নারীরা জন্ম নিরোধক পিল সেবনের ফলে হায়েয অনিয়মিত হলে শরীয়তের বিধি বিধান পালনের ক্ষেত্রে করনীয় কী

বর্তমানে অনেক নারী জন্ম নিরোধক পিল সেবনের ফলে তাদের হায়েয অনিয়মিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধি বিধান পালনের ক্ষেত্রে করনীয় কী?
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: স্বাভাবিক ভাবে হায়েজের সময় হায়েজ নিবারক ট্যাবলেট সেবন করে হায়েজ বন্ধ রাখা উচিত নয়। বরং আল্লাহর বিধানের উপর সন্তুষ্ট থাকার মধ্যে বান্দার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তবে বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শারীরিক কোন ক্ষতি না হলে এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত না হলে হায়েজ নিবারক ঔষধ ব্যবহার করে সাময়িকভাবে ঋতু বন্ধ রাখা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই দুটি শর্ত পালন করতে হবে অর্থাৎ নিম্নের শর্ত দুটো পূর্ণ না হলে কোন নারীর জন্ম নিরোধক পিল সেবন করা উচিত নয়।
.
(১)। হায়েজ নিবারক পিল সেবন করার প্রয়োজন থাকা। যেমন- অসুস্থ হওয়া, শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়া এবং গর্ভধারণ করলে অসুস্থতা ও দুর্বলতা আরও বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি।
.
(২)। হায়েজ নিবারক পিল গ্রহনের ক্ষেত্রে স্বামী অনুমতি দেওয়া। কেননা স্বামীর সন্তান লাভের অধিকার আছে। সাথে আরো কিছু বিষয় রয়েছে যেমন, স্ত্রী তালাক প্রাপ্তা হওয়ার পর ইদ্দত পালন করে চলছে এবং ইদ্দত পালনকালে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ স্বামীর ওপর ওয়াজিব। এমতাবস্থায় ইদ্দতকাল দীর্ঘ করে ভরণ-পোষণ বেশি পাওয়ার উদ্দেশ্যে যদি স্ত্রী হায়েয প্রতিরোধ করার জন্য ঔষধ ব্যবহার করতে চায় তাহলে এক্ষেত্রে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামী অনুমতি দিলে করতে পারবে, অন্যথায় পারবে না।
.
উক্ত দুটি শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও এ পিলগুলো ব্যবহারের আগে নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা আবশ্যকীয় যেমন— নারীর স্বাস্থ্যের জন্য এ পিলগুলো কতটুকু উপযুক্ত এবং ভবিষ্যতে এর কোন ক্ষতি আছে কিনা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। কেননা ঔষধ সেবনের ফলে যদি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে ব্যবহার করা জায়েয হবে না। কেননা কুরআনে মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:‘‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে পতিত করো না।’’ (সূরা আল-বাকারাহ,২/১৯৫) এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন: ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’’সূরা আন-নিসা: ৪/২৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে রমজান মাসে এবং অন্যান্য সময়ে ঋতুস্রাব বন্ধ রাখার জন্য মেডিসিন ব্যবহার করার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে শাইখ বলেছেন,
.
তার জন্য হায়েজ নিবারক ট্যাবলেট সেবন করায় কোনো সমস্যা নেই,যাতে করে সে মানুষের সাথে সালাত পড়তে পারে এবং মানুষের সাথে রোজা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো এই ব্যবস্থাটি নিরাপদ হতে হবে,যা তার কোনো ক্ষতি করবে না। আর এই কাজ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে এবং স্বামীর অনুমোদন নিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।যাতে করে সে নিজের ক্ষতি করে না ফেলে এবং স্বীয় স্বামীর অবাধ্য না হয়। এটি যখন পরামর্শের ভিত্তিতে হবে এবং অনিষ্ট থেকে নিরাপদ হওয়ার মতো সতর্কতার ভিত্তিতে হবে,তখন এতে কোনো সমস্যা নেই।অনুরূপ ভাবে হজের ক্ষেত্রেও একই বিধান। (বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং ১৮৬৯৬ মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১৫; পৃষ্ঠা: ২০০-২০১)

▪️হায়েজ নিবারক পিল সেবনের ফলে অনিয়মিত রক্তপাতের হুকুম এবং এ অবস্থায় সালাত ও সিয়ামের হুকুম কী?
.
এটা সুবিদিত যে, হায়েজ নিবারক এ পিলগুলো সেবন করলে মহিলাদের হায়েযে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে কখনও কখনও হায়েযের মেয়াদকাল বেড়ে যায়। আবার কখনও কখনও হাযেযের সময় এগিয়ে আসে। এখন হায়েজের এই বিশৃঙ্খলার ফলে সালাত সিয়ামসহ শরীয়তের বিধি বিধান কিভাবে পালন করতে হবে,এবং অনিয়মিত এই রক্তপাত কি হায়েয হিসেবে গন্য হবা; নাকি হায়েয হিসেবে গন্য নয়? এ মাসয়ালায় আহালুল আলেমগন মতভেদ করেছেন। যেমন:
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-এর মনোনীত অভিমত হচ্ছে— এ পিলগুলো সেবনের কারণে হায়েযের মেয়াদকাল যে কয়দিন বাড়বে সেটা হায়েযই হবে। তিনি বলেন:

“من مساوئ هذه الحبوب : أنها توجب اضطراب العادة على المرأة فتوقعها في الشك والحيرة وكذلك توقع المفتين في الشك والحيرة ؛ لأنهم لا يدرون عن هذا الدم الذي تغير عليها أهو حيض أم لا ؟

وعلى هذا : إذا كان من عادتها أن تحيض خمسة أيام واستعملت الحبوب التي لمنع الحمل ثم زادت عادتها , فإن هذه الزيادة تبع الأصل , بمعنى أنه يحكم بأنه حيض ما لم تتجاوز خمسة عشر يوماً , فإن تجاوزت خمسة عشرة يوماً صارت استحاضة , وحينئذ ترجع إلى عادتها الأولى التي هي خمسة أيام”

এ পিলগুলোর কুফল হচ্ছে: এগুলো নারীর স্বভাবগত হায়েযকে বিশৃঙ্খল করে ফেলে এবং নারীকে সন্দেহ ও পেরেশানীতে ফেলে দেয়। অনুরূপভাবে মুফতিদেরকেও সন্দেহ ও পেরেশানীতে ফেলে দেয়। কেননা মুফতিরা জানেন না যে, এই যে রক্ত নিঃসরিত হচ্ছে—এটা কি হায়েয; নাকি হায়েয নয়?।

অতএব, এ নারীর স্বাভাবিক অভ্যাস যদি হয় পাঁচদিন হায়েয হওয়া এবং জন্ম নিরোধক পিল সেবনের ফলে হায়েযের মেয়াদকাল বেড়ে যায় তাহলে এ বেড়ে যাওয়া সময়টা মূলের অনুবর্তী হবে। অর্থাৎ এটাকে হায়েয হিসেবে গণ্য করা হবে; যতক্ষণ না এ রক্তপাত পনের দিনের বেশি সময় অতিক্রম না করে। যদি পনের দিনের বেশি সময় অতিক্রম করে তাহলে সেটা ইস্তিহাযা (রোগজনিত রক্তস্রাব)। তখন সে নারী তার স্বাভাবিক হায়েযের মেয়াদকে ধর্তব্য ধরবেন। তার স্বাভাবিক মেয়াদকাল হচ্ছে—পাঁচদিন।(উসাইমীন ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (১/১২৩)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণের মনোনীত অভিমত হচ্ছে—

أن المرأة تنظر إلى الدم النازل بسبب هذه الحبوب ، فإن كان بصفات دم الحيض فهو حيض ، وإن كان بصفات الدم المعتاد فهو نزيف ، وليس حيضاً .

এ অবস্থার শিকার নারী রক্তটাকে যাচাই করে দেখবেন। যদি দেখেন যে, এ রক্তে হায়েযের রক্তের বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাহলে সেটা হায়েয। আর যদি সাধারণ রক্তের বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে সেটা রক্তপাত; হায়েয নয়।
.
তাদেরকে আরও জিজ্ঞেস করা হয় যে: বর্তমানে মহিলারা নানা রকম কৃত্রিম জন্ম নিরোধক উপায় গ্রহণ করে থাকে; যেমন—পিল ও কপার-টি। যে কোন ডাক্তার কপার-টি সেট করা বা পিল দেয়ার আগে মহিলাকে দুটো ট্যাবলেট খেতে দেন যাতে করে গর্ভধারণ না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। এ অবস্থায় গর্ভধারণ যদি না হয়ে থাকে তাহলে রক্তপাত হওয়া আবশ্যকীয়।

প্রশ্ন হচ্ছে— কয়েক দিন ধরে নারীর এই যে রক্তপাত হয় এটার হুকুম কি হায়েযের রক্তের হুকুম যে, নামায, রোযা ও সহবাস পরিত্যাগ করতে হবে? উল্লেখ্য, এ রক্তপাত হায়েয়ের স্বভাবগত স্বাভাবিক সময়ে হয় না।

অনুরূপভাবে কোপার-টি কিংবা পিল ব্যবহারের পর কিছু কিছু মহিলাদের হায়েয আবর্তনের সিস্টেম পরিবর্তন হয়ে যায়। জন্ম নিরোধক ব্যবহার করার পর হঠাৎ করে মেয়াদ বেড়ে যায়। এমনকি কোন কোন নারী মাসে মাত্র এক সপ্তাহের বেশি পবিত্র থাকে না। আর বাকী তিন সপ্তাহ লাগাতরভাবে তার রক্তপাত হতে থাকে। এ সময়ে নিঃসরিত রক্ত হায়েযের রক্তের মতোই। অনুরূপভাবে গর্ভধারণ না থাকা নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে দুটো ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়; পূর্বের প্রশ্নে যা উল্লেখ করা হয়েছে; সে সময়ের রক্তও হায়েযের রক্তের মতোই।

প্রশ্ন হচ্ছে—এই তিন সপ্তাহব্যাপী সময়ে নারীর হুকুম কী? সেটা কি হায়েয? নাকি নারী জন্ম নিরোধক ব্যবহার করার আগে তার যে অভ্যাস ছিল সেটা মেনে চলবেন; নাকি দশদিন হায়েয ধরবেন?

জবাবে তারা বলেন:

“إذا كان الدم الذي نزل بعد أخذ الحبتين هو دم العادة المعروف للمرأة فهو دم حيض تترك وقته الصوم والصلاة ، وإذا كان غير ذلك فلا يعتبر دم حيض يمنع الصوم والصلاة والجماع ؛ لأنه إنما نزل بسبب الحبوب ”

দুটো ট্যাবলেট খাওয়ার পরে যে রক্তপাত শুরু হয়েছে সেটা যদি হায়েযের রক্তের মতো হয়ে থাকে তাহলে সেটা হায়েয। এ সময় মহিলারা নামায-রোযা বর্জন করবেন। আর যদি সেটা হায়েযের রক্তের মতো না হয় তাহলে সেটা হায়েযের রক্ত হিসেবে গণ্য হবে না; যার কারণে নামায, রোযা ও সহবাস নিষিদ্ধ হয়। কেননা এ রক্ত ট্যাবলেটের কারণ নিঃসরিত হচ্ছে।[ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ দায়িমা: খন্ড:৫ পৃষ্ঠা; ৪০২)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে আরও বর্ণনা করা হয় যে, তাঁকে পিল খাওয়ার কারণে যে হায়েয শুরু হয় সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:

على المرأة أن تسأل الطبيب ، فإذا قال : هذا حيض فهو حيض ، وإذا قال : هذه عصارات من هذه الحبوب فليس بحيض ”

নারীর কর্তব্য হল ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা। ডাক্তার যদি বলেন: এটা হায়েয; তাহলে সেটা হায়েয। আর যদি বলেন: এটা এই ঔষধের কারণে নিঃসরিত রস; তাহলে সেটা হায়েয নয়।(ফাতাওয়া ওয়া দুরুসুল হারাম আল-মাক্কী: খন্ড২ পৃষ্ঠা:২৮৪)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একথা পরিস্কার যে,শরীয়ত সম্মত সুস্পষ্ট কারণ না থাকলে হায়েজ নিবারক পিল সেবন করা জায়েজ নয়।
এখন প্রয়োজনে কেউ সেবন করলে এবং হায়েযে অনিয়ম দেখা দিলে সেই অনিয়মিত দিনগুলা কি হায়েজ হিসেবে গণ্য হবে নাকি হবে না এই বিষয়ে ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত মতটি উত্তম অভিমত। এর ভিত্তিতে আর কোন আপত্তি থাকে না। (আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১২৭২৫৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।