নবীর উপর দরূদ না পড়া পর্যন্ত প্রত্যেক দু’আ আসমান এবং জমীনের মাঝে আটকে থাকে মর্মে হাদীসটি কি সহীহ

প্রশ্ন: নবী করীম (ﷺ)-এর উপর দরূদ না পড়া পর্যন্ত প্রত্যেক দু’আ আসমান এবং জমীনের মাঝে আটকে থাকে; হাদীসটি কি সহীহ?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: হাদীসটি ইমাম তিরমিজি তার সুনানে তিরমিজিতে বর্ননা করেছেন। বর্ননাটি হচ্ছে- প্রখ্যাত সাহাবী ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ২৩ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; إِنَّ الدُّعَاءَ مَوْقُوْفٌ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا يَصْعَدُ مِنْهُ شَيٌّء حَتَّى تُصَليِّ عَلَى نَبِيِّكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ “প্রত্যেক দুআ ততক্ষণ পর্যন্ত আসমান ও যমীনের মাঝে লটকে থাকে, (আকাশে ওঠে না বা আল্লাহর কাছে কবুল হয় না) যতক্ষণ না নবীর উপর দরূদ পাঠ করা হয়।” (তিরমিযী ৪৮৬, সহীহ তারগীব ১৬৭৫, ১৬৭৬)। একই বর্ননা আলী, মুয়াজ ইবনে জাবাল, আনাস ইবনে মালিক (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকেও রয়েছে।
.
হাদীসটির সনদ: ইমাম তিরমিজি বলেন, আমাদেরকে আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে সালাম মাসাহাফী বালখী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি নাজির ইবনে সুমায়িল আবু কুররা আল আসাদী থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি সাইদ ইবনে মুসাইয়াব থেকে, তিনি ওমর ইবনুল খাত্তাবের সানাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
.
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ-জয়ীফ নিয়ে কথা থাকলেও অধিক বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে হাদীসটি জয়ীফ। কারণ, হাদিসটির সনদে আবু কুররা আল আসাদী নামে একজন ব্যক্তি রয়েছেন। আর তিনি হলেন অর্থাৎ মাজহুল অপরিচিত রাবী।
.
যারা হাদীসটি হাসান হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটির সনদ জায়িদ বলেছেন।(মুসনাদুল ফারুক খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৭৬)
.
ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] প্রথমে হাদীসটি জয়ীফ বলেছেন অতঃপর হাদীসটির একাধিক শাহেদ পর্যালোচনা করে পরিশেষে বলেন, যখন এই সমস্ত ইসনাদ এবং সমর্থনকারী বর্ননা গুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, হাদিসটি অন্তত হাসান, ইনশাআল্লাহ। (আলবানী সিলসিলা সহীহা হা/২০৩৫)
.
হাফিজ ইরাকি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; যদিও এই বর্ননাটি মওকূফ, তবে ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে এ জাতীয় বিষয়গুলি বলা যায়না। এটি একটি তাওকিফী বিষয়। এর হুকুম মারফু হাদিসের হুকুম এর মত। কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবি এই হাদিসটি উল্লেখ করার পরে তিনি বলেছেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যদি এইটা না জানতেন তাহলে অবশ্যই এভাবে বলতেন না। কেননা এটা নিজের থেকে গবেষণার বিষয় নয়।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৩১৯৪)
.
অপরদিকে জমহুর মুহাদ্দিসগন হাদীসটিকে জয়ীফ বলেছেন। যেমন; হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ফতুহাতুর রব্বানীয়্যাহ গ্রন্থের বলেন, তার সনদে আবু কুররা আসাদী তার নাম এবং অবস্থা পরিচিত নয়। ইমাম তিরমিজি এবং অন্যান্য সুনাম গ্রন্থকারদের নিকটে তার সম্পর্কে কোন কিছু পরিচিত নয়, তারা সবাই এটা মওকুফ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আবু কুররা এর সানাদে এখতেলাফ রয়েছে। (ফতুহাতুর রব্বানীয়্যাহ, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৩৪)
.
শুআইব আল-আরনাউত্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসটি জয়ীফ। কারণ সনদে আবু কুররাহ আল-আসাদী রয়েছেন; যিনি অজানা। (তাখরিজ শরহ সুন্নাহ,খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ২০৫)।
.
শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসটি দুর্বল। (তুহফাতুল আহওয়াযী,খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩৫৬ )।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] -কে হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন: في سنده أبو قرة الأسدي ، وهو من رجال البادية مجهول ، كما في التقريب ، وهو الراوي له عن سعيد بن المسيب عن عمر رضي الله عنه ..؛ وبذلك يعتبر هذا الأثر ضعيفا من أجل جهالة أبي قرة .. والله أعلم এই সানাদের মধ্যে আবু কুররা আল আসাদী নামক একজন রাবি রয়েছেন । যিনি মাজহুল রাবী। আর তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব থেকে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আবু কুররা আল আসাদের অজ্ঞতার কারণে এই হাদিসটি দুর্বল হিসেবে গণ্য হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। (বিন বায মাজমুউ ফাতাওয়া; খন্ড: ২৬ পৃষ্ঠা: ২৮৯)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এটা কি সঠিক যে দোয়া কবুল হওয়ার জন্য আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় না, যদি তার পূর্বে ও পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরুদ পাঠ না করা হয়, উত্তর দিয়ে ধন্য করবেন?
.
জবাবে শাইখ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, الشيخ : الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم قبل الدعاء والبداءة بحمد الله والثناء عليه قبل الدعاء هذا هو الأفضل وهو المشروع، فإذا أراد أحد أن يدعو الله عز وجل فليبدأ بحمد الله والثناء عليه، ثم الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يدعو بما شاء، ولو دعا بدون ذلك فلا حرج عليه فيه، وليس تركه للحمد والثناء على الله تعالى والصلاة على رسوله صلى الله عليه وسلم بمانع من قبول دعوته، بل قد يقبل دعاؤه وإن لم يفعل. وأما الحديث الذي أشار إليه فإنه ما يذكر عن النبي صلى الله عليه وسلم من قوله: “الدعاء موقوف بين السماء والأرض حتى تصلي على نبيك” ولكنه لا يحضرني الآن مدى صحة هذا الحديث. “দোয়া করার পূর্বে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ করা এবং দোয়ার পূর্বে আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে দোয়া শুরু করা এটি শ্রেষ্ঠ বা উত্তম এবং শরীয়ত সম্মত। অতএব যখন কেউ আল্লাহর কাছে দোয়া করবে সে যেন আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু করে। অতঃপর রাসূল (ﷺ)এর উপর দরুদ পাঠ করবে এবং তারপর তার ইচ্ছা অনুযায়ী দোয়া করবে। আর কেউ যদি এই পদ্ধতি ছাড়াও দোয়া করে তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই। আল্লাহর উপর হামদ ও সানা এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ না করা দোয়া কবুল হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধকতা নয়। বরং তার দোয়া কবুল হবে। যদিও সে এরূপ না করে। আর যে হাদিসটি ইঙ্গিত করে যে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেন: দোয়া আসমান ও জমিনের মাঝে অবস্থান করে যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের উপর দরুদ পাঠ না করা হয়। কিন্তু এই হাদিসের সহিহ হওয়ার কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত আমার নিকট নেই। (উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব, ১৩৭)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে; হাদীসটির সনদ সহীহ-জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। প্রায় সকল মহাদ্দিস এককভাবে বর্ননাটি জয়ীফ বলেছেন। আর একাধিক শাহেদ থাকার কারণে ইমাম আলবানিসহ কয়েকজন মুহাদ্দিস হাদিসটি হাসান বলেছেন। হাদীসটি বিশুদ্ধ ধরা হলেও এর অর্থ এই নয় যে, দু’আর সাথে দরুদ পাঠ না করা হলে দু’আ কবুল হবে না। বরং দু’আর শর্তগুলো পূরণ করে দু’আ করলে কবুল হবে বলে আশা করা যায়। সালাফগণ এ বিষয়ে একমত যে, দু’আর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ করা মুস্তাহাব। কিন্তু এটি দু’আ কবুলের অন্তরায় কিংবা শর্ত নয়। তার দলিল হলো; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা প্রত্যেকটা দু’আর মাঝে তার ওপর দরুদ পাঠ করার বিষয়টি আবশ্যক করেননি। অপরদিকে দু’আর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরুদ পাঠ করা এ বিষয়টি আলেমগণ তিনটা স্তর উল্লেখ করেছেন।
.
১ম: শায়েখ বকর আবু জায়েদ তার “তাসহীহুদ দোয়া” কিতাবের ২৩ নং পৃষ্ঠায় বলেন; দু’আর শুরুতে হোক কিংবা মধ্যখানে হোক কিংবা শেষে হোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরে দরুদ পাঠ করা স্পষ্ট একটি বড় স্তর। দোয়া হলো ডানার ন্যায় , ইখলাস নিয়ে আকাশের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
.
২য়: দু’আর শুরুতে অথবা শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ করা যাবে।
.
৩য়: দু’আর শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরুদ পাঠ করতে হবে। (এই স্তরগুলো ইবনুল কাইয়ুম রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাব “যালাউল আফহাম” গ্রন্থের ৫৩১ থেকে ৫৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।