ধূমপান করা মাকরুহ নাকি হারাম?

প্রশ্ন: ধূমপান করা মাকরুহ নাকি হারাম? “ধূমপান করলে ৪০ দিনের ইবাদত কবুল হয়না”এ বক্তব্য কতটুকু সঠিক?
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: নি:সন্দেহে মাদকদ্রব্য হচ্ছে সকল অকল্যাণ ও অমঙ্গলের প্রধান উৎস। মাদকের নীল নেশায় ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের তারুণ্য। মাদকতার গহীন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বর্তমান যুবসমাজ।যেসকল মাদকদ্রব্য সমাজ ধ্বংস করছে তার মধ্যে অন্যতম সিগারেট বা ধূমপান। ধুমপান হচ্ছে তামাক (Tobacco) জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা,ও বিভিন্ন বিজ্ঞানীগণসহ মোটামুটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধুমপানের কারণে ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহবা ও কণ্ঠনালি, কিডনী ইত্যাদিতে ক্যান্সার ও ব্রংকাইটিস ও হৃদরোগ হয়ে মানুষ মারা যায়। ধুমপান করলে ঠোঁট, দাতের মাড়ি, আঙ্গুল কালো হয়ে যায়। যৌনশক্তি ও ক্ষুধা কমে যায়। এমনকি স্মৃতি শক্তিও কমে যায়। যার ফলাফল স্বরূপ মানুষ দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।অথচ মহান আল্লাহ বলেন: তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না (সূরা বাকারা:১৯৫, নিসা: ২৯)। আহালুল আলেমগন এই বিষয়ে একমত যে, তামাক (Tobacco) থেকে তৈরি সকল প্রকার নেশাধার বস্তু গ্রহণ করা হারাম। যারা সিগারেট খাওয়াকে মাকরুহ বলেন তাদের এই বক্তব্যের পক্ষে কোন দলিল নেই তারা মূলত গুল, জর্দা খাওয়ার সেই বাপ-দাদার আমলের প্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য এমনটি বলে। অথচ এগুলো নেশাদার দ্রব্য এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্‌ তা’আলা এক্ষেত্রে আমাদেরকে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন যে খাবার ও পানীয়ের ক্ষেত্রে আমরা যেন শুধুমাত্র পবিত্র বস্তু খাই ও পান করি এবং অপবিত্র খাবার ও পানীয় না খাই (সূরা আরাফ: ৭/৩২)। অপবিত্র খাবার কি তা আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআন মাজিদে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। মদ ও সকল প্রকার নেশাদার দ্রব্যকে আল্লাহ্‌ তা’আলা অপবিত্র ও শয়তানের পথ বলেছেন এবং এর কাছেও যেতে নিষেধ করেছেন (সূরা মায়েদা,৫/৯০)।
.
তাছাড়া প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বহু বাণী দ্বারা সূর্যালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, মাদকদ্রব্য সেবন করা হারাম। এ মর্মে তাঁর একাধিক বাণী বিধৃত হয়েছে। যেমন: জাবির (রাযিয়াল্লাহু) থেকে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে বস্তুর অধিক পরিমাণ ব্যবহারে নেশা আনয়ন করে, ঐ বস্তুর অল্প পরিমাণ ব্যবহার করাও হারাম’। (মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৫৮; আবু দাঊদ, হা/৩৬৮১; তিরমিযী, হা/১৮৬৫; নাসাঈ, হা/৫৬০৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৯৩ ও ৩৩৯৪, সনদ হাসান সহীহ)। অপর বর্ননায় রাসূল (সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: ‘মাদকতা আনয়নকারী প্রত্যেক বস্ত্তই মদ এবং প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসই হারাম।(সহীহ মুসলিম: ২০০৩, আবূ দাঊদ: ৩৬৭৬, নাসায়ী: ৫৬৭৩, তিরমিযী: ১৮৬১, সহীহ আল জামি: ৪৫৫৩, মিশকাত হা/৩৬৩৮)।
.
সিগারেট বা নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করা, বহন করা, বিক্রি করা, চাষাবাদ করা, এতে কর্মী হিসাবে কাজ করা সবই হারামের অন্তর্ভুক্ত। (সহীহ বুখারী হা/৬১২৪; আবুদাঊদ হা/৩৪৮৮; তিরমিযী হা/১২৯৫, ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮২, মিশকাত হা/২৭৭৬, ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৮/৩৩৭, ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৩/৫৪, ২২/১৪৪, আল-মাউসূ‘আতুল ফিকহিয়াহ ৫/২৫)।
.
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সব ধরনের নেশাদার দ্রব্য হারাম’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮৮)। অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে জিনিস এক ফারাক্ব পরিমাণ ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি হয়, উহা হাতের অঞ্জলি পরিমাণ ব্যবহারও হারাম’। (মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪৬৮; আবু দাঊদ, হা/৩৬৮৭; তিরমিযী, হা/১৮৬৬; মিশকাত, হা/৩৬৪৬, সনদ সহীহ)।
.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঐ বস্তু যা বিবেকের ক্ষতি করে সেসবই মদ। আর সব ধরনের মদই হারাম।’ [ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯০] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, প্রত্যেক পানীয় যা নেশা সৃষ্টি করে, তাই হারাম।’ (সহীহ বুখারী, হা/৫৫৮৬; সহীহ মুসলিম, হা/২০০১; মিশকাত, হা/৩৬৩৭)।
.
সুতরাং যারা এ সকল ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত তাদের জন্য ফরজ হল, অনতিবিলম্বে এগুলো বর্জন করা এবং একনিষ্ঠ ভাবে তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসা। মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার, বিশুদ্ধ তাওবা সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। (সূরা তাহরীম,৬৬/৮)।

◾বিড়ি-সিগারেট খেলে কি ৪০ দিনের ইবাদত কবুল হবেনা কি?
_______________________________________
ধূমপান করা হারাম যা উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট কিন্তু ধূমপান করলে ৪০ দিনের ইবাদত কবুল হবে না, উক্ত বক্তব্য শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা এখানে কিছু শর্ত রয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মদ পান করে কেউ যদি যদি নেশাগ্রস্ত হয় তথা মদের প্রভাবে মাতাল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করবেন না (অন্যান্য ইবাদত নয়) দলিল আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, কেউ মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হলে তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তবে যদি সে তওবা করে নেয় তা হলে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন। এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে আবারও তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অবশ্য যদি সে তওবা করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন। এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে আবারও তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কিন্তু যদি সে তওবা করে নেয় তাহলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তখন আল্লাহর হক হয়ে যায়, ক্বিয়ামতের দিন তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ পান করানো। ছাহাবীগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ‘রাদগাতুল খাবাল’ কী? তিনি বললেন, জাহান্নামীদের পুঁজ। (ইবনু মাজাহ, হা/২৭৩৮;সহীহুল জামে‘, হা/৬৩১৩ সনদ সহীহ)।

উক্ত হাদীসের আলোকে আবূ আব্দিল্লাহ ইবনু মানদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, لا يثاب على صلاته أربعين يوماً عقوبة لشربه الخمر كما قالوا في المتكلم يوم الجمعة والإمام يخطب إنه يصلي الجمعة ولا جمعة له يعنون أنه لا يعطى ثواب الجمعة عقوبة لذنبه ‘চল্লিশ দিন সালাত কবুল হবে না’-এর অর্থ হল, মদপানের শাস্তি হিসাবে চল্লিশ দিনের সালাতের ছাওয়াব পাবে না। যেমন ফক্বীহগণ বলেছেন, জুমু‘আর দিন খুত্ববাহ চলাকালীন যদি কেউ কথা বলে সে জুমু‘আহ পড়বে কিন্তু তার জুমু‘আহ হবে না। অর্থাৎ তার এই অপরাধের কারণে তাকে জুমু‘আর ছালাতের ছওয়াব প্রদান করা হবে না।’ (তা‘যীম কাদরিছ সালাত, ২/৫৮৭ ও ৫৮৮)।

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَأَمَّا عَدَم قَبُول صَلاته فَمَعْنَاهُ أَنَّهُ لا ثَوَاب لَهُ فِيهَا وَإِنْ كَانَتْ مُجْزِئَة فِي سُقُوط الْفَرْض عَنْهُ وَلا يَحْتَاج مَعَهَا إِلَى إِعَادَة ‘আর সালাত কবুল না হওয়ার অর্থ হল, এতে তার ছাওয়াব হবে না। যদিও ফরয আদায়ের জন্য তা যথেষ্ট হবে এবং তা পুনরায় আদায় করার প্রয়োজন নেই’ (শরহুন সহীহ মুসলিম, ১৪/২২৭ পৃ.)।
.
অর্থাৎ ৪০ দিন সালাত কবুল না হওয়ার বিধানটি কেবল মদ-গাজা বা নেশা দ্রব্য পান করার মাধ্যমে যারা নেশাগ্রস্ত বা মাতাল হয় তাদের উপর প্রযোজ্য; সাধারণ ধূমপানকারীদের উপর নয়। কারণ ধূমপান, গুল-জর্দা ইত্যাদি সেবনের মাধ্যমে সাধারণত: মানুষ নেশায় বুদ হয়ে মতালামি বা পাগলামি করে না। সুতরাং এসব হারাম ও ক্ষতিকর দ্রব্যাদি সেবনের ফলে কবিরা গুনাহগার হলেও যতক্ষণ না পর্যন্ত ধূমপান করা ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত বা মাতাল না হয় তার পূর্বে তাকে উক্ত ৪০ দিনের সালাত কবুল হবেনা মর্মে বর্ণিত হাদীসের আওয়াতায় ফেলার সুযোগ নাই।
.
পরিশেষে,তামাক শুধু মানুষের জন্য নয়,বরং সকল প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ লোক তামাকজনিত রোগে মারা যায়। তন্মধ্যে ৬ লাখের অধিক হ’ল পরোক্ষভাবে ধূমপায়ী।আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করো না।’ [ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০ সহীহাহ হা/২৫০] আল্লাহ আমাদের সকলকে মাদকতা পরিত্যাগ করে সুশীল সমাজ গড়ার তাওফীক্ব দিন। (আল্লাই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।