পুরুষের মাথার চুল রাখার সুন্নাতী তরীকা

প্রশ্ন: পুরুষের মাথার চুল রাখার সুন্নাতী তরীকা কি কি? চুলে সিঁথি করা এবং চুল লম্বা হলে রাবার ব্যান্ড ব্যবহার করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পুরুষের মাথার চুল লম্বা ও খাটো উভয়টিই রাখা জায়েয। তবে চুলের নিদিষ্ট পরিমাপ আছে, সবচেয়ে বড় চুল হল কাঁধ বরাবর। এর চেয়ে বড় এবং বিভিন্ন স্টাইলে চুল রাখা রাসূল (ﷺ) এর তরীকার খিলাপ। যেমন: মাথার এক অংশ কামিয়ে ফেলা, অপর অংশে চুল রাখা। কোন বিধর্মীদের অনুকরণে চুল রাখা।কোন ফাসিক ব্যক্তির চুলের হেয়ার ষ্টাইল নকল করে চুল রাখা নাজায়েজ। চুল বড় বা ছোট করে রাখা ‘সুনানুয যাওয়ায়েদ’ বা ব্যবহারগত অতিরিক্ত সুন্নাত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যার উপর আমল করা উত্তম। তবে ছেড়ে দেওয়া অপছন্দনীয় নয়।’ (শরীফ জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, বৈরূত ছাপা ১৪০৮/১৯৮৮ ‘সুন্নাতের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ, পৃঃ ১২২)।

বড় চুল তিন পদ্ধতিতে রাখা যায়,এটি মানুষের ব্যবহারগত অতিরিক্ত সুন্নাত সমূহের অন্তর্ভুক্ত।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মাথায় তিন ধরনের চুল থাকত। যেমনঃ

▪️[১] ওয়াফরা, যা কানের লতি পর্যন্ত [আবুদাঊদ হা/৪২০৬]।
▪️[২] লিম্মা, যা কাঁধের কাছাকাছি ঘাড়ের মধ্যস্থল পর্যন্ত ঝুলে পড়ত। [সহীহ মুসলিম হা/২৩৩৭]
▪️[৩] জুম্মা, সবচেয়ে বড় যা ঘাড়ের নীচ পর্যন্ত। [সুনানে নাসাঈ হা/ ৫০৬২, ৫০৬৬]।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর চুল সাধারণত জুম্মার চেয়ে ছোট এবং ওয়াফরার চেয়ে বড় থাকত। [ইবনু মাজাহ হা/৩৬৩৫]।

আয়েশা [রাঃ] থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি হায়েয [ঋতুবতী] অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মাথার কেশ পরিপাটি করতাম। [মুসহীহ বুখারী, হা/২৯৫; নাসাঈ, হা/২৭৭সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/১৩৫৯ মিশকাত, হা/৪৪১৯]। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)চুল আঁচড়াবার সময় ডান দিক থেকে শুরু করতেন। [আবূ দাঊদ হা/৪১৬০]। তিনি তাঁর মাথার মাঝখানে সিঁথি করতেন। [আবূ দাঊদ হা/৪১৮৯, ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/৩৬৩৩]।
.
আবু ইসহাক বলেন, আবু আব্দুল্লাহ [ইমাম আহমাদ] কে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল,যার মাথায় লম্বা চুল ছিল। তিনি বলেন, এটি উত্তম সুন্নাত। যদি আমরা সক্ষম হই,তাহলে আমরাও অনুরূপ লম্বা চুল রাখব। তিনি আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জুম্মা চুল ছিল। তিনি আরো বলেন,রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ৯ জন সাহাবীর লিম্মা চুল ছিল। ১০ জন সাহাবীর জুম্মা চুল ছিল। ইমাম আহমাদ নিজে মধ্যম সাইজের চুল রাখতেন। [ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১/৭৩-৭৪ পৃঃ চুল ছাঁটা ও মুন্ডনের হুকুম অনুচ্ছেদ]।

সাহাবী ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) একদিন লম্বা চুল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে এলেন। তখন রাসূল (ﷺ) মাছি বসবে, মাছি বসবে বলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। ফলে তিনি ফিরে গিয়ে পরে চুল কেটে খাট করে এলেন। তখন রাসূল (ﷺ)বললেন, এটি সুন্দর (هذا أحسن)।[আবুদাঊদ হা/৪১৯০; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৩৬; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১/৭৩-৭৪ পৃঃ]।

পূর্বে আমি উল্লেখ করেছি যে, পুরুষেরা মাথার মাঝখানে সিঁথি করতে পারে এটি মুস্তাহাব। এবং সিঁথি না করে ছেড়ে রাখা মকরূহ। যেহেতু তাতে আহলে কিতাবের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। অবশ্য চুল ছোট হলে সিঁথি না করে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে রাখায় দোষ নেই। (শা’রুর রা’স ৫০ পৃঃ)।
.
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার কেশ নিম্নদেশে ঝুলিয়ে রাখতেন (অর্থাৎ প্রথমদিকে তিনি সিথি করতেন না)। আর মুশরিকরা তাদের মাথায় সিঁথি করত। পক্ষান্তরে আহলে কিতাব তাদের মাথার চুল ঝুলিয়ে রাখত। প্রথমদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ব্যাপারে প্রত্যাদেশ না পেতেন, সেসব ব্যাপারে আহলে কিতাবদের অনুসরণ পছন্দ করতেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার কেশকে সিঁথি করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩৫৫৮, নাসাঈ, হা/৫২৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০৫ শামায়েলে তিরমিযি, হাদিস নং ২৫ ইবনু মাজাহ ৩৬৩২, মুসনাদে আহমাদ ২৩৬৪, মিশকাত হা/৪৪২৫) ।অপর বর্ণনায় রয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চুল বাবরী ছিল,তাতে সিঁথি হলে তিনি তা সিঁথি করতেন, না হলে ছেড়ে দিতেন। অতএব বিশুদ্ধ মত হলো,সিঁথি মুস্তাহাব। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯১৭)।
.
পুরুষের চুলে ব্যান্ড, রাবার ব্যান্ড জুটি ইত্যাদি ব্যবহার করা শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা এগুলো নারীদের সদৃশ হয়ে যায়। তাছাড়া যেহেতু পুরুষের চুল সোজা রাখার জন্য অন্য পদ্ধতিও রয়েছে। (টুপি পরিধান, নিয়মিত তৈল বা অন্য কিছু লাগিয়ে চুলের যত্ন নেওয়া ইত্যাদি)। সুতরাং ঘরে অথবা বাইরে কোথাও পুরুষের জন্য মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণ বৈধ নয়। তাই মাথার লম্বা চুল বেঁধে রাখা মহিলাদের সাদৃশ্যগ্রহণ হওয়ায় তা করা পুরুষের জন্য জায়েজ হবে না। কেননা হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লা’নত করেছেন নারীরূপী পুরুষ ও পুরুষরূপী নারীদের উপর এবং বলেছেন, তাদেরকে বের করে দাও তোমাদের ঘর হতে এবং তিনি অমুক অমুককে বের করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ২১৫২, ২১৫৪, ২২৩৩, মুসলিম ১৭০৩, ১৭০৪, তিরমিযী ১৪৩৩, ১৪৪০, আবু দাউদ ৪৪৬৯, ৪৪৭০, ইবনু মাজাহ ২৫৬৫, আহমাদ ৭৩৪৭, ৮৬৬৯, মালেক ১৫৬৪,বুলুগুল মারাম,১২১৮) উক্ত হাদীসের ব্যাখায় মুবারকপুরী (রহ,) তুহফাতুল আহওয়াহি গ্রন্থে বলেন, সুন্দর্য্যতা, পোশাক-আশাক, খেযাব, আওয়াজ, আকৃতি, কথাবার্তা, সহ সমস্ত নড়াচড়া ও উঠাবসায় পুরুষের জন্য মহিলার সাদৃশ্য গ্রহণ হারাম ও নাজায়েয। এবং হাদীসে সাদৃশ্য দ্বারা এই সর্বপ্রকার সাদৃশ্যই ধর্তব্য।(ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৮০৫৯)।
.
এমনকি সালাতে ও পুরুষ তাদের চুল বেঁধে রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। সাঈদ ইবনু আবু সাঈদ আল-মাক্ববুরী থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুক্তদাস আবু রাফি‘কে হাসান ইবনু ‘আলী (রাঃ) এর পাশ দিয়ে যেতে দেখলেন। তখন তিনি [হাসান ইবনু ‘আলী (রাঃ)] গর্দানের পেছনে চুলের ঝুটি বেঁধে সলাত আদায় করছিলেন। আবূ রাফি’ (রাঃ) বাঁধন খুলে দিলে হাসান (রাঃ) তার প্রতি রাগের দৃষ্টিতে তাকালেন। আবূ রাফি বলেন, আগে সালাত আদায় শেষ করুন, রাগ করবেন না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ এটা (চুলের ঝুটি) হচ্ছে শয়তানের ঘাঁটি বিশেষ, অর্থাৎ শয়তানের আড্ডাখানা। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং-৬৪৬)।
.
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের শেষাংশে বলা হয়েছে যে, وَلاَ نَكْفِتَ الثِّيَابَ وَالشَّعَرَ ‘এবং আমরা যেন সিজদাকালে আমাদের কাপড় ও চুল গুটিয়ে না নেই।’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা৮৮৭; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৮২৭ ‘সিজদা ও তার মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ; নায়লুল আওত্বার ৩/২২ পৃঃ)। উক্ত বিষয়টি পুরুষের জন্য খাছ,মহিলাদের জন্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এই নিষেধাজ্ঞা না জানার কারণে অনেক পুরুষ মুসল্লী সালাতের সময়ে তাদের মাথার চুল বেঁধে নিতেন। একদা ইবনু আব্বাস (রাঃ) জনৈক বদরী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিছ (রাঃ) এর চুল খুলে দেন। (ইবনু মাজাহ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, নায়লুল আওত্বার ৩/২৩৫ সহীহ ইবনু মাজাহ হা/৮৬১ সহীহ আবুদাঊদ হা/৬৪৬)। ইমাম শাওকানী উপরোক্ত হাদীস দু’টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,والحديثان يدلان علي كراهية صلاة الرجل وهو معقوص الشعر ‘হাদীস দু’টি পুরুষের জন্য চুল বাঁধা অবস্থায় সালাত আদায় করা মাকরূহ সাব্যস্ত করে। হাফেয ইরাকী বলেন, এটি পুরুষের জন্য খাছ, মেয়েদের জন্য নয়। কেননা তাদের চুলও সতরের অন্তর্ভুক্ত, যা সালাত অবস্থায় ঢেকে রাখা ওয়াজিব।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, চুল বড়-ছোট উভয় পদ্ধতিতেই রাখা জায়েজ। তবে সুন্দরভাবে রাখতে হবে এবং নিয়মিত চুলের পরিচর্যা করতে হবে। রাসূল (ﷺ) বলেন,‘যে ব্যক্তির চুল আছে, সে যেন তার যত্ন করে রাখে।’ (আবুদাউদ হা/৪১৬৩; মিশকাত হা/৪৪৫০; সহীহাহ হা/৫০০)।কোন অবস্থাতেই বেহায়াপনা করা যাবে না এবং অন্যদের অনুসরণ করা যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘যারা অন্যদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে,তারা তাদের মধ্যেই গণ্য হবে।’ (আবুদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।