পুঁজ ও দুষিত রসের হুকুম

প্রশ্ন: পুঁজ এবং দুষিত রস কী? শরীরের আহত স্থান বা ফোঁড়া থেকে নির্গত পুঁজের সাদা কিংবা হলুদ রঙের দাগ কি নাপাক; যদি সেটা তরল হয় কিংবা কঠিন? এই বিষয়ে ইসলাম কি বলে?
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পুঁজের সংজ্ঞায় মু‘জামু লুগাতিল ফুকাহা গ্রন্থে বলা হয়েছে পুঁজ হলো:هو السائل اللزج الأصفر الذي يخرج من الجرح ونحوه لفساد فيه “ক্ষত বা এ জাতীয় অন্য স্থান থেকে পচনের কারণে নির্গত হলুদ রঙের পিচ্ছিল তরল।(মু‘জামু লুগাতিল ফুকাহা: পৃষ্ঠা: ৩৭৩)

অপরদিকে “সাদীদ” (দূষিত রস) হলো:
هو ماء الجرح الرقيق المختلط بدم قبل أن يغلظ ويصير قيحاً
ক্ষতস্থানের রক্তমিশ্রিত পাতলা পানি; গাঢ় হয়ে পুঁজে পরিণত হওয়ার আগে যে অবস্থায় থাকে।’ (দেখুন: তিলবাতুত তালাবা: পৃষ্ঠা: ২২; আল-মাউসূয়াতুল ফিকহিয়্যাহ: খন্ড:২১ পৃষ্ঠা: ২৫) সুতরাং পুঁজের আগে ক্ষতস্থানে দূষিত রস থাকে।
.
▪️পুঁজ ও দুষিত রসের হুকুম: প্রসিদ্ধ চার মাযহাব ও অন্যান্য অধিকাংশ ফকীহের মতে এই দূষিত রস ও পুঁজের বিধান রক্তের মতই নাপাকির দিক থেকে এবং কিঞ্চিত পরিমাণ ক্ষমার্হ হওয়ার দিক থেকে। কারণ দূষিত রস ও পুঁজ মূলত রক্ত; যা পঁচে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই রক্ত যদি নাপাক হয় তাহলে পুঁজ নাপাক হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত।(দেখুন: বাদায়েউস সানায়ে, খন্ড; ১; পৃষ্ঠা: ৬০; নববী আল-মাজমূ, খন্ড; ২ পৃষ্ঠা; ৫৫৮; আল-কাওয়ানীন আল-ফিকহিয়্যা পৃষ্ঠা: ২৭) পুঁজ রক্ত থেকে সৃষ্ট। আর শাখা তার মূলের হুকুম গ্রহণ করে।
.
আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতে এসেছে:

اتَّفَقَ الْفُقَهَاءُ عَلَى أَنَّ الْقَيْحَ إِذَا خَرَجَ مِنْ بَدَنِ الإنْسَانِ : فَهُوَ نَجِسٌ ؛ لأِنَّهُ مِنَ الْخَبَائِثِ ، قَال اللَّهُ تَعَالَى : ( وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ) ، وَالطِّبَاعُ السَّلِيمَةُ تَسْتَخْبِثُهُ ، وَالتَّحْرِيمُ لاَ لِلاِحْتِرَامِ : دَلِيل النَّجَاسَةِ ؛ لأِنَّ مَعْنَى النَّجَاسَةِ مَوْجُودٌ فِي الْقَيْحِ ؛ إِذِ النَّجِسُ اسْمٌ لِلْمُسْتَقْذَرِ ، وَهَذَا مِمَّا تَسْتَقْذِرُهُ الطِّبَاعُ السَّلِيمَةُ لاِسْتِحَالَتِهِ إِلَى خَبَثٍ وَنَتْنِ رَائِحَةٍ ؛ وَلأِنَّهُ مُتَوَلِّدٌ مِنَ الدَّمِ ، وَالدَّمُ نَجِسٌ”

“ফকীহরা এই মর্মে একমত যে মানুষের শরীর থেকে পুঁজ বের হলে সেটা নাপাক। কারণ সেটা কদর্য বা খারাপ বস্তু। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর তাদের জন্য তিনি খারাপ জিনিসকে হারাম করেন।” মানুষের সুস্থ প্রকৃতি এটাকে খারাপ হিসবে জানে। আর সম্মানের কারণ ছাড়া অন্য কারণে কোন কিছু হারাম করা প্রমাণ করে যে সেটা নাপাক। কারণ নাপাকির অর্থ পুঁজে বিদ্যমান। যেহেতু নোংরা জিনিসের আরেক নাম নাপাকী। মানুষের সুস্থ প্রকৃতি এটাকে নোংরা বিবেচনা করে; যেহেতু এটা আবর্জনা ও দুর্গন্ধে পরিণত হয়েছে এবং যেহেতু এটি রক্ত থেকে সৃষ্ট। আর রক্ত নাপাক।”(আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা; খন্ড: ৩৪ পৃষ্ঠা; ১২৮)
..
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,

: ” وَالْقَيْحُ ، وَالصَّدِيدُ ، وَمَا تَوَلَّدَ مِنْ الدَّمِ : بِمَنْزِلَتِهِ ، إلَّا أَنَّ أَحْمَدَ قَالَ : هُوَ أَسْهَلُ مِنْ الدَّمِ .وَرُوِيَ عَنْ ابْنِ عُمَرَ وَالْحَسَنِ : أَنَّهُمَا لَمْ يَرَيَاهُ كَالدَّمِ .وَقَالَ أَبُو مِجْلَزٍ ، فِي الصَّدِيدِ : إنَّمَا ذَكَرَ اللَّهُ الدَّمَ الْمَسْفُوحَ “.

“পুঁজ, দূষিত রস এবং যা কিছু রক্ত থেকে সৃষ্ট সব রক্তের পর্যায়ভুক্ত। তবে ইমাম আহমদ বলেছেন: এর হুকুম রক্ত থেকে হালকা।ইবনে উমর (রাঃ) ও হাসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে— তারা এই দুটিকে রক্তের মত গণ্য করতেন না।আবু মিজলায দূষিত রসের ব্যাপারে বলেন: আল্লাহ তো প্রবাহিত রক্তের কথা বলেছেন।”(আল-মুগনী, খন্ড; ২ পৃষ্ঠা; ৪৮৩) তিনি আরো বলেন: “পূর্বোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে রক্তের ক্ষেত্রে যতটুকু পরিমাণ ক্ষমার্হ এটার (পুঁজের) ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণ ক্ষমার্হ। কারণ রক্তের চেয়ে পরিমাণে বেশি না হওয়া পর্যন্ত এটাকে বেশি গণ্য করা হয় না। আর যেহেতু এটার ব্যাপারে কোনো দ্ব্যর্থহীন দলিল নেই। বরঞ্চ এটি নাপাক হওয়ার কারণ হলো এটা রক্ত থেকে নোংরা অবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া।”(ইবনে কুদামার ‘আল-মুগনী’খন্ড: ২; পৃষ্ঠা; ৪৮৪)
.
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) জন্ম ১৬৪ হি./৭৮০ খ্রি. এবং মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আপনার কাছে রক্ত আর পুঁজ কি সমান?’

তিনি উত্তর দেন:

” لا ، الدم لم يختلف الناس فيه ، والقيح قد اختلف الناس فيه ، وقال مرَّة : القيح والصديد عندي أسهل من الدم ”

“না; রক্তের ব্যাপারে লোকরা মতভেদ করেনি। কিন্তু পুঁজের ব্যাপারে মতভেদ করেছে।” আরেকবার তিনি বলেন: “আমার কাছে পুঁজ আর দূষিত রস রক্তের তুলনায় হালকা।”(ইগাসাতুল লাহফান, খন্ড; ১ পৃষ্ঠা; ১৫১)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] পুঁজ ও দূষিত রস পবিত্র হওয়ার মত গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন:” لا يجب غسل الثوب والجسد من المِدَّة والقيح والصديد ، ولم يقم دليل على نجاسته “পুঁজ বা দূষিত রসের জন্য কাপড় এবং শরীর ধোয়া আবশ্যক নয়, এগুলোর নাপাকির পক্ষে কোনো দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”(আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠা: ২৬)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! নিঃসন্দেহে এই মাসালায় অধিকাংশ আলেমের মত অর্থাৎ পুঁজ নাপাক এই মতটিই নিরাপদ এবং দায়মুক্তির অধিক নিকটবর্তী। তবে পুঁজ যদি অতি সামান্য পরিমাণ হয় সেটা ক্ষমার্হ। বিশেষ করে এর থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হলে এবং এর দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে। যেমনটি অসুস্থ ও আহতদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। প্রশ্নে যে ‘দাগ-এর কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে ধারণা করা যায় সেটি সামান্য পরিমাণ; খুব বেশি নয়। সুতরাং পুঁজ যদি খুব সামান্য পরিমাণ হয় তাহলে কাপড়ে লাগলে তা ধৌত করা আবশ্যক নয় এবং এমন কাপড়ে সালাত আদায়েও কোনো সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। কারণ এ থেকে সম্পূর্ণ বেঁচে থাকাটা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য। যেভাবে প্রবাহমান রক্ত নাপাক হলেও হালাল প্রাণী জবেহ করার পর গোস্তের সাথে যে সামান্য রক্ত লেগে থাকে তা নাপাক নয়। আর সামান্য পরিমাণ হলে সেটা ক্ষমার্হ এই মর্মে সালাফদের বক্তব্য থেকে দলিল হচ্ছে,ইবনু ’উমার (রাদি.) একদা একটি ছোট ফোঁড়া টিপ দিলেন, তা থেকে রক্ত বের হল, কিন্তু তিনি উযূ করলেন না।(সহীহ বুখারী হা/১৭৬ টীকা)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,

” الدم والقيح والصديد يعفى عن اليسير منها إذا كان خروجاً من غير الفرج ؛ لأن في الاحتراز من قليلها مشقة وحرج “.

“রক্ত, পুঁজ ও দূষিত রস সামান্য পরিমাণ হলে ক্ষমার্হ; যদি সেটা লজ্জাস্থান ছাড়া অন্য কোথাও থেকে বের হয়। কারণ এগুলোর সামান্য পরিমাণ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন।”(ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ: খন্ড; ৫ পৃষ্ঠা; ৩৬৩; বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০৯১২৩) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।