হে সুদর্শন যুবক ভাই আপনার সৌন্দর্যের কারণে যেন কোন নারী ফিতনায় নিপতিত হতে না পারে

হে আমার সুদর্শন যুবক ভাই, আপনার সৌন্দর্যের কারণে যেন কোন নারী ফিতনায় নিপতিত হতে না পারে, সর্বদা এই বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
পর্দার কথাটা শুনলেই আমাদের মনে হয় পর্দা শুধু নারীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট; পুরুষদের সাথে নয়। তার দরুণ পুরুষরা নারীদের পর্দা নিয়ে কথা বলতে বেশ উচ্ছাসিত। কিন্তু ইসলাম শুধুমাত্র নারীদের পর্দার আদেশ দেননি বরং পুরুষদের ক্ষেত্রেও পর্দার বিধান দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ! পুরুষের চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়; একথা ঠিক। কিন্তু তাই বলে যেখানে সেখানে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা, নন মাহরাম নারীদের সামনে সাজসজ্জা করে চলাফেরা করা, বিশেষ করে যেখানে ফিতনার আশংকা রয়েছে অর্থাৎ যে সকল নারীরা পুরুষদের সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে, এবং ফিতনায় পতিত হতে পারে সেখানে পুরুষদের উচিত নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শনে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে বলবো যদিও নারীদের জন্য পর-পুরুষের দিকে তাকানো এবং প্রয়োজনীয় কথা জায়েজ তবে সে ক্ষেত্রেও শর্ত রয়েছে। অর্থাৎ পর পুরুষের দিকে তাকানোর ক্ষেত্রে নারী নিজে পরিপূর্ণ পর্দা করবে এবং তাকানোর সময় কামনা-বাসনার দৃষ্টি পরিহার করতে হবে, কথা বলার সময় আকর্ষণীয় ও আকৃষ্টকারী নরম কণ্ঠ ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা পরিহার করতে হবে। কেননা মহিলাদের জন্য পর-পুরুষ হতে পর্দা করা ফরয। মোটকথা যে সকল কার্যক্রমের নিজে কিংবা অন্য কেউ ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সেগুলো পরিহার করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আবশ্যক।
.
কুরআন-হাদিস অধ্যায়ন করলে আপনি বুঝতে পারবেন যে; কেয়ামতের আলামত হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্র ও সর্বত্র এমন ভাবে ফিৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়বে যে, লোকেরা ফিৎনার ভয়ে মৃত্যু কামনা করবে। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে অন্ধকার রাতের টুকরার ন্যায় চরম বিপর্যয় আসতে থাকবে। ঐ সময় সকাল বেলা যে ব্যক্তি মুমিন থাকবে সে সন্ধ্যাবেলা কাফের হয়ে যাবে এবং সন্ধ্যাবেলা যে ব্যক্তি মুমিন থাকবে সে সকাল বেলা কাফের হয়ে যাবে। এ সময় উপবিষ্ট ব্যক্তি দন্ডায়মান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে, দন্ডায়মান ব্যক্তি চলমান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে এবং চলমান ব্যক্তি দ্রুত ধাবমান ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে।…..(ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬১; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৫২৪; সহীহুল জামে হা/১২২১; ইরওয়া হা/২৪৫১)। অপর বর্ণনায় প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, অন্ধকার রাতের টুকরার ন্যায় ফিৎনা তোমাদের আচ্ছাদিত করবে। লোকদের মাঝে উঁচু পাহাড়ে আরোহনকারীই কেবল সেই ফিৎনা থেকে রক্ষা পাবে, যে তার ছাগলের দুধ পান করে দিনাতিপাত করবে। অথবা এমন লোক রক্ষা পাবে যে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে সর্বদা রাস্তায় প্রস্ত্তত থাকবে, তার তরবারী যা উপার্জন করে দিবে তা থেকে সে খাবে। (মোস্তাকরাকে হাকেম হা/২৪৬০, সহীহুল জামে হা/১০৩৫)
.
হে প্রিয় পাঠক! আপনি কি জানেন? বিশুদ্ধ সূত্রে একাধিক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা প্রখ্যাত সাহাবী ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ২৩ হি.]-এর খেলাফতকালে মদিনায় নাসর ইবনে হাজ্জাজ নামে একজন সুদর্শন যুবক ছিল; যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মদিনার নারীরা তার নামে কবিতা রচনা করত, তাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা করতো, এটি প্রত্যক্ষ করে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) নাসর ইবনে হাজ্জাজকে নিজ শহর মদিনা থেকে বসরায় নির্বাসন করেছিলেন।
.
ঘটনাটির সারমর্ম হলো- বিখ্যাত সাহাবী খলিফা ইবনুল খাত্তাব মদিনায় রাত্রে ঘোরাঘুরি করতেন। একদিন এক মহিলাকে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনলেন। সেই মহিলাটি কবিতার মধ্যে বলছে মদ পান করা কি কোন ভাবে বৈধ করা যাবে যাতে করে নাসর ইবনে হাজ্জাজ-এর নিকটে যাওয়া যায়। ওমর (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) এই ঘটনা দেখে নাসর ইবনে হাজ্জাজকে ডাকলেন, নাসর ইবনে হাজ্জাজ ছিল এক সুন্দর যুবক। অতঃপর মদিনার নারীদেরকে তার সৌন্দর্যের ফেতনা থেকে রক্ষা করার জন্য তার মাথা মুন্ডন করে দেওয়া হলো। কিন্তু তাতে কোন ফলাফল আসেনি। বরং এর ফলে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেল। অতঃপর চিন্তা-ভাবনা করে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) তাকে মদিনা থেকে বসরায় নির্বাসন করলেন যাতে করে মহিলারা তার দ্বারা ফেতনায় না পড়ে। অতঃপর হাজ্জাজ তার স্বদেশ মদিনায় ফিরে যাওয়ার জন্য ওমর ইবনুল খাত্তাব এর কাছে চিঠি প্রেরণ করেন এবং চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে তিনি কোন অন্যায় করেননি, কিন্তু উমর (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) তাকে মদিনায় আগমনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন; যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন নয়। (ঘটনাটি সাম’আনী “আল-আনসাব” খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৫৬ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তার মাজমূঊল ফাতাওয়া; খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা: ৫৫২, ইবনুল ক্বাইয়িম ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ২৮৪ ইবনে হাজার আসকালানী আল ইসাবাহ খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা:৩৮২ এবং ইবনুল মুফলিহ আল-আদাব আল-শারইয়্যা খন্ড; ৩ পৃষ্ঠা: ১৩২ এ উল্লেখ করেন)
.
উক্ত ঘটনা সম্পর্কে অষ্টম হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন; ওমর ইবনুল খাত্তাব নাসর ইবনে হাজ্জাজকে মদীনা থেকে অর্থাৎ তার মাতৃভূমি থেকে তাকে বসরায় নির্বাসিত করেছিলেন, যখন তিনি শুনেছিলেন যে নারীরা নাসর ইবনে হাজ্জাজের প্রতি তাদের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে কবিতা রচনা করছে। প্রাথমিকভাবে (তাকে নির্বাসিত না করে) উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আদেশ জারি করেছিলেন যে তার (নাসর ইবনে হাজ্জাজের) চুল মুণ্ডন করা হবে, যাতে তার চেহারার সৌন্দর্য হ্রাস করা যায়, যার দ্বারা মহিলারা প্রলুব্ধ হয়েছিল। কিন্তু তার মাথা মুন্ডন করার পরে তিনি দেখলেন যে হাজ্জাজ বিন নাসের তার গালের দিক থেকে সবচেয়ে সুদর্শন লোকদের একজন এবং এটি তাকে আকর্ষিত করে, তাই তিনি তাকে বসরায় নির্বাসিত করেন। তাকে বসরায় নির্বাসনের কারণ এই নয় যে, সে কোনো অন্যায় করেছে বা কোনো অনৈতিক কাজ করেছে যার জন্য তাকে শাস্তি স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। বরং মহিলাদের মধ্যে এমন কিছু ছিল যারা তাকে প্রলুব্ধ করেছিল, তাই ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) আদেশ জারি করেছিলেন যে, তার অত্যাশ্চর্য সুন্দর চেহারা হ্রাস করার জন্য কিছু একটা করতে হবে। তাকে তার স্বদেশ থেকে সরিয়ে দিলে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং শারীরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সে অনুভব করবে যে তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এটি সংঘটিত হওয়ার আগে অনৈতিকতা এবং মোহের ভয়ে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যম। এটা শাস্তির জন্য ছিল না। (মাজমু’আল-ফাতাওয়া: খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ৩১৩)
.
এখন যদি প্রশ্ন করা হয়; নাসের বিন হাজ্জাজকে বসরায় নির্বাসনের ফলে সেখানকার নারীরা ফিতনায় জড়াবে না তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? আমরা শুধুমাত্র সমস্যাটিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করেছি, কিন্তু আমরা তো এখানে সমস্যার মূল নিয়ে কাজ করিনি! এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়-
.
প্রথমত: তাকে তার স্বদেশ (মদিনা) থেকে বহিষ্কার করা এবং তাকে এমনভাবে নির্বাসিত করার কারণে বিষয়টি তার কাছে শাস্তির মত মনে হবে। ফলে তার অন্তরে এবং অন্যদের অন্তরে ফিতনার আশঙ্কাকে দুর্বল করে দেবে এবং এটি মানুষকে কামনা-বাসনাকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে, এবং অনৈতিকতার নিন্দা হিসাবে পরিবেশন করবে। তাছাড়া উমর (রাঃ)-কে যেহেতু শয়তান ভয় করত, সে কারণে তার খেলাফত কালে তৎকালীন লোকেরা তাঁর মুখোমুখি হতে ভয় পেত- সুতরাং তারা যদি বুঝতে পারে যে, ওমর ইবনুল খাত্তাব এই ব্যক্তিকে শুধুমাত্র ফিতনার ভয়ে নির্বাসিত করেছেন, তাহলে তারা সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং তার দ্বারা ফিতনার আশঙ্কা থেকে সতর্ক থাকবে। তাই ওমর রাঃ বসরাবাসীকে বলেছেন, আমি এই লোকটিকে তোমাদের দেশে নির্বাসিত করেছি যাতে সে আমার মতো একই শহরে বসবাস করতে না পারে, সুতরাং তার দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়া থেকে সাবধান থাকবে।
.
দ্বিতীয়ত: যে নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে প্রবাসে আছে সেখানে সে একজন অপরিচিত ব্যক্তির ন্যায়, সে একজন মাতৃভূমির বাসিন্দার মত নয়, কারণ সে এমন এক বিচিত্র দেশে আছে যেখানে সে জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজে মনোযোগী হতে হবে যা তাকে স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসী জীবন থেকে দূরে রাখবে, যেমনটা তিনি নিজ মাতৃভূমিতে পরিবারের সাথে উপভোগ করতেন। সুতরাং জীবিকা নির্বাহের চিন্তা তার সুন্দর চেহারা হ্রাস করবে এবং তাকে নিজের এবং তার চেহারার যত্ন নেওয়া থেকে বিরত রাখবে।
.
তৃতীয়ত: তাকে বসরায় নির্বাসনের ঘটনাটি ঘটেছে এবং বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, পরবর্তীতে লোকেরা এটি সম্পর্কে জানবে। ফলে নতুন প্রজন্মকে ফিতনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখাবে, পাশাপাশি শাসকদের শেখাবে কীভাবে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের বিষয়গুলি পরিচালনা করতে হয় এবং কীভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর জনস্বার্থ অগ্রাধিকার দিতে হবে।এটাও প্রমাণ করে যে, নারীর আকর্ষণের বা প্রলোভনের বস্তু সবচেয়ে বড় ফিতনার একটি।
.
চতুর্থত: মদিনা পবিত্র এবং নিরাপদ ভূমি। সুতরাং মদীনার পবিত্রতা রক্ষায় যাবতীয় ফিতনা-ফাসাদ দূর করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যে কাউকে নির্বাসিত করতে হবে, যদি জানা যায় তিনি ফিতনার মাধ্যম। যার কারণে অন্যরা ফেতনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০১৬৩৩)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে- মুসলিম-উম্মাহর জন্য ফিতনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা জিনিস। সুতরাং আমাদের উচিত ফেতনার যাবতীয় রাস্তা থেকে দূরে অবস্থান করার পাশাপাশি ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য নেক আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় ফিতনা থেকে হেফাজত করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।