শরীয়তের দৃষ্টিতে তাসবীহ গণনার সুন্নাতী পদ্ধতি কি এবং তাসবীহদানা ও কাউন্টার মেশিন দিয়ে তাসবিহ পাঠ করা সুন্নাত না বিদআত

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ডান হাতের আঙুলে গুণে তাসবিহ গননা করা মুস্তাহাব এবং উত্তম।তবে কারও হাতের আঙ্গুলে সমস্যা থাকলে অথবা ব্যক্তি অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে সংখ্যা মনে রাখতে না পারলে তখন তাসবীহ দানা, পুঁথিদানা বা ডিজিটাল কাউন্টার মেশিন ব্যবহার করা জায়েজ তবে উত্তম নয়। কারন প্রিয় নবী রাসূল (ﷺ) ডান হাতের আঙুলে গুণে তাসবিহ গননা করছেন এবং উম্মাহকে করতে উৎসাহিত করেছেন। তাছাড়া কিয়ামতের দিন আঙ্গুলগুলোকে জিজ্ঞেস করা হবে এগুলো যা উপার্জন করেছে এবং কোন জিনিসের ক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে। এই আঙুলগুলো আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘আর তোমরা গোপন করতে পারতে না তোমাদের চক্ষু, কর্ণ, তোমাদের দৃষ্টি, তোমাদের চামড়া তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়া থেকে।’’ (সূরা ফুসসিলাত ৪১/২২)
.
ইউসাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। (তিনি ছিলেন মুহাজিরা নারীদের একজন) তিনি বলেন, আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘অবশ্যই তোমরা তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাক্বদিস (সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস) ভালোভাবে আঙুলে গুণে রাখবে। কেননা, এগুলো কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে এবং এদেরকে কথা বলানো হবে। সুতরাং, তোমরা উদাসীন থেকো না, তাহলে (আল্লাহর) রহমত (পেতে) ভুলে যাবে।’’ (তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৮৩; আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৪৫; হাদিসটি সহিহ)
.
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (ছাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে আঙুলে গুনে গুনে তাসবীহ পাঠ করতে দেখেছি ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ডান হাতের আঙুল দ্বারা (আবু দাঊদ হা/১৫০২, ১/২১০ পৃঃ; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/৩১৪৮;সহীহ ইবনে হিববান হা/৮৪৩)
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,‘হে নারীকুল! আঙুল দ্বারা তাসবীব পড়বে। কেননা (কিয়ামতের দিন) এগুলো জিজ্ঞেসিত হবে ও কথা বলবে’। (তিরমিযী, হা/৩৪৬৮, সনদ হাসান)।
.
উক্ত হাদীসগুলো থেকে আমরা জানলাম, নবীজি আঙুলে গুণে যিকর করেছেন এবং করতে বলেছেন। তাই হাতের আঙুল দ্বারা তাসবি গণনা করা এটি সর্বোত্তম পদ্ধতি। তবে কারো আঙ্গুলে সমস্যা থাকলে কিংবা অসুস্থ ও বৃদ্ধ হওয়ার কারণে সংখ্যা মনে রাখতে না পারলে তখন তাসবীহ দানা বা ডিজিটাল কাউন্টার মেশিন, পুঁথিদানা ইত্যাদি ব্যবহার করতে এবং ওযরবশতঃ বাম হাতের আঙ্গুল দ্বারাও তাসবিহ গননা করতে কোন অসুবিধা নেই এবং এমনটি করলেও বিদআত হবেনা ইনশাআল্লাহ। যাদিও রাসূল (ﷺ) আঙুলে গুণে তাসবিহ গননা এবং যেকোন কাজ ডান দিক থেকে করা পছন্দ করতেন। (সূরা তাগাবুন,৬৪/১৬)। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০০)। আর বিভিন্ন জিনিসের সাহায্যে তাসবিহ গননা করার বেশ কিছু বর্ননা থাকলেও সেগুলো বিশুদ্ধ নয়। যেমন:
.
উম্মুল মুমিনিন সফিয়্যাহ (রা.) বলেন, একদিন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে এলেন। আমার কাছে তখন চার হাজার খেজুর-বিচি ছিলো। এগুলো দ্বারা আমি তাসবিহ পাঠ করছিলাম। তিনি বললেন,‘‘তুমি তো এগুলোর মাধ্যমে তাসবিহ পাঠ করছো। যে পরিমাণ তাসবিহ তুমি পাঠ করেছো, তারচেয়ে অধিক পরিমাণে (পড়া)-র উপায় কি আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো?’’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই আমাকে শিখিয়ে দিন।’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি বলবে, (سُبْحَانَ اللَّهِ عَدَدَ خَلْقِهِ) – অর্থ: সৃষ্টির সংখ্যা পরিমাণ আল্লাহর মহিমা (বর্ণনা করছি)।’’ (তিরমিযি, আস-সুনান ৩৫৫৪;আর-রাদ্দু আলাত তা’কীবিল হাসীস,৩৫-৩৮ সনদ:মুনকার)। উক্ত হাদীস সম্পর্কে ইমাম আবু ঈসা (তিরমিজি বলেনঃ এ হাদীসটি গারীব। কেননা সাফিয়্যা (রাঃ)-এর এ হাদীস আমরা শুধু হাশিম ইবনু সাঈদ আল-কূফীর সূত্রে জেনেছি। এর সনদ তেমন সুপরিচিত নয়। এ অনুচ্ছেদে ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও হাদীস বর্ণিত আছে।

সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাযিআল্লাহু আনহু) কঙ্কর দ্বারা তাসবীহ পাঠ করতেন’ (নায়লুল আওতার, ২/৩৬৬), ইবনু সা‘দ ‘ত্ববাক্বাত’ নামক গ্ৰন্থে এ হাদীছ বর্ণনা করেন। হাদীছের সনদ বিচ্ছিন্ন। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৯/৩২২) এরকম আরো অনেকগুলো হাদীছ রয়েছে, যার কোনোটাই দুর্বলতা ও সমালোচনা থেকে মুক্ত নয়।
.
শাইখুল ইসলাম, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭২৮হি.) বলেছেন,‘আঙুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা সুন্নাহ। তবে, বিচি, কংকর ও এ জাতীয় বস্তু দ্বারা গণনা করা যায়। কেননা, সাহাবায়ে কেরামের অনেকে এমনটি করতেন। তাছাড়া, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনিনকে কংকর দিয়ে গণনা করতে দেখেছেন এবং এর সমর্থন করেছেন (কারণ তিনি নিষেধ করেননি)।’ (মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২২/৫০৬)
.
আল্লামা মুনাউয়ি (রাহ.) বলেন, ‘পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোনো ফকিহ এটি মাকরুহ বলেছেন, এমন কিছু পাওয়া যায়নি।’ (ফায়দ্বুল কাদির: ৪/৩৫৫)
.
সুনান তিরমিযির শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার আল্লামা মুবারকপুরি (রাহ.) সা’দের হাদিস দ্বারা দলিল গ্রহণ করে বলেছেন জপমালা, কঙ্কর দিয়ে তাসবিহ পাঠ করা জায়েয। (তুহফাতুল আহওয়াযি: ৯/৩২২)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, তাসবিহদানা ব্যবহার করা জায়েয। তবে উত্তম হল হাতের আঙুল ও আঙুলের কর ব্যবহার করা। তাসবিহছড়া হাতে নিয়ে থাকলে রিয়া বা লৌকিকতার উদ্রেক হতে পারে। আর যারা তাসবিহছড়া ব্যবহার করে, সাধারণত (যিকরের সময়) তাদের অন্তর উপস্থিত থাকে না (মনোযোগ থাকে না)। তারা এদিক-ওদিক তাকায়। এজন্য বিদ্বানগণ তাসবীহদানা ব্যবহারকে অপছন্দ করেছেন। সুতরাং আঙুল ব্যবহার করাই উত্তম ও সুন্নাহসম্মত। (ইবনে উসাইমীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ৩/৩০ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ২৬০ নং প্রশ্নের উত্তর)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম আঙুল দ্বারা তাসবীহ পাঠ করা উত্তম। কারণ এ ব্যাপারে একাধিক সহীহ ও হাসান হাদীস বর্ণিত হয়েছে।অপরদিকে বীচি, কঙ্কর বা পুঁথির দানা দিয়ে তাসবীহ পাঠ করা সম্পর্কে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে কোনোটিই মন্তব্য থেকে মুক্ত নয়।তবে কেউ বীচি, কঙ্কর বা পুঁথির দানা দিয়ে তাসবীহ পাঠ করলে সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ সেটিও জায়েজ। কিন্তু আমাদের উচিত হবে, সহীহ হাদীসের উপর আমল করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সুবোধ দান করুন- আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।