পবিত্র এই রামাদান মাসকে কিভাবে কাজে লাগাবেন

আলহামদুলিল্লাহ অন্য সব সাধারণ মাসের মতোই একটি মাসের নাম রামাদান। কিন্তু ফজিলত, বরকত ও রহমতের কারণে এর রয়েছে অনন্য মর্যাদা। বাকি ১১মাসের তুলনায় অনেক বেশি এই মাসে। একনজরে রামাদান মাসে ২০টি করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ননাসহ আলোচনা করা হলো:-

◼️◼️(১). তাক্বওয়া অর্জন করা:
______________________________
রামাদানের সিয়ামের প্রধান ও মৌলিক উদ্দেশ্য হলো তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, যা বান্দার সার্বিক কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী ভিত্তি। এ কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের বহু স্থানে বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৩)
.
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তাক্বওয়া যাবতীয় কর্মের মুকুট। (মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১, সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৫৫৫)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দিব। সিয়াম ঢালস্বরূপ, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করতে চায়, তবে সে তাকে বলবে, আমি ছায়েম তথা সিয়াম পালনকারী।[সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৭৯]

◼️◼️(২). প্রতিদিন ন্যূনতম দুই ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত করা:
____________________________________
একসঙ্গেও হতে পারে, আলাদা আলাদা সময়েও হতে পারে। তিলাওয়াত অবশ্যই সুন্দরভাবে তাজউঈদের সঙ্গে পড়া উচিত, এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো কাম্য নয়। আলেম হলে অর্থ বুঝে বুঝে পড়া চাই। যেমন হাদীসে এসেছে, এ কিতাবের একটি হরফ পাঠ করলে পাওয়া যায় দশটি সওয়াব। (তিরমিযী, সহীহুল জামে হা/৬৪৬৯)
.
কুরআন যে শিখে ও শিক্ষা দেয় সেই হল শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিখেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। (সহীহ বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫০২৭)। তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করবে। কেননা, ক্বিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াতকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে।” (সহীহ মুসলিম হা/৮০৪; মিশকাত হা/২১২০)

◼️◼️(৩). প্রতিদিন এক ঘণ্টা কোরআন তরজমা ও তাফসির অধ্যয়ন করা:
______________________________
কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যই হলো তাকে বুঝা, অনুধাবন করা ও সে অনুযায়ী কাজ করা। শুধুমাত্র পাঠ করা ও মুখস্ত করা নয়। যদিও তাতে রয়েছে অশেষ নেকী। তবে বুঝে পড়া সর্বোত্তম। মহান আল্লাহ বলেন; তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে? (সূরা মুহাম্মদ:২৪; নিসা:৮২)
.
আবু যার গেফারী (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূল (ﷺ) স্রেফ একটি আয়াত দিয়ে তাহাজ্জুদ শেষ করেন। এমতাবস্থায় ফজর হয়ে যায়। সেটি হলো; ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহলে তারা আপনার বান্দা। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তাহলে আপনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।’ (মায়েদাহ ৫/১১৮; নাসাঈ হা/১০১০)। এতে বুঝা যায়, তাঁর কুরআন অনুধাবন কত গভীর ছিল। হাসান বসরী (২১-১১০ হি./৬৪২-৭২৮ খৃ.) বলেন, আল্লাহর কসম! কুরআন অনুধাবনের অর্থ কেবল এর হরফগুলি হেফয করা এবং এর হুদূদ বা সীমারেখাগুলি বিনষ্ট করা নয়। যাতে একজন বলবে যে, সমস্ত কুরআন শেষ করেছি। অথচ তার চরিত্রে ও কর্মে কুরআন নেই। (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ছোয়াদ; ২৯আয়াত)। তিনি বলতেন, কুরআন নাযিল হয়েছে তা বুঝার জন্য ও সে অনুযায়ী আমল করার জন্য। অতএব তোমরা তার তেলাওয়াতকে আমলে পরিণত কর। (ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন; বৈরূত: তাহকীক সহ দারুল কিতাবিল আরাবী, ৩য় সংস্করণ ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খৃ.; ১/৪৫০)

◼️◼️(৪) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সঙ্গে পড়ার চেষ্টা করা:
__________________________________
◾আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুম‘আ হতে পরবর্তী জুম‘আ, এক রামাদান হতে পরবর্তী রামাদান এর মধ্যকার যাবতীয় পাপের কাফফারা স্বরূপ। যদি সে কাবীরা গোনাহ সমূহ থেকে বিরত থাকে। (সহীহ মুসলিম হা/৫৭৪, ১/১২২ পৃঃ, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; মিশকাত হা/৫৬৪)

◼️◼️(৫) ফরজ সালাতের পাশাপাশি সালাতুত তারাবিহ ও দৈনিক ১২ রাকাত নফল সালাত আদায় করা:
___________________________________
যেমন: হাদীসে এসেছে, তারাবীহর সালাত নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। বহু হাদীসগ্রন্থে আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত‌ তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কিয়ামে রামাদানের ব্যাপারে (সকলকে) উৎসাহিত করতেন; কিন্তু তিনি বাধ্যতামূলকরূপে আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান রেখে সওয়াবের আশায় রামাদানের কিয়াম করবে, সে ব্যক্তির পূর্বকৃত পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে। (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৮১, ৫২৯, বুখারী ১৯০১, মুসলিম ৭৫৯, সহীহ আবু দাঊদ ১২২২)
.
নফল সালাতের ফজিলত সম্পর্কে উম্মু হাবীবাহ (রাঃ) বলেন- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনে রাতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হবে। সেগুলো হলো- যোহরের পূর্বে চার পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পর দুই এবং ফজরের পূর্বে দুই। (মুসলিম হা/১৭২৯, ১/২৫১ পৃঃ, ইফাবা হা/১৫৬৪, ‘মুসাফিরের সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৫)

◼️◼️(৬) কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা:
______________________________
তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত। রামাদানে রাতের প্রথমাংশে এই নফল সালাত আদায় করা হয়, এজন্য একে তারাবীহ বলা হয়। একে হাদীসের পরিভাষায় ‘সালাতুল লায়ল’ ও ‘ক্বিয়ামে রামাদান’ বলা হয়। আর অন্য ১১ মাসে রাতের এই সালাতকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয়। সুতরাং তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পৃথক দু’টি সালাত নয়। (নায়ল ২/২৯৫ পৃঃ; মির‘আতুল মাফাতীহ ২/২২৪ পৃঃ)
.
রাসূল (ﷺ) বলেন, ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে রাতের সালাত। (মুসলিম হা/১১৬৩; তিরমিযী হা/৪৩৮; মিশকাত হা/২০৩৯)। তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত। +সহীহ বুখারী, ১/১৫৪, হা/১১৪৭ এবং ১/৫০৪, হা/৩৫৬৯)। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি রামাযানের রাতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ্ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী হা/৩৭, ২০০৯; মুসলিম হা/৭৫৯, মিশকাত হা/১২৯৬)। সম্ভব হলে রামাদানে কিয়ামুল লাইল, যিকির-আযকার, তিলাওয়াত, দ্বীনি বই অধ্যয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করা। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া এবং এটাকে ধীরে ধীরে এমন অভ্যাসে পরিণত করা, যাতে সারা বছরই পড়া যায়। অধিকহারে ইসতিগফার ও দোয়ায় কান্নাকাটি করা।

◼️◼️(৭). নফল ইবাদত বেশী বেশী করা:
______________________________________
আর রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবে। এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে উঠাবেন। (ইসরা; ১৭/৭৯)। শুধু তাই নয়, তাঁর সাথীরাও একইভাবে নফল ইবাদত করতেন। (সূরা মুযযাম্মিল; ৭৩/২০)
.
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, আল্লাহ বলেন- যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয় বান্দার সাথে দুশমনী করল, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। আমি যেসব বিষয় ফরয করেছি, তার মাধ্যমে আমার নৈকট্য অনুসন্ধানের চাইতে প্রিয়তর অন্য কিছু আমার কাছে নেই। বান্দা বিভিন্ন নফল ইবাদতের মাধ্যমে সর্বদা আমার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টায় থাকে, যতক্ষণ না আমি তাকে ভালবাসি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমিই তার কান হয়ে যাই…।(বুখারী হা/৬৫০২, ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-৮১, ‘নম্রতা‘ অনুচ্ছেদ-৩৮; মিশকাত হা/২২৬৬)। সেকারণে কোন সংকটে পড়লেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নফল ছালাতে লিপ্ত হতেন। (আবু দাঊদ হা/১৩১৯; মিশকাত হা/১৩২৫; সহীহুল জামে হা/৪৭০৩)

◼️◼️(৮) কম ঘুমানোর চেষ্টা করা:
________________________________
রোযাদারের জন্য দিনে ঘুমানো বৈধ। কিন্তু সকল নামায তার যথাসময়ে জামাআত সহকারে আদায় করতে অবহেলা প্রদর্শন করা বৈধ নয়। যেমন: বিভিন্ন ইবাদতের কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা উচিৎ নয়। বরং উচিৎ হলো, ঘুমিয়ে সময় নষ্ট না করে রমাযানের সেই মাহাত্ম্যপূর্ণ সময়কে নফল নামায, যিকির-আযকার ও কুরআন কারীম তেলাওয়াত দ্বারা আবাদ করা। যাতে তার রোযার ভিতরে নানা প্রকার ইবাদতের সমাবেশ ঘটে। (ইবনে উষাইমীন, ফাসিঃ মুসনিদ ৩১-৩২পৃঃ)
.
মোটকথা; মুমিনের সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে। তার প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হবে আল্লাহর স্মরণে এবং তাঁর বিধান পালনের মাধ্যমে রমজাম দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় অফারের মাস। বেশি ঘুমালে অফার বেশি নেওয়া যাবে না। বঞ্চিত হতে হবে। তাই যথাসম্ভব সময়কে কাজে লাগিয়ে যত অর্জন করে নেওয়া যায়, ততই লাভ।

◼️◼(৯). প্রতিদিন একজনকে হলেও ইফতার করানোর চেষ্টা করা:
___________________________________
যায়দ বিন খালেদ জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায় সেই ব্যক্তিও ঐ রোযাদারের সমপরিমাণই সওয়াব অর্জন করে। আর এতে ঐ রোযাদারের সওয়াব কিঞ্চিৎ পরিমাণও কম হয়ে যায় না। (তিরমিযী ৮০৬, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ১৭৪৬, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহীহ তারগীব, আলবানী ১০৬৫)
.
কেউ যদি কোন সায়েমকে ইফতার করায় তবে তার জন্যও অনুরূপ (সিয়ামের) সওয়াব হবে। কিন্তু এতে সিয়াম পালনকারীর সওয়াবে কোন ঘাটতি হবে না।(তিরমযী হা/৮০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬; মিশকাত হা/১৯৯২)। গরীব-অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত এবং মিসকীন যখন কষ্ট, ক্লেশ এবং খাদ্য সংকটে পতিত হয়, তখন তাদের সহযোগিতা করা ধনীদের উপর অপরিহার্য হয়। আর এটা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য। (তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৬)

◼️◼️(১০). সিয়াম অবস্থায় বেশি বেশি দোয়া করা:
_______________________________________
রামাদান তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, দুআ কবুল হওয়া, রহমত, বরকত লাভ করা, ক্ষমা প্রাপ্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত নিশ্চিত করার এক অনন্য মাস। রামাদানের মর্যাদার কারণে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাতে ও দিনে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। (তিরমিযী, হা/৬৮২; মিশকাত, হা/১৯৬০)
.
উক্ত সাফল্য নির্বিঘ্নে অবিরত ধারায় নাযিলের জন্য সারাটা মাস আসমানের সমস্ত দরজা, জান্নাত ও রহমতের সমস্ত দরজা খুলে রাখা হয়। অন্যদিকে অগ্রগামী বান্দা যেন কোন ইবাদতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সে জন্য শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। (সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৮-১৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯)। সিয়াম অবস্থায় দো‘আ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তিন শ্রেণীর ব্যক্তির দো‘আ আল্লাহ ফেরত দেননা। (১). সায়েমের দো‘আ ইফতারের সময়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। (২). ন্যায়পরায়ণ শাসকের দো‘আ ও (৩). মযলুমের দো‘আ। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/৩৪২৮)

◼️◼️(১১). সামর্থ্য থাকলে উমরাহ করা:
_____________________________________
হজ্জ ও উমরা পালনকারীগণ আল্লাহর অফদ-মেহমান। তারা যদি আল্লাহকে ডাকে আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা যদি গুণাহ মাফ চায় আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন। (ইবনে মাজাহ; ২৮৮৩)
.
রামাদান মাসে উমরাহ করা বড় ফযীলতপূর্ণ সওয়াবের কাজ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘অবশ্যই রামাদানের উমরাহ একটি হজ্জ অথবা আমার সাথে একটি হজ্জ করার সমতুল্য। (বুখারী হা/১৮৬৩, মুসলিম হা/১২৫৬)

◼️◼️(১২). পরিবার-পরিজনদের সুশিক্ষা দেওয়া:
_______________________________________
রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তিন ধরনের লোকের জন্য দু’টি সওয়াব রয়েছে- (১). আহলে কিতাবের যে ব্যক্তি তার নবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরও ঈমান এনেছে। (২). যে ক্রীতদাস আল্লাহর হক আদায় করে এবং তার মালিকের হকও (আদায় করে)। (৩). যার একটি বাঁদী ছিল, যার সাথে সে মিলিত হত। তারপর তাকে সে সুন্দরভাবে আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়েছে এবং ভালভাবে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিয়েছে, এরপর তাকে আযাদ করে বিয়ে করেছে; তার জন্য দু’টি সওয়াব রয়েছে। (বুখারী হা/১৯৬০; ইবনু হিব্বান হা/৩৬২০।)
.
তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়। (বুখারী হা/৫০২৭; আবু দাউদ হা/১৪৫২; মিশকাত হা/২১০৯)

◼️◼️(১৩). সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সাদকা করা:
_______________________________________
বরকত, রহমত ও মাগফিরাতের অনন্য মাস হলো রামাযান। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে বরকতের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন, রহমতের দরজা খুলে দেন। ফলে চতুর্দিকে শান্তির সমীরণ প্রবাহিত হয়। তাই বিভিন্ন ইবাদতে ভরপুর এ মাসে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জনের জন্য নানাবিধ ইবাদতে মশগুল থাকে। রমাযান মাসে যে সকল কর্ম করা মুসলিমের জন্য অধিকতর কর্তব্য, তার মধ্যে সাদকাহ বা দান করা অন্যতম। সময়ের মর্যাদা গুণে রমাযান মাসে দানের পৃথক মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) অন্যান্য মাসে সবার চাইতে বেশী দান করতেন; কিন্তু সবচেয়ে বেশী দান করতেন এই রমাযান মাসে। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘গোপন সাদাক্বা রবের ক্রোধকে মিটিয়ে দেয়।’ (সিলসিলা সহীহাহ হা/১৯০৮)
.
তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সাদাক্বা কবরের উত্তাপ নিভিয়ে দেয় এবং ক্বিয়ামতের দিন মুমিন তার সাদাক্বার ছায়াতলে আশ্রয় পাবে।’ (তাবারানী কাবীর হা/৭৮৮; সহীহাহ হা/৩৪৮৪)। তিনি আরও বলেন, ‘সাদাক্বা গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।’ (তিরমিযী হা/৬১৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩; মিশকাত হা/২৯)। এছাড়া উক্ত হাদীসে বয়স বৃদ্ধি করার অর্থ হলো জীবন ও জীবিকায় বরকত দান করা। অর্থাৎ নির্ধারিত বয়সে সুস্থ থাকা, অধিক সৎকর্ম করতে পারা ও প্রশান্তির সাথে জীবন পরিচালনায় সক্ষম হওয়া। (নববী, শরহ মুসলিম ১৬/১১৪ হা/২৫৫৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)

◼️◼️(১৪). শেষ দশকের আমল ও ইবাদত:
_______________________________________
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রমাযানের শেষ দশকে ইবাদত করতে যে মেহনত ও চেষ্টা করতেন, মাসের অন্যান্য দিনগুলিতে তা করতেন না। (সহীহ মুসলিম হা/১১৭৫)
.
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রমাযানের শেষ দশক এসে উপস্থিত হলে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ইবাদতের জন্য) নিজের কোমর (লুঙ্গি) বেঁধে নিতেন, সারারাত্রি জাগরণ করতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগাতেন। (বুখারী ২০২৪নং, আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪১, আবূ দাঊদ ১৩৭৬)

◼️◼️(১৫). ইতিকাফ করা:
____________________________
ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ হলো, কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং তাতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা, রত থাকা, মগ্ন থাকা, লিপ্ত থাকা। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক রামাদানে ১০দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের বছরে তিনি ২০ দিন ই’তিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী ২০৪৪নং)
.
আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক রামাদানে ইতিকাফ করতেন। ফজরের সালাত পড়ে তিনি তাঁর ই’তিকাফগাহে প্রবেশ করতেন। (বুখারী ২০৪১, মুসলিম ১১৭৩)

◼️◼️(১৬). শবেকদর অন্বেষণ করা:
_________________________________
রামাদান মাসের শেষ দশকের বেজোড় সংখ্যার রাত্রিগুলোতে শবেকদর অনুসন্ধান করা মুস্তাহাব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অনুসন্ধানে উক্ত রাত্রিগুলিতে বড় মেহনত করতেন। আর এ কথা পূর্বে বলা হয়েছে যে, রামাদানের শেষ দশক এসে উপস্থিত হলে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ইবাদতের জন্য) নিজের কোমর (লুঙ্গি) বেঁধে নিতেন, সারারাত্রি জাগরণ করতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগাতেন। তাছাড়া শবে কদরের সন্ধানে ও আশায় তিনি ঐ শেষ দশকের দিবারাত্রে ই’তিকাফ করতেন। আল্লাহ বলেন- অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি ঐ কুরআনকে শবেকদরে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জান, শবেকদর কি? শবেকদর হল হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (কুরআনুল কারীম; ৯৭/১-৩)
.
এক হাজার মাস সমান ৩০ হাজার রাত্রি। অর্থাৎ এই রাতের মর্যাদা ৩০,০০০ গুণ অপেক্ষাও বেশী! সুতরাং বলা যায় যে, এই রাতের ১টি তাসবীহ অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ তসবীহ অপেক্ষা উত্তম। অনুরূপ এই রাতের ১ রাকআত সালাত অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ রাকআত অপেক্ষা উত্তম।

◼️◼️(১৭). আল্লাহর স্মরণ করা ও তার প্রিয় রাসূল সাঃ এর উপর দুরুদ পড়া:
_______________________________
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করব? যে আমল হবে তোমাদের মালিকের নিকট সবচেয়ে পরিশুদ্ধ তোমাদের মর্যাদা সমুচ্চকারী, সোনা ও রূপা আল্লাহর পথে ব্যয় করার চেয়েও তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আর এর চেয়েও মঙ্গলকর হবে যে তোমরা শত্রুর সম্মুখীন হয়ে তাদের গর্দানে আঘাত করবে আর তারা তোমাদের গর্দানে আঘাত করবে। সাহাবীরা বললেন; হ্যাঁ বলুন। তিনি বললেন, এ হলো আল্লাহর যিকর।’ (তিরমিযী হা/৩৩৭৭; মিশকাত হা/২২৬৯)
.
রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা প্রসঙ্গে রাসূল (ﷺ) বলেন- ‘যে আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করেন।’ (মুসলিম হা/৩৮৪; আবু দাঊদ হা/৫২৩; মিশকাত হা/৬৫৭)

◼️◼️(১৮). অপ্রয়োজনীয় কথা, কাজ পরিহার করা:
_______________________________________
মানুষের মুখের কথা একটি গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। সঠিকভাবে এ নেয়ামতের ব্যবহার করা জরুরী। অন্যথা এটা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। কেননা মানুষের মুখে উচ্চারিত প্রতিটি কথা মহান আল্লাহর দরবারে সংরক্ষিত হয়। আল্লাহ বলেন, সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে। (সূরা ক্বাফ; ৫০/১৮)
.
রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কর্ম ছাড়ল না তার খানাপিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ বুখারী, মিশকাত হা/১৯৯৯)। সুতরাং, জিহবা নিয়ন্ত্রণ করা ও সংযত কথাবার্তা বলা মানুষের জন্য অবশ্য করণীয়। কেননা এ জিহ্বাই মানুষকে ক্ষতির মধ্যে নিপতিত করে। পক্ষান্তরে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পরকালে নাজাত পাওয়া ও জান্নাতে যাওয়া সম্ভব হবে। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, সুফিয়ান ইবনু আবদুল্লাহ আস-সাক্বাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনার দৃষ্টিতে আমার জন্য সর্বাধিক ভীতিকর বস্ত্ত কোনটি? তিনি স্বীয় জিহ্বা ধরে বললেন, এটি’।(তিরমিযী হা/২৪১০; মিশকাত হা/৪৮৪৩, সনদ সহীহ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত বস্ত্ত ও তার দু’পায়ের মধ্যস্থিত বস্ত্তর যিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যিম্মাদার হবো। (বুখারী, হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২)

◼️◼️(১৯). সবধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা:
____________________________________
যারা কবিরা গুণাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা কমপক্ষে কবিরা গুণাহ ছেড়ে দেবে। আর যারা সগীরা গুনাহে অভ্যস্ত ছিল, তারা সগীরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। যারা সব গুনাহ থেকে দূরে ছিল, তারা নফল-মুস্তাহাব-সুন্নাত ইত্যাদি আমলের প্রতি আরও যত্নবান হবে। এভাবে রোজাদার এ মাসে নৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে একটি স্তরে হলেও উন্নতি করতে হবে।
.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই অপরাধী। উত্তম অপরাধী তারাই যারা তওবা করে, ক্ষমা চায়।’ (আবু দাউদ, হাদীস সহীহ, মিশকাত হা/২৩৪০)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আমি দিনে ৭০ বারেরও বেশী আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই এবং তাঁর নিকট তওবা করি। (বুখারী, মিশকাত হা/২৩২৩)

◼️◼️(২০). যাকাতুল ফিতরা আদায় করা:
______________________________________
রামাদান মাসের সিয়ামের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে- শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতর বা ফিত্‌রা বলা হয়ে থাকে। যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ফরয। এটাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মুসলিমের উপর অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছেন।
.
আর যাকাতুল ফিতর মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-কৃতদাস সকলের ওপর ফরয। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে স্বাধীন, গোলাম, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের ওপর এক সা‘ খেজুর, বা এক সা‘ যব যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন। (বুখারী: ১৫০৩; মুসলিম: ৯৮৪)। আর এক সা‘ বর্তমান হিসাবে প্রায় আড়াই কেজি থেকে তিন কেজি চাউলের সমান অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল। (আওনুল মা‘বূদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৯৫; ফাতাওয়া শায়খ বিন বায, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ২০১১)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন অনর্থক ও অশ্লীল কথা-বার্তা দ্বারা সিয়ামের যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তা থেকে পবিত্র করা এবং মিসকীনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা যাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হবে। (আবু দাউদ: ১৬০৯; ইবন মাজাহ: ১৮২৭; মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৪০৯)

🔹মহান আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ ভাবে এই রামাদান মাসে তার ইবাদত করার তৌফিক দান করুক,,,আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।