তাক্বওয়া কি এবং রামাদানের সাথে তাক্বওয়ার সম্পর্ক কি

আরবী (তাক্বওয়া) শব্দটি وقاية হতে উৎপত্তি। যার অর্থ হলো অনিষ্টকর ও কষ্টদায়ক বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা, সতর্কতা, আল্লাহর ভয়, আল্লাহভীতি, পরহেযগারী, দ্বীনদারী, ধার্মিকতা ইত্যাদি। (ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড কায়রো পৃষ্ঠা. ৬১৫)। সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে ‘তাক্বওয়া’ বলা হয়। শারঈ অর্থে- আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর নির্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা, জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম যেন লংঘিত না হয়, এরকম সতর্কতার সাথে চলার নামই তাক্বওয়া।
.
তাক্বওয়ার সংজ্ঞা: ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট তাক্বওয়ার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই সংকীর্ণ এবং যে পথের দুই দিকেই কাঁটাপূর্ণ গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কিভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, খুবই সতর্কতার সাথে কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে সে পথ অতিক্রম করেছি। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এটাই ‘তাক্বওয়া’। (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪)।

শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হলো, فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা।’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২০)।

আবার কেউ বলেন; ‘ফরয-ওয়াজিব পালন করা, হারাম পরিত্যাগ করার সাথে সাথে সন্দেহজনক কর্মগুলো বর্জন করা। আর নফল আমল করা এবং মাকরূহ কাজকে বর্জন করাকে তাক্বওয়া বলে।’ (জামিঊল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৫৯)। আর মুমিনের তাক্বওয়া তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন অণু পরিমাণ পাপ করতে গিয়েও আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থাকে। (ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃ. ১৯)। উল্লেখ্য, তাক্বওয়ার মূল কথা হলো- এটি অন্তরের আমল। (সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪)। আর অন্তরের আমল দ্বীনের মূলনীতি ও মূলভিত্তি। এটি ব্যতীত কোন আমল বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য মুমিন যখন তাক্বওয়া অবলম্বন করে সিয়াম রাখে, তখন সে প্রবৃত্তিকে লাগাম পরিয়ে রাখে। মূলকথা তাক্বওয়া উত্তম চরিত্রের সংরক্ষক, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী ও ধ্বংস এবং যাবতীয় অনাচার থেকে মুক্তির রক্ষাকবচ। অতএব তাক্বওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার নাম। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসারে সার্বিক জীবন পরিচালনার নাম ‘তাক্বওয়া’।
.
▪️রামাদানের সাথে তাক্বওয়ার সম্পর্ক কি?
_______________________________________
রামাদান তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, দুআ কবুল হওয়া, রহমত, বরকত লাভ করা, ক্ষমা প্রাপ্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত নিশ্চিত করার এক অনন্য মাস। রামাদানের সিয়ামের প্রধান ও মৌলিক উদ্দেশ্য হলো তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন, যা বান্দার সার্বিক কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী ভিত্তি। এ কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের বহু স্থানে বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তাক্বওয়া যাবতীয় কর্মের মুকুট। (মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১, সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৫৫৫)। এ জন্য তিনি প্রত্যেক খুৎবার শুরুতেই তাক্বওয়ার আয়াত পাঠ করে আল্লাহভীতি অর্জনের নির্দেশ দিতেন। (আলে ইমরান: ১০২; নিসা: ১; আহযাব: ৭০; নাসাঈ, হা/১৪০৪, সনদ সহীহ)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহ সালাফগণ সর্বদা তাক্বওয়া অর্জনের অসিয়ত করতেন‌। (আবু দাঊদ, হা/৪৬০৭, ৪৬১২; সহীহ মুসলিম, হা/৮৮৫, ১৭৩১; সহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৩৫২, ৮৩৬৭)। কারণ, কোন মুমিনের হৃদয়ে তাক্বওয়া ঠাঁই পেলে তার দ্বারা কখনো অন্যায় কর্ম সংঘটিত হতে পারে না। বরং সে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি বেশি মনোযোগী হবে এবং পাপ থেকে লক্ষ-কোটি মাইল দূরে থাকবে। কোন পাপ তাকে স্পর্শই করতে পারবে না।সুতরাং রামাযানের সাথে তাক্বওয়ার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কেননা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জন। আর যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে, সেই হেদায়াত লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৩)। নিশ্চয় সিয়াম তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম কারণ। সিয়ামের মাধ্যমে যেভাবে তাক্বওয়া অর্জিত হয়। যথা-
.
(১). রামাদান মাসে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশ পালন করে এবং নিষেধ বর্জন করে। আর এটাই তাক্বওয়া। (সূরা আল-বাক্বারাহ; ২/১৮৩)।
.
(২). (সুবহে সাদিক্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) খাওয়া, পান এবং সহবাস করা সহ আল্লাহ যা হারাম করেছেন, অন্তর ও প্রবৃত্তির ঝোঁক থাকার পরও আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নেকি অর্জন করার জন্য সিয়াম পালনকারী তা পরিত্যাগ করে; যা তাক্বওয়ার অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আল-বাক্বারাহ, ২/১৮৭, সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১)
.
(৩). সিয়াম পালনকারী আল্লাহর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রাণাধীনে থাকার অনুশীলন করে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে প্রবৃত্তির চাহিদাগুলো পরিত্যাগ করে।আর এটাই তাক্বওয়া। (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১)
.
(৪). নিশ্চয় শয়তান মানুষের মধ্যে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে। সিয়াম পালনকারী সিয়াম অবস্থায় শয়তানের রাস্তাকে সঙ্কীর্ণ ও সংকুচিত করে, তার প্রভাব ও কর্তৃত্বকে দুর্বল করে এবং পাপাচার কমে যায় আর এটাই তাক্বওয়া। (সহীহ বুখারী, হা/২০৩৯, ‘ই‘তিকাফ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২সহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪)
.
(৫). সিয়াম পালনকারী আল্লাহর আনুগত্য করে। যেমন; রামাদানে ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত বেশি বেশি করে। (সূরা আল-বাক্বারাহ, ২/১৮৪)। আর অনুগত থাকা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রামাযানের সিয়াম পালন করে তার পূর্বের (সগীরা) গুণাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্বের (সগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯, ২০১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৯, ৭৬০)
.
(৬). গরীব-অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত এবং মিসকীন যখন কষ্ট, ক্লেশ এবং খাদ্য সংকটে পতিত হয়, তখন তাদের সহযোগিতা করা ধনীদের উপর অপরিহার্য হয়। রমাদানে সেটি অধিক হারে হয়। আর এটাই তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য। (তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৬)
.
(৭). সিয়াম যৌবনকে দমন করার মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করে। আর এটা তাক্বওয়ার গুণ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৪০০)
.
(৮). সিয়াম পালনকারীর মধ্যে রয়েছে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা এবং মন্দ আচরণ থেকে অন্তরের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। কেননা সিয়াম মন্দ আচরণকে প্রতিরোধ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭)
.
(৯). সিয়াম লৌকিকতামুক্ত ইবাদত। কেননা অন্য যে কোন ইবাদত যথা সালাত, হজ্জ ইত্যাদি লৌকিকতা রক্ষার খাতিরে অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকে, কিন্তু সিয়ামের ব্যাপারটি সম্পূর্ণটাই স্বতন্ত্র। সিয়াম শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্যই পালন করা হয়। যা তাক্বওয়ার চরিত্র। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত। কারণ সিয়াম আমারই জন্য পালন করা হয় এবং তার প্রতিদান আমিই দিব।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১)
.
(১০). সিয়াম মানুষকে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। মানুষের আহার, অসংযত আচরণ, অবাধ যৌন স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্ণ এক মাস সময়ের এ সংযম মেনে চলার ট্রেনিং বা অভ্যাস তাকে গোটা বছর সংযমী হয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে প্রতি বছরের এক মাস ট্রেনিং তার পূর্ণ জীবনকে সংযমী করে গড়ে তোলে। (ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, তাক্বওয়া অর্জনে সিয়ামের ভূমিকা; পৃষ্ঠা. ২০)

(১১). সাধারণত মানুষের চিত্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। তার মন সব সময় লোভনীয় জিনিস পাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। এ চাহিদা পূরণে সে বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য পর্যন্ত ভুলে যায়। সে জন্য চিত্তের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। একমাত্র সবর বা ধৈর্যের শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ সবরের শিক্ষা লাভ করা যায়। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ২১)
.
পরিশেষে বলা যায় যে, সিয়াম শুধু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। যা তাক্বওয়া অর্জনে ভূমিকা পালন করে। আর এ তাক্বওয়াই তাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। তাই যে ব্যক্তি হেদায়াত লাভ করে, তার কোন ভয় নেই এবং চিন্তাও নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যে হেদায়াত উপস্থিত হবে, অতঃপর যে আমার সেই হেদায়াত অনুসরণ করবে বস্তত তাদের কোনই ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।’। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩৮ আল ইখলাস থেকে সংকলিত। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।