘আম,৬/ ১৪৫)
.
◾স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরী পাত্রের ব্যবহার এবং তাতে রক্ষিত পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের হুকুম: স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরী পাত্রে শুধুমাত্র খাওয়া ও পান করা হারাম। এছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা জায়েয। হাদীসে ,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোটা ও পাতলা রেশমের বস্ত্র পরিধান করতে এবং সোনা-রূপার পাত্রে পান করতে নিষেধ করেছেন।(সহীহুল বুখারী ৫৮৩১, ৫৪২৬, ৫৬৩২, ৫৬৩৩,মুসলিম ২০৬৭, তিরমিযী ১৮৭৮, নাসায়ী ৫৩০১, আবূ দাউদ ৩৭২৩, ইবনু মাজাহ ৩৪১৪,রিয়াদুস সলেহিন, ১৮০৫)।উল্লেখিত হাদীসে স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্র শুধুমাত্র খাওয়া এবং পান করার কাজে ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা জায়েয। এসব পাত্রে রাখা পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করাও জায়েয। কেননা যদি অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার অবৈধ হ’ত তাহলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে খাওয়া ও পান করতে নিষেধ করতেন না।(মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মসতাকনে ১/৭৫; ফিক্বহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ৬)
.
◾কাফিরদের পাত্র ব্যবহার করার হুকুম:যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে,কাফিরদের ব্যবহারিক পাত্রে কোন অপবিত্র বস্ত্ত তোলা হয়নি,তাহলে তা ব্যবহার করা হালাল। আর যদি জানা যায় যে, তাতে অপবিত্র বস্ত্ত তোলা হয়েছে এবং সে পাত্র ছাড়া অন্য কোন পাত্র পাওয়া না যায়,তাহলে তা ভালভাবে ধৌত করে ব্যবহার করা জায়েয।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের একজন মুশরিক মহিলার মশক হতে পানি নিয়েছিলেন এবং তা পান করেছিলেন ও ওযু করেছিলেন।(সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪; এবং শিকার’ অধ্যায়, হা/৫৪৮৮) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।