ওজুর শর্তাবলি, ওজুর ফরজ এবং সুন্নাহগুলো কি কি

প্রশ্ন: ওজুর শর্তাবলি, ওজুর ফরজ এবং সুন্নাহগুলো কি কি? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওজু করার সঠিক পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামের বিধান অনুসারে, ওজু হল দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের একটি পন্থা।
ওজু শুধু পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমই নয়, ফরজ ইবাদতের জন্য শর্ত। এই অজুকে আল্লাহ তা’আলা ফরজ করেছেন। ইবাদত-বন্দেগিতে ওজুর রয়েছে অধ্যাধিক গুরুত্ব। সুন্দরভাবে ওজু করা, ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও ইবাদত। কুরআন সুন্নার আলোকে ওজুর শর্তাবলি, ফরজ ও ওজু করার সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হল:

◾ওজুর শর্তাবলি দশটি। যেমন:
(১) মুসলিম হওয়া,
(২) জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া,
(৩) ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধ সম্পন্ন হওয়া,
(৪) নিয়ত করা,
(৫) নিয়তের বিধানকে অবিচ্ছিন্ন রাখা; বিধায় ওজুকারী পবিত্রতা সম্পন্ন না হওয়া অবধি অন্তরে নিয়তকে বিচ্ছিন্ন করবে না।
(৬) ওজু আবশ্যককারী সকল বিষয়কে (ওজুর সময়) বিচ্ছিন্ন রাখা,
(৭) ওজুর পূর্বে পানি বা পাথর দিয়ে শৌচকার্য করে নেওয়া,
(৮) ওজুর পানি পবিত্র ও বৈধ হওয়া,
(৯) ওজুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ত্বক অবধি পানি পৌঁছতে বাধা দেয় এমন সকল বিষয়কে অপসৃত করা,
(১০) নামাজের সময় হওয়া; এই শর্ত তার জন্য,যার মধ্যে ওজু নষ্টের কারণ সর্বদা বিদ্যমান থাকে, ফলে সকল ফরজ নামাজের জন্য তাকে ওজু করে নিতে হবে।
·
◾ওজুর ফরজ কার্যবলী:ওজুর ফরজ ছয়টি।যেমন:
(১) মুখমণ্ডল ধৌত করা; কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া এর অন্তর্ভুক্ত। মুখমণ্ডলের পরিসীমা দৈর্ঘ্যে মাথার চুলের উৎস থেকে থুতনি অবধি এবং প্রস্থে দু কানের শাখা পর্যন্ত বিস্তৃত।
(২) কনুই পর্যন্ত দু হাত ধোয়া,
(৩) পুরো মাথা মাসেহ করা,দুই কান এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
(৪) টাখনু অবধি দুই পা ধোয়া,
(৫) উক্ত পর্যায়ক্রম বজায় রাখা,
(৬) অবিচ্ছিন্নতা অটুট রাখা।(এসবের দলিল দেখুন সূরা মায়েদাহ,৬ নাসায়ি, হা/২৯৬২; আবু দাউদ, হা/১৭৫; সনদ সহীহ]।ফরয ব্যতীত ওজুতে বাকি অন্যান্য যত কাজ দলীল দ্বারা প্রমাণিত,সেগুলোই হলো সুন্নাত।

◾শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওজু করার সঠিক পদ্ধতি কি?
__________________________________________
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (ﷺ) যেভাবে ওজু করতেন তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো। ক্রমানুসারে এসব কাজের মধ্যে ওজুর ফরয, সুন্নাত,মুস্তাহাব সবই রয়েছে। তবে সর্বাগ্রে মিসওয়াক করে নেওয়া উত্তম। সহীহ বুখারী,৭২৪০ মুসলিম,২৫২ তিরমিজি,২২)।এবার একনজরে অযু করার সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হল:-
.
➤(১) নিয়ত করা: প্রথমে মনে মনে ওজুর নিয়ত করবে। কারণ নিয়ত ছাড়া কোন কর্মই শুদ্ধ হয় না,নিজেকে পবিত্র করাই ওজু করার উদ্দেশ্য,এরূপ সংকল্প করবে। আর অন্তরের এ ইচ্ছাটি এমনভাবে পোষণ করবে যে, এ ওজুর উদ্দেশ্য হলো শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন।(দেখুন,সহীহ বুখারী,১ মিশকাত,১)।মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়া সর্বসম্মতিক্রমে বিদআত।
.
➤(২) ওজুর শুরুতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলুন।ওজুর শুরুতে আল্লাহর নাম স্মরণের কথা হাদিসে এসেছে।(আবুদাঊদ হা/১০১; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৮,সহিহুল জামি: ২/১২৫৬)।তবে,এটি ওজু বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত (জরুরি) নয়। অর্থাৎ বিসমিল্লাহ পড়তে ভুলে গেলে ওজুর কোন সমস্যা হবেনা,এটিই বিশুদ্ধ মত। আর বিসমিল্লাহ না বলে এর বাইরে ‘নাউয়াইতু আন….’বা এ জাতীয় কোন কিছু হাদিসে বর্ণিত হয়নি।সুতরাং এগুলো পড়া বিদআত।(সহীহ বুখারী মুসলিম মিশকাত,১৪০)
.
➤(৩) তারপর তিনবার দুইহাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করুন।
ওজুর অঙ্গগুলোকে কমপক্ষে ১ বার করে ধোয়া বাধ্যতামূলক।২ বার করে ধুলেও চলে। তবে ৩ বার করে ধোয়াই উত্তম।তিনবার ধোয়ার আমল রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবীরা করতেন।কিন্তু তিনবারের অধিক ধোয়া অতিরঞ্জন,বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করা। (সহীহ বুখারী: ১৬৪, ১৮৫ আবূদাঊদ,মিশকাত ৪১৭-৪১৮) হাত ধোয়ার সময় এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে খিলাল করুন।আঙুলে আংটি থাকলে সেটা নাড়িয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন। (দারা কুতনী, ইবনে মাজাহ মিশকাত ৪০৭)। মেয়েদের হাতে-কানে গহনা থাকলে তা নাড়িয়ে সেই স্থানে পানি পৌঁছাতে হবে,যাতে কোন অংশ শুকনো না থাকে। জেনে রাখা ভাল যে,নখে নখ পালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেইন্ট থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত ওজু হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় ওজু-গোসল হয়ে যাবে।(ছালেহ আল-ফাউযান, আল-মুলাক্ষাছুল ফিকহী, ১/৪১ পৃঃ; আল-ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ১৮)
.
➤(৪) তারপর ডান হাতে এক অঞ্জলি পানি নিয়ে মুখ ও নাকে এক সাথে দিন।অর্থাৎ অর্ধেক দিয়ে গড়গড়া করে কুল্লি করুন বাকি অর্ধেক দিয়ে নাক ঝাড়ুন। সিয়াম অবস্থায় থাকলে সাবধানে নাকে পানি টানবে,যাতে গলার নিচে পানি না চলে যায়। কারণ রাসূল (ﷺ) এক অঞ্জলী পানি নিয়ে অর্ধেক দিয়ে কুলি করতেন এবং অর্ধেক পানি নাকে দিতেন।(বুখারী হা/১৯১, ১৯৯; মুসলিম হা/২৩৫; মিশকাত হা/৩৯৪)। এর বিপরীত যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (আবুদাউদ হা/১৩৯, আহমাদ হা/১৩৫৫, সনদ যঈফ; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৮৫; নববী, শরহ মুসলিম ৩/১০৫-১০৬) তবে যারা সহজে একাজটি করতে পারে না, তারা আলাদা ভাবে পানি নিয়ে নাকে ও মুখে দিয়ে ওজু করতে পারে। (ইবনে উসাইমীন,মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১২/২৫৭। কারণ এর উদ্দেশ্য হ’ল ভালোভাবে কুলি করা ও নাক ঝাড়া। সাহেবে মিরক্বাত বলেন, এটি স্পষ্ট যে, ‘এক অঞ্জলী’ শব্দের মধ্যে দু’টি ক্রিয়া রয়েছে। অর্থাৎ এক অঞ্জলী দ্বারা কুলি করবে এবং অপর অঞ্জলী দ্বারা নাক ঝাড়বে। (মিরক্বাত হা/৩৯৪-এর ব্যাখ্যা)
.
➤(৫) তারপর মুখমন্ডল (এক কান থেকে অপর কানের মধ্যবর্তী এবং কপালের চুলের গোড়া থেকে দাড়ির নিচের অংশ পর্যন্ত অঙ্গ) ৩ বার পানি লাগিয়ে দুইহাত দ্বারা ধৌত করুন। (সহীহ বুখারী ১৪০)। এক লোট পানি দাড়ির মাঝে দিয়ে দাড়ির ফাঁকে ফাঁকে আঙ্গুল চালিয়ে তা খিলাল করুন। (আবূ দাঊদ,মিশকাত ৪০৮)
মহিলাদের কপালে টিপ থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ ওজু হবে না।
.
➤(৬) তারপর প্রথমে ডান হাতে পানি দিয়ে ডান বাহুর উপর গড়িয়ে দিয়ে বাম হাত দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলের মাথা হতে কনুইর নিচ পর্যন্ত ঘষামাজা করে করে ধৌত করুন। এবং আঙ্গুল খিলাল করুন। ঠিক এভাবে বাম হাতও কনুই পর্যন্ত ধৌত করুন। (সহীহ বুখারী: ১৬৪, মুসলিম: ২২৬, ২৪৬, ইবনে খুযাইমা: ১১৮)
.
➤(৭) অতঃপর মাথার সম্মুখ থেকে পিছনে নিয়ে সেখান থেকে পুনরায় সামনে এনে একবার মাসাহ করুন। এটিই রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের নিয়মিত সুন্নাত। (দেখুন তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫; আবুদাঊদ হা/১১৮)। তবে তিনবার মাসাহ করা বিষয়ে উসমান (রাঃ) থেকে একটি আমল পাওয়া যায় করতে পারেন। (আবুদাঊদ হা/১০৭, ১১০)। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে কষ্টকর,ঝামেলা ও ঠাণ্ডাজনিত কারণে ওজু করার সময় তাদের হিজাবের উপর মাসাহ করতে পারবে।আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কতিপয় মহিলা সাহাবী এমনটি করতেন।(উসাইমীন,মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১২০; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৭২৩৯১)। কিন্তু এর বিপরীতে গর্দান মাসাহ করার কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ নেই। তাই ওজুতে গর্দান মাসেহ করা থেকে বিরত থাকুন। ইমাম নববী (রহঃ) একে ‘বিদ‘আত’ বলেছেন।(আহমাদ হা/১৫৯৯৩, আবুদাঊদ হা/১৩২, আলবানী, উভয়ের সনদ যঈফ; নায়লুল আওত্বার ১/২৪৫-৪৭)।যে ব্যক্তি ওজুতে ঘাড় মাসাহ করবে, ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় বেড়ী পরানো হবেনা’ বলে যে হাদীস বলা হয়ে থাকে,সেটি মওযূ বা জাল। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৭৪৪)
.
➤(৮) অতঃপর আর নতুন পানি না নিয়ে ঐ হাতেই দুই কান মাসাহ্‌ করুন। অর্থাৎ একই সঙ্গে ভিজা শাহাদাত আংগুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আংগুল দ্বারা কানের পিঠ মাসাহ করবে। (নাসাঈ, হা/১০২; আবু দাঊদ হা/১৩৭; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১; মিশকাত হা/৪১৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৭৮, ২/৮৪ পৃ.)।
.
➤(৯) অতঃপর ডান পায়ের আঙ্গুলের মাথা হতে গোড়ালি ও টাখনু পর্যন্ত তিন বার ধৌত করুন। (সহীহ মুসলিম: ২৪৬)। এবং বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল দ্বারা পায়ের আঙ্গুল খিলাল করুন। এরপর এ নিয়মেই বাম পা ধৌত করুন।(আবু দাউদ তিরমিজি মিশকাত: ৪০৬, ৪০৭)।
.
➤(১০) এরপর হাতে পানি নিয়ে কাপড়ের উপর থেকে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিন। বিশেষ করে পেশাব করার পর ওজু করলে এই আমল অধিকরুপে ব্যবহার্য।(আহমাদ হা/১৭৫১৫; মিশকাত হা/৩৬৬; সহীহাহ হা/৮৪১)। লজ্জাস্থান বরাবর কাপড়ের উপর পানি ছিটানো নারী-পুরুষের উভয়ের জন্য মুস্তাহাব।(মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৫০-এর ব্যাখ্যা)।
.
➤(১১) অতঃপর ওজু শেষে কালিমা শাহাদাহ পাঠ করুন।ওজু শেষে এটি পড়া ওয়াজিব নয়,তবে পড়লে বিশাল পুরস্কার আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওজু করে এটি পড়বে তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। সে যে কোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।(সহীহ মুসলিম ১/২০৯)। জেনে রাখা ভাল যে,দুআটি পড়ার সময় আকাশের দিকে তাকানো সুন্নাত নয়। কেননা, আকাশের দিকে তাকানোর ব্যাপারে যে বর্ণনাটি প্রচলিত সে হাদীসটি সহীহ নয়। কেননা উক্ত মর্মে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হ’লেও আকাশের দিকে তাকানোর বিষয়টি নেই। (দেখুন আহমাদ হা/১৭৪০১; ইরওয়া হা/৯৬,সনদ যঈফ)
(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।