তালাক সম্পর্কে বিস্তারিত

তালাক কি? স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার হুকুম এবং উপযুক্ত কারণ কি? তালাকের সঠিক পদ্ধতি কি? ইসলামে হিল্লা বিবাহ কি জায়েয?(পোস্টটি একটু বড় হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশা করি পড়লে উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ)।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মানব জীবনে পারিবারিক বন্ধন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বামী ও স্ত্রীর মাধ্যমে এই পরিবার গড়ে ওঠে। বিবাহের মাধ্যমেই এ সম্পর্কের সূত্রপাত। আবার কখনো যদি সম্পর্কের টানাপোড়নে একত্রে বসবাস সম্ভব না হয়, তাহলে তালাকের মাধ্যমেই তার পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই তালাক সম্পর্কে সবিস্তার অবহিত হওয়া জরুরী। তালাক্ব (الطلاق) অর্থ বন্ধনমুক্তি বিচ্ছিন্ন হওয়া ইত্যাদি। যেমন: বলা হয় أُطْلِقَ الْأسِيْرُ ‘বন্দী মুক্ত হয়েছে’। শারঈ পরিভাষায় তালাক অর্থ স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা। অর্থাৎ স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া। ইসলামে তালাককে অপছন্দ করা হয়েছে। আল্লাহর নিকটে তালাক সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল কাজ’ উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীসটির সনদ জয়ীফ হলেও (আবূদাউদ হা/২১৭৮; যঈফুল জামে‘ হা/৪৪)। তবে মর্ম সঠিক। শায়খ ইবনে উসাইমীন বলেন, উক্ত মর্মে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু সনদ সহীহ নয়। যদিও মর্ম সহীহ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তালাক দেওয়াকে অপসন্দ করেন। কিন্তু জাতির কল্যাণে এর বৈধতা রেখেছেন(লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ৫৫/ ১০) সুতরাং বেদ্বীনী, অবাধ্যতা, যেনাকারিতা প্রভৃতি চূড়ান্ত অবস্থায় এটাকে জায়েয রাখা হয়েছে এবং তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হলেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজআত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। মোটকথা বৈধ কারণে ইসলাম তালাক প্রদান করাকে জায়েয করেছে। (সূরা বাক্বারাহ; ২/২২৯) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “তালাক দেওয়ার ব্যপারে শরীয়তের মূলনীতি হচ্ছে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ। তালাক দেওয়া শুধুমাত্র তখনই জায়েজ হবে, যখন তালাক দেওয়ার ‘উপযুক্ত কারণ’ থাকা সাপেক্ষে তালাক দেওয়ার ‘প্রয়োজনীয়তা’ বিদ্যমান থাকে।”(মাজমু আল-ফাতওয়াঃ ৩৩/৮১) জেনে রাখা ভাল,তালাকের অধিকার একমাত্র স্বামীর। স্ত্রী তালাকের অধিকার রাখে না। অতএব স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিলে তালাক হবে না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,তালাক শুধু সেই দিতে পারে যে চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে (তথা স্বামী)’ (ইবনু মাজাহ, হা/২০৮১; ইরওয়ায়ুল গালীল, হা/২০৪১)। তবে স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় তাহলে,উভয় পক্ষের মাঝে সালিশী প্রক্রিয়ায় স্বামীর নিকট হতে পূর্ণ মোহরানা (সম্মতিতে কম-বেশি হতে পারে) ফেরত দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে (সূরা আল-বাক্বারা, ২/২২৯) স্ত্রীর পক্ষ থেকে খোলা তালাক সংক্রান্ত একটি পর্ব আসবে ইনআশাল্লাহ।
.
🔹তালাকের উপযুক্ত কারণ কি?
_______________________________
সংসারে চলতে গিয়ে অনেক কারণেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হতে পারে। বা স্বামী-স্ত্রী একজন আরেক জনের উপর অনেক কারণেই অসন্তুষ্ট হতে পারে। তাই বলে মন চাইলেই কি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবে? মহান আল্লাহ তাআ’লা স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের “পোশাক” বলেছেন। আমাদের পোশাকে যদি একটু ময়লা লাগে, আমরা কি পোশাকটা ফেলে দেই? না। বরং, আমরা সেটা সুন্দর করে পরিষ্কার করে আবার ব্যবহার করি। ঠিক তেমনি ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, সামান্য মনোমালিন্য বা বাঁধাবাঁধির কারণে সংসার ভেঙ্গে না দিতে। এতে যেমন দুইটা মানুষের জীবনের উপরে আঘাত আসে, আবার তাদের সাথে তাদের ছেলেমেয়ে ও দুইটি পরিবারের উপরেও অনেক দুঃখ নেমে আসে।

🔹যে কারণগুলোর কারণে তালাক দেওয়া বৈধ হতে পারে:
_____________________________________
(১). স্ত্রী যদি চরিত্রহীনা, ব্যভিচারী হয়, কিংবা ফাহেশা কাজে লিপ্ত থাকে।
(২). স্ত্রী যদি বেনামাযী, দ্বীনদার না হয়, অথবা তার কারণে স্বামীর দ্বীন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
(৩). স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামী বা সন্তানদের জীবনের কোন ক্ষতির কোনো আশংকা থাকে।
(৪). স্ত্রী অবাধ্য, অহংকারী, কটুভাষী হয়, এবং স্বামীর হক্ক আদায় করতে অস্বীকার করে।
বোঝাই যাচ্ছে, এরকম গুরুতর কোন কারণ থাকলে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া বৈধ হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি অন্যায়ভাবে কাউকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তার কি শাস্তি হবে? প্রথম কথা; এর দ্বারা কি একজন মানুষ উপর যুলুম করা হচ্ছে না? একজনের জীবন বিপন্ন করে দেওয়া হচ্ছেনা? যুলুমের কি শাস্তির কথা ক্বুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে? আল্লাহ সুবহা’নাহু তাআ’লা স্বয়ং নিজের উপর যুলুম করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন, সেইখানে আমাদের মতো তুচ্ছ একজন বান্দার কোনো অধিকার আছে কারো উপর যুলুম করার? একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “হে আমার বান্দারা! আমি নিজের ওপর যুলুম হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর যুলুম করো না।”(সহীহ মুসলিম, তিরমিজী হা/২৪৯৫)অপর বর্ননায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বিশেষভাবে আমাদেরকে জুলুম থেকে বেঁচে থাকতে আদেশ করেছেন। “তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো কারন জুলুম কিয়ামতের দিন গভীর অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে।” (সহীহ মুসলিম হা/ ৬৭৪১। জুলুম এতো মারাত্মক যে, মজলুম যদি জালেমের বিরুদ্ধে বদদোয়া করে আল্লাহ সাথে সাথে সেই দুয়া কবুল করে নেন। আর এইজন্য জালেমরা দু্নিয়ার বুকে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।একজন আরব কবি সুন্দর বলেছেনঃ “ক্ষমতা থাকলেই তুমি কারো প্রতি যুলুম করো না, যুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুইনা। যুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও, কিন্তু মযলুমের চোখে ঘুম আসে না। সে সারা রাত তোমার জন্য বদ দোয়া করে আর আল্লাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না!” সুতরাং হে আমার দ্বীনি ভাইয়েরা! অন্যায়ভাবে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ব্যপারে সাবধান। আপনি মনে করছেন তালাক দিলেই ভালো হবে, কিন্তু অন্যায়ভাবে তালাক দিলে যদি আপনার স্ত্রীর অভিশাপ আপনার উপর পড়ে, আপনি কি সুখী হতে পারবেন, দুনিয়া বা আখেরাতে? আর স্ত্রীর এইটা ভালো না, সেইটা এইরকম… আপনি নিজের কথা চিন্তা করুন…আপনি নিজে কতটুকু ভালো? নিজে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করুন, আপনার স্ত্রীও সংশোধন হবে ইন শা আল্লাহ।

🔹তালাকের সঠিক পদ্ধতি কি?
_____________________________
ইসলামী শরীয়তে তালাক প্রদানের সঠিক পদ্ধতি নিম্নরূপ:-
(১). স্ত্রীকে তার ঋতু থেকে মুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক ত্বালাক্ব দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজা‘আত করতে পারে। অর্থাৎ পুনরায় বিবাহ ছাড়াই ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন ভাবে মোহর নির্ধারণ করে বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে এবং সেখানে অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হলো ত্বালাক্বের সর্বোত্তম পন্থা।

(২). সহবাসহীন তোহরে প্রথম ত্বালাক্ব দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় ত্বালাক্ব দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় ত্বালাক্ব দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার ত্বালাক্ব উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেয়া যাবে না। অতএব, ২য় তোহরে ২য় ত্বালাক্ব দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২৯; সূরা আত-তালাক্ব: ১)।
.
ইসলামের সোনালী যুগে তালাকের উক্ত পদ্ধতিই চালু ছিল। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের ত্বালাক্ব দিতে চান, তাহলে ইদ্দত অনুযায়ী ত্বালাক্ব দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান! ত্বালাক্বের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হতে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। এগুলো আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, ত্বালাক্বের পরেও আল্লাহ কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিতে পারেন। (সূরা আত-তালাক্ব; ১)। উক্ত আয়াতের তাৎপর্য এই যে, ত্বালাক্ব মূলত ইদ্দতের ত্বালাক্ব, আকস্মিক বা যুগপৎ ত্বালাক্ব নয়। স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই নির্ধারিত ইদ্দত গণনা করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে তিন ঋতু মুক্তির তিন মাস স্বামী অবকাশ পাবেন যে, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারবেন কি-না। এছাড়াও স্ত্রীকে স্বামীগৃহেই অবস্থান করতে হবে। এর দ্বারা উভয়কে পুনর্মিলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।উল্লেখ যে,স্ত্রী গর্ভবতী হ’লেও তাকে তালাক দেয়া বৈধ। তাকেও সুন্নাত মোতাবেক এক তালাক দিতে হবে। গর্ভবতী মহিলার ইদ্দত সন্তান প্রসবকাল পর্যন্ত। প্রসবের সাথে সাথেই তার ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে। এবার সে নতুন করে অন্যত্র বিয়ে করতে পারবে। আর নিয়ম মাফিক এক কিংবা দুই তালাক দেওয়া থাকলে প্রথম স্বামীকেও বিয়ে করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,‘আর গর্ভবতীদের ইদ্দত সন্তান প্রসব পর্যন্ত’(সূরা তালাক্ব ৬৫/৪)।তবে ঋতুবতী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হারাম অর্থাৎ যে স্ত্রীর মাসিক জারি রয়েছে তাকে মাসিক চলাকালে তালাক প্রদান জায়েজ নয় বরং এমতাবস্থায় তাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। আবার পবিত্রতা কালে তাকে তালাক দেওয়ার সময় যেন ঐ পবিত্রতার মেয়াদকাল সহবাসশূন্য হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা গর্ভাশয় সন্তানমুক্ত রাখা ইদ্দত পালনের অন্যতম লক্ষ্য। ইতিপূর্বে ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে মাসিক অবস্থায় তালাক না দিতে ও সহবাসমুক্ত পবিত্রতার মেয়াদে তালাক দিতে রাসূল (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছে।

▪️এক বৈঠকে তিন তালাকের হুকুম কি?
____________________________________
ইসলামী শরী‘আতে বৈবাহিক বন্ধনকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই এই বন্ধন যেন ঝটিকার ন্যায় ছিন্ন-ভিন্ন না হয়ে যায় বরং চিন্তা ভাবনা ও পরামর্শের মাধ্যমে এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে সুযোগ রেখে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের বিষয়টিকে ইসলাম ইদ্দতের সাথে সম্পৃক্ত করে শেষ সময়কাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত রেখেছে। ইদ্দতের সময়কাল হলো তিন তুহুর, তিন ঋতু বা তিন মাস। (সূরা বাক্বারাহ; ২/২২৮)।
.
উল্লিখিত সময়কালের চেয়ে আরো কম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর শারঈ বিধান ইসলামী শরীআতে নেই। চাই এক তালাকের ক্ষেত্রে হৌক অথবা দুই তালাক ও তিন তালাকের ক্ষেত্রে হৌক। অর্থাৎ এক তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হতে হলে এক তালাক প্রদানের পর তালাক অবস্থায় পূর্ণ ইদ্দত অতিক্রম করতে হবে। দুই তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হতে হলে দুই তুহুরের পর পর দুই তালাক প্রদান করে বাকী ইদ্দত পূর্ণ করতে হবে এবং এর মধ্যে রাজ‘আত করবে না। তবেই সবচেয়ে কম সময়ে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। উক্ত তালাককে শারঈ পরিভাষায় ‘রাজঈ’ তালাক বলা হয়। আর তিন তালাকের মাধ্যমে সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করতে হলে কোন তালাকের মধ্যে রাজ‘আত (ফিরিয়ে নেওয়া) না করে এক ইদ্দতের প্রতি তুহুরে একটি করে পর পর তিন তুহুরে তিন তালাক প্রদান করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ একেবারে চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এখানে প্রথম দু’টি তালাকে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পূর্বে সাধারণভাবে ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় এবং ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার পর অন্যের সাথে বিবাহ না হয়েও সরাসরি নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু তৃতীয় তালাক প্রদান করা মাত্র কোনভাবেই সেই তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না, যতক্ষণ না তার অন্যত্র স্বেচ্ছায় বিবাহ ও স্বেচ্ছায় আবারো তালাক ঘটে যায়। (সূরা বাক্বারাহ; ২/২৩০)।

এটাই হলো সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর কিতাব ও সুন্নাহ ভিত্তিক একমাত্র শারঈ বিধান। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন, ‘তালাকের রাজঈ দু’বার।’ (সূরা বাক্বারাহ; ২/২২৯)। অতঃপর রাজ‘আত করার অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার সর্বনিম্ন সময়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যখন ইদ্দতের শেষ সময়ের নিকট পৌঁছবে, তখন হয় তাকে রাজ‘আত কর, নইলে (ইদ্দতের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করিয়ে অথবা তৃতীয় তুহুরে তৃতীয় তালাক প্রদানের মাধ্যমে) তোমরা বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দাও।’ (সূরা বাক্বারাহ; ২/২৩১)। উল্লিখিত আয়াতে রাজ‘আত করার সর্বশেষ সময় ও বিবাহ বিচ্ছেদের সর্বনিম্ন সময় একটি ইদ্দতের তৃতীয় তুহুরকে নির্ধারিত করা হয়েছে। তবে আল্লাহ পাক স্বামী-স্ত্রীর পুনঃমিলনকেই বেশী পছন্দ করেন। আর সেজন্যই তিনি এরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা কোন মহিলাকে তালাক দিবে এবং সে ইদ্দত শেষ হওয়ার নিকটবর্তী অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তাদেরকে তাদের স্বামীদের সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধা দিয়ো না, যখন তারা আপোষে সুন্দরভাবে রাযী হয়।’ (সূরা বাক্বারাহ; ২/২৩২)। এক্ষণে যদি একই সাথে একই তুহুরে তিন তালাক প্রদান কার্যকর করা হয়, তবে এক দিকে স্বামীকে যে রাজ‘আত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা যেমন খর্ব করা হবে, অন্য দিকে তেমনি সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর সীমালংঘন করা হবে। কেননা তৃতীয় তালাক কার্যকর হওয়ার অর্থই হলো অবিলম্বে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ। সুতরাং এক বৈঠকের তিন তালাকের হুকুম সম্পর্কে যদিও আহালুল আলেমগনের মধ্যে কয়েকটি মত রয়েছে। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো এক সাথে তিন বা ততোধিক তালাক প্রদান করলে এক তালাকে পরিণত হবে। (মুসলিম হা/১৪৭২; আহমাদ হা/২৮৭৭; হাকেম হা/২৭৯৩)

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে তার স্ত্রীকে হায়েযা অবস্থায় তালাক দিলে উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, তুমি তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দাও। এরপর সে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত যেন বিরত থাকে। এরপর আবার হায়েযা হবে এবং পবিত্র হবে। এরপর চাইলে সে রাখবে অথবা স্পর্শের পূর্বেই তালাক প্রদান করবে। আর এটাই হলো সেই সময়সীমা যার ব্যাপারে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হা/৫২৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭১)। সুতরাং, কেউ তার স্ত্রীকে এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে। ইদ্দতের (তিন তোহরের) মধ্যে হলে স্বামী সরাসরি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবে। ইদ্দত পার হয়ে গেলে উভয়ের সম্মতিতে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিবে। (সূরা বাক্বারাহ; ২/২৩২)
.
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আবু রুকানা তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে তালাক দিয়েছ? তিনি বললেন, এক মজলিসে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, আমি জানি ওটা এক তালাকই হয়েছে। তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও। অতঃপর তিনি সূরা তালাকের ১ম আয়াতটি পাঠ করে শুনান। (আবু দাঊদ হা/২১৯৬; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৪৯৮৬, সনদ হাসান)।
অএতব, কেউ যদি তার স্ত্রীকে এক বৈঠকে তিন তালাক দেয় এবং তালাক প্রদানের পর এক দুই বা তিন তুহুর অথবা তারও বেশি পার হয়ে যায় এবং একটি মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পর দ্বিতীয় বার তালাক না দেয় তাহলেও ঐ স্ত্রীর উপর এক তালাক কার্যকর হবে এবং তিন তুহুরের মধ্যে ফেরত না নিলে বিবাহ ছিন্ন হয়ে যাবে। পুনরায় ঐ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে নতুন ভাবে মোহর নির্ধারণ করে বিবাহ করে ফেরত নিতে হবে

🔹ইসলামে হিল্লা বিয়ে কি জায়েয?
_______________________________
‘হিল্লা’ শব্দটি সঠিক নয়। আরবীতে শব্দটি হল, ‘হীলাহ্’ অর্থাৎ কৌশল, ফন্দি, ছল, চাতুরী ইত্যাদি। কোন স্বামীর তিন ত্বালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে এ শর্তে বিয়ে করা যে, বিয়ের পর সহবাস শেষে স্ত্রীকে ত্বালাক দিবে, যেন সে পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয়, সে তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারে। এটাই প্রচলিত হিল্লা। এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামে হিল্লা বিয়ে হারাম। এটি একটি গর্হিত, জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ। আলী বিন আবী ত্বালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেছেন, ‘রাসূল (ﷺ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে অভিসম্পাত বা লানত করেছেন।’ (তিরমিযী, হা/১১১৯, ১১২০; আবু দাঊদ, হা/২০৭৬; ইরওয়াউল গালীল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩০৮-৩০৯)।
.
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের ভাড়াটে পাঁঠা সম্পর্কে অবহিত করব না? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তিনি বলেন, সে হল হিল্লাকারী। আল্লাহ হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় তাদের উভয়কে অভিসম্পাত বা লা‘নত করেছেন। (ইবনু মাজাহ, হা/১৯৩৬; মুসতাদরাক হাকিম, হা/২৮৪৩-২৮৪৪, সনদ হাসান; সহীহুল জামি, হা/২৫৯৬)। অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ﷺ)-এর যুগে এটাকে যিনা হিসাবে গণ্য করা হত। (মুসতাদরাক হাকিম, হা/২৮৪৫; উমদাতুত তাফসীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৩; ইরওয়াউল গালীল, হা/১৮৯৮)। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হিল্লা সম্পর্কে বলেন, ‘আমার নিকট হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় তাদের পেশ করা হলে, আমি তাদেরকে ‘রজম’ বা প্রস্তরাঘাত করব।’ (মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/৩৬১৯১; বায়হাক্বী, আস-সুনান আল-কুবরা, হা/১৪১৯১; ইগাসাতুল লাহফান লি ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১১, সনদ সহীহ)।
.
তবে হ্যাঁ, ত্বালাক প্রাপ্তা নারীর ইদ্দাত শেষ হওয়ার পর কোন পুরুষ যদি তাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করে, ত্বালাক দেওয়ার পরিকল্পনা বা বৈধ করার উদ্দেশ্য ছাড়াই সহবাস করে এবং পরবর্তীতে যদি দ্বিতীয় স্বামী কোন কারণে তাকে স্বেচ্ছায় ত্বালাক দেয় বা মারা যায়, সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামী তাকে আবার বিয়ে করতে পারবে। (সূরা আল-বাক্বারাহ; ২৩০)। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে তার স্ত্রীকে তিন ত্বালাক দিয়েছে, ফলে সে অন্য পুরুষকে বিয়ে করে তার সাথে নির্জনবাস করে, অতঃপর সহবাস ব্যতীতই স্বামী তাকে ত্বালাক দেয়, সে কি পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হবে? নবী (ﷺ) বললেন, ‘প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অপরের সহবাসের স্বাদ গ্রহণ করে এবং সে তার সহবাসের স্বাদ গ্রহণ করে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৫২৬১, ৫২৬৫, ৫৭৯২; সহীহ মুসলিম, হা/১৪৩৩ আল ইখলাস)।
.
পরিশেষে, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান তালাক নিয়ে স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে তালাকের ক্ষেত্রে শারঈ পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। আর এ সম্পর্কে সকলকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে ‘হিল্লা বিবাহ’ নামক জাহেলী প্রথা থেকে সর্বাত্মকভাবে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন!
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।