গোসল সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: গোসল কাকে বলে? কোন কোন কারণে গোসল করা ওয়াজিব হয়? গোসলের সঠিক নিয়ম কি? গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহ কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: গোসল এর আভিধানিক অর্থ-ধৌত করা।পারিভাষিক অর্থ- ইবাদতের উদ্দেশ্যে, নির্দিষ্ট নিয়মে, পবিত্র পানি দ্বারা সর্ব শরীর ধৌত করার নাম গোসল। (ফিকহুল মুয়াস্সার, মুজাম্মা মালিক ফাহ্দ, পৃঃ ২৮) গোসল সাধারণত দু’প্রকার। যথা:

▪️(১) ফরয: ঐ গোসলকে বলা হয়, যা করা অপরিহার্য। বালেগ বয়সে নাপাক হ’লে গোসল ফরয হয়। যেমন- আল্লাহ বলেন, وَ إِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا ‘যদি তোমরা নাপাক হয়ে থাক, তবে গোসল কর।’ (মায়েদাহ ৬)।

▪️(২) মুস্তাহাব: ঐ গোসলকে বলা হয়, যা অপরিহার্য নয়। কিন্তু করলে নেকী আছে। যেমন- জুম‘আর দিনে বা দুই ঈদের দিনে গোসল করা। সাধারণ গোসলের পূর্বে ওযু করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সাইয়িদ সাবিক্ব একে ‘মানদূব’ (পছন্দনীয়) বলেছেন। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪১)

◾যে সকল কারণে গোসল করা ওয়াজিব:
______________________________________
▪️(ক) যৌন উত্তেজনার সাথে বীর্য নির্গত হওয়া:আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوْا ‘আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও।'(সূরা মায়েদা ৬) আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন-অর্থাৎ আমার প্রায়ই মযী নির্গত হ’ত এবং আমি গোসল করতাম। এমনকি এ কারণে আমার পৃষ্ঠদেশে ব্যথা অনুভব করতাম। অতঃপর আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পেশ করি অথবা অন্য কারো দ্বারা পেশ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তুমি এরূপ করবে না। বরং যখনই তুমি মযী দেখবে তখন তোমার পুরুষাঙ্গ ধৌত করবে এবং সালাত আদায়ের জন্য ওযু করবে। অবশ্য যদি কোন সময় উত্তেজনা বশতঃ বীর্য নির্গত হয় তবে গোসল করবে’। [আবু দাউদ, ২০৬, নাসাঈ,১৯৩]। অতএব জাগ্রত অবস্থায় অসুস্থতার কারণে যৌন উত্তেজনা ছাড়াই বীর্যপাত হলে তার উপর গোসল ওয়াজিব নয়। (শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৩৩৪)। অর্থাৎ সে ব্যক্তি শুধুমাত্র লজ্জস্থান ধৌত করবে এবং যে পোষাকে বীর্য লেগেছে তা পরিবর্তন করে নতুনভাবে ওযু করে সালাত আদায় করবে।পক্ষান্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় বীর্যপাত হলেই গোসল ওয়াজিব হবে। এক্ষেত্রে গোসল ওয়াজিব হওয়ার জন্য যৌন উত্তেজনা শর্ত নয়। (দেখুন সহীহ বুখারী,১৩০ সহীহ মুসলিম, ৩১৩ আর লুলু ওয়াল মারজান,১৮০)। অতএব স্বপ্নের কিছু বুঝতে পারুক বা না পারুক, ঘুম থেকে জেগে বীর্য দেখলেই তার উপর গোসল ওয়াজিব।

▪️(খ) পুরুষাঙ্গের খাতনার স্থান পর্যন্ত স্ত্রীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করালে বীর্য নির্গত হোক বা না হোক গোসল ওয়াজিব হবে। আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: যখন তোমাদের কেউ স্ত্রীলোকের চার শাখার (দুই হাত দুই পা) মাঝখানে বসে সঙ্গমে রত হয় তখন তার উপর গোসল করা ফরজ হয়ে যায়,যদিও বীর্যপাত না হয়। (সহীহ মুসলিম ৩৪৮, বুখারী ৩৪৮ মিশকাত,৪৩০) অপর বর্ননায় পুরুষের খাতনার জায়গা মহিলার খাতনার জায়গা অতিক্রম করলেই গোসল করা ফরয হয়ে যাবে। (সহীহ তিরমিযী ১০৮, ইবনু মাজাহ্ ৬০৮। মিশকাত,৪৪২)।

▪️(গ) মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃএক ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থানরত অবস্থায় আকস্মাৎ তার উটনী হ’তে পড়ে যায় এতে তার ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেছেন, ঘাড় মটকে দিল (যাতে সে মারা গেল)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করাও, তার পরিধেয় বস্ত্র দু‘টি দিয়ে তার কাফন দাও, কিন্তু তার মুখমণ্ডল ও মাথা অনাবৃত রাখ। কারণ তাকে কিয়ামাতের দিন তালবিয়াহ্ পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭৮৬ (ই.ফা. ২৭৬৩, ই.সে. ২৭৬১)। উল্লিখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার উপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে যুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তির উপর গোসল ওয়াজিব নয়। (দেখুন সহীহ বুখারী ১৩৪৩, ইবনু মাজাহ্ ১৫১৪, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৬৭৫৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬৯২৫। মিশকাত, ১৬৬৫)।

◾পবিত্রতা অর্জনের গোসলের সঠিক নিয়ম:
_______________________________________
অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসল করা ওয়াজিব। আর সেই গোসলের সুন্নাতী নিয়ম হ’ল সে পবিত্রতা অর্জনের নিয়ত করবে এবং বিসমিল্লাহ বলে প্রথমে উভয় হাত ধৌত করবে। অতঃপর লজ্জাস্থান ও তার আশেপাশে যে স্থানগুলোতে বীর্য লেগেছে তা ধৌত করবে। এরপর সে সালাতের ওযুর ন্যায় ওযূ করবে। তারপর হাতে পানি নিয়ে মাথার চুল খিলাল করবে। অতঃপর হাত দ্বারা মাথায় তিন বার পানি দিবে এবং সারা শরীরে পানি ঢেলে দিবে। (সহীহ সহিহ বুখারী,২৪৮ ২৬২, ২৭২; মুসলিম ৩/৯, হাঃ ৩১৬, আহমাদ ২৫৭০৪ ই ফাঃ ২৪৬ মিশকাত ৪৩৫-৪৩৬) মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে। (বুখারী, মিশকাত ৪৩৮)। নখ নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট্‌ থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না।

বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৬০পৃ: দ্র:)। গোসলের পর নামাযের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই নামায হয়ে যাবে। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪৪৫ নং)।

রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূদাঊদ, মিশকাত ৫৬০-৫৬১)। সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩০৪)।

◾যে সকল কারণে গোসল করা সুন্নাত:
___________________________________
▪️(ক) সহবাসের পরে পুনরায় সহবাসে লিপ্ত হ’তে চাইলে ওযু গোসল করা সুন্নাহ করা। (আবূ দাঊদ ২১৯, আহমাদ ২৩৩৫০ মিশকাত ৪৭০)।

▪️(খ) জুম‘আর সালাতের জন্য গোসল করা সুন্নত (সহীহ: বুখারী ৮৭৭, মুসলিম ৮৪৪, নাসায়ী ১৩৭৬, সহীহ আল জামি‘ ৪৫৮ মিশকাত, ৫৩৭)।

▪️(গ) দুই ঈদের দিনে গোসল করা সুন্নত। (সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ, হা/৬৩৪৩ ইরওয়া হা/১৪৬)।

▪️(ঘ) হজ্জ ও ওমরার ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা সুন্নত। (তিরমিয়ী ৮৩০, দারেমী ১৭৯৪ বুলুগুল মারাম,৭৩০)।

▪️(ঙ) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার পরে গোসল করা সুন্নত। (সহীহ আবূ দাঊদ ৩১৬১, তিরমিযী ৯৯৩, ইবনু মাজাহ্ ১৪৬৩, ইরওয়া ১৪৪, আহমাদ ৯৮৬২, মিশকাত, ৫৪১)।

▪️(চ) কোন অমুসলিম ইসলাম কবুল করলে গোসল করা সুন্নত (আবু দাউদ,৩৫৫ মিশকাত হা/৫৪৩)।

◾গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহ:
_______________________________________
(ক) মসজিদে অবস্থান করা। তবে মসজিদে অবস্থান না করে তা অতিক্রম করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِيْ سَبِيْلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوْا ‘আর অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।’ (নিসা ৪৩)।

(খ) কুরআন স্পর্শ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ব্যতীত’ (ওয়াকিয়া ৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلا طَاهِرٌ. ‘কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত’। (তিরমিযী ১/১৪৬; আহমাদ হা/৬৩৯, ৮৭২;বুখারী, মিশকাত হা/৪৫১)।

(গ) সালাত আদায় করা। সালাত সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো,ছোট ও বড় উভয় প্রকার নাপাকী হ’তে পবিত্রতা অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ. ‘পবিত্রতা ব্যতীত সালাত এবং হারাম মালের দ্বারা দান কবুল হয় না’। (সহীহ মুসলিম ২২৪ বুখারী হা/৩৩১)।

(ঘ) পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা।বিনা ওযুতে কাবাঘর তওয়াফ করা নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কাবাঘরে তাওয়াফ করা নামাযতুল্য।” (সূনানে নাসাঈ: ২৯২০)। অপর এক হাদীসে আয়েশা (রা) কে সম্বােধন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,“পবিত্র না হয়ে আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করো না।” (সহীহ বুখারী: ২৯৪ ও ৩০৫ সহীহ মুসলিম, ২৯৭৭)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।