পুরুষরা কি রুপার গহনা পরতে পারবে

প্রশ্ন: পুরুষরা কি রুপার গহনা যেমন; আংটি, চেইন, ব্রেসলেট ইত্যাদি পরতে পারবে?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মূলনীতি হচ্ছে, পুরুষদের জন্য রৌপ্যের আংটি বা ঘড়ি পরা জায়েয; যেমনটি নারীদের জন্যেও জায়েয। এমনকি আংটির উপরে নকশা করা ও বৈধ কোন কিছু লেখাও জায়েয, এতে দোষের কিছু নেই। হাদীসে এসেছে, আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন; “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চিঠি লিখলেন কিংবা লিখতে চাইলেন। তখন তাঁকে বলা হলো তারা সীলমোহর বিহীন কোন চিঠি পড়ে না। সে প্রেক্ষিতে তিনি একটি রুপার আংটি বানালেন। তাতে লেখা ছিল, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (অর্থ- মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল)। আমি যেন তাঁর হাতে সে আংটির শুভ্রতা এখনো দেখতে পাচ্ছি। (সহীহ বুখারী হা/৬৫; সহীহ মুসলিম হা/৫৪৭১; আবু দাউদ হা/৬১৬৬)। অপর বর্ননায় ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বর্ণের একটি আংটি তৈরি করে কিছুদিন পর তা ফেলে দিলেন। এরপর একটি রুপার আংটি তৈরি তাতে ‘মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ’ কথাটি খোদাই করলেন। তিনি বললেন, কেউ যেন আমার এ আংটির খোদাইর অনুরুপ খোদাই না করে। তিনি যখন এটি পরতেন, এর মোহরটি হাতের তালুমুখী করে রাখতেন। সেটাই মুআয়কিব (রাঃ) থেকে আরীস নামক কুপে পড়ে গিয়েছিল। (সহীহ মুসলিম হা/৫৩৭০; ই.ফা ৫৩০০, ই.সে ৫৩১৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে পুরুষদের রৌপ্য পরিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন; রূপার আংটির ক্ষেত্রে ইমামগণের ঐক্যমত অনুযায়ী এটা জায়েয। কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটি রৌপ্য আংটি ছিল সেটি তিনি ব্যবহার করতেন এবং তাঁর সাহাবীগণও আংটি পরতেন। এটি সোনার আংটির বিপরীত,আর পুরুষের জন্য সোনার আংটি ব্যবহার করা চার ইমামের ঐক্যমত অনুসারে নিষিদ্ধ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।অপরদিকে রৌপ্য পরিধানের ক্ষেত্রে,এটাকে হারাম বলে কোন সাধারণ বক্তব্য নেই,যেহেতু এর কোন শরয়ী প্রমাণ নেই তাই এটাকে হারাম বলার অধিকার কারো নেই। যেহেতু সুন্নাহ রৌপ্যের আংটি পরা অনুমতি দেয়, সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে রৌপ্য পরা জায়েয।”(মাজমু’আল-ফাতাওয়া, খন্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ৬৩-৬৫)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, “বিবাহিত ও অবিবাহিত নারীর জন্য রুপার আংটি পরা বৈধ; যেমন তার জন্য স্বর্ণের আংটি পরা বৈধ। এটি সর্বসম্মত অভিমত। এটি যে, মাকরুহ নয়- সে ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই। খাত্তাবি বলেন; নারীর জন্য রুপার আংটি পরা মাকরুহ। কারণ এটি পুরুষের আলামত। তিনি বলেন; যদি কোন নারীর স্বর্ণের আংটি না থাকে তাহলে সে নারী রুপার আংটি পরতে পারেন। তবে জাফরান কিংবা অন্য কোন রঙ দিয়ে এটিকে হলুদ করে নিবেন। খাত্তাবি যা বলেছেন- তা সঠিক নয়; বরং ভিত্তিহীন। সঠিক মত হচ্ছে- এটি পরা নারীর জন্য মাকরূহ নয়। এরপর বলেন; “পুরুষের জন্য রুপার আংটি পরা জায়েয। সে পুরুষ কোন রাষ্ট্রীয় পদে থাকুন কিংবা না থাকুন। এটিও সর্বসম্মত অভিমত। পক্ষান্তরে সিরিয়ার জনৈক আলেম থেকে যে একটি মত বর্ণিত আছে যে- ‘রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী কোন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের জন্য এটি পরা মাকরুহ’ এমন অভিমত বিচ্ছিন্ন, কুরআন-হাদিসের দলিল ও সালফে-সালেহীনদের ইজমা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। আবদারি ও অন্য এক আলেম এ বিষয়ে ইজমা বর্ণনা করেছেন।(ইমাম নববী আল-মাজমু’ খন্ড:৪ পৃষ্ঠা: ৩৪০)
.
পুরুষদের জন্য রুপার ঘড়ি পরা জায়েজ এই মর্মে সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:

“إذا كانت الساعة أو سيرها ذهبا فلا يجوز لبسها للرجل ، وإذا لم تكن من ذهب جاز لبسها للرجل

“যদি ঘড়ি বা এর ব্যান্ড সোনার হয় তবে পুরুষের জন্য এটি পরা জায়েয নয়,কিন্তু যদি তা স্বর্ণের তৈরি না হয় তবে পুরুষদের জন্য তা পরিধান করা জায়েয”।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৬৩)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:

الساعة المطلية بالذهب للنساء لا بأس بها ، وأما للرجال فحرام ؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم حرم الذهب على ذكور أمته.
أما إذا كانت الساعة من الأحجار الكريمة غير الذهب ، فيجوز للرجل لبسها ، ما لم تكن من حلى النساء أو تشبهه ، وما لم يكن
اقتناؤها من الإسراف

মহিলাদের জন্য সোনার প্রলেপযুক্ত ঘড়ি পরতে কোন দোষ নেই, তবে পুরুষদের জন্য সেগুলি হারাম,কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর উম্মতের পুরুষদের জন্য স্বর্ণ হারাম করেছেন।কিন্তু যদি ঘড়িটি স্বর্ণ ছাড়া মূলবান পাথরের তৈরি হয় তাহলে তা পুরুষদের জন্য ব্যবহার করা জায়েজ যদি তা নারীদের অলঙ্কার অথবা তাদের সাদৃশ্য না হয় এবং যদি তাতে অপচয় না করা হয়।”(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১১ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬২)
.
পুরুষের জন্য আংটি বা ঘড়ি ডান হাতে বা বাম হাতে পরতে কোন আপত্তি নেই। ব্যক্তির জন্য যেটি সহজতর সেটি তিনি নির্বাচন করতে পারেন। এর কোনটিকে সুন্নাহ পরিপন্থী বলা যাবে না।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন; “আংটির মত ঘড়ি ডানহাতে কিংবা বামহাতে পরতে কোন আপত্তি নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি ডানহাতে ও বামহাতে আংটি পরেছেন। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা,খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ২৫৫)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন: “ডানহাতে ঘড়ি পরা বামহাতে ঘড়ি পরার চেয়ে উত্তম নয়। কেননা ঘড়ির বিষয়টি আংটির কাছাকাছি। এ কারণে ঘড়ি ডানহাতে পরা কিংবা বামহাতে পরার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে বামহাতে পরা মানুষের জন্য সহজতর পরার দিক থেকে এবং ঘড়ি-দেখার দিক থেকে। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বামহাতে ঘড়ি পরাটা অধিক নিরাপদ। কেননা ডানহাতে বেশি কাজ করা হয়। তাই সেটি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়টিতে প্রশস্ততা রয়েছে। তাই এ কথা বলা যাবে না যে, ডানহাতে পরা সুন্নত। কেননা হাদিসে ডানহাতে ও বামহাতে আংটি পরার বিষয়টি উদ্ধৃত হয়েছে। ঘড়ি আংটির সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ।(উসাইমীন আল-শারহুল মুমতি:খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:১১০)
.
▪️পুরুষরা কি চেইন, ব্রেসলেট ও কানে দুল পরতে পারে?
_______________________________________
হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত যে, রাসূল (ﷺ) পুরুষের জন্য নারীর বেশ ধারণ এবং নারীর জন্য পুরুষের বেশ ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। তাই একজন পুুরুষের জন্য গলায় শিকল বা চেইন, হাতে ব্রেসলেট, চুরি, কানে দুল, পায়ে নুপুর ইত্যাদি পরা জায়েয নয় বরং হারাম, এবার সেটি তৈরির উপাদান স্বর্ণ হোক বা অন্য কিছু হোক। কারণ এগুলো নারীদের সাজ-সজ্জার অন্তর্ভুক্ত।তাছাড়া ইসলামী শরীয়তে এমন কোন দলিল নেই যা প্রমাণ করে যে পুরুষদের জন্য রৌপ্যের চেইন, ব্রেসলেট, কানের দুল,পায়ে নুপুর ইত্যাদি পরা জায়েয।
অথচ হাদিসে বিপরীত লিঙ্গের সাদৃশ্য অবলম্বনকে অভিসম্পাত যোগ্য গর্হিত কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: আবু হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন ঐসব পুরুষকে যারা নারীর অনুরূপ পোশাক পরে এবং ঐসব নারীকে যে পুরুষের অনুরূপ পোশাক পরিধান করে। (সহীহ বুখারী হা/৫৮৮৫; আবু দাউদ হা/৪০৯৮)
.
শাইখ যাকারিয়া আল-আনসারী আল-শাফেয়ি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; একজন ব্যক্তি (পুরুষ) আহালুল ইমামগণের ঐক্যমতের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদাহরণ অনুসরণ করার জন্য একটি রূপার আংটি পরতে পারে; প্রকৃতপক্ষে এটা করা সুন্নত, যেমনটা হাদিসে এসেছে …কিন্তু ব্রেসলেট এবং অন্যান্য কিছু জিনিস যেমন চুড়ি কিংবা নেকলেস পরিধান করা পুরুষদের জন্য জায়েয নয় যদিও সেগুলো রূপার তৈরি হয়। কারণ এটা এমন এক ধরনের মেয়েলিপনা যা সম্মানিত পুরুষদের জন্য শোভনীয় নয়।(আসনাল মাতালিব; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৭৫; মাম নববী আল-মাজমু’ খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৪৪৪)
.
ইবনে হাজার আল-হায়তামী (রহ.) বলেন: “তাদের (মহিলাদের) অনুকরণ করা হারাম যা তাদের জন্য অনন্য, যেমন ব্রেসলেট,পায়ের পাতা/ নুপুর ইত্যাদি ব্যবহার করা,তবে আংটি ক্ষেত্রে ভিন্ন।”(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা,খন্ড:১ পৃষ্ঠা:২৬১) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।