তালাকের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি

প্রশ্ন: তালাকের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি কি? কেউ যদি তার স্ত্রীকে এক বা দুই তালাক দেয় এবং ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে না নেয়, অতঃপর ইদ্দত শেষ হলে নতুন করে সেই নারীকে বিবাহ করে, তাহলে তিনি কতটি তালাকের মালিক থাকবেন?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে যখন স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীকে তালাক দেয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় থাকে না, তখন তালাক দেয়ার উত্তম পন্থা বা পদ্ধতি হচ্ছে, স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তি বা মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার শুরুতে সহবাস করা ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় স্ত্রী তিনটি ঋতুস্রাব বা মাসিক পর্যন্ত স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করার মাধ্যমে অপেক্ষা করবে এবং এই সময় স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিবে। আরো সহজ করে বললে স্ত্রীকে একটি তালাক দিলে উক্ত তালাক্বের পর স্ত্রীর ইদ্দত পরিপূর্ণ তিন হায়েয। অর্থাৎ তার একবার হায়েয হবে, এরপর তিনি পবিত্র হবেন। এরপর আবার হায়েয হবে এবং পবিত্র হবেন। এরপর আবার হায়েয হবে এবং পবিত্র হবেন। এটাই হলো পরিপূর্ণ তিন হায়েয; চাই হায়েযের এই সময়কাল দীর্ঘ হোক কিংবা সংক্ষিপ্ত হোক। অতঃপর স্ত্রীর তিন ঋতুর ইদ্দতের সময় শেষ হওয়ার পূর্বে স্বামী চাইলে কোন বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই স্ত্রীকে রাজ‘আত অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে এবং তার সাথে সংসার করতে পারে। কিন্তু স্ত্রীকে তিনটি ইদ্দতের মধ্যে ফেরত না নিলে; অতঃপর ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে স্বামীকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন ভাবে বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন বিবাহ ছাড়া ফেরত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটিই হলো তালাকের সর্বোত্তম পন্থা, সাহাবীগণও একেই তালাকের সর্বোত্তম পন্থা বলে অভিহিত করেছেন।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে আবী শাইবাহঃ ১৭/৭৪৩) ইবনে আবি-শাইবা তার গ্রন্থে ইবরাহীম নাখায়ী (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে আরও উদ্ধৃত করেছেন যে, সাহাবীগণ তালাকের ব্যাপারে এ পদ্ধতিকেই পছন্দ করেছেন যে, মাত্র এক তালাক দিয়েই ছেড়ে দিবে এবং এতেই ইদ্দত শেষ হলে বিবাহ বন্ধন স্বাভাবিকভাবেই ছিন্ন হয়ে যাবে। একই বিধান দ্বিতীয়,তৃতীয় তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তবে তৃতীয় তালাকের পর স্বাভাবিক ভাবে ফেরত নেওয়ার সুযোগ নেই।
.
এখন যদি একজন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে এক বা দুই তালাক দিয়ে তালাক দেয়, এবং ইদ্দতের মধ্যে ফেরত না নেয়, অতঃপর স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হয়ে যায়, তারপর উক্ত ব্যক্তি পুনরায় এই নারীকে বিবাহ করতে চায় কিংবা এই নারীকে অন্য কেউ বিবাহ করে তারপর শারঈ কারণবশত তাকে তালাক দেয়, অতঃপর প্রথম স্বামী তাকে আবার পুনরায় উভয় পক্ষের সম্মতিতে শরীয়ত সম্মতভাবে বিয়ে করে, তবে তার যত তালাক অবশিষ্ট থাকে তার চেয়ে বেশি তালাকের অধিকার তার নেই।সুতরাং যদি সে তাকে পূর্বে একবার তালাক দিয়ে থাকে তবে তার কেবল দুটি তালাক অবশিষ্ট থাকবে এবং যদি সে তাকে দুবার তালাক দিয়ে থাকে তবে তার কেবল একটি তালাক অবশিষ্ট রয়েছে। এটাই বিশুদ্ধ কথা।
.
আশ-শাইখ শারাফুদ্দিন আবুন-নাজা মুসা বিন আহমাদ আল-হাজ্জাউয়ি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু: ৯৬৮ হি.]-এর বিখ্যাত যাদুল মুসতাকনা গ্রন্থে বলা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মোট সংখ্যার চেয়ে কম (অর্থাৎ তিন তালাকের চেয়ে কম তালাক দিয়ে থাকে), তারপর ইদ্দতের মধ্যে উক্ত স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় অথবা ইদ্দত শেষে তার সাথে নতুন করে বিবাহ চুক্তি করে। সেক্ষেত্রে যতগুলো তালাক অবশিষ্ট থাকবে তার অতিরিক্ত মালিক সে (স্বামী) হবে না। (অর্থাৎ যে কয়টি তালাক বাকি ছিল তিনি সেগুলোরই মালিক হবেন) এক্ষেত্রে উক্ত নারীর অন্য কারো সাথে বিবাহ হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসেনা। (কিছুটা পরিমার্জিত যাদুল মুসতাকনি ফি ইখতিসারিল-মুকনি থেকে)। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, তারপর ঐ নারী অন্য পুরুষকে বিয়ে করে এবং সে (দ্বিতীয় স্বামী) মারা যায় অথবা কোন কারনে স্বেচ্ছায় সে তাকে তালাক দেয়, তারপর প্রথম স্বামী তাকে আবার বিয়ে করে সেক্ষেত্রে সকল আলেমদের ঐক্যমতে সে (প্রথম স্বামী) তিন তালাক দেওয়ার অধিকার ফিরে পায়। অর্থাৎ ইতিপূর্বের দেওয়া তিন তালাক তার জন্য বাতিল হয়ে যাবে। (বিস্তারিত যানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৫০৯৮)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন;

فلهذه المسألة ثلاث صور :الأولى : طلقها ثم راجعها فلا يملك إلا ما بقي .
الثانية : طلقها ثم انقضت عدتها ، ثم تزوجها بعقد جديد فلا يملك إلا ما بقي .الثالثة : طلقها ثم انقضت عدتها ، ثم تزوجت بآخر ثم فارقها الثاني ، ثم تزوجها الأول فلا يملك إلا ما بقي .ومفهوم قوله: دون ما يملك أنه لو طلق ما يملكه وهي الثلاث في الحر والثنتان في العبد ، فإنها لا تحل له إلا بعد زوج ، فإذا تزوجها بعد الزوج فإنه يستأنف الطلاق من جديد ويكون له ثلاث طلقات ، كأنه ما تزوجها إلا الآن ؛ وذلك لأن نكاح الزوج الثاني في هذه المسألة صار له تأثير ، وهو أنه أحلها للأول ، ولولا هذا النكاح ما حلت للأول ، فلما كان له التأثير وقد استكمل الزوج الأول ما يملك ، فإنها تعود إليه على طلاق جديد ، ولا يقال : إنه إذا عادت إليه فله أن يطلقها مرة واحدة فقط ثم تبين ؛ لأننا نقول : إن الزوج الثاني هدم ما كان للأول ؛ ولذلك أباحها له ، مع أنها كانت لا تحل له .
وذهب بعض أهل العلم إلى أنها في المسألة الأولى إذا تزوجت فإن الزوج الثاني يهدم الطلاق ، حتى فيما إذا كان أقل من ثلاث ، ولكن الصواب ما ذهب إليه المؤلف ؛ لأن نكاح الزوج الثاني إذا كان الزوج الأول لم يطلق ثلاثا لا أثر له ؛ لأنها تحل لزوجها الأول سواء تزوجت أم لم تتزوج
.
অর্থাৎ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; এই মাসআলার ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতির রয়েছে। অর্থাৎ:-
.
ক). সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়েছে; এজন্য সে বাকি তালাকের মালিক হবে।(অর্থাৎ যে কয়টি বাকি আছে সেগুলোর মালিক হবে)
.
খ). সে তাকে তালাক দেওয়ার পরে তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেছে; তারপরে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে অর্থাৎ নতুন করে বিয়ে করেছে। এজন্যই সে বাকি অর্থাৎ শুধুমাত্র অবশিষ্ট তালাকের মালিক হবে।
.
গ). সে তালাক দেওয়ার পরে তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেছে। অতঃপর সে মহিলা অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে, তারপরে দ্বিতীয় স্বামী তাকে আবার তালাক দিয়েছে তারপরে প্রথম স্বামী তাকে পুনরায় বিয়ে করেছে ফলে সে বাকি (অবশিষ্ট) তালাকের মালিক হবে।
.
“তিনি যে পরিমাণ তালাক পাওয়ার অধিকারী ছিলেন তার চেয়ে কম”- এই বাক্যাংশ থেকে যা বোঝা যায় তা হলো যে, যদি তিনি তার প্রাপ্য তালাকের সংখ্যা ব্যবহার করতেন, যা একজন স্বাধীন নারীর ক্ষেত্রে তিনটি আর ক্রীতদাসীর ক্ষেত্রে দুই তালাক দিয়ে দেয়। (অর্থাৎ মুগাল্লাযা বা চূড়ান্ত তালাক দেয়) তাহলে এই নারী তার জন্য জায়েজ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ না হবে। অতঃপর যদি সে (নারী) অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর (পূর্ব স্বামী) তাকে আবার নতুন ভাবে বিয়ে করে, তাহলে সে নতুন ভাবে তালাক দিতে পারবে। তার জন্য তখন তিন তালাক নতুন হিসেবে গণ্য হবে। মনে হচ্ছে যেন সে এখনই নতুন বিয়ে করল। কারণ এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে বিবাহের একটি প্রভাব রয়েছে, যা তাকে প্রথম স্বামীর জন্য জায়েয করে দেয় এবং যদি এই (দ্বিতীয়) বিয়ে না হতো তবে সে প্রথম স্বামীর জন্য জায়েয হতো না। কারণ এটির প্রভাব রয়েছে, কেননা প্রথম স্বামী ইতিমধ্যেই পূর্ণ সংখ্যক তালাক ব্যবহার করে ফেলেছিলেন যার অধিকারী তিনি ছিলেন, ফলে সে তালাকের পরিচ্ছন্ন শর্তাবলী নিয়ে তার কাছে ফিরে যায়, এবং যদি সে তার কাছে ফিরে যায়, এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না যে সে তার কাছে ফিরে এসেছে এর মানে সে তাকে মাত্র একটি তালাক দিতে পারবে এরপর সে তার জন্য স্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাবে। বরং আমরা স্পষ্টভাবে বলি যে, দ্বিতীয় স্বামী বিয়ে করার ফলে প্রথম স্বামীর যে তালাকগুলো দেওয়া হয়েছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে ফলে প্রথম স্বামীর জন্য সেই স্ত্রী হালাল এবং সে নতুন ভাবে আবার তালাক দিতে পারে। তবে আহলে ইলমের কেউ কেউ বলেন, নিশ্চয় এটি প্রথম মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত। যখন সে দ্বিতীয় স্বামীকে বিবাহ করে তখন দ্বিতীয় স্বামী তার তালাক বাতিল করে দেয়। এমনকি যদি তিন তালাকের কমও হয়। কিন্তু সঠিক কথা হলো লেখক যে মতটি দিয়েছেন। আর তা হলো যদি প্রথম স্বামী তাকে তিনবার তালাক না দিয়ে থাকে তবে দ্বিতীয় স্বামীর বিয়েটা কোনো প্রভাব ফেলবে না, কারণ সে অন্য কাউকে বিয়ে করুক বা না করুক, প্রথম স্বামীর জন্য তাকে পুনরায় বিয়ে করা জায়েয। (ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি; খন্ড: ১৩ পৃষ্ঠা: ১৯৬)
.
স্ত্রীকে এক বা দুই তালাক দেয়ার পর ইদ্দত পালন শেষে পুনরায় নতুনভাবে বিবাহ করলে, পূর্ববর্তী বিবাহের বকেয়া থাকা তালাকের সংখ্যা নিয়ে স্ত্রী তার স্বামীর নিকটে ফিরে যাবে এই কথাটি হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] রাসূল (ﷺ) এর প্রখ্যাত সাহাবীদের দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন, যারা এই মতের পক্ষে ছিলেন তারা হলেন- প্রখ্যাত সাহাবী ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ২৩ হি.], আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৪০ হি.] উবাই ইবনে কাব, মুয়াজ, ইমরান ইবনে হুসাইন, আবু হুরায়রা, যায়েদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। আর এমনটিই বলেছেন; বিখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনে মুসাঈব, উবাইদাহ, হাসান, ইমাম মালেক, সুফিয়ান আস-সাওরী, ইবনে আবি লাইলা, ইমাম শাফেঈ, ইসহাক, আবু উবাইদাহ, আবু সাওরী, মোহাম্মদ ইবনে হাসান, ইবনে মুনজির। অপরদিকে তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, (অর্থাৎ এক/দুই তালকের পর ইদ্দত শেষে নতুন করে বিবাহ করলে স্বামী পুনরায় তিন তালাকের মালিক হবে) এই মতের পক্ষে সাহাবী ইবনে ওমর, ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এবং তাবেঈদের মধ্যে আত্বা, নাখয়ী, শুরাহই , ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ। (কিছুটা পরিমার্জিত ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৩৭৯)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার স্ত্রীকে এক তালাক কিংবা দুই তালাক দেওয়া হলে অতঃপর ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিলে কিংবা ইদ্দত শেষ হলে নতুন করে বিবাহের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিলে উক্ত স্বামীর হাতে শুধুমাত্র অবশিষ্ট তালাকই বাকি থাকবে এর বেশি নয়। এবার স্ত্রী দ্বিতীয় কাউকে বিবাহ করুক আর না করুক বিধান একই এটাই বিশুদ্ধ মত। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।