টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পড়া সম্পর্কে

প্রশ্ন: আমরা জানি পুরুষের জন্য টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করা হারাম। আবার কেউ কেউ বলেন অহংকার না করে টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পড়তে পারবে? কোনটি সঠিক? দলিলের আলোকে বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: প্রথমে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার সেটা হল পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এর সহীহ সুন্নাহ আমাদের জন্য অনুসরণীয়। কেননা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রদর্শিত পথের অনুসরণই মূলত আল্লাহর অনুসরণ। মহান আল্লাহ বলেন,যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (সূরা আল-আহযাব: ২১)। তিনি আরো বলেন, অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)।সুতরাং চার মাযহাব সহ অন্যান্য ইমামদের কথা যদি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক হয়, তাহলে তাদের কথা অবশ্যই গ্রহণীয়। কিন্তু যদি তাদের কথা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর বিপরীত হয় তাহলে, কুরআন ও সহীহ সুন্নাহকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে, তাদেরকে নয়। আবূ রাফে‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমরা এসব কিছু জানি না। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, আমরা তারই অনুসরণ করব’। (মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯১২; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৩; বায়হাক্বী-দালাইলনু নবুঅত হা/২৯৩৬; মিশকাত, হা/১৬২)
.
সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, অহংকারের উদ্দেশ্য হোক বা না হোক পুরুষের জন্য টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা হারাম। এটাই কুরআন-সুন্নাহর দাবি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তিন ব্যক্তির সাথে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না, তাদের প্রতি তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। রাবী বলেন, একথাগুলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বললেন। আবু যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তারা ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তারা কারা? তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, কিছু দান করে অনুগ্রহ প্রকাশকারী এবং মিথ্যা কসম করে পণ্যদ্রব্য বিক্রয়কারী। (সহীহ মুসলিম, হা/১০৬; মিশকাত, হা/২৭৯৫)
.
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَا يَنْظُرُ اللهُ إِلَى مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلَاءَ ‘যে ব্যক্তি অহংকার করে তার কাপড় টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পরবে তার দিকে আল্লাহ তা‘আলা রহমতের দৃষ্টি দিবেন না।’ (সহীহ বুখারী, হা/৫৭৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/২০৮৫)
.
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আর যে ব্যক্তি অহংকারের উদ্দেশ্য ছাড়া কাপড় ঝুলিয়ে পরবে তাঁর ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী জাহান্নামী (সহীহ বুখারী, হা/৫৭৮৭; মিশকাত, হা/৪৩১৪)। এই হাদীসে অহংকারের কথা নেই।
.
অন্য বর্ণনায় আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘‘মু’মিন ব্যক্তির কাপড় অর্ধ নলা পর্যন্ত, এতে কোন অসুবিধা নেই’’ (হাঁটু থেকে পায়ের তলার মধ্যভাগকে নলা বলা হয়)। অন্য বর্ণনায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরূপ বলেনঃ ‘‘পায়ের টাখনু এবং হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থানে কাপড় পরিধান করাতে কোন অসুবিধা নেই যে টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করা হবে তা জাহান্নামে যাবে, আর যে ব্যক্তি অহংকারবশতঃ কাপড় ঝুলিয়ে পরবে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ‌ তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না।’ (আবু দাউদ, ৪০৯৩ ইবনে মাকা, ৩৫৭০-৭৩ রিয়াদুস সালেহীন, ৮০৩)
.
তিনি আরো বলেন, লুঙ্গি বা পায়জামার পায়ের গোছা স্পর্শ করার কোন অধিকার নেই (তিরমিযী হা/১৭৮৩)।
.
সালাতে টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান সম্পর্কে অন্য হাদীছে এসেছে,ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সালাতের মধ্যে টাখনুর নীচে কাপড় পরে, সে হালালের মধ্যে আছে, না হারামের মধ্যে আছে তা আল্লাহর যায় আসে না।’ (আবু দাঊদ, হা/৬৩৭, ১/৯৩ পৃ.সনদ সহীহ; আওনুল মা‘বূদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪০)
.
আরেক বর্ণনায় এসেছে পূর্ববর্তী যুগে কোন এক ব্যক্তিকে টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাকে মাটির নীচে দাবিয়ে দিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩৪৮৫; সহীহ মুসলিম, হা/২০৮৮; মিশকাত, হা/৪৩১৩)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট ইত্যাদি কাপড় যদি পায়ের কিঞ্চিৎ নিচে ঝুলিয়ে পরিধান করা হয় এবং তাঁর উদ্দেশ্য হয় অহংকার করা, তবে তাঁর শাস্তি হল কিয়ামত দিবসে আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর দিকে দৃষ্টি দিবেন না, তাঁর সাথে কথা বলবেন না, তাকে পবিত্র করবেন না এবং তাঁর জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর যদি অহংকারের সাথে নয় বরং সাধারণভাবে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, তবে তাঁর শাস্তি হল তাঁর টাখনুদ্বয়কে জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে। (ফাতওয়া আল বালাদুল হারাম, ১৫৪৭, ১৫৪৯, ১৫৫০ নং পৃষ্ঠা এবং ফতোয়া আরকানুল ইসলাম প্রশ্ননং ২১৪)
.
◾উল্লেখ্য যে, অহংকার ছাড়া পুরুষের জন্য লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট ইত্যাদি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পড়ার ব্যাপারে অনেকে নিম্নলিখিত হাদীসটি দিয়ে দলীল পেশ করেন যে, অহংকারবশত না হলে টাখনুর নিচে কাপড় পড়া যাবে। অথচ উক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। তাই এ বিষয়টি বিস্তারিত বলার প্রয়োজন রয়েছে।প্রথমে হাদীস দেখা যাক।
.
আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত,নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশতঃ কাপড় হেঁচড়িয়ে চলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার দিকে তাকাবেন না। তখন আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! অসাবধানতাবশত অনেক সময় আমার লুঙ্গি টাখনুর নিচে ঝুলে যায়। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেনঃ যারা অহংকারবশত কাপড় ঝুলায় আপনি তাদের অন্তরভুক্ত নন। (সহীহ বুখারী ৩৬৬৫, আবূ দাঊদ ৪০৮৫, নাসায়ী ৫৩৩৫, সহীহুল জামি‘ ৬১৮৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৬৮২,মিশকাত,৪৩৬৯)

◾আবু বকর (রাঃ) এর হাদীস দ্বারা যারা দলীল পেশ করতে চায় দু’দিক থেকে তাদের যুক্তি খন্ডনঃ
_______________________________________
▪️প্রথম কথাঃ আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, আমার কাপড়ের এক পার্শ্ব (অনিচ্ছাকৃত) ঝুলে পড়ে কিন্তু আমি তা বারবার উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।” অতএব তিনি তো ইচ্ছাকৃত একাজ করতেন না। বরং তাঁর শরীর অধিক ক্ষীণ হওয়ার কারণে অনিচ্ছাকৃত কাপড় ঝুলে যেত। তাছাড়া তিনি তা উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যারা কাপড় ঝুলিয়ে পরে এবং ধারণা করে যে তারা অহংকার করে না, তারা তো ইচ্ছাকৃত একাজ করে। অতএব তাদের ক্ষেত্রে আমরা বলব, অহংকারের উদ্দেশ্য ব্যতীত ইচ্ছাকৃত কাপড় ঝুলিয়ে পড়লে তার টাখনু জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। যেমনটি আবু হুরায়রার হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আর যদি অহংকার বশতঃ হয় তবে তার শাস্তি হচ্ছে, আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে কথা বলবেন না, তাঁর দিকে তাকাবেন না, তাকে পবিত্র করবেন না এবং তাঁর জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

▪️দ্বিতীয় কথাঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই আবু বকর (রাঃ) কে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত নন, যারা অহংকার বশত একাজ করে থাকে। অতএব বর্তমানে এরা কি নবীজীর পক্ষ থেকে এরূপ সচ্চরিত্রের সনদ ও তাঁর সাক্ষ্য লাভ করেছে? কিন্তু শয়তান প্রবৃত্তির অনুসারী লোকদেরকে কুরআন সুন্নাহ্‌ থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ উক্তি সমূহকে খেয়াল-খুশির উপর ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। তখন তারা বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করে থাকেন। মোটকথা কোন অজুহাত ছাড়া কোন পুরুষের জন্য টাখনুর নিচে লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট ইত্যাদি পরা বৈধ নয়।(বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইমাম নববী সরহে মুসলিম ও মিশকাত, ৪৩৬৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য এবং ইবনে উসাইমীন (রহ)বএর ফতোয়ায় আরাকানুল ইসলাম প্রশ্ন নং ২১৪)
.
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত যে, পুরুষদের জন্য অহংকারবশত অথবা অহংকার ছাড়া উভয় অবস্থাতেই টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা বৈধ নয় সুতরাং যারা বলেন, টাখনুর নীচে অহংকার ছাড়া কাপড় ঝুলিয়ে পড়তে তেমন কোন অসুবিধা নেই। তাদের সেই যুক্তি যে ভিত্তিহীন সেটা উল্লেখিত হাদিসগুলি থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক আমীন।(আল্লাহ্‌ই অধিক জ্ঞাত আছেন)।
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।