পবিত্রতা বা অযু কাকে বলে এবং পবিত্রতা অর্জনের হুকুম কি

প্রশ্ন: পবিত্রতা বা অযু কাকে বলে? পবিত্রতা অর্জনের হুকুম কি? অযুর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কি? সহীহ হাদীস অনুযায়ী অযুর কি কি ফজিলত রয়েছে?
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।(সূরা যারিয়াত-৫৬)।এবং ইবাদত কিভাবে করতে হবে
যাবতীয় নিয়ম-পদ্ধতি অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন,যা পবিত্র কুরআন ও প্রিয় নবী রাসূল ﷺ)-এর সহীহ হাদীস গ্রন্থ সমূহে বিদ্যমান। আর সকল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হল সালাত,যা পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত বৈধ নয়। এ কারণে সকল মুহাদ্দিস এবং ফক্বীহগণ ত্বাহারাহ বা পবিত্রতা অধ্যায় দিয়ে কিতাব লিখা শুরু করেছেন। অতএব,নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম।
.
ওযু / অজু (الوُضوء) আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো নির্দিষ্ট চারটি অঙ্গ ধৌত করা। ইসলামি পরিভাষায় শরীর পবিত্র করার নিয়তে পবিত্র পানি দিয়ে শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন-হাত, মুখ, পা ধৌত করা ও (ভিজা হাতে) মাথা মাসাহ করাকে ওযু বলে।
.
মহান আল্লাহ বলেন-‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও,তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর,মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর) এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাক,তবে ভালোভাবে পবিত্র হও।(সূরা আল-মায়িদাহ :৬)। সুতরাং বড় নাপাকী না থাকার ফলে গোসলের দরকার না হলেও নামাযের জন্য ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ওযু ফরয। এ ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) বলেন, “ওযু নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় ওযু না করা পর্যন্ত আল্লাহ কারো নামায কবুল করেন না।”(সহীহ বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৩০০)
.
◾পবিত্রতা অর্জনের হুকুম,গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:
_________________________________
নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন করা সক্ষম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব।নামায কবুল হওয়ার জন্য যেমন বিশুদ্ধ ঈমান এবং হৃদয়কে শিরক,কুফরী ধারণা ও বিশ্বাস থেকে পবিত্র রাখা জরুরী শর্ত,ঠিক তেমনি নামাযীর বাহ্যিক দেহ্ ও পোশাক-আশাককে পবিত্র রাখাও এক জরুরী শর্ত। যেহেতু “নামাযের চাবিকাঠিই হল পবিত্রতা।”(আবু দাঊদ ৬১৮, তিরমিযী ৩,তিরমিযী ৩,মিশকাত ৩১২)
.
পবিত্রতা অর্জন করা মূলত দু’প্রকারের : অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক, অর্থাৎ দৈহিক। ‘অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা’ বলতে বুঝায় হৃদয়কে যাবতীয় শিরকী আক্বীদা ও ‘রিয়া’ মুক্ত রাখা এবং আল্লাহর ভালবাসার ঊর্ধ্বে অন্যের ভালবাসাকে হৃদয়ে স্থান না দেওয়া। ‘দৈহিক পবিত্রতা’ বলতে বুঝায় শারঈ তরীকায় ওযু,গোসল বা তায়াম্মুম সম্পন্ন করা।মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ‘তোমার পোষাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ।’(সূরা মুদ্দাছছির -৪)। তিনি অন্যত্র বলেছেন,আর ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।(সূরা আল-বাক্বারাহ ১২৫) আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা অর্জনকারীর প্রশংসা করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভালবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-“নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।’’(সূরা বাক্বারাহ ২২২)
.
আল্লাহ মসজিদে কুবার অধিবাসীদের প্রশংসা করে বলেন-সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।’(সূরা তওবা ১০৮)।
.
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,’পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত কারোর সালাত কবুল হয় না এবং হারাম মালের সাদাক্বা কবুল হয় না।’(সহীহ মুসলিম ২২৪। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৩০১)
.
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যার অযু ছুটে গেছে তার সলাত কবুল হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত সে অযু না করে।(সহীহ বুখারী ১৩৫, মুসলিম ২২৫। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৩০০)
.
কবরের কঠিন আযাব থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হ’ল অপবিত্র বস্ত্ত থেকে দূরে থাকা। যেমন হাদীসে এসেছে,ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,তিনি বলেন-একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, নিশ্চয়ই এই দুই ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করছে। কিন্তু তারা বড় কোন অপরাধের কারণে শাস্তি ভোগ করছে না। তার মধ্যে এই ব্যক্তি প্রসাব থেকে সতর্ক থাকত না। আর এই ব্যক্তি চোগলখোরী করে বেড়াত’।(সহীহ বুখারী,৬০৫২ সহীহ মুসলিম,৫৬৪, তিরমিজি, ৭০ মিশকাত,৩৩৮)

◾ওযুর মাহাত্ম ও ফযীলত প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।কয়েকটি বর্ননা নিন্মরুপ:-
_________________________________________
➤(১).ওযু ঈমানের অর্ধেক:রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلطُّهُوْرُ شَطْرُ الإِيْمَانِ ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।'(সহীহ মুসলিম,২২৩ ও ৪২২ মিশকাত,২৮১ হাদীস সম্ভার,৫৬৩)
.
➤(২).ওযু ছোট পাপের কাফ্ফারা:এ মর্মে হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন-কোন মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা ওযু করার সময় যখন মুখমন্ডল ধুয়ে ফেলে তখন তার চোখ দিয়ে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা (তিনি বলেছেন,) পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে উভয় হাত ধৌত করে তখন তার দু’হাতের স্পর্শের মাধ্যমে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে উভয় পা ধৌত করে তখন তার দু’পা দিয়ে হাঁটার মাধ্যমে অর্জিত পাপ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে ঝরে যায়। এইভাবে সে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়।’(সহীহ মুসলিম,৪৬৬ তিরমিজি,২ মিশকাত,২৮৫)
.
➤(৩).ওযুর পরবর্তী সীমিত সময়ের গুনাহও ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ইবনে শিহাব (রা) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি নবী (স)-কে বলতে শুনেছি,“যেকোন ব্যক্তি সুন্দর করে ওযু করবে,অতঃপর সালাত আদায় করবে, পরবর্তী সালাত আদায় করা পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সময়ে (হয়ে যাওয়া) তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।(সহীহ বুখারী: ১৬০, আধুনিক: প্রকাশনী ১৫৬)
.
➤(৪) ওযু বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে:আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন-আমি কি তোমাদেরকে (এমন কাজ) জানাবো না,যা করলে আল্লাহ বান্দার গুনাসমূহ ক্ষমা করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বলল,হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন, কষ্টকর অবস্থায় থেকেও পুর্ণাঙ্গরূপে ওযু করা, সালাতের জন্য মসজিদে বার বার যাওয়া এবং এক সালাতের পর আর এক সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। আর এই কাজগুলোই হ’ল সীমান্ত প্রহরা’।(সহীহ মুসলিম,৪৭৫ তিরমিজি,৫১ মিশকাত,২৮২)
.
➤(৫) ওযু জান্নাত লাভের মাধ্যম:আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা ফজরের সালাতের সময় বেলাল (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,‘হে বেলাল! ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক সন্তোষজনক যে আমল তুমি করেছ,তা আমাকে বল। কেননা জান্নাতে (মি‘রাজের রাতে) আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বেলাল (রাঃ) বললেন,আমার নিকট এর চেয়ে (অধিক) সন্তোষজনক কিছু আমি করিনি যে, দিন-রাত যখনই যে কোন প্রহরে আমি পবিত্রতা অর্জন করেছি,তখনই সে তাহারাত দ্বারা সালাত আদায় করেছি,যে পরিমাণ সালাত আদায় করা আমার তাক্বদীরে লেখা ছিল।’
(সহীহ বুখারী,১১৪৯ সহীহ মুসলিম,২৪৫৮ সহীহ আত তারগীব,২২৬ মিশকাত,১৩২২)
.
➤(৬) ওযু অন্যান্য উম্মাতের সাথে উম্মাতে মুহাম্মাদীর পার্থক্যকারী :একটি হাদীসে এসেছে,সাহাবীগণ বললেন,অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার উম্মাতের এমন লোকদের কিভাবে চিনবেন যারা এখনও দুনিয়াতেই আসেনি?উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,বল দেখি,যদি কোন ব্যক্তির নিকট কাল এক রঙ্গা বহু ঘোড়ার মধ্যে একদল ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা বিশিষ্ট ঘোড়া থাকে,সে কি তার ঘোড়া সমূহ চিনতে পারবে না? তারা বললেন-হ্যাঁ,হে আল্লাহর রাসূল! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,আমার উম্মতের লোকেরও ওযুর কারণে (ক্বিয়ামতের দিন) সেইরূপ ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা অবস্থায় উপস্থিত হবে আর আমি হাউযে কাওছারের নিকট তাদের অগ্রগামী হিসাবে উপস্থিত থাকব’।(সহীহ বুখারী,২৩৬৭ সহীহ মুসলিম,২৪৯ ইবনে মাজা,৪৩০৬ মিশকাত,২৯৮)
.
➤(৭) ওযু শয়তানের গিঁট খোলার অন্যতম মাধ্যম:আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন-তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদাংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়,তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত,অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহ’লে একটি গিঁট খুলে যায়।পরে ওযু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর সালাত আদায় করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য সহকারে।’(সহীহ বুখারী,১১৪২, ৩২৬৯ সহীহ মুসলিম,৭৭৬ আবু দাউদ,১৩০৬ ইবনে মাজা,১৩২৯ মিশকাত,১২১৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।