ফরয সালাতের পর প্রচলিত ইমাম ও মুক্তাদীর সম্মিলিত মুনাজাত করার ব্যাপারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেমগণের অভিমত

প্রশ্ন: ফরয সালাতের পর প্রচলিত ইমাম ও মুক্তাদীর সম্মিলিত মুনাজাত করার ব্যাপারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেমগণের অভিমত জানতে চাই?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হল ইসলাম। (সূরা আলে ইমরান,১৯)। আর এই দ্বীন পরিচালিত হবে একমাত্র আল্লাহর বিধান অনুযায়ী। এবং তা বাস্তবায়িত হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে। আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবদ্দশাতেই আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন-ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। (সূরা মায়েদা: ৩) যার মধ্যে সামান্যতম সংযোজন-বিয়োজন করার অধিকার পৃথিবীর কোন মানুষকে দেওয়া হয়নি। দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে ইসলামের মধ্যে এমন কতগুলি কাজ ইবাদত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে যার কোন ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে না থাকলেও মানুষ সেগুলিকে ইসলামের বিধান হিসাবেই গ্রহণ করেছে। এমনি একটি প্রচলিত আমল পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর দেশের বিভিন্ন মসজিদে সালাম ফিরানোর পরে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে ইমামের সরবে দো‘আ পাঠ ও মুক্তাদীদের সশব্দে ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলা। যা দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম হতে এর পক্ষে সহীহ বা যঈফ সনদে কোন দলীল নেই। এই একটি বিদআত প্রচলনের জন্য একদিকে যেমন বহু সুন্নত মাটি দেয়া হয়েছে অপরদিকে অসংখ্য বিদআত সৃষ্টি হয়েছে মনে হচ্ছে যেন নিন্মলিখিত হাদীসটির বাস্তব প্রতিফলন। হাসসান বিন আত্বিয়াহ মুহারেবী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ ‘যখনই কোন সম্প্রদায় তাদের দ্বীনের মধ্যে কোন বিদ‘আত সৃষ্টি করে, তখনই আল্লাহ তাদের মধ্য হতে সেই পরিমাণ সুন্নাত উঠিয়ে নেন। অতঃপর ক্বিয়ামত অবধি তা আর তাদের মধ্যে ফিরে আসে না’ (দারেমী: ৯৮ মিশকাত হা/১৮৮)। বলা আবশ্যক যে, আজও ইসলামের শহর মক্কা-মদিনার দুই হারাম এর মসজিদে উক্ত বিদআতি প্রথার কোন অস্তিত্ব নেই। ফরয সালাতের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা স্পষ্ট বিদ‘আত প্রমানে ইতিহাস বিখ্যাত আলেমদের ২০ টি ফাতওয়া তুলে ধরা হল।যেমন:

➤(১) জগদ্বিখ্যাত ইমাম শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত: ৭২৮ হি.) তার ৩৭ খণ্ডে সমাপ্ত মাজমুউল ফাতাওয়ায় সম্মিলিত মুনাজাত বিদআত মর্মে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার কাছে ফরজ সালাতের পর করনীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সালাতের পর যিকির সংক্রান্ত অনেক দোয়া উল্লেখ করেন। তার কাছে সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সালাতের পরে ইমাম ও মুক্তাদী একত্রে দু‘আ করার বিষয়টি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কেউই বর্ণনা করেননি। (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২২ খণ্ড, পৃ. ৫১৬-৫১৭)।

➤(২) ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] তার যাদুল মাআদ গ্রন্থে বলেন,‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতের পরে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে দু‘আ করেননি এবং মুক্তাদীরা তার দু‘আয় ফজর ও আসর কিংবা সমস্ত সালাতের পরে সর্বদা ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলেননি। ফলে এটা করা নিষেধ। যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছোট, বড়, পুরুষ ও মহিলা একজনও বর্ণনা করেনি।’ (ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন ২/৫৮৯-৫৯০ পৃ. যাদুল মা’আদ১/২৪৯ পৃঃ)।

◾সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ প্রচলিত ‘মুনাজাত’ সম্পর্কে ৪ টি ফাতাওয়ায় বলেছেন,

➤(ক) ৩৯০১ নং প্রশ্নোত্তরে বলা হয়েছে, ‘ফরয সালাত সমূহের পর দু‘আ করা সুন্নাত নয়, যদি তা হাত তুলে করা হয়, চাই ইমাম একাকী হোক, বা মুক্তাদী একাকী হোক, অথবা ইমাম-মুক্তাদী একত্রে হোক; বরং এটা বিদ‘আত। কারণ এটা না নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, না তাঁর সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৭/১০৩ পৃ.)।

➤(খ) উক্ত বোর্ড অন্যত্র ৫৫৬৫ নং ফাতাওয়াতে বলেন, ‘আমরা যা জানি তাতে ফরয সালাতের সালামের পর হাত তুলে দু‘আ করা নবী করীম (ﷺ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি। তাই ফরয সালাতের সালামের পরে দু’হাত তুলে দু‘আ করা সুন্নাত বিরোধী কাজ।’ (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৭/১০৪ পৃ., ফাতাওয়া নং ৫৫৬৫)।

➤(গ) অন্য এক প্রশ্নোত্তরে প্রশ্নকারীকে লক্ষ্য করে উক্ত বোর্ড বলেছেন, ‘ফরয সালাত থেকে ফারেগ হয়ে ইমাম দু‘আর জন্য হাত তুলবে এবং মুক্তাদীরা তার অনুসরণ করবে মর্মে আপনি যা প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন, শরী‘আতে তার কোন ভিত্তি আছে বলে আমাদের জানা নেই।’ (ঐ, ৭/১০৪-৫ পৃ., ফৎওয়া নং-৫৭৬৩)।

➤(ঘ) অন্য এক ফৎওয়ায় বলা হয়েছে,‘রাসূল (ﷺ) এ জন্য সাহাবীদের কাউকে তলব করেননি যে, সে তাঁর সাথে একত্রিত হয়ে দু‘আ করবেন। কতিপয় লোকেরা সালাতের পর দলবদ্ধভাবে সূরা ফাতিহা পড়া এবং দু‘আ করার যে প্রথার আমল করছে, তা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত।’ (৭/১২১-২২ পৃ., ফৎওয়া নং-৩৫৫২)।

➤(৪) সঊদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফাতাওয়া হল: ‘পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত ও নফল সালাত সমূহের পর সজোরে দু‘আ পাঠ করা অথবা দলবদ্ধভাবে গদবাধা দু‘আ করা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। কারণ এরূপ দু‘আ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবীদের যুগে ছিল না। যে ব্যক্তি ফরয সালাতের পর অথবা নফল সালাতের পর দলবদ্ধভাবে দু‘আ করে, সে যেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করে।’ (হাইয়াতু কিবারিল ওলামা ,১/২৪৪ পৃ.)।

➤(৫) বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা যা জানি তা হল নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত হয়নি যে, তারা ফরয সালাতের পরে হাত তুলে দু‘আ করেছেন। এজন্য পরিষ্কার বুঝা যায় এটা বিদ‘আত।’ (মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুন মুতানাওয়াহ, ১১/১৬৭ পৃ.)।

শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন,“ইমাম-মুক্তাদি সম্মিলিতভাবে দু’আ করার প্রমাণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে ,কথা ,কর্ম ও অনুমোদন (কাওলী, ফে’লী, তাক্বরীরী) কোন হাদীস সম্পর্কে আমরা অবগত নই। আর একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শের অনুসরণেই রয়েছে সমস্ত কল্যাণ। সালাত আদায়ের পর ইমাম-মুক্তাদির দু’আ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ সুস্পষ্ট আছে, যা তিনি সালামের পর পালন করতেন। চার খলীফা সহ সাহাবীগণ এবং তাবেঈগণ যথাযথভাবে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। অতঃপর যে ব্যক্তি তাঁর আদর্শের বিরোধীতা করবে, তাঁর আমল পরিত্যাজ্য হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“যে ব্যক্তি আমার নির্দেশ ব্যতীত কোন আমল করবে, তা পরিত্যাজ্য।” কাজেই যে ইমাম হাত তুলে দু’আ করবেন এবং মুক্তাদীগণ হাত তুলে আ-মীন আ-মীন বলবেন তাদের নিকট এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য দলীল চাওয়া হবে। অন্যথায় (তারা দলীল দেখাতে ব্যর্থ হলে) তা পরিত্যাজ্য।” (হাইয়াতু কেবারিল ওলামা ১/২৫৭)।

➤(৬) বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, ‘ফরয সালাত সমূহের পরে দু‘আ করা ও দু’হাত তুলা যদি সম্মিলিতভাবে হয় যেমন: ইমাম দু‘আ করে আর মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত হবে।’ (মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৩/২৫৮ পৃ.)।

➤(৭) বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস সুনানে আরবাসহ সহীহ-জয়ীফ-জাল হাদীসের পার্থক্যকারী অন্যতম ইমাম নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৩৩-১৪২০ হিঃ) ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত বিদআত আখ্যায়িত করে বলেন,‘উল্লিখিত স্থানে হাত তুলার ব্যাপারে শরী‘আতে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য একটি হাদীস ও নেই।যারা এই জঘন্য বিদআত করে তাদেরকে উল্লেখ করে বলেন, এই কাজ হলো তাদের মত যারা দ্বীনের মধ্যে বিদআত সৃষ্টি করাকে ভাল মনে করে এবং একটা অকাট্য দলিল সাব্যস্ত করার জন্য শরীয়তের পূর্ণাঙ্গতার উপর দলিল কায়েম করে না।অতঃপর তিনি তাদের হেদায়েতের জন্য এভাবে দোয়া করেছেন,আমরা আমাদের এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়েত কামনা করছি।(সিলসিলা যঈফাহ, ৩/৩১ পৃ. আরো বিস্তারিত দেখুন হা/৫৭০১ আলোচনার দ্রষ্টব্য)।

➤(৮) আল্লামা ইবনুল হাজ মাক্কী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নিঃসন্দেহে এ কথা বলা চলে যে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরয সালাতের সালাম ফিরানোর পর হাত উঠিয়ে দু’আ করেছেন এবং মুক্তাদীগণ আ-মীন, আ-মীন বলেছেন, এরুপ কখনও দেখা যায় না। চার খলীফা থেকেও এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই এ ধরনের কাজ, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি, তাঁর সাহাবীগণ করেননি, নিঃসন্দেহে তা না করা উত্তম এবং করা বিদ’আত। (মাদখাল, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৮৩)।

➤(৯) আল্লামা মাজদুদ্দীন ফিরোযাবাদী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ফরয সালাতের সালাম ফিরানোর পর ইমামগণ যে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেন, তা কখনও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি এবং এ সম্পর্কে কোন হাদীসও পাওয়া যায় না। (ছিফরুস সা’আদাত, পৃঃ ২০)।

➤(১০) আল্লামা ওবায়দুল্লাহ রহমানী মোবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহ) যিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত আহালুল হাদীস বিদ্বান মিশকাতের ভাষ্য মির’আতুল মাফাতীহ প্রনেতা তিনি বলেন, ফরজ সালাতের পর ইমাম মুক্তাদী হাত উঠিয়ে ইমামের সজোরে দোয়া করা এবং মুক্তাদী আমিন আমিন বলার প্রথাটি দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সংযোজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি জয়ীফ হাদিসও নেই। (ওবায়দুল্লাহ মোবারকপুরী রহঃ মাসিক মুহাদ্দিস বেনারস জুন’৮২ পৃঃ১৯-২৯)।

➤(১১) আল্লামা ইউসুফ বিন নূরী বলেন, অনেক স্থানেই এ প্রথা চালু হয়ে গেছে যে ফরয সালাতের সালাম ফিরানোর পর সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা হয়, যা রাসূল সাঃ হতে প্রমাণিত নয়। (মা’আরেফুস সুনান , ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৪০৭)।

➤(১২) আল্লামা আবুল কাশেম নানুতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ফরয সালাতের সালাম ফিরানোর পর ইমাম-মুক্তাদি সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা নিকৃষ্ট বিদ’আত। (এমদুদ্দীন, পৃঃ ৩৯৭)।

➤(১৩) হানাফি মাজহাবের আলেম সহীহ বুখারী ও তিরমিযীর ভাষ্যকার আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্বারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,ফরজ সালাতের পর দু হাত তোলা ছাড়া অনেক দোয়া হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয়। (আল উরফুস শাযি পৃঃ ৯৫ সম্মিলিত মুনাজাত পৃ: ৪০)।

➤(১৪) আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বর্তমান সমাজে যে প্রচলিত প্রথা অর্থাৎ ফরজ সালাতের পর ইমাম মক্কা দুই হাত তুলে সম্মিলিত দোয়া করা ইত্যাদি এবং আমিন আমিন বলার প্রথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল না। (ফাতওয়া আব্দুল হাই ১/১০০ পৃঃ সম্মিলিত মুনাজাত পৃঃ ১৫)।

➤(১৫) মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ফরয সালাতের পর ইমাম সাহেব দু’আ করবেন এবং মুক্তাদীগণ আ-মীন আ-মীন বলবেন, এ সম্পর্কে ইমাম আরফাহ এবং ইমাম গারবহিনী বলেন, এ দু’আকে সুন্নাত অথবা মুস্তহাব মনে করা নাজায়েজ। (ইস্তিবাবুদ দাওয়াহ পৃঃ ৮)।

➤(১৬) মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বর্তমানে অনেক মসজিদের ইমামদের অভ্যাস হয়ে গেছে যে, কিছু আবরী দু্’আ মুখস্থ করে নিয়ে সালাত শেষ করেই (দু’হাত উঠিয়ে ) ঐ মুখস্থ দু’আগুলি পড়েন । কিন্তু যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে যে, এ দু’আ গুলোর সারমর্ম তাদের অনেকেই বলতে পারে না। আর ইমামগণ বলতে পারলেও এটা নিশ্চিত যে,অনেক মুক্তাদী এ সম্স্ত দু’আর অর্থ মোটেই বুঝে না। কিন্তু না জেনে না বুঝে আ-মীন, আ-মীন বলতে থাকে। এ সমস্ত তামাশার সারমর্ম হচ্ছে কিছু শব্দ পাঠ করা মাত্র। প্রার্থনার যে রুপ বা প্রকৃতি, তা এতে পাওয়া যায় না । (মা’আরেফুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫৭৭)।তিনি আরো বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে ইযাম হতে এবং শরীয়তের চার মাযহাবের ইমামগণ হতেও সালাতের পরে এ ধরনের মুনাজাতের প্রমাণ পাওয়া যায় না। সারকথা হল, এ প্রথা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের প্রদর্শিত পন্থা ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের পরিপন্থি। (আহকামে দু’আ ১৩ পৃঃ)।

➤(১৭) পাকিস্থানের বিখ্যাত মুফতী আল্লামা রশীদ আহমাদ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পাঁচবার প্রকাশ্যে জামা’আত সহকারে পড়তেন। যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও সম্মিলিতভাবে মুক্তাদীগণকে নিয়ে মুনাজাত করতেন তাহলে নিশ্চয়ই একজন সাহাবী হলেও তা বর্ণনা করতেন। কিন্তু এতগুলো হাদীসের মধ্যে একটি হাদীসও এ মুনাজাত সম্পর্কে পাওয়া যায়নি। তারপর কিছুক্ষনের জন্য মুস্তাহাব মানলেও বর্তমানে যেরুপ গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে,তা নিঃসন্দেহে বিদ’আত। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৩য় খন্ড,পৃঃ ৬৮)।

➤(১৮) মাওলানা মওদুদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এতে সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে জামা’আতে সালাত আদায় করার পর ইমাম ও মুক্তাদী মিলে যে নিয়মে দু’আ করেন, এ নিয়ম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানায় প্রচলিত ছিল না। এ কারণে বহুসংখ্যক আলেম এ নিয়মকে বিদ’আত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৩য় খন্ড,পৃঃ ৬৯৮)।

➤(১৯) মুফতী আযম ফয়যুল্লাহ হাটহাজারী বলেন, ফরয সালাতের পর দু’আর চারটি নিয়ম আছে। যথা:

(১) মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠানো ব্যতীত হাদীসে উল্লিখিত মাসনুন দু’আ সমূহ পড়া। নিঃসন্দেহে তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

(২) মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠিয়ে দু’আ করা।এটা কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।তবে কিছু যঈফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

(৩) ইমাম ও মুক্তাদীগণ সম্মিলিতভাবে দু’আ করা। এটা না কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, না কোন যঈফ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

(৪) ফরয সালাতের পর সর্বদা দলবদ্ধভাবে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করার কোন প্রমাণ শরীয়তে নেই। না সাহাবী ও তাবেঈদের আমল দ্বারা প্রমাণিত, না হাদীস সমূহ দ্বারা, সহীহ হোক অথবা যঈফ হোক অথবা জাল হোক। আর না ফিক্বাহ এর কিতাবের কোন পাতায় লিখা আছে। এ দু’আ অবশ্যই বিদ’আত। (আহকামে দু’আ, পৃঃ ২১)।

➤(২০) মাসিক মঈনুল ইসলাম পত্রিকার প্রশ্নোত্তর কলামে বলা হয়েছে, জামা’আতে ফরয সালাতান্তে ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদ’আত ও মাকরুহে তাহরীমী।কেননা সাহাবয়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনদের কেউ এ কাজ শরী’আত মনে করে আমল করেছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা নিশ্চয়ই মাকরুহ ও বিদ’আত। (মাসিক মঈনুল ইসলাম, সফর সংখ্যা ১৪১৩ হিঃ)।
.
✅➤জেনে রাখা ভাল যে, ইসলামী শরীয়তে ৪ টি স্থানে সম্মিলিতভাবে দু‘আ করা জায়েজ যেমন:
_______________________________________
(১) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাত তুলে সম্মিলিত দু‘আ করেছেন,পানি চাওয়ার জন্য। (সহীহ বুখারী, হা/১০২৯, ১/১৪০ পৃ.; সহীহ মুসলিম, হা/৮৯৬, ১/২৯৩ পৃ.; মিশকাত, হা/১৪৯৮ ‘ইস্তিস্কা’ অনুচ্ছেদ),

(২) বৃষ্টি বন্ধের জন্য। (সহীহ বুখারী হা/১০১৩, ১/১৩৭ পৃ.), চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় (সহীহ মুসলিম হা/৯১৩, ১/২৯৯ পৃ.;সহীহ বুখারী হা/১০৪০ ও ১০৪৩),

(৩) কুনূতে নাযেলা পাঠের সময়। (মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪২৫; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুছ ছগীর, হা/৫৩৬, সনদ সহীহ; আবু দাঊদ, হা/১৪৪৩, সনদ হাসান; মিশকাত, হা/১২৯০),

(৪) বিতর সালাতে কুনূত পড়ার সময়। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১০৯৭; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নাবী, পৃ. ১৮০; ফাতাওয়া আরক্বানিল ইসলাম, পৃ. ৩৫০-৩৫১, ফৎওয়া নং-২৭৭)।

উপরোক্ত চারটি স্থান ছাড়া অন্য যত স্থানে সম্মিলিত মুনাজাত সমাজে প্রচলিত আছে যেমন: ফরয সালাতের পর, মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর, বিবাহের পর, সমাবেশের পর, দুই ঈদের সালাতের পর কেউ দাওয়াত করলে সেখানে,রমজানে ইফতারের সময়, এবং টঙ্গীর মাঠে আখেরী মুনাজাতসহ বাকি যত প্রথা চালু আছে, তা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।

পরিশেষে, মহান আল্লাহ বলেন, এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করবে না। কারণ তা তোমাদেরকে হেদায়াতের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আল্লাহ তোমাদের এ নিদের্শ দিলেন যেন তোমরা সতর্ক হও। [সূরা আনআম,৬/১৫৩] সুতরাং সিরাতে মুস্তাকীম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সহজ সরল ও সঠিক পথ। যে পথের দিকে উক্ত আয়াতে আহবান করা হয়েছে। এটাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত তথা জীবনাদর্শ। আর সুবুল বা বিভিন্ন রাস্তা হচ্ছে (দ্বীনের মধ্যে) মতানৈক্য ও বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ। উপরোক্ত আয়াতে সকল প্রকারের বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে ইবনে মসউদ (রাঃ) এর একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করি;তিনি বলেন, “তোমরা অনুসরণ কর, নতুন কিছু রচনা করো না। কারণ তোমাদের জন্য তাই যথেষ্ট। আর তোমরা পুরাতন পন্থাই অবলম্বন কর।” (সিলসিলা যয়ীফাহ্‌ ২/১৯) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী ‘আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।